আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলা গদ্যরীতি ১
বাংলা গদ্যরীতি ১
বাংলা গদ্যরীতি ১
ভূমিকা
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে সৃষ্ট পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা ছিলো বাংলা। পূর্ব পাকিস্তানের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ এই ভাষাকে রাষ্ট্রের সরকারি অফিস-আদালতসহ জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহারের কথাটি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ভাবেন। বর্ণমালা সমস্যা, বানান জটিলতা, লিপিসংস্কার ইত্যাদিও এই ভাবনায় স্থান পায় । এই প্রেক্ষাপটে মুনীর চৌধুরীর কতিপয় বক্তব্য স্থান পেয়েছে ‘বাংলা গদ্যরীতি’ প্রবন্ধে।
লেখক পরিচিত
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর মানিকগঞ্জ জেলায় মুনীর চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ছিলো নোয়াখালি জেলায়। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আই.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে অনার্সসহ ইংরেজিতে স্নাতক হন এবং পরের বছর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে জেলে আটক থাকা অবস্থায় মুনীর চৌধুরী প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে বাংলায় এম.এ. পাশ করেন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন ও ১৯৫৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন ভাষাতত্ত্বে এম.এ ডিগ্রি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তিনি যোগদান করেন ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করেন।
মূলত এ সময় থেকেই মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক জীবন শুরু। একই বছর খুলনার ব্রজলাল (বি.এল) কলেজে ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৯-এ রাজনৈতিক তৎপরতার দায়ে কারারুদ্ধ হন। পরের বছর মুক্তি পেয়ে প্রথমে জগন্নাথ কলেজে ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৫২-তে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার দায়ে পুনরায় কারারুদ্ধ হন।
মুক্তি পেয়ে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে পাকিস্তানী সৈন্যদের অনুচর স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর বাহিনী ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর তাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন। মুনীর চৌধুরী গদ্যলেখক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সতেরো শতাব্দীর হেয়কি কবিতা’ সম্ভবত তাঁর প্রথম রচনা। এর পর ছোটগল্প ও নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন। কারাগারের অভ্যন্তরে রচিত ও মঞ্চস্থ হয় তাঁর নাটক ‘কবর’। নাটক রচনার প্রথাবদ্ধতা ছিন্ন করে তিনি নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অবতীর্ণ হন । সাহিত্য-সমালোচনায় তিনি তুলনামূলক পদ্ধতিও প্রয়োগ করেন।
তার গদ্য পরিশীলিত, সাবলীল ও পরিমিতিময়। মুনীর চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: রক্তাক্ত প্রান্তর (১৯৬২), মীরমানস (১৯৬৫), কবর (১৯৬৬), তুলনামূলক সমালোচনা (১৯৬৯), বাংলা গদ্যরীতি (১৯৭০), মুখরা রমণী বশীকরণ (১৯৭০) ইত্যাদি।
পাঠ-পরিচিতি
