আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলা গদ্যরীতি ২
বাংলা গদ্যরীতি ২
বাংলা গদ্যরীতি ২
মূলপাঠ
পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা গদ্যের রূপায়ণ ও অনুশীলনের বর্ণনাকে দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একদিকে রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানী গদ্যের আদর্শ স্বরূপ সম্পর্কে নানাবিধ সোপারেশ, ভবিষ্যদ্বাণী ও তত্ত্বালোচনা; অন্যদিকে হল সৃষ্টির ক্ষেত্রে সাহিত্যিকদের বিভিন্নমুখী প্রয়াসের প্রত্যক্ষ ফসল। আমরা প্রথমে পন্ডিত সংস্কারক-গবেষকদের চিন্তা ও বাসনার শ্রেণী প্রকৃতি বিশেষণ করতে চেষ্টা করব, পরে প্রকৃত সাহিত্যকর্মে যে ভাষাদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে তার বৈশিষ্ট্য নির্দেশে উদ্যোগী হব ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ভূতপূর্ব অধ্যাপক এবং আমার শিক্ষক পরলোকগত মোহিতলাল মজুমদার তৎকালীন বাংলা ভাষার গতি পরিবর্তনের চিহ্নসমূহ লক্ষ্য করে একটি সরস মন্তব্য করেন ‘ভাষার আদর্শ ক্ষুণ্ন করার প্রয়োজন দুই কারণে হইতে পারে – প্রথম, ভাষার আদর্শ সম্বন্ধে অজ্ঞতা,
বিশুদ্ধ বাক্যরচনার অক্ষমতা; দ্বিতীয়, ভাষাকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিয়াও লেখকের নিজের খেয়াল-খুশী চরিতার্থ করিবার আগ্রহ… কিন্তু অজ্ঞতা ও অক্ষমতার প্রমাণ এতই স্পষ্ট যে, দ্বিতীয় কারণটির উল্লেখ বা আলোচনা অনাবশ্যক মনে হইতে পারে।’
দুঃখজনক হলেও স্বীকার না করে উপায় নেই যে পূর্ব পাকিস্তানী গদ্যের উৎসাহী সংস্কারকদের অনেকেই প্রথমোক্ত দলের। দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহারের ফলে বাংলা গদ্যরীতির যে-সকল আদর্শ সাহিত্যিক মর্যাদায় ভূষিত, বানান ও উচ্চারণের যে- সকল নিয়ম শিষ্ট ও শুদ্ধ বলে সম্মানিত, এঁরা অনেকেই সেগুলো শ্রম ও সাধনারদ্বারা আয়ত্ত করার সুযোগ-সুবিধা বা উৎসাহ-অনুপ্রেরণা লাভ করেননি।
ফলে এই শ্রেণীর ভাষা-বিপবীগণ যে পর্যায়ের সংস্কারের ফরমান জারী করেন তা বাংলা ভাষার মূলগত বুনিয়াদের সচেতনতা থেকে উদ্ভূত নয়। নিজেদের ব্যক্তিগত অনভ্যাস বা অপারগতাকে মাত্রাতিরিক্ত রকম আদর্শায়িত করে স্বকপোলকল্পিত তামাদ্দুনিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা বা জনকল্যাণ সাধনের মহৎ অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। প্রচলিত বর্ণমালা এদের চক্ষুশূল; এরাই বানানে ণত্বষত্ব-বিধি নস্যাৎ করতে চান এবং পদগঠনে অভিনব নিয়ম প্রবর্তনে উদ্যোগী হন।
বাংলা গ্রন্থ বিক্রয়ের বাজার যত সম্প্রসারিত হচ্ছে এঁদের তৎপরতাও সেই পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভাষা বিজ্ঞানী ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র কোনো কোনো মত আপাত দৃষ্টিতে উপরোক্ত মন্ত্রণার পরিপোষকতা করে বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। ভাষার চূড়ান্ত সরলীকরণের ফলে গণশিক্ষা ত্বরান্বিত হবে এই প্রত্যাশাই তাঁর সংস্কারমূলক প্রয়াসের অনুপ্রেরণা স্বরূপ।
