প্রশিক্ষণার্থীদের বিদ্যমান ধারণা চিহ্নিতকরণ ও সুস্পষ্টকরণে গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ের ব্যবহার

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় প্রশিক্ষণার্থীদের বিদ্যমান ধারণা চিহ্নিতকরণ ও সুস্পষ্টকরণে গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ের ব্যবহার – যা আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেণিতে সকল শিক্ষার্থীর চাহিদা মেটানোর উপায় এর অন্তর্ভুক্ত।

Table of Contents

প্রশিক্ষণার্থীদের বিদ্যমান ধারণা চিহ্নিতকরণ ও সুস্পষ্টকরণে গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ের ব্যবহার

 

প্রশিক্ষণার্থীদের বিদ্যমান ধারণা চিহ্নিতকরণ ও সুস্পষ্টকরণে গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ের ব্যবহার

 

শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত

শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় ব্যক্তির আচরণের কাঙ্খিত পরিবর্তন বলে- যা জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। একটি গতিশীল প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যক্তির আচরণের সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। ব্যক্তি তথা শিক্ষার্থীর মাঝে এ বিকাশ ও পরিবর্তন কতটা হয়েছে তা নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন মূল্যায়নের। আর মূল্যায়ন হল একটি প্রক্রিয়া- যার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত শিক্ষার্থীর সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করা হয়।

সহজ ভাষায় শিক্ষার্থীরা শিখন উদ্দেশ্য কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে তা নিরূপণের জন্য তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে বলা হয় মূল্যায়ন। শিক্ষার্থীদের শিখন অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অর্জন যাচাইকে মূল্যযাচাই বা মূল্য নিরূপণ বা মূল্য আরোপ বলা হয় ।

শিখন-শেখানো সমূদয় কার্যক্রমের মাঝে মূল্যযাচাই অতিগুরুত্বপূর্ণ। মূল্যযাচাই বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নের পরিধি প্রকাশ করার সুযোগ প্রদান করে। শিক্ষার্থীদের অর্জনের মূল্যযাচাই নানাভাবে করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রধান দু’টি মূল্যযাচাই প্রক্রিয়ার একটি হল গঠনকালীন বা গাঠনিক মূল্যযাচাই (Formative Assessment) এবং অন্যটি হল সামষ্টিক বা চূড়ান্ত মূল্যযাচাই (Summative Asessment)। এ অধিবেশনে আমরা গঠনকালীন মূল্যযাচাই সম্পর্কে আলোচনা করবো।

গঠনকালীন মূল্যযাচাই-এর ধারণা

গাঠনিক বা গঠনকালীন মূল্যযাচাই-এর নামের সাথে এর পরিচয়ের আভাষ নিহিত। গঠনকালীন মূল্যযাচাইকে ইংরেজিতে Formative Assessment বলা হয়। ‘ormative’ শব্দটির উৎপত্তি ‘Form’ থেকে- যার অর্থ গঠন করা বা তৈরি করা। আর শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যযাচাই হলো— শিক্ষার্থী, শিক্ষাক্রম, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা কর্মসূচি ও শিক্ষানীতি সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মূল্যযাচাই বলতে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের গুণগত ও পরিমাণগত পরিমাপের জন্য যে কৌশল অবলম্বন করা হয় তাকে বোঝায়।

শিক্ষার্থীর কৃতিত্ব পরিমাপের জন্য মূল্যযাচাই করা হয়। তাই মূল্যযাচাই শিক্ষার্থীর কৃতিত্ব পরিমাপক। আক্ষরিক অর্থের নিরিখে বলা যায় শিক্ষার্থীর দুর্বলতা বা সবলতা সনাক্ত করে নিরাময়মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে তৈরি বা গঠন করে নেয়ার জন্য যে মূল্যযাচাই তা-ই গঠনমূলক বা গাঠনিক মূল্যযাচাই। অন্যভাবে বলা যায়, শিক্ষার্থীর শিখনে সবলতা ও দুর্বলতা সনাক্ত করে তা নিরাময়ের জন্য যে কৌশল অবলম্বন করে শিক্ষার্থীদের গঠন করা হয় তাকে গঠনকালীন মূল্যযাচাই বলে।

গঠনকালীন মূল্যযাচাই হলো প্রাক ও ধারাবাহিক মূল্যযাচাই যা শিক্ষার্থীকে যথোপযুক্তভাবে গড়ে তোলা তথা শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে উন্নয়ন ও সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত মূল্যায়নের পূর্বে করা হয়। গঠনকালীন মূল্যযাচাই প্রক্রিয়ায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কোর্স চলাকালীন সময়ে শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা ও বাস্তবায়নকালে কার্যক্রমের অগ্রগতির তদারকি করা ও মানযাচাই করা যায়।

গঠনকালীন মূল্যযাচাই প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদদের দেয়া কয়েকটি সংজ্ঞার প্রতিদৃষ্টি দেয়া যাক। যেমন- শিক্ষাবিদ Ruth Sutton বলেছেন, “গাঠনিক মূল্যযাচাই হল আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত একটি চলমান অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিশুর শিখন সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় এবং তার মাধ্যমে পরবর্তী ধাপের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়”। বেষ্টওকান (১৯৯৫) বলেন, গাঠনিক মূল্যায়ন হল একটি চলমান ও অবিরত প্রক্রিয়া।