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদগণ প্রাত্যহিক জীবনচর্চা ও সরকারি অফিস-আদালতের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি ভাষা কমিটি গঠিত হয়। এর অন্যতম সদস্য ছিলেন মুনীর চৌধুরী। তিনি বাংলা গদ্যরীতি সম্পর্কিত একখানি গ্রন্থ রচনা করেন।
বর্তমান প্রবন্ধটি তাঁর রচিত ‘বাংলা গদ্যরীতি’ (১৯৭০) পুস্তকের অবতরণিকা ‘সাহিত্য নির্দেশ’ অধ্যায় থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও গ্রন্থের অবতরণিকা অংশ থেকে বর্তমান প্রবন্ধটি গৃহীত তবুও এর নামকরণে গ্রন্থটির নামই যুক্তিযুক্তভাবে নেয়া হয়েছে। কারণ এই প্রবন্ধটি মূলত বাংলা গদ্যরীতি প্রচলনের এক পূর্ণাঙ্গ কিন্তু সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। সে দিক থেকে নামকরণটি যথাযথ।
যেহেতু বিষয়বস্তু অথবা অন্তর্নিহিত ভাবকে অবলম্বন করে প্রবন্ধের নামকরণ হয়ে থাকে, সেহেতু বর্তমান প্রবন্ধের নামকরণও বিষয়বস্তুকে নির্ভর করেই হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা গদ্যসাহিত্যের উদ্ভবের ইতিহাস থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর আধুনিক গদ্য নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চর্চার মধ্যদিয়ে গড়ে উঠেছে।
এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিলো মূলত শব্দ নির্বাচন, বাক্যিক সংগঠন ও ভাষার গতিশীলতা নিয়ে। গদ্যচর্চার প্রথম দিকে এর শিল্পগুণের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়নি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতেই প্রথম বাংলা গদ্য শিল্পিতভাবে উপস্থাপিত হয়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের ‘প্রথম শিল্পী’ বলে অভিহিত করেছেন।
মূলপাঠ
১.১. বাংলা গদ্যের জন্ম ঊনবিংশ শতাব্দীতে। এই সময়ের পূর্বেকার দলিলদস্তাবেজ ও চিঠিপত্রে ব্যবহৃত যে গদ্যের নমুনা আমাদের হস্তগত হয়েছে তার রূপ ও প্রকৃতি অনির্দিষ্ট এবং অপরিস্ফুট, বিচ্ছিন্ন এবং খন্ডিত। কোনো গদ্য নিবন্ধ বা গ্রন্থের পরিপূর্ণ আকারে তা রূপায়িত বা প্রচারিত হয়নি। তার সাহিত্যিক মূল্য অকিঞ্চিৎকর এবং পরবর্তীকালের বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশের ধারার সঙ্গে এর যোগসূত্র সুরক্ষিত নয়।
১.২. ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকেও বাংলা গদ্য, শব্দ চয়নে, পদ গঠনে বা বাক্য সংগঠনে কোনো স্থির সুনির্দিষ্ট আদর্শের অনুসারী ছিল না। সবই ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক। লেখকগণ সচেতনভাবে চেষ্টা করেছেন বাংলা ভাষার আন্তর-প্রকৃতিকে আবিষ্কার করতে। তৃতীয় চতুর্থ দশকে বাংলা গদ্য বহুল পরিমাণে স্বাভাবিকতা ও প্রাঞ্জলতা অর্জন করেছিল সত্য কিন্তু এ গদ্যও কোনো বিশিষ্ট শিল্পগুণসম্পন্ন ছিল না।
যে প্রতিভা বাংলা গদ্যকে প্রথম এই ঐশ্বর্যে পরিমন্ডিত করেন তাঁর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যে গ্রন্থারা এই কীর্তি সম্পাদিত হয় তার নাম ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’, রচনাকাল ১৮৪৭। বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত গদ্যই পরবর্তীকালের বাংলা ভাষার বহুমুখী বিকাশের রীতিগত ভিত্তিভূমি ।