তাঁর প্রস্তাবিত সরলায়িত বুনিয়াদী বাংলা প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের সীমায়িত এলাকায় বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহৃত হলে সুফল লাভের সম্ভাবনা আছে বলে আমরাও স্বীকার করি। দ্বিতীয় এক পক্ষ আছেন যাঁদের উপাস্য আদর্শ পূর্ববঙ্গীয় আঞ্চলিক বুলি। চলিত বাংলার শিষ্ট রূপকে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গীয় অর্থাৎ বিজাতীয় বলে মনে করেন। শব্দ চয়নে, ক্রিয়াপদের রূপায়ণে, বাক্যাংশের নির্মাণে তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক উপভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চান।
এই তত্ত্বের প্রধান প্রচারকগণের অধিকাংশই পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের প্রতিপত্তিশালী নাগরিক। যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-পাবনা-রাজশাহী-বগুড়ার উত্তর-দেশীয় আঞ্চলিক বুলি যে চলিত বাংলার শিষ্ট রূপের নিকট-আত্মীয় এ সত্যকে তাঁরা অগ্রাহ্য করতে বদ্ধপরিকর। তাঁরা একথাও অস্বীকার করতে চান যে সমার্থক শব্দ মাত্রেই সম-ভাবনার অনুষঙ্গী নয়। প্রতি শব্দের স্বতন্ত্র অর্থ আছে, সেই অর্থের স্বতন্ত্র ভাবানুষঙ্গও তার অন্তরে নিহিত থাকে।
সাহিত্যে তার দীর্ঘকালীন পৌনঃপুনিক প্রয়োগই সেই অনুষঙ্গের পরিমন্ডল গড়ে তোলে। খেয়াল-খুশী মতো তার আবেদনের ভোল পাল্টানো যায় না। ‘ডর সান্ধাইয়াছে’ এই বাক্যাংশ কোনক্রমেই ‘আতঙ্ক সঞ্চারের’ সমভাবনাত্মক বলে বিবেচিত হতে পারে না। নিরক্ষর কৃষকের শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার অর্থ এই নয় যে তাঁর মুখের বুলিকেও মার্জিত ও সাহিত্যিক গুণ-সম্পন্ন বলে সর্বত্র গ্রহণ করব।
গণ-সাহিত্য সৃষ্টির অর্থ জনগণের জীবন সমস্যাকে সাহিত্যিক রূপদান করা, তার জীবনসংগ্রামকে জয়যুক্ত করার পথনির্দেশ দান করা, তার চিত্রকর্ষের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে জাগরিত করে তোলা। আঞ্চলিক বুলির মহিমা কীর্তনের সঙ্গে এই শিল্পগত মহৎ প্রয়াসের কোনো আত্যন্তিক যোগাযোগ নেই। যাঁরা আঞ্চলিক উপভাষাকেই প্রকৃত মাতৃভাষা বলে অভিহিত করতে চান তাঁদের মাতৃভক্তি যথার্থ স্থলে নিবেদিত হয় না।
কারণ মাতৃভূমির প্রকৃত অর্থ যেমন মামার বাড়ী নয় তেমনি মাতৃভাষা বলতেও আক্ষরিক অর্থে মায়ের বুলি বা গাঁয়ের বুলিকে বোঝায় না। মাতৃভূমি স্বদেশের প্রতিশব্দ, মাতৃষাভার অর্থ স্বদেশের ভাষা।
তৃতীয় এক পক্ষ রয়েছেন যাঁরা ভাষার ধর্মীয় প্রকৃতিতে আস্থাবান। তাঁদের মতে বাংলা ভাষার মূলগত প্রকাশরীতি বহুলাংশে হিন্দু-চিন্তাধারার বাহক ও ধারক। সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলা ভাষার দীর্ঘকালীন ঘনিষ্ঠতা তাঁদের নিকট পরম অনুশোচনার বিষয়। তাঁদের বিবেচনায় বাংলা ভাষার সঙ্গে আরবী-ফারসীর সংযোগই একমাত্র সত্য, বাদবাকী সবই কৃত্রিম উপায়ে আরোপিত, মিথ্যা এবং পরিত্যাজ্য।
