আরবি শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিষয় দক্ষতা, পেশাগত যোগ্যতা ও মূল্যবোধ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় আরবি শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিষয় দক্ষতা, পেশাগত যোগ্যতা ও মূল্যবোধ – যা দাখিল স্তরের শিক্ষাক্রমে আরবি এর অন্তর্ভুক্ত।

আরবি শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিষয় দক্ষতা, পেশাগত যোগ্যতা ও মূল্যবোধ

 

আরবি শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিষয় দক্ষতা, পেশাগত যোগ্যতা ও মূল্যবোধ

 

শিক্ষক হলেন শিক্ষা কার্যক্রমের মূল স্তম্ভ। আদর্শ ও যোগ্য শিক্ষক ব্যতীত শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব নয়। ভালো প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষণ পদ্ধতি যত কিছুই থাকুক না কেন, সবকিছু থেকে কাঙ্খিত ফল পাওয়ার জন্য প্রয়োজন একজন আদর্শ যোগ্য শিক্ষক। শিক্ষকের কিছু সাধারণ যোগ্যতা ও গুণাবলি থাকতে হয়। তাছাড়া আরবি শিক্ষকের বিশেষ কতিপয় গুণ থাকা আবশ্যক। আরবি শিক্ষক ভাষা ও সাহিত্যে পারদর্শীতা প্রদর্শনের সাথে সাথে মানবীয় মূল্যবোধ চর্চার ক্ষেত্রে অনুসরণীয় মডেল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।

আরবি শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদরাসা) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮-এ বর্ণিত দাখিল স্তরের আরবি শিক্ষক (সহকারী মৌলভি)-এর শিক্ষাগগত যোগ্যতা নিম্নরূপ:

১. বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড হতে ফাজিল / স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমমান ডিগ্রিসহ বিএমএড/বিএড/সমমান। অথবা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়/ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত মাদরাসাসমূহ হতে ফাজিল বা সমমান ডিগ্রিসহ বিএমএড/বিএড/সমমান। অথবা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়/স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের থিউলজি অনুষদ, আরবি ও ফিকহ বিভাগে অনার্স ডিগ্রিসহ বিএমএড/বিএড/সমমান।

২. বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড হতে ফাজিল/স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমমান ডিগ্রি। অথবা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়/ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত মাদরাসাসমূহ হতে ফাজিল ডিগ্রি সমমান। সমগ্র শিক্ষা জীবনে যে কোন ১টি ৩য় বিভাগ/শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হবে।

আরবি শিক্ষকের বিষয় দক্ষতা

আরবি ভাষার শিক্ষককে আরবি ভাষায় গভীর ও সুস্পষ্ট বিষয় জ্ঞান থাকতে হবে। ভাষা শিক্ষণে শোনা, বলা, পড়া, লেখার দক্ষতা প্রদর্শন করতে হবে। দাখিল স্তরের আরবি বইগুলোর উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করতে হবে। বিশেষত যে শ্রেণিতে যে বিষয় পড়াবেন, সে সম্পর্কে বিশেষ পারদর্শীতার অধিকারী হবেন।

আরবি শিক্ষককে শুধু আরবি বিষয়ের জ্ঞান থাকলে হবে না, তাঁকে কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও আকাইদ বিষয়েও গভীর জ্ঞান রাখতে হবে। কারণ এ সকল বিষয়ও আরবি ভাষায় রচিত। তাছাড়া তাঁর মাতৃভাষা বাংলায় স্বচ্ছ ধারণা ও ইংরেজি ভাষায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে আরবি ভাষা ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট শব্দ ভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে। নির্ভুল ভাষা ব্যবহারের জন্য কাওয়ায়েদ এর জ্ঞান তথা শব্দ প্রকরণ, বাক্য গঠন, ধ্বনির ব্যবহার এর উপর স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। আকর্ষণীয় ভাচন ভঙ্গি, শুদ্ধ ও স্পষ্ট উচ্চারণ কন্ঠস্বরের উঠা নামা নিয়ন্ত্রণ, যতি ও বিরাম চিহ্নের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে।