১.৩. পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার মত বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশ পরীক্ষা করলেও যে সত্যটি উপলব্ধি করা যায় তা হল এই যে, ভাষা পরিবর্তনশীল এবং বৈচিত্র্যের অনুসন্ধানী। সমাজ-সংগঠনের রূপান্তর, চিন্তার বিবর্তন, রস-পিপাসার নব নব রূপায়ণ যুগে যুগে নতুন প্রতিভার আবির্ভাবের উপযোগী পরিবেশ রচনা করে। কালক্রমে শিল্পীর প্রতিভা ভাষায় নতুন সুর ও শক্তি সংযোজিত করে, নতুন আঙ্গিক ও রসের জন্ম দেয়।
১.৪. বাংলা গদ্যের উন্মেষ-পর্বেও রীতি-বৈচিত্র্যের আভাস লক্ষণীয়। কেরীর ‘কথোপকথন’-এ ইতরজনের মৌখিক বুলির অসংস্কৃত প্রয়োগ, রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’-এ আরবী-ফারসী শব্দের বিষয়োপযোগী ব্যবহার, মৃত্যুঞ্জয়ের ‘বত্রিশ সিংহাসন’-এ সংস্কৃত পদগঠন ও বাক্যগঠন-রীতির অত্যধিক অনুসরণ পরবর্তীকালের বাংলা গদ্যরীতির তিনটি স্বতন্ত্র বিকাশ-ধারার সংকেত বহন করে।
সমকালীন জীবনের আলেখ্য রচনায় কথ্যবুলির কৌশলময় ব্যবহার টেকচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’-কে স্মরণীয় সরসতা ও প্রাণবন্ততা দান করেছে। দীনবন্ধুর প্রহসনে এই ভাষাতেই চূড়ান্ত নাটকীয় উৎকর্ষ লাভ করেছে। রামরাম বসুর আরবী-ফারসী শব্দ-সম্ভারের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বিংশ শতাব্দীর একাধিক মুসলমান লেখকের রচনায় বিস্তৃততর অভিব্যক্তি লাভ করেছে। মৃত্যুঞ্জয়ের অতিপণ্ডিতী-রীতির শিল্পগুণ-মন্ডিত সার্থক রূপায়ণ আছে বিদ্যাসাগরের কোনো কোনো রচনায়।
বঙ্কিম, টেকচাঁদ ও বিদ্যাসাগর উভয়ের রচনার দুই বিশিষ্ট প্রকৃতির শক্তির সমন্বয় সাধন করে প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর নিজস্ব গদ্যের এক হৃদয়গ্রাহী আদর্শ রূপকে। এই ভাষাতেই নিজের অনন্যসাধারণ ভাবকল্পনার উপযোগী বাহনরূপে পুনর্গঠিত করেন রবীন্দ্রনাথ; ভাষাকে করে তোলেন সূক্ষ্ম ও প্রগাঢ়, সংকেতময় এবং সংগীতময়, বহু বর্ণশোভিত ও কারুকার্যমন্ডিত।
কিন্তু রাবীন্দ্রিক গদ্যরীতিও প্রথম চৌধুরীর পুরোপুরি মনঃপূত হয়নি। বিদগ্ধজনের কথ্য বুলির আদলে তিনি সৃষ্টি করলেন নতুন এক প্রখর ও শাণিত গদ্যের ধারা। পরিবর্তনের জোয়ার যে এখানে এসেই থেমে গেছে তা নয়। শরৎচন্দ্র কি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, মুজতবা আলী কি অন্নদাশঙ্কর রায় প্রত্যেকেই নিজ নিজ ব্যক্তিমানসের বিশিষ্ট প্রতিভা, প্রয়োজন ও প্রবণতা অনুযায়ী বাংলা গদ্যরীতিকে যথার্থ বহুমাত্রিকতা দান করেছেন।
দেড়শত বৎসরের বাংলা গদ্যের বিচিত্র ঐশ্বর্যে এই ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণরূপে শোষণ করে নিয়েই প্রতিভাবান পূর্ব পাকিস্তানী সাহিত্যকর্মী আজ বাংলা ভাষার প্রকাশ-ক্ষমতার নব নব দিগন্ত উন্মোচনে ব্যাপৃত ।
১.৫. বলাবাহুল্য, বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশের উপরোক্ত বর্ণনা নিতান্তই সংক্ষিপ্ত এবং সামান্য। বিদ্যাসাগরী গদ্য, আলালী গদ্য, বঙ্কিমী গদ্য প্রভৃতি নামাঙ্কন মোটামুটিভাবে কয়েকটি স্বতন্ত্র গদ্যরীতির সাধারণ বৈশিষ্ট্যবোধক হলেও প্রকৃতপক্ষে এঁরা কেউ একক প্রণালীর গদ্য রচনা করেই ক্ষান্ত হননি। প্রত্যেকেই তঁদের সাহিত্য-জীবনের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন ধরনের গদ্যরীতির উদ্ভাবন ও অনুশীলন করেছেন।
বিদ্যাসাগরের সর্বশেষ রচনা-সমূহের ভাষা মৌখিক বুলির মতই সরল ও অনর্গল এবং তাতে আরবী-ফারসী শব্দের প্রয়োগও প্রচুর। অপরপক্ষে টেকচাঁদের অনেক রচনারই বিষয়বস্তু আধ্যাত্মিক। ভাষা সাধু এবং সংস্কৃতানুসারী। বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’র (১৮৬৫) ভাষা ঝংকারময় এবং পান্ডিত্যপূর্ণ, ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩)-এর ভাষা বলিষ্ঠ হয়েও নমনীয়, আড়ম্বরহীন হয়েও ক্রীড়াশীল।
