আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় দুই মুসাফির
দুই মুসাফির
দুই মুসাফির
লেখক-পরিচিতি
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারি বর্তমান ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলার সবল সিংহপুর গ্রামে শওকত ওসমানের জন্ম। তাঁর পিতার নাম শেখ মুহম্মদ এহিয়া। শওকত ওসমানের পিতৃপ্রদত্ত নাম শেখ আজিজুর রহমান; তার লেখক- নামের দেশজোড়া পরিচিতির কারণে প্রকৃত নামটি অনেকেরই অজানা।
১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর তিনি কলকাতার বিখ্যাত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৩৫ সনে আই.এ এবং ১৯৩৮ সনে বি.এ পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে শওকত ওসমান এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে।
শিক্ষক হিসেবে চাকুরি-জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করলেও শওকত ওসমান কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ওয়াটার ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টে। তিনি কিছুকাল কাজ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ তথ্য মন্ত্রণালয়ে, শিক্ষকতা করেছেন বেসরকারী স্কুলেও। পরে কলকাতার ইস্টিটিউট অব কমার্সে যোগ দেন বাংলা ও অর্থনীতি- এই দুই বিষয়ের অধ্যাপক রূপে ।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪-১৫ আগস্ট ভারত-বিভাগ সম্পন্ন হলে শওকত ওসমান তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসেন। এখানে তাঁর চাকুরী জীবন শুরু হয় চট্টগ্রাম সরকারী কমার্স কলেজে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে শওকত ওসমান ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। ঐ কলেজে কর্মরত অবস্থায় ১৯৭২ সনে ৫৫ বছর বয়সে শওকত ওসমান চাকুরী জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অতঃপর সুদীর্ঘ অবসর জীবনে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন সাহিত্যসাধনা ও সমাজসেবায়।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান এক বিশিষ্ট নাম। কলকাতা বাসকালীন সময়ে চলিশের দশকের প্রারম্ভেই সাহিত্যজগতে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। এ সময়েই তিনি রচনা করেন প্রথম উপন্যাস জননী (১৯৬৮ সনে প্রথম প্রকাশিত)। তাঁর প্রথম মুদ্রিত উপন্যাস বনি আদম ১৯৪৩ সনে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানশাসিত পূর্ববাংলায় সামরিক শাসনামলে কয়েকটি রূপক উপন্যাস রচনা করে শওকত ওসমান সুখ্যাতি অর্জন করেন।
এ সময়ের রচনা ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২) তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ছোট গল্প সৃজনের ক্ষেত্রেও শওকত ওসমান দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর বেশ কিছু গল্প বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের উজ্জ্বল সম্পদ । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালে সুদীর্ঘ অবসর জীবনে শওকত ওসমান সাহিত্য ও সমাজসেবার মাধ্যমে ক্রমশ পরিণত হন জাতির বিবেকে। এ সময়ে তাঁর সমগ্র কর্মকান্ডের উৎসে সক্রিয় ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
