আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় বাঙ্গালা ভাষা ১
বাঙ্গালা ভাষা ১
বাঙ্গালা ভাষা ১
ভূমিকা
বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। উপন্যাস রচনার পাশাপাশি সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও তাঁর মননশীলতার পরিচয় সুস্পষ্ট। বিশেষত প্রবন্ধ রচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সমকালে যে চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, বিষয়বস্তু বিচারে তা উলেখের দাবি রাখে। উনিশ শতকের বাংলা গদ্য গড়ে ওঠার সময় তাঁর প্রবন্ধ-রচনাশৈলীও এক বিশেষ গদ্যভঙ্গির প্রতিনিধি হিসেবে সমাদৃত হয়।
লেখক পরিচিতি
‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধের লেখক বঙ্গিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার নৈহাটি থানার কাঁঠালপাড়া গ্রামে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। পিতার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর হুগলী কলেজের বিদ্যালয় বিভাগে প্রথম ভর্তি হন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর গ্র্যাজুয়েট হন দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে। ওই বছরই যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর নিযুক্ত হন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ললিতা তথা মানস’ নামক কাব্য প্রকাশিত হয়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ তাঁর রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাস; বের হয় ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে।
‘সীতারাম’ (১৮৮৮) তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস। ১৮৭২ থেকে ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ‘বঙ্গদর্শন’ নামক একটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। সার্থক উপন্যাস রচনাই শুধু নয়, বাংলা ভাষায় প্রথম তুলনামূলক সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধও তিনি রচনা করেন। তাঁর হাতে বাংলা গদ্যরীতি বিশিষ্টতা অর্জন করে। বিদ্যাসাগরের সংস্কৃতানুসারী ভাষা ও প্যারীচাঁদ মিত্রের কথ্য বাক্-ভঙ্গি নতুনভাবে বিন্যস্ত করে তিনি একটি নিজস্ব গদ্যরীতি প্রবর্তন করেন।
‘বঙ্গদর্শনে’র মতো একটি উচ্চাঙ্গের সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করেও তিনি বাংলা গদ্যের শ্রীবৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখেন। নিজেও প্রবন্ধের বিষয় ও আঙ্গিকে বৈচিত্র্য আনয়ন করেন। লঘু কৌতুক, হাস্যরস, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, মননশীলতা, গাম্ভীর্য, আবেগ ইত্যাদির সংমিশ্রণে তাঁর প্রবন্ধ বিশিষ্ট হয়ে ওঠে।
পাঠ-পরিচিতি
‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “বিবিধ প্রবন্ধ’ নামক প্রবন্ধ-গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রবন্ধ ১২৮৫ বঙ্গাব্দের ‘বঙ্গদর্শন’ সাময়িক পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি লেখকের একটি চিন্তামূলক প্রবন্ধ । চিন্তাটি মূলত বাংলা ভাষা ও তার লেখ্যরীতি সম্পর্কিত। এই প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা গদ্যরীতির উৎকর্ষ বিষয়ক নিজস্ব সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন।