এ সব কথা যদিও পুরাতন এবং বিদিত তবু যাঁরা জবরদস্তি ইতিহাস উপেক্ষা করে অগ্রসর হতে উদ্যোগী তাঁদের কথা স্মরণ করে পুনরুক্তি আবশ্যক বিবেচনা করেছি।
শব্দার্থ ও টীকা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর— প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা। জন্ম ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে, মৃত্যু ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে। পিতার নাম বীরসিংহ শর্মা। বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ এবং সমাজসংস্কারক। বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, নারী শিক্ষা ও বহুবিবাহরদ আন্দোলনের পুরোধা । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে অভিহিত।
বেতালপঞ্চবিংশতি — ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থ; রচনাকাল ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দ।
সমাজ-সংগঠনের রূপান্তর — সমাজের অভ্যন্তরীণ ও বহির্গত স্তর-কাঠামোর পরিবর্তন।
কেরী— উইলিয়াম কেরী। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রতিষ্ঠিত বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। একই সনে ‘কথোপকথন’ নামে তাঁর গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মৌখিক ভাষার হুবহু প্রয়োগ দেখা যায়।
কথোপকথন— উইলিয়াম কেরী রচিত গদ্যগ্রন্থ; প্রকাশকাল ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে।
রামরাম বসু— উইলিয়াম কেরীর প্রথম ও প্রধান সহায়ক পন্ডিত। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। ফারসী ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। নিজের রচিত গদ্যগ্রন্থে প্রচুর আরবী-ফারসী ভাষার প্রয়োগ করেন।
মৃত্যুজ্ঞয়— মৃত্যুজ্ঞয় বিদ্যালঙ্কার। উইলিয়াম কেরীর অধীনে নিয়োজিত প্রধান পন্ডিত। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয়। সংস্কৃত ভাষায় অসাধারণ দখল ছিলো। পাঁচটি বাংলা গ্রন্থ লেখেন। তাঁর গদ্যরীতি সংস্কৃত ব্যাকরণ-অনুসারী।
বত্রিশ সিংহাসন — মৃত্যুজ্ঞয় বিদ্যালঙ্কার রচিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দ ।
টেকচাঁদ— টেকচাঁদ ঠাকুর। প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখক নাম। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ ও ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা গদ্যে কথ্য ভাষারীতির তিনি প্রবর্তক। তাঁর মতে, সংস্কৃত শব্দবহুল গদ্যরীতির পরিবর্তে প্রচলিত শব্দনির্ভর সরল গদ্যই বাংলা ভাষায় আদর্শ হওয়া উচিত। এই গদ্যরীতিতে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৭) গ্রন্থটি রচনা করেন।
দীনবন্ধু— দীনবন্ধু মিত্র; জন্ম ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে, মৃত্যু ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। আধুনিক বাংলা নাটকের অন্যতম প্রাণপুরুষ। ‘নীলদর্পন’ (১৮৬০) তার বিখ্যাত নাটক। এছাড়া তিনি কয়েকটি প্রহসনও রচনা করেন।
সংকেতময়তা ও সঙ্গীতময়তা — ভাষার প্রধান দুটি গুণ। রূপ-প্রতীকের আশ্রয়ে রচনার অতিরিক্ত ভাবপ্রকাশ এবং তাতে হৃদয় মনোমুগ্ধকারী সুরের আবহ সৃষ্টি।