তাঁরা আশঙ্কা করেন যে বাংলা ভাষার কাঠামো থেকে সংস্কৃতের যাবতীয় প্রভাব চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে না পারলে এই ভাষা আমাদের তামাদ্দুনিক বৈশিষ্ট্যের বাহনে পরিণত হতে পারবে না। অনেক সময় মনে হয় যেন, বাংলা কেন ষোল আনা আরবী, ফারসী বা উর্দু হয়ে উঠল না, বাংলাই রয়ে গেল, আক্ষেপটা সেই জন্যই ।
আমার বর্তমান প্রয়োজন ও ইচ্ছানুযায়ী অতীতের ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম, সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও ভাষার বিবর্তন সংগঠিত হয়নি কেন সে জন্য উত্তেজনা প্রকাশ করা নিরর্থক। বাংলা ভাষাকে যে রূপে লাভ করেছি সেটাই বাংলা ভাষা । তার গঠনপ্রকৃতির মজ্জাগত বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে নীতিমূলক বিচারে প্রবৃত্ত হওয়া আমাদের দায়িত্ব বহির্ভূত।
আমাদের মতে, পূর্ব পাকিস্তানী বাংলা ভাষায় হিন্দু-মুসলমান দৈনন্দিন জীবনে যে-সকল আরবী ফারসী শব্দ ব্যবহার করে অভ্যস্ত, বাংলা ভাষা থেকে সেগুলো নির্বিচারে পরিহার করবার জন্য যিনি পরামর্শ দেন তিনি হয় অজ্ঞানী নয় বিকারগ্রস্ত। তৎসম ও তদ্ভব শব্দই যে বাংলা শব্দ-ভান্ডারের বৃহত্তম অংশ, বহুস্থলে সংস্কৃত থেকে ঋণ গ্রহণ করা যে বাংলা ভাষার পদগঠন রীতি অনুযায়ী অধিক সংগত ও স্বাভাবিক- এ সকল কথা যিনি অস্বীকার করেন তিনিও তাই।
আমাদের সৌভাগ্যবশত: পূর্ব পাকিস্তানী প্রবন্ধকার, নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা আধুনিক চিন্তাধারার শিল্পকলার অনুশীলনকারী, সমকালীন পূর্ব পাকিস্তানী জীবনের যথার্থ রূপকার, বিদগ্ধ এবং মননশীল তাঁরা কেউ পূর্ব বর্ণিত অর্থে ভাষা-সংস্কারক নন। তাঁরা শিল্পী। অদ্যাবধি বাংলা ভাষায় রূপ ও রসে মূল্যবান যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে সবই তাঁদের শিল্পচেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাদের সাহিত্যিক ঐতিহ্যবোধের বুনিয়াদ।
সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছ তাদের বিশিষ্ট পূর্ব পাকিস্তানী জীবনোৎকণ্ঠা, যুক্ত হয়েছে পাশ্চাত্য সাহিত্যরসের আস্বাদন শক্তি। উপভাষিক শব্দ, আরবী-ফারসী শব্দ, তৎসম শব্দ, সমাসবদ্ধ পদ, জটিল বাক্য – কোনো কিছুই তাদের কাছে আত্যন্তিকভাবে ঘৃণ্য বা পূজ্য নয়। নির্বাচিত জীবনাংশের মর্মবাণী উন্মোচনের জন্য স্বকীয় জীবনোপলব্ধির স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেক কথাশিল্পীই ভাষায় নানারকম কারিগরী প্রদর্শন করেন। এক অর্থে,
সরল ও সাধু ব্যক্তিগণ যে ভাষা প্রত্যহ ব্যবহার করে সন্তুষ্ট শিল্পীর প্রাথমিক দায়িত্ব হল সেই অভ্যাসের দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করা। এই প্রয়োজনে কেউ আঞ্চলিক বুলি সেঁচে, কেউ অভিধান ঘেঁটে, কেউ আরবী ফারসী ছুঁড়ে সেই শব্দটি বার করেন যা অমোঘরূপে বর্ণনীয় বিষয়ের বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক, বাক্যগঠনে এমন স্বকীয় ভংগী আরোপ করেন যার নতুনত্ব অমনোযোগী পাঠককেও সচকিত করে তোলে।