এ প্রসঙ্গে তাঁর সমকালীন উল্লেখযোগ্য গদ্য রচয়িতাদের ভাষারীতি বিশেষণ করা হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং প্যারীচাঁদ-কালীপ্রসন্নর ভাষারীতিই ওই সময় বাংলা গদ্যচর্চায় ব্যবহৃত হত। বঙ্কিমচন্দ্র এঁদের চর্চিত ভাষারীতিকে শাণিত বুদ্ধি ও আধুনিক চিন্তার আলোকে বিশেষণ করেছেন।
একই সঙ্গে যৌক্তিক যুক্তির পারম্পর্যে এই উভয় মতের সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলা গদ্যরীতি সম্পর্কে নিজস্ব বক্তব্য প্রদান করেন বলে প্রবন্ধটির নামকরণ করা হয় ‘বাঙ্গালা ভাষা’। নামকরণটি নিঃসন্দেহে যথাযথ হয়েছে।
মূলপাঠ
প্রায় সকল দেশেই লিখিত ভাষা এবং কথিত ভাষায় অনেক প্রভেদ। যে সকল বাঙ্গালী ইংরেজি সাহিত্যে পারদর্শী, তাঁহারা একজন লন্ডনী কী বা একজন কৃষকের কথা সহজে বুঝিতে পারেন না, এবং এতদ্দেশে অনেকদিন বাস করিয়া বাঙ্গালীর সহিত কথাবার্তা কহিতে কহিতে যে ইংরেজেরা বাঙ্গালা শিখিয়াছেন, তাহারা প্রায় একখানিও বাঙ্গালাগ্রন্থ বুঝিতে পারেন না।
প্রাচীন ভারতেও সংস্কৃত ও প্রাকৃতে, আদৌ বোধ হয়, এইরূপ প্রভেদ ছিল, এবং সেই প্রভেদ হইতে আধুনিক ভারতবর্ষীয় ভাষাসকলের উৎপত্তি। বাঙ্গালার লিখিত এবং কথিত ভাষায় যতটা প্রভেদ দেখা যায়, অন্যত্র তত নহে। বলিতে গেলে, কিছুকাল পূর্বে দুইটি পৃথক্ ভাষা বাঙ্গালায় প্রচলিত ছিল। একটির নাম সাধুভাষা; অপরটির নাম অপর ভাষা। একটি লিখিবার ভাষা, দ্বিতীয়টি কহিবার ভাষা।
পুস্তকে প্রথম ভাষাটি ভিন্ন, দ্বিতীয়টির কোন চিহ্ন পাওয়া যাইত না। সাধুভাষায় অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দসকল বাঙ্গালা ক্রিয়াপদের আদিম রূপের সঙ্গে সংযুক্ত হইত। যে শব্দ আভাঙ্গা সংস্কৃত নহে, সাধুভাষায় প্রবেশ করিবার তাহার কোন অধিকার ছিল না। লোকে বুঝুক বা না বুঝুক, আভাঙ্গা সংস্কৃত চাহি। অপর ভাষা সে দিকে না গিয়া, যাহা সকলের বোধগম্য, তাহাই ব্যবহার করে। গদ্য গ্রন্থাদিতে সাধুভাষা ভিন্ন আর কিছু ব্যবহার হইত না।
তখন পুাকপ্রণয়ন সংস্কৃত ব্যবসায়ীদিগের হাতে ছিল। অন্যের বোধ ছিল যে, যে সংস্কৃত না জানে, বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রণয়নে তাহার কোন অধিকার নাই, সে বাঙ্গালা লিখিতে পারেই না। যাঁহারা ইংরেজিতে পন্ডিত, তাহারা বাঙ্গালা লিখিতে পড়িতে না জানা গৌরবের মধ্যে গণ্য করিতেন। সুতরাং বাঙ্গালায় রচনা ফোঁটা-কাটা অনুস্বারবাদীদিগের একচেটিয়া মহল ছিল। সংস্কৃতেই তাহাদিগের গৌরব।
তাঁহারা ভাবিতেন, সংস্কৃতেই তবে বুঝি বাঙ্গালা ভাষার গৌরব; যেমন গ্রাম্য বাঙ্গালী স্ত্রীলোক মনে করে যে, শোভা বাড়ুক আর না বাড়ুক, ওজনে ভারি সোনা অঙ্গে পরিলেই অলঙ্কার পরার গৌরব হইল, এই গ্রন্থকর্তারা তেমনি জানিতেন, ভাষা সুন্দর হউক বা না হউক, দুর্বোধ্য সংস্কৃতবাহুল্য থাকিলেই রচনার গৌরব হইল। এইরূপ সংস্কৃতপ্রিয়তা এবং সংস্কৃতানুকারিতা হেতু বাঙ্গালা সাহিত্য অত্যন্ত নীরস, শ্রীহীন, দুর্বল, এবং বাঙ্গালা সমাজে অপরিচিত হইয়া রহিল।