রাবীন্দ্রিক গদ্য – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গদ্য বা তাঁর গদ্যভঙ্গির বৈশিষ্ট্য অনুসারে রচিত অন্য কারো গদ্য ।
দুর্গেশনন্দিনী— ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিত বাংলা ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ, মৌলিক ও সার্থক উপন্যাস। মুঘল ও পাঠানের রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সার পটভূমিকায় বিন্যস্ত আলোচ্য উপন্যাসটিতে শাশ্বত মানব প্রেমের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
বিষবৃক্ষ— ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত সামাজিক উপন্যাস।
বস্তু-সংক্ষেপ
বাংলা গদ্যের উদ্ভব উনিশ শতকে। এর পূর্বকালে রচিত বাংলা গদ্যের যে নমুনা পাওয়া যায় তার রূপ ও প্রকৃতি একদিকে অনির্ধারিত এবং অস্পষ্ট, অন্যদিকে বিযুক্ত ও কর্তিত। ফলে বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশের ধারায় এগুলো সুরক্ষিত নয়। উনিশ শতকের প্রথম চার দশকেও বাংলা গদ্য তেমন বলিষ্ঠ হয়ে ওঠেনি। প্রথম দুই দশক ছিলো নিতান্তই পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক; তৃতীয় ও চতুর্থ দশক সরল গদ্য গড়ে উঠলেও তা শিল্পগুণসম্পন্ন ছিলো না।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদাসাগর প্রণীত ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭) গ্রন্থের মাধ্যমেই বাংলা গদ্য প্রথম ঐশ্বর্য-পরিমন্ডিত হয়ে ওঠে। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার মতো বাংলা ভাষাও পরিবর্তনশীল ও বৈচিত্র্যের অনুসন্ধানী। বাংলা গদ্যের সূচনা পর্বে উইলিয়াম কেরী অনুসৃত মৌখিক বুলির হুবহু প্রয়োগরীতি, রামরাম বসু অনুসৃত আরবী-ফারসী শব্দের বিষয়োপযোগী ব্যবহার রীতি ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার অনুসৃত বাংলায় সংস্কৃত ভাষারীতি অনুসরণের ত্রিবিধ ধারার জন্ম হয়।
পরবর্তীকালে টেকচাঁদ ঠাকুর, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ মৌখিক বুলির প্রয়োগরীতিতে সাফল্য অর্জন করেন। রামরাম বসুর পথ অবলম্বর করেন মুসলমান লেখকগণ। বিদ্যাসাগরের মধ্যে দেখা যায় মৃত্যুঞ্জয়ী গদ্যরীতির প্রভাব। বঙ্কিমচন্দ্র টেকচাঁদ ও বিদ্যাসাগর উভয়ের রচনা-প্রকৃতিকে সমন্বিত করে হৃদয়গ্রাহী এক গদ্যভঙ্গি উপস্থাপন করেন। এই গদ্যভাষাকে আরো অধিক শিল্পমন্ডিত করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রথম চৌধুরী রাবীন্দ্রিক গদ্যরীতিকে অতিক্রম করে কথ্য বুলির আদলে সৃষ্টি করেন নতুন এক প্রখর ও শাণিত গদ্যধারা। পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্র, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, মুজতবা আলী, অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখের হাতে বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে। সে পথ ধরেই পূর্ব-পাকিস্তানী সাহিত্যকর্মীগণ বাংলা ভাষার নতুন দিক উন্মোচনে ব্যাপৃত।
আজ বিদ্যাসাগরী গদ্য, আলালী গদ্য, বঙ্কিমী গদ্য ইত্যাদি ব্যক্তি নামাঙ্কিত স্বতন্ত্র গদ্যরীতির পরিচয় পাওয়া গেলেও, বলাবাহুল্য, এই ব্যক্তিবর্গ সর্বদাই একরীতিতে গদ্যচর্চা করেননি।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সংক্ষিপ্ত-উত্তরমূলক প্রশ্ন
১. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত গদ্যরীতির পূর্ববর্তীকালের বাংলা গদ্য মূলত কিরূপ ছিলো?