সৃজনশীল রচনার পাশাপাশি এ পর্যায়ে তিনি প্রভূত সংখ্যায় সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি ও ধর্ম বিষয়ে মননশীল প্রবন্ধ রচনা করেন। প্রখর সমাজজ্ঞান, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও পরিহাসপ্রিয়তা এবং আরবি-ফারসি-উর্দু হিন্দি শব্দ সহযোগে স্বকীয় রচনাশৈলী শওকত ওসমানের সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য । নিরলস সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতি-স্বরূপ শওকত ওসমান ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কারে। ১৯৬২ সনে বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রদান করে তাঁকে সম্মানিত করা হয়।
অতঃপর ১৯৬৬ সনে তিনি ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ১৯৬৭ সনে পাকিস্তান সরকারের ‘প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৮৩ সনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ‘একুশে পদক’ প্রদান করে তাঁর সাহিত্যকৃতির স্বীকৃতি দেন। ১৯৯১ সনে শওকত ওসমানকে ‘মাহবুবউলাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার’ ও ‘মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করে সম্মানিত করা হয়।
১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে ঢাকায় প্রায় বিরাশি বছর বয়সে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের জীবনাবসান ঘটে। শওকত ওসমান রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ:
ছোটগল্প: পিজরাপোল (১৩৫৮), জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প (১৩৫৮), সাবেক কাহিনী (১৯৫৩), প্রস্তর ফলক (১৯৬৪), শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৭৪), জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫), মনিব ও তাহার কুকুর (১৩৯৩), ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৯০)।
উপন্যাস: বনি আদম (১৯৪৩), জননী (১৯৫৮) ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২), সমাগত (১৩৭৪), জাহান্নাম হতে বিদায় (১৯৭১), রাজা উপাখ্যান (১৩৭৭), দুই সৈনিক (১৯৭৩), নেকড়ে অরণ্য (১৩৮০), পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩), ,জলাংগী (১৯৮৬)।
নাটক: আমলার মামলা (১৯৪৯), বাগদাদের কবি (১৩৫৯), পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা (১৯৯০)।
শিশু সাহিত্য: ওটেন সাহেবের বাংলো (১৯৪৪), প্রাইজ ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৯), ক্ষুদে সোশালিস্ট (১৯৭৩)।
প্রবন্ধ: সমুদ্র নদী সমর্পিত (১৯৭৩), সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই (১৯৮৫), মুসলিম মানসের রূপান্তর (১৯৮৬)।
পাঠ-পরিচিতি
শওকত ওসমান রচিত শ্রেষ্ঠ গল্পগুলির মধ্যে ‘দুই মুসাফির’ বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। দুজন মৃত মানুষের মর্তলোকে আগমনকে উপলক্ষ করে গল্পকার গল্পটিতে রূপক ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। ইহজাগতিক জীবনের গৌরব যে একজন মানুষকে যুগপরম্পরায় লোকমানসে জীবন্ত করে রাখে। এই বাণীই কবি লালন ফকিরকে কেন্দ্র – করে দুই মুসাফিরের রূপকে গল্পটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গল্পকারের মানবপ্রেম ও ইহজাগতিক চেতনা গল্পটির বড় সম্পদ।
‘দুই মুসাফির’ শওকত ওসমানের অন্যতম গল্পগ্রন্থ প্রস্তর ফলক -এর অন্তর্ভুক্ত প্রথম গল্প। ঢাকার এ.বি পাবলিকেশন্স থেকে ১৯৬৪ সনের আগস্ট মাসে প্রস্তর ফলক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ‘দুই মুসাফির’ গল্প দুটি অংশে বিভক্ত; প্রথম অংশে সর্বজ্ঞ গল্পকারের ভাষ্যে মূল কাহিনী-অংশ উপস্থাপিত হয়েছে, , দ্বিতীয় অংশে পরলোক থেকে আগত কবি লালন ফকির ও ভূস্বামী জোয়ার্দারের মধ্যে বিনিময়কৃত সংলাপ গুচ্ছ সংযোজিত হয়েছে।