টেকচাঁদ ঠাকুর প্রথমে এই বিষবৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করিলেন। তিনি ইংরেজিতে সুশিক্ষিত। ইংরেজিতে প্রচলিত ভাষার মহিমা দেখিয়াছিলেন এবং বুঝিয়াছিলেন। তিনি ভাবিলেন, বাঙ্গালার প্রচলিত ভাষাতেই বা কেন গদ্যগ্রন্থ রচিত হইবে না? যে ভাষায় সকলে কথোপকথন করে, তিনি সেই ভাষায় “আলালের ঘরের দুলাল” প্রণয়ন করিলন। সেই দিন হইতে বাঙ্গালা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি । সেই দিন হইতে শুষ্ক তরুর মূলে জীবন-বারি নিষিক্ত হইল ।
সেই দিন হইতে সাধুভাষা, এবং অপর ভাষা, দুই প্রকার ভাষাতেই বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রণয়ন হইতে লাগিল, ইহা দেখিয়া সংস্কৃতব্যসবায়ীরা জ্বালাতন হইয়া উঠিলেন; অপর ভাষা, তাঁহাদিগের বড় ঘৃণ্য। মদ্য, মুরগী এবং টেকচাঁদি বাঙ্গালা এককালে প্রচলিত হইয়া ভট্টাচার্যগোষ্ঠীকে আকুল করিয়া তুলিল। এক্ষণে বাঙ্গালা ভাষার সমালোচকেরা দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হইয়াছেন। একদল খাঁটি সংস্কৃতবাদী – – যে গ্রন্থে সংস্কৃতমূলক শব্দ ভিন্ন অন্য শব্দ ব্যবহার হয়, তাহা তাঁহাদের বিবেচনায় ঘৃণার যোগ্য।
অপর সম্প্রদায় বলেন, তোমাদের ও কচকচি বাঙ্গালা নহে। ইহা আমরা কোন গ্রন্থে ব্যবহার করিতে দিব না। যে ভাষা বাঙ্গালা সমাজে প্রচলিত, যাহাতে বাঙ্গালার নিত্য কার্য সকল সম্পাদিত হয়, যাহা সকল বাঙ্গালীতে বুঝে, তাহাই বাঙ্গালা ভাষা – তাহাই গ্রন্থাদির ব্যবহারের যোগ্য। অধিকাংশ সুশিক্ষিত ব্যক্তি এক্ষণে এই সম্প্রদায়ভুক্ত। আমরা উভয় সম্প্রদায়ের এক এক মুখপাত্রের উক্তি এই প্রবন্ধে সমালোচিত করিয়া স্থূল বিষয়ের মীমাংসা করিতে চেষ্টা করিব।
সংস্কৃতবাদী সম্প্রদায়ের মুখপাত্রস্বরূপ আমরা রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয়কে গ্রহণ করিতেছি। বিদ্যাসাগর প্রভৃতি মহামহোপাধ্যায় পন্ডিত থাকিতে আমরা ন্যায়রত্ন মহাশয়কে এই সম্প্রদায়ের মুখপাত্রস্বরূপ গ্রহণ করিলাম, ইহাতে সংস্কৃতবাদীগিদের প্রতি কিছু অবিচার হয়, ইহা আমরা স্বীকার করি। ন্যায়রত্ন মহাশয় সংস্কৃতে সুশিক্ষিত, কিন্তু ইংরেজি জানেন না – পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য তাঁহার নিকট পরিচিত নহে।
তাঁহার প্রণীত বাঙ্গালা সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাবে ইংরেজি বিদ্যার একটু পরিচয় দিতে গিয়া ন্যায়রত্ন মহাশয় কিছু লোক হাসাইয়াছেন। আমরা সেই গ্রন্থ হইতে সিদ্ধ করিতেছি যে, পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের অনুশীলনে যে সুফল জন্মে, ন্যায়রত্ন মহাশয় তাহাতে বঞ্চিত। যিনি এই সুফলে বঞ্চিত, বিচার্য বিষয়ে তাঁহার মত তাঁহার নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেই যে অধিক গৌরব প্রাপ্ত হইবে, এমত বোধ হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: যে সকল সংস্কৃতবাদী পন্ডিতদিগের মত অধিকতর আদরণীয়, তাঁহারা কেহই সেই মত স্বপ্রণীত কোন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখেন নাই। সুতরাং তাঁহাদের কাহারও নাম উল্লেখ করিতে আমরা সক্ষম হইলাম না। ন্যায়রত্ন মহাশয় স্বপ্রণীত উক্ত সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাবে আপনার মতগুলি লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন এই জন্যই তাঁহাকে এ সম্প্রদায়ের মুখপাত্রস্বরূপ ধরিতে হইল।