২. বাংলা গদ্য উদ্ভবের প্রথম চারদশকে যে ধরনের গদ্য রচিত হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন।
৩. বাংলা গদ্যের সূচনাপর্বে যে তিন ধরনের রীতি লক্ষ্য করা যায় সেগুলো কি কি?
২ নং সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্নেরমুনা উত্তর:
মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা গদ্যের জন্ম। এর আগে দলিল বা চিঠিপত্রে গদ্যের যে রূপ দেখা যায় তা অপরিস্ফুট ও অনির্দিষ্ট। এর সাহিত্যিক মূল্য অকিঞ্চিৎকর এবং পরবর্তীকালের বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশের ধারার সঙ্গে এর যোগসূত্র কম। উনিশ শতকের প্রথম দুই দশকেও বাংলা গদ্য শব্দ চয়নে, পদ গঠনে বা বাক্য সংগঠনে কোন স্থির সুনির্দিষ্ট আদর্শের অনুসারী ছিলো না।
বাংলা ভাষার আন্তর-প্রকৃতি আবিষ্কারে উৎসাহী লেখকগণ মূলত এ সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে বাংলা গদ্য বহুল পরিমাণে স্বাভাবিকতা ও প্রাঞ্জলতা অর্জন করেছিলো সত্য, কিন্তু এ গদ্যও কোন বিশিষ্ট শিল্পগুণসম্পন্ন ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে, বাংলা গদ্য উদ্ভবের প্রথম চার দশকে যে ধরনের গদ্য রচিত হয়েছে তা যেমন ঐশ্বর্য পরিমন্ডিত ছিলো না, তেমনি এর রীতিগত ভিত্তিভূমিও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা লিখুন
১. বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত গদ্যই পরবর্তীকালের বাংলা ভাষার বহুমুখী বিকাশের রীতিগত ভিত্তিভূমি ।
২. পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার মত বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশ পরীক্ষা করলেও যে সত্যটি উপলব্ধি করা যায় তা হল এই যে, ভাষা পরিবর্তনশীল এবং বৈচিত্র্যের অনুসন্ধানী।
৩. দেড়শত বছরের বাংলা গদ্যের বিচিত্র ঐশ্বর্যে এই ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণরূপে শোষণ করে নিয়েই প্রতিভাবান পূর্ব পাকিস্তানী সাহিত্যকর্মী আজ বাংলা ভাষার প্রকাশ-ক্ষমতার নব নব দিগন্ত উন্মোচনে ব্যাপৃত।
২ নং ব্যাখ্যার নমুনা-উত্তর
বক্ষ্যমান অংশটুকু মুনীর চৌধুরী রচিত ‘বাংলা গদ্যরীতি’ শিরোনামের প্রবন্ধ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে প্রবন্ধকার বাংলা গদ্য আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলা ভাষার বিকাশধারায় এর পরিবর্তনশীলতা ও বৈচিত্র্যময়তার কথা বলেছেন। পৃথিবীর সব ভাষাই নানা রকমের পরিবর্তনশীলতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যদিয়ে অগ্রসরমান। বাংলা ভাষাও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলোর একটি। এই ভাষাতেও পরিবর্তন অনিবার্য।
বাংলা গদ্যের দিকে লক্ষ্য করলে যে সত্যটি অনুধাবন হয় তাহলো, উনিশ শতকের প্রারম্ভে এর সাহিত্যিক সূচনার পর নানাভাবে এখানে পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য এসেছে। উনিশ শতকের প্রথম চার দশকে এই বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষ্যযোগ্য হয়ে না উঠলেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭) গ্রন্থ প্রকাশের পর থেকে তা স্পষ্টতর হয়ে উঠতে থাকে।
পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, মুজতবা আলী প্রমুখের হাতে বাংলা গদ্য আরও বিকশিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, ক্রমবিকাশের সঙ্গে এর পরিবর্তনশীলতা ও বৈচিত্র্যের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বাংলা ভাষাও এ থেকে মুক্ত নয়।
আরও দেখুন :