ঐ সংলাপ-অংশই গল্পটির ক্লাইম্যাক্স কিংবা শীর্ষচূড়া। সর্বজ্ঞ গল্পকারের বিবৃতিতে ও চরিত্রসমূহের সংলাপে গৃহীত হয়েছে চলিত ভাষারীতির গদ্য। আরবি-ফারসি শব্দ সহযোগে শওকত ওসমানের গদ্যরচনার সাধারণ বৈশিষ্ট্যটি আলোচ্য গল্পটিতেও সুলভ। বিষয়ের প্রতি আসক্ত ও আসক্তিশূন্য দুই মুসাফিরের পার্থক্য সূত্রে নির্মোহ কবির কালজয়ী মাহা্যের কথা গল্পটির মুখ্য বিষয় হওয়ায় এর ‘দুই মুসাফির’ নামকরণ সার্থক হয়েছে।
মূলপাঠ
গ্রীষ্মের দুপুর প্রায় শেষ। অড়হর ক্ষেতে ছায়া পড়ছে। ক্রমশ: দীর্ঘতর। কুষ্টিয়া জেলা বোর্ডের সড়ক পথে একজন পথিক হাঁটছিলেন। পরণে গেরুয়া তবৃন্দ, গায়ে গেরুয়া আলখেলা। লম্বাটে মুখ-বোঝাই সাদা দাড়ী। হাতে একটি এক তারা। পথিক ঘর্মক্লান্ত। তবু দুই চোখ পথের উপর নয়, পথের দুধারে। গ্রীষ্মের দাবদাহ সব পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। এই রুক্ষতার সৌন্দর্য বৈরাগীর মনের রঙের মত।
পথিক তাই চেয়ে চেয়ে দেখছেন আর হাঁটছেন। মাঝে মাঝে এক তারায় হঠাৎ আঙুল অজানিতে গিয়ে পড়ে। টুংটাং আওয়াজ রৌদ্রের বিবাগী সুরে মিশে যায়। তা নিতান্ত অজানিতে। নচেৎ পথিকের মন এখন একতারার সুরে নয়, বহির্বিশ্বের ফ্রেমে আবদ্ধ। মাঝে মাঝে ছায়াবতী গাছ পড়ে। কিন্তু মুসাফির থামে না। তিন মাইল দূরে গঞ্জ দেখা যায়। সেখানেই হয়ত তার গন্তব্য।
পেছনে আর একজন হাঁটছেন। একটু দ্রুত। তার ইচ্ছা অগ্রগামী পথিকের সঙ্গ ধরা। ডাক দিয়ে হয়ত চলা থামানো যায়। কিন্তু এই মুসাফির অতদূর গায়ে-পড়া-ভাব দেখাতে রাজি নন। তাছাড়া এই মহাজনের চেহারায় রুক্ষ-কাঠিন্যের ছাপ স্পষ্ট, তার কালো গুফরাশি এবং সুঠাম লোমপূর্ণ দুই বাহুর মধ্যে। মুখটি বেশ চওড়া। চোখ গোলা-ভাঁটার মত। দেখলেই মনে হয়, এই মানুষ হুকুম দিতে অভ্যস্ত, তামিলে নয়।
কিন্তু তিনি হাঁটছেন জোর-পা। অগ্রগামী পথিককে ধরা উচিত। পথ-চলার ক্লান্তি দূর করতে সঙ্গীর মত আর কিছু নেই। দ্বিতীয় পথিক জোরে হাঁটতে লাগলেন। ফলে ঘাম ঝরে তার শরীর থেকে। মুখে অস্বোয়ান্তির ছাপ পড়ে। কিন্তু তবু সংকল্প টলে না । কাছাকাছি এসে দ্বিতীয় পথিক ডাক দিলেন, “ও ভাই।” আগের পথিক এবার পেছনে তাকায়। অন্য মানুষ দেখে, মুখে অভিনন্দনের হাসি, থামলেন প্রথম পথিক ।
পেছনে ফিরে বললেন,
“আমাকে ডাকাছেন, ভাই?”
জী, পামালেকুম ।
আলায়কুম আস্ সালাম ।
আপনি কোন্ দিকে যাচ্ছেন?
ঐ গঞ্জে। বেশ বেশ। আমিও যাব।
বেশ ভালই হোল। চলুন, একসঙ্গে কথায় বার্তায় যাওয়া যাবে।
দুইজনে এগোতে থাকে। এবার কিন্তু দুজনেরই পদক্ষেপ শথ। সঙ্গী পেলে পথের দূরত্ব আর ভীতিজনক থাকে না। তাই হয়ত তারা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলেন। দুজনে পাশাপাশি। দাড়ি শোভিত পথিকের দৃষ্টি বাইরের দিকে। গুক্ষধারী মুসাফির কিন্তু সঙ্গীর দিকে বার বার তাকায়। গ্রীষ্মের দিগন্ত আলোর তীব্রতায় মুহ্যমান। সেই রূপ সব সময় পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় মুসাফির সেদিকে তাকিয়ে সঙ্গীর চোখের দৃষ্টি কোথায় মিশেছে দেখতে চায়।
সেই দৃষ্টি দিগন্ত অভিমুখী। দ্বিতীয় মুসাফির তাই কয়েকবার দূরে তাকিয়ে আবার সঙ্গীর অবয়বের দিকে লক্ষ্য করেন। অপরজন নির্বিকার। এই নিঃস্তব্ধতা দ্বিতীয় পথিকের কাছে অসহ্য লাগে। কথার বন্ধন না এলে আর সঙ্গী কী? গুমোট দূর করতে তিনি বেশ উঁচু আওয়াজেই বলেন, “ভাই, আপনি কি গান করেন?” সদ্য চমক-ভাঙা প্রথম আনমনা মুসাফির শুধান, “কি ভাই, আমাকে কিছু বলছিলেন?”