তিনি “আলালের ঘরের দুলাল” হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া লিখিয়াছেন যে, “এক্ষণে জিজ্ঞাস্য এই যে, সর্ববিধ গ্রন্থ রচনায় এইরূপ ভাষা আদর্শস্বরূপ হইতে পারে কিনা?- ? – আমাদের বিবেচনায় কখনই না। আলালের ঘরের দুলাল বল, হুতোমপেঁচা বল, মৃণালিনী বল – পত্নী বা পাঁচজন বয়স্যের সহিত পাঠ করিয়া আমোদ করিতে পারি – কিন্তু পিতাপুত্রে একত্র বসিয়া অসঙ্কুচিতমুখে কখনই ও সকল পড়িতে পারি না।
বর্ণনীয় বিষয়ের লজ্জাজনকতা উহা পড়িতে না পারিবার কারণ নহে, ঐ ভাষারই কেমন একরূপ ভঙ্গী আছে, যাহা গুরুজনসমক্ষে উচ্চারণ করিতে লজ্জাবোধ হয়। পাঠকগণ! যদি আপনাদের উপর বিদ্যালয়ের পুত্ত্বক নির্বাচনের ভার হয়, আপনারা আলালী ভাষায় লিখিত কোন পুাককে পাঠ্যরূপে নির্দেশ করিতে পারিবেন কি? – — বোধ হয়, পারিবেন না।
কেন পারিবেন না? – ইহার উত্তরে অবশ্য এই কথা বলিবেন যে ওরূপ ভাষা বিশেষ শিক্ষাপ্রদ নয়, এবং উহা সর্বসমক্ষে পাঠ করিতে লজ্জাবোধ হয়। অতএব বলিতে হইবে যে, আলালী ভাষা সম্প্রদায়বিশেষের বিশেষ মনোরঞ্জিকা হইলেও, উহা সর্ববিধ পাঠকের পক্ষে উপযুক্ত নহে। যদি তাহা না হইল, তবে আবার জিজ্ঞাস্য হইতেছে যে, ঐরূপ ভাষায় গ্রন্থরচনা করা উচিত কিনা? আমাদের বোধে অবশ্য উচিত।
যেমন ফলারে বসিয়া অনবরত মিঠাই এন্ডা খাইলে জিহ্বা একরূপ বিকৃত হইয়া যায় – মধ্যে মধ্যে আদার কুচি ও কুমড়ার খাট্টা মুখে না দিলে সে বিকৃতির নিবারণ হয় না, সেইরূপ কেবল বিদ্যাসাগরী রচনা শ্রবণে কর্ণের যে একরূপ ভাব জন্মে, তাহার পরিবর্তন করণার্থ মধ্যে মধ্যে অপরবিধ রচনা শ্রবণ করা পাঠকদিগের আবশ্যক। ”
শব্দার্থ ও টীকা
লন্ডনী কক্নী — লন্ডনের গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা অর্থাৎ লন্ডনের আঞ্চলিক ভাষা। প্রাচীন ভারতেও সংস্কৃত ও প্রাকৃতে
প্রভেদ ছিল— আদিকালে ভারতে সংস্কৃত ভাষাভাষী অঞ্চলে অশিক্ষিত জনসাধারণ প্রাকৃতভাষায় ভাব বিনিময় করতো। প্রাচীন ভারতে মানুষের শ্রেণীভাগের মতো ভাষাতেও এমন উচ্চ-নিচ প্রভেদ ছিলো। যেমন, কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটকে দুষ্মন্ত বা শকুন্তলার ভাষা সংস্কৃত হলেও মৎস্যশিকারীর ভাষা প্রাকৃত।
সংস্কৃত ব্যবসায়ী – সংস্কৃত পন্ডিত; ব্যঙ্গার্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। –
অনুস্বারবাদীদিগের— সংস্কৃত পন্ডিতদের; বিদ্রূপার্থে। সংস্কৃত ভাষার মতো প্রচুর অনুস্বার ও বিসর্গ ব্যবহার করে যে- পন্ডিতগণ বাংলা ভাষাকে আড়ষ্ট করতে চান তাদের বুঝানো হয়েছে।
সংস্কৃতানুকারিতা — সংস্কৃত ভাষাকে অনুকরণ করার প্রবণতা।
টেকচাঁদ ঠাকুর – প্যারীচাঁদ মিত্রের ছদ্মনাম টেকচাঁদ ঠাকুর। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ও ১৮৮৩ – খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা গদ্যে কথ্য ভাষারীতির তিনি প্রবর্তক। তাঁর মতে, সংস্কৃত শব্দবহুল গদ্যরীতির পরিবর্তে প্রচলিত শব্দনির্ভর সরল গদ্যই বাংলা ভাষায় আদর্শ হওয়া উচিত। এই গদ্যরীতিতে তিনি ‘আলালের ঘরের দুলাল’, (১৮৫৭) গ্রন্থটি রচনা করেন।
বিষবৃক্ষ — যে গাছ বিষাক্ত ফল দেয়। এখানে সংস্কৃতবহুল বাংলাভাষাকে বলা হয়েছে।
নিষিক্ত — সিঞ্চিত। –
মুখপাত্র — প্রধান প্রতিনিধি ।
রামগতি ন্যায়রত — ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম; মৃত্যু ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। মূলত প্রাচীনপন্থী ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘সংস্কৃত সাহিত্য প্রস্তাব’-এর অনুকরণে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ‘বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
