আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় দাখিল শিক্ষাক্রমে আরবি শিক্ষাক্রমের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য – যা দাখিল স্তরের শিক্ষাক্রমে আরবি এর অন্তর্ভুক্ত।
দাখিল শিক্ষাক্রমে আরবি শিক্ষাক্রমের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা অতি প্রাচীন। এ শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উৎস হচ্ছে কুরআন ও হাদিস। আর কুরআন ও হাদিসের ভাষা আরবি। তাই কুরআন ও হাদিস বুঝার জন্য এবং আরব দেশসমূহের সাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগের জন্য আরবি অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষা। আরবি জাতিসংঘের ৬টি অফিসিয়াল ভাষার মধ্যে একটি। এটি বিশ্ব মুসলিমের নিকট গুরুত্বপূর্ণ ভাষা । তাছাড়া ২২টি আরব দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে আরবি ভাষার চর্চা চলছে। তাই এটি আর্জাতিক ভাষা হিসেবেও বিশেষ মর্যাদার দাবিদার।
বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা ধারায় সুপ্রাচীনকাল থেকেই আরবি বিষয়টি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত আছে এবং এ ধারার শিক্ষার্থীরা আরবি ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞান চর্চা করে আসছে। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষার জন্য যুগোপযোগী ও মানসম্মত শিক্ষাক্রমের অনুপস্থিতির কারণে এ ধারার শিক্ষার্থীরা কুরআন হাদিসের জ্ঞান লাভ করা সত্ত্বেও আরবি ভাষায় দক্ষতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হচ্ছিল। তাই জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০১০- এর আলোকে মাদরাসা শিক্ষার মাধ্যমে উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন আধুনিক কর্মক্ষম জনশক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে- ২০১২ সালে দাখিল স্তরের নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়।
এতে আরবি ভাষা ও সাহিত্যকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে অন্তর্ভূক্ত করে আরবি বিষয়ের শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করা হয়। আরবি শিক্ষাক্রমে তাওহিদ, রিসালাত, আখলাক, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, শিষ্টাচার, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, ধর্মীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে মূল্যবোধ তৈরির সাথে সাথে আরবি ভাষায় যোগযোগ দক্ষতার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এবতেদায়ী স্তর থেকেই আরবি ভাষার পাঠ গ্রহণ করে। এ স্তরে তারা আরবি ভাষার উপর সম্যক ধারণা লাভ করে। দাখিল স্তরে তাদের আরবি ভাষার উপর দক্ষতা আরও বিকশিত হয়। দাখিল স্তরের বর্তমান শিক্ষাক্রমে নিম্নে বর্ণিত উদ্দেশ্যগুলো স্থির করা হয়েছে।
সাধারণ উদ্দেশ্য
দাখিল স্তরে আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়টি অধ্যয়ন করে শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক জীবনে যতটুকু আরবি ভাষা প্রয়োজন, তা জানবে। বয়স ও স্তর অনুযায়ী আরবি শুনে বুঝবে, বলতে পারবে এবং পড়তে ও লিখতে সক্ষম হবে। আরবি ভাষা শিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে ও আগ্রহী হবে। ভাষাগত এই দক্ষতা অর্জনসহ তারা কুরআন ও সুন্নাহ বুঝতে আগ্রহী হবে।
তাছাড়া আরবি গল্প, কবিতা ও কথোপকথনের বিষয় থেকে সৎ গুণে গুণান্বিত হতে উৎসাহিত হবে। তারা আরবি ভাষায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণে প্রত্যয়দীপ্ত হবে, যা তাদেরকে কুরআন ও হাদিস অনুধাবনসহ আরবি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জনে এবং আরব দেশসমূহের সাথে যোগাযোগ ও কর্ম-সম্পাদনের মাধ্যমে নিজের এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়নে সক্ষম করে তুলবে।