দুইজনের মধ্যে আর কোন বাক্যালাপ হয় না। তাড়াতাড়ি পথ শেষ করাই তখন লক্ষ্য। মাঠ শেষ হোয়ে গেল। ওরা দুইজনে এখন লোকালয়ের মধ্যে এসে পড়েছেন। গাছ-গাছালির মাঝখানে খড়ো বাড়ী, টিনের ঘর, কচ্ছিৎ ইমারৎ দেখা যাচ্ছে। সড়কের দুপাশে এখানে বহু গাছের সারি। দুএকজন পথিক যে যার কাজে যাচ্ছে, এদের দিকে কেউ তাকায় না। তবু মানুষের সঙ্গ পাওয়া গেল, প্রথম মুসাফির ভাবলেন।
ওরা এবার একটা জায়গায় এসে পড়েছেন এখানে সড়কের দুপাশ ফাঁকা। তারপরই অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ভিটা, পুকুর পুষ্করিণী। এক জায়গায় জড়াজড়ি করা কয়েকটা ইমারৎ দেখা গেল, বেশ বড় বাগানের ফলের গাছের সারির ভিতর দিয়ে। দ্বিতীয় পথিকের সেদিকে চোখ পড়া মাত্র তিনি বৈরাগী পথিকের হাত ধরে টান দিলেন আর বললেন, “একটু জলদি আসুন। ঐ আমার ঘর দেখা যাচ্ছে। ঐ আমার বাগান।
এই চারিদিকে যত জমি-জিরাৎ সব আমার। চলুন, চলুন। আপনাকে ঐ যে নারিকেল গাছ দেখা যাচ্ছে, ওখান থেকে যা ডাব খাওয়াব – – সাতদিনের পিয়াস মরে যাবে।” প্রথম মুসাফির আর জবাব দেওয়ার অবসর পান না। দ্বিতীয় পথিকের মুঠির মধ্যে তার হাত বাঁধা। দ্রুত হাঁটতে তাই বাধ্য হচ্ছেন। দুই জনে এসে একটা পাকা সান বাঁধানো দীঘির ধারে থামলেন। পাড়ে শত শত নারিকেল গাছ।
দ্বিতীয় পথিক বললেন, “এখানে বসুন এই কামিনী গাছের ছায়ার নীচে। আমি ডাবের বন্দোবস্ত করি। এই সব আমার। এই দীঘি, আগান-বাগান, ওই ইমারৎ আর ওপাশে মাঠে চোখ যদ্দর যায়, সমস্ত আবাদ জমি আমার। আর এই যে— পথিকের কথা সমাপ্ত হয় না। এরা লক্ষ্য করেননি, সান বাঁধা ঘাটের একপাশে দুটো মোটা নারিকেল গাছের আড়ালে আর একজন বেশ মোটা তেজীয়ান, গোঁফবান ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি হঠাৎ বেরিয়ে এলেন। একদম দুজনের মুখোমুখি ।
উভয়ের সারা বদনে দৃষ্টি বুলিয়ে সে দ্বিতীয় পথিককে জিজ্ঞেস করলে, “আপনি কি বলছিলেন?”
টীকা
লালন ফকীর – বিখ্যাত বাউল সাধক ও কবি লালন শাহ্। ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক ঝিনাইদহ’র হরিশপুর গ্রামে, মতান্তরে কুষ্টিয়া-কুমারখালীর ভাঁড়রা গ্রামে লালন শাহ্র জন্ম হয়। তাঁর গানের তত্ত্বমূল্য, রসব্যঞ্জনা ও শিল্পমূল্য বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বপ্রথম লালনের গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করেন।
সাম্প্রদায়িক বিভেদমুক্ত সর্বজনীন আবেদনের কারণে সর্বধর্মের মানুষের কাছেই লালন শাহ্ মহৎ কবিরূপে পরিচিত। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এই অমর কবির জীবনাবসান ঘটে।
বস্তুসংক্ষেপ
ইহলোকে একদিন অবস্থানের বাসনা নিয়ে পরলোক থেকে মাটির পৃথিবীতে এসে উপস্থিত হয়েছেন মরমী কবি লালন ফকীর। গ্রীষ্মের শেষ-দুপুরে কুষ্টিয়া জেলা বোর্ডের সড়ক পথে গৈরিক বস পরিহিত ও সাদা শ্মশ্রুমন্ডিত মুসাফির বেশী লালন ফকীর একতারা হাতে হেঁটে চলছিলেন। একদিকে রুক্ষ প্রকৃতির সৌন্দর্য অন্যদিকে বাউল কবির একতারা-ধ্বনিত টুংটাং বিবাগী সুর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল।
মুসাফির লালনের গন্তব্য হয়ত তিন মাইল দূরবর্তী গঞ্জ; কেননা তিনি বিরামহীন পদক্ষেপে ঐদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। লালন ফকীরের পেছনে আর একজন মুসাফিরও দ্রুত হাটছিলেন। তার উদ্দেশ্য অগ্রগামী মুসাফিরের সঙ্গ ধরে পথ-চলার ক্লান্তি খানিকটা দূর করা। দ্বিতীয় মুসাফিরের অবয়বে মহাজনী চেহারার রুক্ষ কাঠিন্যের ছাপ। তাকে দেখলেই মনে হয় ইনি হুকুম দিতেই অভ্যস্ত, হুকুম তামিলে নয়।