আমাদের আধুনিক লেখকগণ গ্রামজীবনের কাহিনীতে অনেক গ্রামের কথা ব্যবহার করেন। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ নোয়াখালীর, শামসুদ্দীন আবুল কালাম বরিশালের, শাহেদ আলী সিলেটের, আবু ইসহাক বিক্রমপুরের, আলাউদ্দিন আল আজাদ চট্টগ্রামের এবং হাসান আজিজুল হক কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষা বা ডায়ালেক্ট প্রচুর পরিমাণে তাঁদের রচনায় গ্রহণ করেছেন। তবে অধিকাংশ স্থলেই পূর্ববঙ্গীয় উপভাষা কেবল সংলাপে বাস্তবতা সম্পাদনের জন্য গৃহীত হয়।
এই রীতি বাংলা ভাষায় শতবর্ষ পুরাতন। তবে এর মধ্যে যা নতুন তা হল এই যে কেউ কেউ, অজ্ঞতা বা স্বভাববশত: নয়, স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে, কেবল সংলাপে নয় কাহিনী বর্ণনার কালেও স্থলবিশেষে পূর্বাঞ্চলিক শব্দ বা শব্দসমষ্টি বা বাকভংগী চমৎকার বিশিষ্টার্থে প্রয়োগ করেছেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪) ও ‘দুই তীর’ (১৯৬৫), আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘কর্ণফুলী’ (১৯৬০) ও ‘ক্ষুধা ও আশা’ (১৯৬৪), শাহেদ আলীর ‘একই সমতলে’ (১৯৬৩) এবং শহীদুল্লা কায়সারের ‘সারেং বৌ’ (১৯৬৩) গ্রন্থাদিতে আমাদের গদ্যরীতির এই প্রবণতার উৎকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যাবে।
শব্দার্থ ও টীকা
পূর্ব পাকিস্তানী গদ্য – পূর্ব পাকিস্তানের লেখকদেরমারা রচিত, সৃষ্ট ও অনুশীলিত গদ্য । সংস্কার-গবেষক • যে তত্ত্বানুসন্ধানী একই সঙ্গে সংস্কারকও
মোহিতলাল মজুমদার – বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্য-সমালোচক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই তাঁর কাব্য আপন বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
এই শ্রেণীর ভাষা-বিপবীগণ — ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা সংস্কারের কথা বলে একদল অতিউৎসাহী শিক্ষিত মানুষ বাংলা ভাষার কাঠামোগত পরিবর্তন চান। মুনীর চৌধুরীর মতে, বাংলা ভাষার সাহিত্যিক মর্যাদা, বানান ও উচ্চারণের শুদ্ধ ও শিষ্ট নিয়ম যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক ও সুসংবদ্ধ। শ্রম ও সাধনার দ্বারা এ সব আয়ত্ত করতে হয়। যারা ভাষার কাঠামোগত পরিবর্তনের কথা বলছেন তারা, তাঁর মতে, ওই সব নিয়ম আয়ত্ত করেননি। এদেরকেই মুনীর চৌধুরী ব্যঙ্গ করে ‘ভাষা-বিপবী’ বলে অভিহিত করেছেন।
বস্তুসংক্ষেপ
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা গদ্যের রূপায়ণ ও অনুশীলনের বর্ণনাকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমত পূর্ব পাকিস্তানী গদ্যের আদর্শ সম্পর্কে সুপারিশ, ভবিষ্যদ্বাণী ও তত্ত্বালোচনা; দ্বিতীয়ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে সাহিত্যিকদের বিভিন্নমুখী প্রয়াসের প্রত্যক্ষ ফসল। পূর্ব পাকিস্তানে উৎসাহী যে সংস্কারকগণ বাংলা গদ্য সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তারা অনেকেই ভাষার আদর্শ সম্পর্কে অজ্ঞ ও বিশুদ্ধ বাক্য রচনায় অক্ষম।