স্তরভিত্তিক উদ্দেশ্য
- আরবি ভাষা শুনে বুঝতে সক্ষম হবে।
- শ্রেণির উপযুক্ততাভেদে আরবি ভাষায় কথা বলে পরস্পর যোগাযোগ করার পদ্ধতি জানতে পারবে।
- সহজ ভাষায় দৈনন্দিন বিষয়ে লিখিত বিভিন্ন বিষয় পড়ে তা অনুধাবন করতে পারবে।
- ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োজনীয় বিষয় সহজভাবে আরবি ভাষায় লিখিত আকারে প্রকাশ করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে।
- পঠিত বিষয়ের মর্ম অনুধাবন করতে পারবে। সুষ্ঠু বাক্য বিন্যাসের ক্ষমতা অর্জন করবে।
- শব্দ ভাণ্ডার বৃদ্ধিতে সক্ষম হবে।
- মৌখিক ও লিখিত প্রকাশভঙ্গির মানোন্নয়ন করতে পারবে।
- দ্রুত গতিতে সরব ও নীরব পাঠের অভ্যাস গঠন করতে পারবে। নির্ভুল পরিচ্ছন্ন ও দ্রুত লেখার কৌশল অর্জন করতে সক্ষম হবে।
- পরিভাষা ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করবে।
- শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তির বিকাশ সাধন হবে ।
- যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে আরবি ভাষা ব্যবহারের যোগ্যতা অর্জন করবে।
- কর্মক্ষেত্রে ও ব্যবহারিক জীবনে আরবি ভাষার প্রায়োগিক উদ্দেশ্য সাধন হবে।
- সঠিক উচ্চারণের দক্ষতা অর্জিত হবে।
- শিষ্টাচার শিক্ষা ও প্রয়োগের যোগ্যতা অর্জন হবে।
- কুরআন মাজিদ ও হাদিস শুদ্ধ করে পড়া এবং অনুধাবন করার যোগ্যতা অর্জন করবে।
- আরবি ভাষায় দৈনন্দিন বিষয়ে পরস্পর যোগাযোগ করার দক্ষতা অর্জন হবে।
আরবি শিক্ষাক্রমের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য
- জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২-এর দাখিল স্তরের আরবি শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ পরিলক্ষিত হয়:
- দাখিল স্তরের আরবি শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের মাদরাসা ধারার শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশ লাভ হয়। এতে মানবিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিক গুণসম্পন্ন জ্ঞানী, দক্ষ, যুক্তিবাদী, সৃজনশীল, দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হয়েছে।
- কুরআন হাদিসের ভাষা ও আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে আরবির বিষয়বস্তুকে মুখস্থ করার পরিবর্তে শোনা, বলা, পড়া ও লেখা-এ চারটি ভাষাগত দক্ষতাকে শ্রেণিকক্ষে অনুশীলনের মাধ্যমে শেখার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
- আরবি ভাষা শিখনের ক্ষেত্রে কমিউনিকেটিভ এপ্রোচ এর সুপারিশ করা হয়েছে।
- আরবি ভাষার দক্ষতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।
- আরবি শিক্ষার উদ্দেশ্য ও বিষয়ভিত্তিক শিখনফল নির্ধারণে শিখনের তিনটি ক্ষেত্রের (বুদ্ধিবৃত্তীয়, আবেগীয় ও মনোপেশী) মধ্যে সমন্বয় করা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীর চিন্তন, দৈহিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক বিকাশ ভারসাম্যপূর্ণ হবে।
- শিক্ষাবর্ষের কর্মদিবসের সংখ্যানুযায়ী আরবি বিষয়ের শিখনফল ও বিষয়বস্তু বিন্যস্ত হয়েছে। এতে বিষয়বস্তুর ভার এবং ক্লাস সংখ্যা প্রাসংগিকভাবে সুসামঞ্জস্য হয়েছে।
- আরবি ভাষায় দক্ষতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। গতানুগতিক মুখস্থ করার প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
- কার্যক্রমভিত্তিক শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আরও দেখুনঃ