দ্রুত হেঁটে দ্বিতীয় মুসাফির লালনের কাছাকাছি চলে আসেন এবং তার সঙ্গে কথা বলতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। লালন তার ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকান এবং সৌজন্যমূলক সম্ভাষণ করেন। দ্বিতীয় মুসাফিরের প্রশ্নোত্তরে লালন জানান যে তিনিও গঞ্জের দিকে যাচ্ছেন। কথা বলার প্রলোভনে দ্বিতীয় মুসাফির সঙ্গী হন লালনের পথ চলার। কিন্তু কথা বলার চেয়ে লালনের কাছে নীরবতাই আনন্দের। তাঁর নির্বিকার বাউল-দৃষ্টি দিগন্ত অভিমুখী।
এই স্তব্ধতা ভালো লাগে না দ্বিতীয় মুসাফিরের। স্তব্ধতার গুমোট দূর করার জন্যই লালনকে তিনি গান করেন কিনা জিজ্ঞেস করেন। লালন হ্যাঁ-সূচক উত্তর করলে একটি গান পরিবেশনের অনুরোধ করেন দ্বিতীয় মুসাফির। লালন উদাত্ত কণ্ঠে দেহতত্ত্ব বিষয়ক একটি মরমী গান গেয়ে শোনান। তার সুরের ঝর্ণাধারায় নিবারিত হয় তৃষ্ণা, দূরীভূত হয় দাবদাহ। বিমুগ্ধ দ্বিতীয় মুসাফির প্রশংসা করেন প্রথম মুসাফিরের গানের।
মাঠের পথ শেষ করে দুজনে লোকালয়ের চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করেন। চোখে পড়ে অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ভিটা, পুকুর, জড়াজড়ি করা কয়েকটা ইমারৎ। আবেগাপুত দ্বিতীয় মুসাফির লালনের হাত ধরে টান দেন, অনুরোধ করেন দ্রুত হাঁটার। তিনি লালনকে দেখিয়ে দেন অদূরবর্তী ঘর, ফলের বাগান, জমি-জিরাৎ। আনন্দে আত্মহারা দ্বিতীয় মুসাফির চিৎকার করে বলতে থাকেন- এই চারদিকের জমি-জিরাৎ সব আমার।
‘ অতঃপর একটি পাকা সান-বাঁধানো দীঘির ধারে এসে দুজনে থামেন। আবেগাপুত দ্বিতীয় মুসাফির সারিবদ্ধ শত শত নারকেল গাছের পাশে কামিনী গাছের ছায়ায় বসার জন্য আহ্বান করেন লালনকে। জমিজমা ইমারৎ বাগান প্রভৃতির দিকে লক্ষ্য করে পুনরুক্তি করে বলেন, ‘এই সব আমার।’ কিন্তু তার সংলাপ সম্পূর্ণ না হতেই নারকেল গাছের আড়ালে বসে থাকা ‘মোটা তেজীয়ান, গোঁফবান’ এক ব্যক্তি উঠে আসেন তাদের সামনে।
দ্বিতীয় মুসাফিরকে লক্ষ্য করে বলেন- ‘আপনি কি বলছিলেন?’ দ্বিতীয় মুসাফির আশপাশের সবকিছু দেখিয়ে উত্তর দেন-‘এই আগান-বাগান ইমারৎ সব আমার।’ মোটা তেজীয়ান ব্যক্তিটি নাম জিজ্ঞেস করলে দ্বিতীয় মুসাফির জানান যে তার নাম সোবহান জোয়ার্দার। ব্যক্তিটির বিদ্রূপ- মেশানো দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে সোবহান জোয়ার্দার তার বাপের নামটিও উচ্চারণ করেন। মোটাসোটা গোঁফবান ব্যক্তিটির সন্দেহ থাকে না যে জোয়ার্দার নিতান্তই এক উন্মাদ।
তিনি জানিয়ে দেন যে, এ গ্রামে জোয়ার্দার নামে কোনো গাধার অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। কিন্তু ইহলোকে ফিরে আসা জোয়ার্দার তার নিজস্ব সম্পত্তির স্বত্ত্ব বিস্মৃত হন কীভাবে? সম্বোধনে আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসেন জোয়ার্দার। দুজনের মধ্যে মারামারির উপক্রম হলে মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েন সৌম্য দর্শন মুসাফির লালন ফকীর। গোলমাল শুনে আশপাশ থেকে লাঠি হাতে ছুটে আসে লোকজন।