তারা যে প্রস্তাব করেন তা বাংলা ভাষার মূলগত বুনিয়াদ থেকে উদ্ভূত নয়। নিজের মনগড়া ধর্মীয় সংস্কৃতির নামে বর্ণমালার পরিবর্তন ও পদগঠনে অভিনব নিয়ম প্রবর্তনের আগ্রহী এখানে প্রকাশিত। আরবী-ফারসী শব্দের বলপ্রয়োগপূর্বক ব্যবহারের পক্ষপাতী তারা। ভাষা-বিজ্ঞানী ডক্টর শহীদুলাহ্র ভাষা-বিষয়ক কোন কোন বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে এই সংস্কারবাদীদের মতের পৃষ্ঠপোষকতা করে বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়।
শহীদুল্লাহ্র প্রস্তাবে গণশিক্ষা ত্বরান্বিত ও প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপকতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। এক পক্ষ আছেন, যারা চলতি বাংলার শিষ্ট রূপকে বিজাতীয় মনে করেন। তারা চান ভাষায় শব্দ চয়নে, ক্রিয়াপদের রূপায়ণে, বাক্যাংশের নির্মাণে পূর্ব-পাকিস্তানের আঞ্চলিক উপভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হোক। এদের অধিকাংশই পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রতিপত্তিশালী নাগরিক।
অথচ তারা জানেন না যে, নিরক্ষর কৃষকের শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার অর্থ তার মুখের বুলিকে মার্জিত ও সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন বলে গ্রহণ করা যায় না। গণসাহিত্য পৃথক জিনিস এখানে থাকবে জনজীবনের সমস্যার সাহিত্যিক রূপায়ণ এবং জীবনসংগ্রামে জয়ী হতে জনসাধারণের প্রতি দিক নির্দেশনা। এই কাজ উপভাষা নয়, মাতৃভাষাতেই যথাযথভাবে সমাধান করা সম্ভব।
আর এক পক্ষে কতিপয় ব্যক্তি আছেন, যারা কোনভাবেই মেনে নিতে চান না সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা। তারা মনে করেন এ সম্পর্ক বুঝি বাংলা ভাষায় হিন্দু চিন্তাভাবনার অনুপ্রবেশ। বাংলা ভাষার সব শব্দই কেন আরবী বা ফারসী হয়ে উঠলো না এ বিষয়ে তাদের আক্ষেপ যথেষ্ট। ভাষার অতীত ইতিহাসকে অস্বীকার করা হীনবুদ্ধির পরিচায়ক। বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার বিকাশ।
এতে একীভূত আরবী-ফারসী শব্দ নির্বিচারে পরিহার করার পরামর্শ প্রদানও যেমন সঠিক নয়, তেমনি বাংলা শব্দ-ভাণ্ডারের বৃহত্তম অংশ সংস্কৃত ও সংস্কৃতজাত শব্দও পরিত্যাগ করা যাবে না। যারা এ সব বর্জনের পক্ষপাতী তারা হয় অজ্ঞানী, নয় বিকারগ্রস্ত। এ অবস্থার মধ্যে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আধুনিক চিন্তাধারার ধারক ও বাহক এবং সমকালীন জীবনের যথার্থ রূপকার হিসেবে কয়েকজন বলিষ্ঠ প্রবন্ধকার, নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক আবির্ভূত হয়েছেন।
তাদের কাছে শিল্পচেতনা, সাহিত্যিক ঐতিহ্যবোধ বড় বলে নিজেদের সৃষ্টিতে তুলে আনছেন স্বদেশী জীবনোৎকণ্ঠা, কিন্তু সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন পাশ্চাত্য সাহিত্যরস। সংস্কৃত বা আরবী-ফারসী অথবা উপভাষিক শব্দ তাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য নয়। মানব জীবনের মর্মবাণী উন্মোচনে, নিজের জীবনোপলব্ধির স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণে তারা যে কোন শব্দবিন্যাসে সাহিত্যিক কুশলতা প্রকাশ করতে বদ্ধ পরিকর।