আরবি শিক্ষক হবেন সাহিত্যানুরাগী, তিনি সৃজনশীল পাঠে অভ্যস্ত হবেন। প্রাচীন ও আধুনিক আরবি সাহিত্য সম্পর্কে থাকবে তাঁর সম্যক ধারণা। একজন আরবি শিক্ষকের তুলনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। একটি নির্দিষ্ট বিষয় পাঠদানের সময় ঐ পাঠটির সমধর্মী অন্য পাঠের সাথে তুলনা করতে জানতে হবে। আরবি শিক্ষকের নির্ভুল আরবি ভাষা চর্চার জন্য কাওয়ায়েদের গভীর জ্ঞান থাকা জরুরি। তাঁর থাকবে আরবি কাওয়ায়েদ শিক্ষণের জন্য যথেষ্ট সৃজনশীল উদাহরণ প্রয়োগের দক্ষতা।

আরবি শিক্ষকের উপকরণ তৈরি ও ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে। তিনি তাঁর পাঠের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করবেন। এক্ষেত্রে স্বল্পমূল্য বা বিনামূল্যের উপকরণ ও বাস্তব উপকরণ ব্যবহারে সচেষ্ট হবেন। শিক্ষার্থীদের আরবি বিষয়ে জ্ঞানার্জনের অগ্রগতি যাচাইয়ের জন্য উপযুক্ত মূল্যায়ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় দক্ষতা থাকতে হবে। বিশেষত আরবি ভাষার দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য ধারাবাহিক মূল্যায়নের পদ্ধতি ব্যবহারে পারদর্শী হবেন। সর্বোপরি, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরবি পাঠদানে দক্ষ হতে হবে।

 

আরবি শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিষয় দক্ষতা, পেশাগত যোগ্যতা ও মূল্যবোধ

 

আরবি শিক্ষকের পেশাগত যোগ্যতা ও মূল্যবোধ

শিক্ষকতা একটি মহান ও জটিল পেশা। এটি মানুষ গড়ার শিল্পকর্ম। তাই যিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে মনে প্রাণে গ্রহণ করবেন এবং শৈল্পিক মনোভাব নিয়ে সুনিপুণ কারিগর হিসেবে শিক্ষণ শিখন কার্যক্রমকে আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময় করে এগিয়ে নিতে পারবেন, তিনিই শিক্ষক। আরবি শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীদের জন্য মডেল। আরবি শিক্ষক তাঁর পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্প দক্ষতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের যেমন উদ্দীপিত ও উচ্ছ্বসিত করবেন, তেমনি প্রভাবিত ও বিমোহিত করবেন। তিনি চিন্তায় কাজেকর্মে সর্বত্রই শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশ ও উন্নতিকল্পে সুস্পষ্ট ছাপ রাখবেন।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাঙ্খিত আচরণের বিকাশে সচেষ্ট থাকবেন এবং অকল্যাণকর ও অনাকাঙ্খিত কোন আচরণ যেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে উঠার সুযোগ না থাকে, সে ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকবেন। তাঁর পেশাগত যোগ্যতা ও মূল্যবোধের প্রভাবে শিক্ষার্থীরা আরবি ভাষা ও সাহিত্য পাঠে আগ্রহী হবে এবং আরবি চর্চা ও প্রয়োগে যত্নবান হবে। শিক্ষার্থীদের মনে আরবি শিক্ষকের আসনটি হবে চিরস্থায়ী শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার। তাঁরা এ শিক্ষকের মূল্যবোধগুলো অর্জন করে ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে তাঁকে আদর্শ হিসেবে সামনে রেখে এগিয়ে যাবে। আরবি শিক্ষকের জন্য প্রয়োজনীয় পেশাগত যোগ্যতা ও মূল্যবোধগুলো হলো:

সহযোগিতামূলক মনোভাব:

আরবি শিক্ষক সকল শিক্ষার্থী ও সহকর্মীর সাথে সদ্ভাব গড়ে তুলবেন। তিনি হবেন শিক্ষার্থী ও সহকর্মীর সাথে বন্ধুভাবাপন্ন, আন্তরিক, সহনশীল ও সহযোগিতামূলক । তিনি শ্রেণিকক্ষে সদয়ভাব ও নমনীয়তা প্রদর্শন করবেন।

দায়িত্ব পালনে দৃঢ়তা:

আরবি শিক্ষক তাঁর উপর অর্পিত শিক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক অন্যান্য দায়িত্ব সুচারুরূপে আন্তরিকতার সাথে যথাযথভাবে পালনে দৃঢ় মানসিকতা প্রদর্শন করবেন। তিনি শিক্ষার্থীদের আরবি বিষয়ের জ্ঞানকে কাঙ্খিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা, প্রচেষ্টা ও মানসিকতার অধিকারী হবেন। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন ও বিভিন্ন কাজে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে সহযোগিতার জন্য সদা প্রস্তুত থাকবেন ।

একীভূত শিখনে আগ্রহীঃ

শিখনে সকল শিক্ষার্থীর সমান অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রেরণা প্রদান ও তাদের শিখন কার্যক্রমে সহযোগিতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেন। একটি শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন মেধার ও যোগ্যতার শিক্ষার্থী থাকে, এ সকল শিক্ষার্থীকে শিখন কার্যক্রমে সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করা শিক্ষকের দায়িত্ব। সুতরাং আরবি শিক্ষকের শিক্ষকসুলভ মনোভাব ও বিশ্বাস এমন হবে যে- তিনি সকল শিক্ষার্থীকে শিখনে উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন এবং সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সমান দৃষ্টি রেখে সকলের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাবেন।

প্রত্যেক ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া:

আরবি-শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান তথ্য প্রবাহের যুগে শিক্ষর্থীরা বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। তাই শিক্ষককে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে উপযুক্ত শিক্ষণ পদ্ধতি ও কৌশল নির্বাচন করে যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মবিশ্বাসী হয়ে শ্রেণিকক্ষে যেতে হবে; যাতে করে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান তৃষ্ণা মেঠানো যায় এবং শ্রেণি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

উদ্ভাবনী মনোভাব সৃষ্টি:

একজন আদর্শ শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ পেশাগত যোগ্যতা হলো উদ্ভাবনী শক্তি । যার ফলে তিনি চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও আত্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন জ্ঞান ও পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। সাথে সাথে শিক্ষার্থীদেরকে অংশগ্রহণ করিয়ে শিক্ষণ-শেখানো কার্যক্রমকে অধিকতর উপভোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেন ।

স্বমূল্যায়ন ও আত্মপ্রতিফলন:

আরবি-শিক্ষক স্বীয় শিক্ষণ দক্ষতা ও শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জন-এর উপর আত্মপ্রতিফলনে ও আত্মমূল্যায়নে উদার হবেন। এক্ষেত্রে সহকর্মীর মতামত গ্রহণ ও ফলাবর্তন গ্রহণ করে আত্মোন্নয়নের মানসিকতা থাকতে হবে।

নিজেকে হালনাগাদ করা:

আরবি-শিক্ষককে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সর্বশেষ অগ্রগতি ও বিকাশমান ধারণার সমন্বয়ে নিজেকে হালনাগাদ রাখতে হবে।

মূল্যবোধ সৃষ্টি:

শিক্ষার্থীর ব্যক্তি জীবনে মূল্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমেই শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য অর্জিত হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক ইত্যাদি সকল প্রকার মূল্যবোধ চর্চার মাধ্যমেই সমাজের মানুষ চরম সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। এক্ষেত্রে আরবি-শিক্ষক সমাজের কাঙ্খিত ও প্রয়োজনীয় মূল্যবোধগুলো শিক্ষার্থীর সামনে তুলে ধরবেন এবং এগুলো অর্জনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবেন।

 

আরবি শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিষয় দক্ষতা, পেশাগত যোগ্যতা ও মূল্যবোধ

 

ইসলামি পরিবেশ সৃষ্টি:

আরবি-শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ইসলামি ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে দক্ষ হবেন। তিনি পরিষ্কার পরিপাটি রুচিশীল পোষাক পরিধান করবেন। কথাবার্তা ও আচরণের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে কুরআন সুন্নাহর আবহ তৈরি করতে পারদর্শী হবেন।

শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন:

শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যথেষ্ট ইতিবাচক মনোভাব ও পারদর্শিতার অধিকারী হবেন।

আরও দেখুনঃ

 

Leave a Comment