এরা এই জমিজিরাৎ-এর বর্তমান স্বত্বাধিকারি সোলেমান মলিকের আদেশের অপেক্ষা করে। বিপদজনক পরিণাম আঁচ করে জোয়ার্দার এবার মুখ বন্ধ রাখেন। ঐ মুহূর্তেই মুখ খোলেন প্রথম মুসাফির। তিনি বলেন : জমি-জিরাতের মামলার মীমাংসাস্থল আদালত। এ নিয়ে বিবাদ করা সমীচীন নয়। অতঃপর উত্তেজিত জনতার উদ্দেশে একটি গান পরিবেশনের প্রস্তাব করেন ফকীর মুসাফির। উত্তেজিত সোলেমান মলিক এতে শান্ত হন।
একতারা হাতে দাঁড়িয়ে গান শুরু করেন লালন শাহ্। প্রকৃতিলোকে ছড়িয়ে পড়ে লালনের কণ্ঠোচ্চারিত সুরের মূর্ছনা। সুরের সম্মোহনে ক্রমশ বেড়ে ওঠে জমায়েৎ। গান থামার পর সোলেমান মলিক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে গায়ক ফকীরের নাম জানতে চান। গায়ক মুসাফির জানিয়ে দেন তাঁর নাম লালন ফকীর। সোলেমান মলিক প্রশ্ন করে নিশ্চিত হন এই মুসাফিরই কুষ্টিয়ার বাউল সাধক লালন ফকীর।
ফলে জমায়েতের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, এ ওকে ডাকতে শুরু করে। লালন ফকীরকে দেখে চোখ সার্থক করতে দলে দলে ছুটে আসে গ্রাম্য জনতা। যে কবির নাম এরা দাদা-পরদাদার কাছে শুনেছে, সেই কবিকে এরা সহজে ছাড়তে চায় না। সসম্মানে কাঁধে তুলে নিয়ে তারা গঞ্জের অভিমুখী হয়। গঞ্জের ‘চবুতরায়’ হাজার হাজার লোকের সামনে গান করতে হবে কবিকে। লালন এই হট্টগোলের মধ্যেও খোঁজ নেন সঙ্গী মুসাফিরের।
দেখা যায় লালনের পাশেই আছেন সোবহান জোয়ার্দার। গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে আগত হাজার হাজার জনতা জড়ো হয় গঞ্জে, সকলের মুখে গুঞ্জন ‘কবি লালন ফকীর আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন।’ লোকারণ্য ক্রমশ গঞ্জের চারদিকে বিস্তৃত হতে থাকে। একতারা হাতে গৈরিক বসনধারী লালনের সুরেলা কণ্ঠ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে। সুরের মায়াজালে জনতা স্তব্ধ হয়, নির্বাক হয় পৃথিবী ।
গানের আসরের শেষে রাতের অন্ধকারে ইহলোকে আগত দুই মুসাফিরের পরলোকে প্রত্যাবর্তনের সময় ঘনিয়ে আসে। দুই মুসাফির পরস্পর আলাপচারিতায় নিবিষ্ট হন। জোয়ার্দারের ধারণা হয়েছিলো মর্তের বাসিন্দারা হয়তো অনেক রাত্রি বন্দী করে রাখবে এই শিল্পস্রষ্টাকে। জোয়ার্দার এই মনোভাব ব্যক্ত করলে লালন যে মাত্র একদিনের জন্যে মর্তলোকে এসেছিলেন সে কথা জানিয়ে দেন।
আকাশে তখন উদীয়মান শুকতারা দৃশ্যমান। লালন রাত্রিশেষের পূর্বেই পরলোকে ফিরে যেতে চান। জোয়ার্দারও একদিনের জন্যই দেখতে এসেছিলেন মাটির পৃথিবী। লালন জানতে চান, মর্তলোকে এসে কী অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন জোয়ার্দার। জোয়ার্দার অকপটে জানিয়ে দেন যে, মর্ত্যের মানুষ কেউ তাকে চেনে না, নাম পর্যন্ত জানে না – এই নির্মম বাস্তবতা তিনি প্রত্যক্ষ করে গেলেন পৃথিবীতে।
কিন্তু জোয়ার্দারের এই দেখা যে একপেশে লালন সে কথাটি বুঝিয়ে দেন জোয়ার্দারকে। ইহলোকে জোয়ার্দার-এর অনেক ছিল, পক্ষান্তরে লালন ছিলেন কপর্দকশূন্য। আজ লালনের সব আছে, অথচ জোয়ার্দারের কিছুই নেই। মৃত্যুতে জোয়ার্দার নিঃস্ব; শারীরিক অস্তিত্ব বিলুপ্ত হলেও, লালন যুগ-পরম্পরায় লোকমানসে অমর, জীবন্ত।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের উত্তর লিখুন
১. ইহজগতে আগত লালন ফকীর যখন সড়ক পথে হাঁটছিলেন তখন প্রাকৃতিক পরিবেশ কেমন ছিল?