এ কারণে তারা শ্রমনিষ্ঠ হন এবং তাদের আহৃত শব্দ বা সাহিত্যিক কুশল বিন্যাসে অমনোযোগী পাঠকও সচকিত হন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আবু ইসহাক, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে তাঁদের রচনায় গ্রামজীবনের কাহিনী ফুটিয়ে তুলেছেন। এতে তাঁরা পাত্রপাত্রীর সংলাপে বাংলা ভাষার পুরাতন রীতি অনুসারে পূর্ববঙ্গীয় উপভাষা ব্যবহার করেন।
অনেকে অবশ্য স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবেই সংলাপের পাশাপাশি কাহিনী বর্ণনাতেও স্থলবিশেষে পূর্বাঞ্চলিক শব্দ বা বাকভঙ্গি ব্যবহারের পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। অজ্ঞতা নয়, সৃষ্টিধর্মী প্রতিভার সঙ্গে মননশীল বিশ্বনাগরিকতার সমন্বয়ে গঠিত তাঁদের এই আধুনিক শিল্পী-মন। পূর্ব পাকিস্তানী গদ্যে বহুল পরিমাণে আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহারের রীতির আবিষ্কারক রামরাম বসু এবং এর সরসতার দিক উন্মোচনকারী টেকচাঁদ ঠাকুর।
পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিদ্রূপাত্মক রচনায় এবং পূর্বপাকিস্তানে আবুল মনসুর আহমদ, হাবীবুল্লাহ বাহার, শওকত ওসমান প্রমুখের রচনায় এই রীতির ব্যবহার দেখা যায়। তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে তরুণ লেখকগণ গদ্যরচনার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী লেখকদের চেয়ে যথেষ্ট স্বাতন্ত্র্যাভিলাষী ছিলেন। বিশ্বনাগরিকতাপ্রাপ্ত এ সব লেখকগণ স্বভাবে অনাস্থাবাদী। দেশভক্তি, ধর্মভীতি ও নীতিপরায়ণতার নামে অমানবিকতার এরা বিরোধী।
মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদতা আর লোকসংস্কৃতির নামে স্কুল সরলতা বর্জনীয় এদের কাছে। অনভ্যস্ত ও অনাধুনিক পাঠকেরা এদের ভাষা বুঝতে পারেন না। অভিধান মন্থন করে শব্দ আহরণ, ব্যাকরণের কঠিন নিয়মে পদ সংগঠন, জটিল দীর্ঘসূত্রতায় বাক্য গঠন করে এরা আত্মস্বাতন্ত্র্যমন্ডিত দুরূহ এক কলারীতির সূত্রপাত করেছেন। ‘কণ্ঠস্বর’ সাহিত্যপত্রিকাকে ঘিরে যে গোষ্ঠী গড়ে ওঠেছে তাঁরা এই ধারাকে ব্যাপকতম পরিণতির দিকে নিয়ে চলেছেন।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্নের উত্তর লিখুন
১. ভাষার মাধ্যমে যারা স্বকপোলকল্পিত তামাদ্দুনিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাদের প্রকৃত ধারণা কি ?
২. আঞ্চলিক বুলির মহিমা কীর্তনের সঙ্গে সাহিত্য-শিল্পগত মহৎ প্রয়াসের আত্যন্তিক যোগাযোগ নেই- – কেন?
৩. বাংলা ভাষা থেকে যারা সংস্কৃত শব্দসমূহ বা বহুল ব্যবহৃত আরবি ফারসি শব্দাবলী বর্জন করার কথা বলে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি ?
৪. পূর্ব পাকিস্তানে যারা শিল্পী-মানসিকতা নিয়ে সাহিত্যচর্চা করেছেন তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য কি ?
৫. আত্মস্বাতন্ত্র্যমন্ডিত দুরূহ কলারীতির মাধ্যমে যে গদ্য চর্চা শুরু হয় এর অগ্রদূত কারা ?
২ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর:
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষা সংস্কারের কথা যারা বলছিলেন তাদের একটি গোষ্ঠী চলতি বাংলার শিষ্ট রূপকে পশ্চিমবঙ্গীয়, তাই বিজাতীয় আখ্যা দিয়ে পরিত্যাজ্য মনে করেন। তারা পূর্বপাকিস্তানী বাংলা গদ্যে পূর্বাঞ্চলিক মৌখিক বুলির যথেচ্ছ প্রয়োগের পক্ষে।
কিন্তু তারা হয়তো জানেন না যে, নিরক্ষর মানুষের আঞ্চলিক বুলির যথেচ্ছ ব্যবহারই যেমন শুধু গণসাহিত্য নয়, তেমনি এতে সাহিত্যিক গুণও ক্ষুণ্ন হতে বাধ্য। সাহিত্যিক গুণ ক্ষুণ্ণ হলে মহৎসৃষ্টি হয় না। আঞ্চলিক বুলির মহিমা কীর্তনে আবেগ থাকতে পারে। কিন্তু শিল্প সৃষ্টির জন্যে দরকার সাহিত্যিক মানসম্পন্নতা ।
প্রসঙ্গ উলেখ করে ব্যাখ্যা লিখুন
১ . বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত গদ্যই পরবর্তীকালের বাংলা ভাষার বহুমুখী বিকাশের রীতিগত ভিত্তিভূমি ।
২. পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার মত বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশ পরীক্ষা করলেও যে সত্যটি উপলব্ধি করা যায় তা হল এই যে, ভাষা পরিবর্তনশীল এবং বৈচিত্র্যের অনুসন্ধানী।
৩. দেড়শত বছরের বাংলা গদ্যের বিচিত্র ঐশ্বর্যে এই ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণরূপে শোষণ করে নিয়েই প্রতিভাবান পূর্ব পাকিস্তানী সাহিত্যকর্মী আজ বাংলা ভাষার প্রকাশ-ক্ষমতার নব নব দিগন্ত উন্মোচনে ব্যাপৃত।
৪ নং ব্যাখ্যার নমুনা-উত্তর:
ব্যাখ্যেয় অংশটুকু প্রখ্যাত নাট্যকার ও প্রবন্ধকার মুনীর চৌধুরী রচিত ‘বাংলা গদ্যরীতি’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলা ভাষা সংস্কারের প্রশ্নে যারা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাকে অন্যভাষায় পরিণত করার পক্ষে ছিলেন তাদের কটাক্ষ করা হয়েছে এই পঙক্তির মাধ্যমে। বাংলা ভাষার সরলীকরণের নামে পূর্বপাকিস্তানে ভাষা-সংস্কারের যে উদ্যোগ গৃহীত হয় তাতে একদল পণ্ডিত মত দেন যে, চলিত বাংলার শিষ্টরূপ পশ্চিমবঙ্গীয় তথা বিজাতীয়।
তাই পূর্বাঞ্চলের কথ্যভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা দরকার। অন্য একদল পন্ডিত অভিমত প্রদান করেন যে, বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের আধিক্য, পদবিন্যাস রীতি ও বাক্যগঠন প্রক্রিয়া হিন্দু চিন্তাধারার বাহক ও ধারক। তাই বাংলা ভাষা থেকে এসব বর্জন করে নির্বিচারে আরবি-ফারসি শব্দের আমদানি জরুরি। এভাবেই পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামি তামাদ্দুনিক সৃষ্টির পথ সহজ হবে।
তাদের এই অভিমত বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশের বিরোধী। তারা সম্ভবত বাংলা ভাষার সাংগঠনিক দিকটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। মুনীর চৌধুরী তাদের কটাক্ষ করেই ব্যাখ্যেয় বাক্যটি লিখেছেন।
রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর লিখুন
১. ‘বাংলা গদ্যরীতি’ প্রবন্ধের বস্তুসংক্ষেপ লিখুন।
২. বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশের ধারা ‘বাংলা গদ্যরীতি’ প্রবন্ধের আলোকে বিবৃত করুন ।
৩. তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রবন্ধকার, নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিকগণকে প্রকৃত অর্থে শিল্পী বলা হয়েছে কেন? বিস্তারিত লিখুন ।
৪. ‘আধুনিক শিল্পীদের মানবপ্রকৃতি সৃষ্টিধর্মী প্রতিভার সঙ্গে মননশীল নাগরিকতার সমন্বয়ে গঠিত।’ “বাংলা- গদ্যরীতি’ প্রবন্ধের আলোকে বিস্তারিত লিখুন।
৫. বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশের ধারা আলোচনা করে মুনীর চৌধুরী তাঁর কালের সাম্প্রতিক বাংলা গদ্যের রীতিগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যে আলোকপাত করেছেন তার পরিচয় দিন ।
আরও দেখুন :