বিদ্যাসাগর— প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা। জন্ম ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে; মৃত্যু ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে। পিতার নাম বীরসিংহ শর্মা।
বস্তু-সংক্ষেপ
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই লেখ্য ভাষা ও কথ্য ভাষার পার্থক্য বর্তমান। তবে বাংলায় এর প্রভেদ যতোটা ব্যাপক, অন্যভাষায় ততটা নয়। সাধু ভাষা ও অপর ভাষা এই দুই ভাগে বাংলা ভাষা বিভক্ত। প্রথম দিকে বাংলায় সাধুভাষায় লিখার কাজ সম্পন্ন হতো এবং সেখানে অপর ভাষার কোন রূপ চিহ্ন থাকতো না। অপর ভাষা মৌখিকভাবে ব্যবহার হতো। বিশেষ করে সাধুভাষায় অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দাবলি বাংলা ক্রিয়াপদের আদি রূপের সঙ্গে যুক্ত হয়।
গদ্য গ্রন্থাদি সাধুভাষা ছাড়া রচিত হতো না। অনেকে মনে করতেন যে, সংস্কৃত ভাষা না জানলে বাংলা গ্রন্থ রচনা সম্ভব নয়। অপর ভাষা অপেক্ষাকৃত বোধগম্য হলেও পুস্তকাদিতে তার ব্যবহার দেখা যায়নি। ফলে কতিপয় পন্ডিতের সংস্কৃতপ্রিয়তা ও সংস্কৃতানুকারিতার জন্যে বাংলা সাহিত্য অত্যন্ত নীরস, শ্রীহীন, দুর্বল এবং বাঙালি সমাজে অপরিচিত হয়ে ওঠে।
ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত টেকচাঁদ ঠাকুর প্রথম কথোপকথনের ভাষা অর্থাৎ অপর ভাষায় ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এরপর থেকে সাধুভাষা ও অপর ভাষা এই দুই প্রকার ভাষাতেই বাংলা গ্রন্থ রচিত হয়। তবে খাঁটি সংস্কৃতবাদী ও টেকচাঁদি পক্ষীয়দের মধ্যে এ নিয়ে তর্ক থেকে যায়। প্রথম পক্ষ মনে করেন যে, সংস্কৃতমূলক শব্দ ছাড়া বাংলায় অন্য শব্দ ব্যবহার ঘৃণার যোগ্য, দ্বিতীয় পক্ষের মত এই যে, সংস্কৃত শব্দের কচকচি প্রকৃত বাংলা নয়, তাই গ্রন্থে ব্যবহার হতে পারে না।
পন্ডিত রামগতি ন্যায়রত্নকে সংস্কৃতবাদীদের মুখপাত্র হিসেবে অভিহিত করে প্রবন্ধকার তাঁর গদ্যভাবনা বিচারে অবতীর্ণ হয়েছেন। ন্যায়রত্ন মহাশয় সংস্কৃত-সুপন্ডিত হলেও ইংরেজি জানেন না। তাঁর মতে, ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’ ইত্যাদি পিতাপুত্র একত্রে অসঙ্কুচিত চিত্তে পাঠ করা চলে না – বন্ধু বা পত্নীর সঙ্গে পাঠ করে আমোদ করা চলে।
কারণ ওই ভাষাতে ‘কেমন একরূপ ভঙ্গী আছে যে কারণে তা গুরুজনসমক্ষে উচ্চারণে লজ্জাবোধ হয়। এ জন্যে ওই ভাষা পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষাপ্রদও নয়। ন্যায়রত্ন মহাশয়ের মতো সংস্কৃতবাদীদের মত পুরোপুরি মান্য করলে ‘মাগো আমাকে খাবার দাও’ – এই সাধারণ বাংলা বাক্যটি ‘হে মাতঃ খাদ্যং দেহি মে’ বলতে হয়।
বুঝার ক্ষেত্রে যেহেতু বাক্যটি কষ্টসাধ্য, সেহেতু শিক্ষার ব্যাপরটিও এখানে গৌণ হয়ে যায়। ন্যায়রত্ন মহাশয় সংস্কৃতশব্দবহুল গদ্যের কথা বললেও তাঁর রচিত ‘বাঙ্গালা সাহিত্য’ বিষয়ক প্রস্তাব কিন্তু সরল প্রচলিত ভাষায় লিখিত।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সংক্ষিপ্ত-উত্তরমূলক প্রশ্ন
১. বঙ্কিমচন্দ্র ‘সাধুভাষা’ ও ‘অপর ভাষা’ বলতে কি বুঝিয়েছেন?