২. গঞ্জের পথ ধরে চলমান দুই মুসাফিরের আলাপের বিষয় বর্ণনা করুন।
৩. নিজের বাড়ি-ঘর জমি-জিরাৎ দেখে দ্বিতীয় মুসাফির সোবহান জোয়ার্দার-এর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?
৪. লালনের সুরের মূর্ছনা প্রকৃতিলোকে ও জনমানসে কেমন প্রভাব বিস্তার করেছিল?
৫. লালনের পরিচয় জানতে পেরে গ্রাম্যজনতা কী আচরণ করেছিল?
৬. জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করার ক্ষেত্রে সোবহান জোয়ার্দার-এর দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করুন।
৩ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর:
মাটির পৃথিবীতে আগত দ্বিতীয় মুসাফির সোবহান জোয়ার্দার-এর সমগ্র অবয়বে মহাজনের চেহারার রুক্ষ কাঠিন্যের ছাপ স্পষ্ট করে তুলেছে তার যাপিত ইহজৈবনিক বিষয়াসক্ত জীবনের ইতিহাস। এই মানুষটিকে দেখলেই বোঝা যায় ইনি হুকুম দিতে অভ্যস্ত হলেও হুকুম পালনে তৎপর নন। বস্তুত মর্তলোকে তার আগমনের হেতুও তার অপরিমেয় বিষয়াসক্তি।
মহাজনী কৌশলে ইহজীবনে তিনি যে বিষয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই সাম্রাজ্য প্রত্যক্ষ করার পিছুটান থেকেই ইনি একদিনের জন্য ফিরে এসেছেন ইহজগতে। পথচলার ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্য থেকেই তিনি দ্রুত হেঁটে এসে অগ্রগামী মুসাফির লালন ফকীর-এর সঙ্গী হন। বাউল লালনের দৃষ্টি দিগন্ত অভিমুখী, কিন্তু বিষয়াসক্ত সোবহান জোয়ার্দারের দৃষ্টি নিবন্ধ থাকে পথের দুপাশের জমি-জিরাৎ, বাগান আর ইমারতের দিকে।
পথ চলতে চলতেই সোবহান জোয়ার্দার হঠাৎ আবেগে উদ্দীপনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। পথসঙ্গী লালনের হাত আকর্ষণ করে তিনি অদূরবর্তী আগান- বাগান ইমারৎ আর জমি-জিরাৎ-এর দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে বলে ওঠেন, ‘এই সব আমার।’ বহুপূর্বে ইহজীবন ত্যাগ করলেও বিষয়ান্ধ সোবহান জোয়ার্দার মমতা কাটাতে পারেননি মহাজনী কায়দায় মর্তলোকে গড়ে তোলা তার বিশাল বিষয় সাম্রাজ্যের আকর্ষণ।
ঐ আকর্ষণ থেকেই নিজের গড়া বিষয় সাম্রাজ্য দেখার আনন্দ উপভোগ করার জন্যই তিনি অমর্ত থেকে নরলোকে ফিরে এসে বিষয়ানন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছেন।
৪ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর:
কুষ্টিয়া জেলা বোর্ডের সড়ক পথে লালন যখন একমনে হেঁটে চলেছিলেন, তখন মাঝে মাঝে অজানিতেই তার আঙুল এক তারায় সুর তুলছিল। এই সুর প্রকৃতির রুক্ষ সৌন্দর্য আর রৌদ্রের বিবাগী সুরের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো। এই চলার পথেই দ্বিতীয় মুসাফির সোবহান জোয়ার্দার-এর অনুরোধে সুরের ইন্দ্রজাল বিস্তার করে গান গেয়ে শোনান লালন ফকীর।
রুক্ষ নির্জন মাঠ লালনের সৃজন করা এই সুরের ঝর্ণাধারা থেকে পানীয় সংগ্রহ করে তৃষ্ণা মেটায়। সোবহান জোয়ার্দারও মুগ্ধ হন লালনের গানে। এমন মরমী বাউল গান তিনি শোনেন নি কখনো । গল্পটিতে একতারা হাতে লালন দ্বিতীয়বার গান পরিবেশন করেন এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে, উত্তেজনা প্রশমনের স্বার্থে। বিষয়াসক্ত পরলোকবাসী জোয়ার্দার তার ইহজাগতিক সম্পত্তির স্বত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যাকুল হয়ে উঠলে সোলেমান মলি- কের প্রতিরোধের সম্মুখীন হন।
উত্তেজনা ও চেঁচামেচির কারণে সোলেমান মলিকের স্বপক্ষে মারমুখী জনতার সমাবেশ ঘটলে জোয়ার্দার আর মারমুখী মলিকের মধ্যে এসে দাঁড়ান সৌম্যদর্শন লালন ফকীর। ‘জমি-জিরাতের মালা আদালতে ইন্সাফ হতে পারে — বলে লালন একটি গান পরিবেশনের প্রস্তাব রাখেন উত্তেজিত জনতার কাছে। অতঃপর একতারা হাতে দাঁড়ানো লালন ফকীর গেয়ে শোনান এক মরমী গান।
গ্রীষ্মের পড়ন্ত দুপুরে ‘রৌদ্রের রিমঝিম উত্তাপ’ লালনের সম্মোহনী সুর-মূর্ছনার সঙ্গ-অভিলাষী হয়। সম্মোহিত জনতার বক্ষ- সৈকতে লালনের সুরে আবেশ বায়ু-তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ে। সুরের মায়াজালে মোহাবিষ্ট শ্রোতৃএন্ডলী বিমূঢ় হয়ে পড়ে যখন তারা জানতে পারে এই সুকণ্ঠ গায়ক সুবিখ্যাত লালন শাহ্। এদের কেউ দাদা পরদাদার কাছে শুনেছে লালন ফকীরের নাম। কাজেই এরা সহজে লালনকে ছেড়ে দিতে রাজি হয় না।
সসম্মানে তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে গঞ্জ অভিমুখী হয় রসাগ্রহী জনতা। গঞ্জের ‘চবুতরায়’ হাজার হাজার লোকের সমাবেশে গান পরিবেশন করতে হবে লালনকে। গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে ছুটে আসে জনস্রোত; সকলের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ‘অপূর্ব কাহিনীর গুঞ্জন’- ‘কবি লালন ফকীর আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন।
লোকারণ্য ক্রমশ বিস্তৃততর হয় গঞ্জের চারদিকে। গৈরিকবসন বাউল-কবির বাণীকণ্ঠ আর একতারার সুরলহরী অভিনয় সহযোগে পরিবেশিত হয়ে চলে। লালনের সুরবাণীর ইন্দ্রজালে জনতা স্তব্ধ হয়। আর নির্বাক হয় মাটির পৃথিবী।
উৎস ও প্রসঙ্গ নির্দেশ করে ব্যাখ্যা লিখুন
১. এই রুক্ষতার সৌন্দর্য বৈরাগীর মনের রঙের মত।
২. দেখলেই মনে হয়, এই মানুষ হুকুম দিতে অভ্যস্ত, তামিলে নয়।
৩. এই সব আমার। এই দীঘি, আগান-বাগান, ওই ইমারৎ আর ওই ইমারৎ আর ওপাশে মাঠে চোখ যদ্দ সমস্ত আবাদ জমি আমার।
৪. আপনাদের জমি-জিরাতের মালা, সেটা আদালতে ইনসাফ হতে পারে। ও নিয়ে বিবাদ ভাল নয়।
৫. আমাকে কেউ চেনে না, নাম পর্যন্ত জানে না ।
আরও দেখুন :