২. রামগতি ন্যায়রত্নের মতে বাংলা গদ্য কেমন হওয়া উচিত?
২ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর-প্রশ্নের নমুনা-উত্তর
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রামগতি ন্যায়রত্নকে সংস্কৃতবাদীদের মুখপাত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। ন্যায়রত্ন সংস্কৃতে সুপন্ডিত, কিন্তু ইংরেজি জানেন না। তিনি বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দাধিক্য ও সমাসবদ্ধ পদ আমদানির পক্ষপাতী। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বা ‘হুতোম পেঁচার নক্সা’ পাঠ করলে লজ্জা জন্মে বলে তিনি মনে করেন।
আভাঙ্গা অর্থাৎ খাঁটি সংস্কৃত শব্দ ছাড়া অন্য শব্দ প্রাচীনপন্থীরা বাংলা গদ্যে অন্তর্ভুক্ত করার বিপক্ষে। যাদের সংস্কৃতে দখল নেই, তাদের বাংলা গ্রন্থ প্রণয়নের অধিকার নেই- – প্রাচীনপন্থীদের এই মতই ছিলো রামগতি ন্যায়রত্নের মত।
প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা লিখুন
১. অন্যের বোধ ছিল যে সংস্কৃত না জানে, বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রণয়নে তাহার কোন অধিকার নাই, সে বাঙ্গালা লিখিতে পারেই না।
২. সুতরাং বাঙ্গালায় রচনা ফোঁটা-কাটা অনুস্বারবাদীদিগের একচেটিয়া মহল ছিল।
১ নং ব্যাখ্যার নমুনা-উত্তর:
আলোচ্য বাক্যটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বাঙ্গালা ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে চয়ন করা হয়েছে। এখানে সংস্কৃত পন্ডিতদের মতে বাংলা ভাষার আদর্শ ও রূপ কি হওয়া উচিত সে কথা প্রবন্ধকার ব্যক্ত করেছেন। উইলিয়াম কেরীর কথ্যভাষায় আশ্রয়, রামরাম বসুর আরবী-ফারসী শব্দ-নির্ভরতা আর মৃত্যুজ্ঞয় বিদ্যালঙ্কারের সংস্কৃত ভাষারীতি অবলম্বন – এই ত্রয়ী ধারায় বাংলা গদ্যরীতির প্রাথমিক সূচনা হয়।
কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলা ভাষা, বিশেষত বাংলা গদ্যের আদর্শ ও রূপ কোন নির্দিষ্টতা নিয়ে স্বীকৃত হয়ে ওঠেনি। গ্রন্থাদি সাধুভাষায় প্রণীত হতো এবং এর প্রণেতা ছিলেন মূলত সংস্কৃত পন্ডিতগণ। তাঁরা স্বভাবতই বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত শব্দ ও রীতি নির্ভর করে গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য হলো, বাংলা ভাষায় সংস্কৃত প্রভাব অবশ্যই থাকতে হবে এবং সংস্কৃত প্রভাব অস্বীকার করে বাংলা গ্রন্থ রচিত হতে পারবে না।
এই অভিমতটি এক সময় এতোটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, ধারণা জন্মে, যাঁরা সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণ জানেন না, তাঁরা বাংলা পুস্তক লিখতেই পারেন না। সংস্কৃত পন্ডিতদের এই বক্তব্যটি অবশ্য পরবর্তীকালে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়।
আরও দেখুন :