গাঠনিক পর্যবেক্ষণের প্রধান উদ্দেশ্য বা কাজ হল কোন শিখন কার্যের কতটুকু পূর্ণ হল বা কতটুকু শিখন ঘটল তার মাত্রা নিরূপণ এবং পূর্ণ সফল শিখন ঘটতে কতটুকু বাকি রইল তা সুনির্দিষ্টকরণ। আবার সাটন (১৯৯১)-এর মতে গাঠনিক মূল্যযাচাই হল আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত একটি চলমান ও অবিরত প্রক্রিয়া যার সাহায্যে শিশুর শিখন সংক্রান্ত তথ্য ও সাক্ষ্য পাওয়া যায় এবং তার উপর ভিত্তি করে, কোন ধাপ বা কোন নির্দিষ্ট কার্যকে পরিচাল না করা যায়।

Page Thomas উক্তি করেন, “গাঠনিক মূল্যযাচাই ব্যবস্থায় প্রয়োগকৃত অভীক্ষার ফলাফল থেকে তথ্যের ফলাবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষণ-শিখন ব্যবস্থাকে উন্নত করা যায় বা যা শিক্ষণ পদ্ধতির কার্যকারিতা ও সর্বোচ্চ শিখন প্রতিবন্ধকতার চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম, তাকে গাঠনিক মূল্যযাচাই বলে” ।

বস্তুত গঠনকালীন মূল্যযাচাইকে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করলেও তাদের মূল বক্তব্য প্রায় এক ও অভিন্ন। সর্বোপরি, কোন পাঠ বা কোর্স চলাকালীন শিক্ষার্থীদের যে মূল্যায়ন করা হয় তা-ই গঠনকালীন মূল্যযাচাই । প্রশিক্ষার্থী বন্ধুরা, এবার আসুন উপরের আলোচনার নিরিখে নিজের ভাষায় মূল্যযাচাই ও গঠনকালীন মূল্যযাচাই- এর একটি করে সংজ্ঞা তৈরি করি-

গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ের বৈশিষ্ট্য

বিভিন্ন শিক্ষাবিদদের প্রদত্ত সংজ্ঞার আলোকে গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ চিহ্নিত করা
যায়। যেমন-

১. এটি একটি চলমান বা নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া- যে প্রক্রিয়ায় কোন শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে কিনা তা মনিটর করা হয়।

২. গাঠনিক মূল্যযাচাই হতে পারে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, সান্মাসিক অথবা যে কোন পিরিওডিক মূল্যায়ন। এর মাধ্যমে শিক্ষক শিক্ষাদানের পরবর্তী কার্যক্রম কী হবে, তা ঠিক করে থাকেন।

৩. আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক দু’ভাবেই এটি সম্পন্ন করা যায়।

৪. এটি শিক্ষার্থীর শিখন উদ্দেশ্যকে পরিমাপ করতে সাহায্য করে।

৫. এটি শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নকালে শিক্ষার্থীর অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে ।

৬. শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানে এটি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিতে সহায়তা করে।

৭. কখনো কখনো এর মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও উপকরণের ধরন ও ব্যবহার পরিবর্তন করা হয়।

বিদ্যমান ধারণা চিহ্নিতকরণ ও সুষ্পষ্টকরণে গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ের গুরুত্ব

শ্রেণি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী এমনকি শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষা প্রশাসকের নিকট গঠনকালীন মুল্যযাচাইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। উল্লেখিত পক্ষসমূহের বিদ্যমান ধারণা চিহ্নিতকরণ ও সুস্পষ্টকরণে গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ের গুরুত্ব নিম্নে বর্ণনা করা হলো :

শিক্ষকের ক্ষেত্রে

  •  গাঠনিক মূল্যযাচাইয়ের মাধ্যমে মূল্যায়নে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষকতার শিখন-শেখানো কার্যক্রমের সবলতা-দুর্বলতাচিহ্নিত করে দূর্বলতা উত্তোরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন ।
  • এর মাধ্যমে শিক্ষক শিক্ষার্থীর দুর্বলতা সনাক্ত করে প্রয়োজনীয় নিরাময়মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন ।
  • এর মাধ্যমে যথাসময়ে শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে সচেতন করতে পারেন।
  • শিক্ষক তার অবলম্বিত পদ্ধতির কার্যকরিতা যাচাই করতে পারেন এবং শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশলে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারেন।
  • শিক্ষক তার দক্ষতা পরিমাপের সুযোগ পান।
  •  শ্রেণি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারেন ।
  •  শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।

শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে

  • গাঠনিক মূল্যযাচাইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থী তার শিখন অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত হয়ে দুর্বলতা দূর করার জন্য সচেতনভাবে অগ্রসর হতে পারে।
  •  নিয়মিত মূল্যায়নের কারণে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের প্রতি যে সাধারণ ভীতি থাকে, তা দূর হয়ে যায় । এ মূল্যযাচাই চূড়ান্ত মূল্যায়নের জন্য শিক্ষার্থীকে প্রস্তুত করে।
  • বিষয়বস্তুর পরিষ্কার ধারণা গঠনে সহায়তা করে।
  • সকল প্রশ্নের মানসম্মত উত্তর প্রদান করতে পারে।
  • শ্রেণিতে শিক্ষার্থী তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে।
  • প্রেষণা সৃষ্টি হয় ও উত্তম পাঠ অভ্যাস তৈরি হয়।
  • চূড়ান্ত পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের প্রবণতা হ্রাস পায় । বাছাইকৃত প্রশ্ন পড়ার প্রবণতা হ্রাস পায় ।
  •  নিজের প্রতিচূড়ান্ত পরীক্ষায় সাফল্যের মনোবল বৃদ্ধি পায় ।
  •  অভিভাবককে তার অগ্রগতি ও দুর্বলতা জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আলোচনা করতে পারে।
  •  বিশেষ দুর্বল দিক কাটিয়ে উঠার জন্য শিক্ষকের বিশেষ সহায়তা ও পরামর্শ চাইতে পারে ।
  •  সহপাঠীদের সহায়তায় নিজের দুর্বলতা দূর করার সুযোগ পায়।
  • এ মূল্যযাচাইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চাপমুক্ত থাকে ।
  • এ মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিভিন্নমূখী দক্ষতা ও সামর্থ্য যাচাইয়ের সুযোগ থাকে বিধায় এ মূল্যায়নের ফলে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সমস্যা সমাধান দক্ষতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিকাশ ঘটে।

শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রে

  • শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞগণ গাঠনিক মূল্যায়নের ফলাবর্তনের ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির সবলতা-দুর্বলতা নির্ণয় করতে পারেন।
  • বিশেষজ্ঞগণ গাঠনিক মূল্যায়নের ফলাবর্তন শিক্ষা গবেষণার কাজে ব্যবহার করতে পারেন।
  •  গাঠনিক মূল্যায়নের ফলাবর্তনের ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, পরিমার্জন ও নবায়ন করতে পারেন।

শিক্ষা প্রশাসকের ক্ষেত্রে

  •  শিক্ষা প্রশাসকগণ শিক্ষা বিষয়ক তদারকির সময় গাঠনিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত ফলাফল ব্যবহার করতে পারেন।
  • শিক্ষকদের কর্মকালীন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এ ফলাফল ব্যবহার করতে পারেন।
  •  শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের কাজে এ মূল্যায়নের ফলাফল ব্যবহার করতে পারেন।

গঠনকালীণ মূল্যযাচাইয়ের কৌশল

গাঠনকি মূল্যাযাচাইয়ের ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষের ভিতর ও বাহির উভয় স্থানের বিভিন্ন কর্মকান্ডই বিবেচ্য, তবে সাধারণত শ্রেণিকক্ষের ভিতরেই বেশির ভাগ কর্মকাণ্ড গাঠনিক মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি বিবেচিত হয়। আবার শ্রেণিকক্ষের অনেক মূল্যায়ন কৌশল শিক্ষক/প্রশিক্ষকের উদ্দেশ্য অনুসারে তা গাঠনিক কিংবা চূড়ান্ত মূল্যায়নের অংশ হিসেবে গণ্য করা যায়। অধিকন্তু গাঠনিক মূল্যযাচাই আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক- দু’ভাবেই হতে পারে। শ্রেণিকক্ষের অভ্যন্তরে গাঠনিক মূল্যায়নের ক্ষেত্র ব্যাপক।

শ্রেণিকক্ষে মৌখিক প্রশ্ন, লিখিত প্রশ্ন, বিভিন্ন প্রকার অভীক্ষা, নির্দেশিত পঠন, নির্দেশিত কাজ, প্রশ্নোত্তর, সাক্ষাৎকার, কুইজ, মাথা খাটানো, গল্প বলা, ছবি/চিত্র/মানচিত্র আঁকা, পোস্টার প্রদর্শন, জোড়ায় কাজ, মাইন্ডম্যাপিং, ভূমিকাভিনয়, দলীয় কাজের পারস্পরিক মূল্যায়ন, কেসস্টাডি, পর্যবেক্ষণ, সাপ্তাহিক পরীক্ষা, শ্রেণি পরীক্ষা, মাসিক পরীক্ষা, এ্যাসাইনমেন্ট, সেমিনার, টার্ম পেপার, চেকলিস্ট, বাড়রি কাজ ইত্যাদি বিবেচ্য হতে পারে।

আবার শ্রেণিকক্ষের বাইরে গৃহ পরিদর্শন, সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের কাজ বিবেচনা করে গাঠনিক মূল্যায়ন করা যেতে পারে। নিম্নে গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ের কতিপয় কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হল ।

শ্রেণির কাজ

কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের/শিক্ষার্থীদের বিদ্যমান ধারণা চিহ্নিতকরণ ও সুস্পষ্টকরণে শ্রেণির কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কৌশল। শিক্ষার্থীদের চিন্তন দক্ষতা ও তাদের সহযোগিতামূলক শিখন দক্ষতা বিকাশ শ্রেণি কাজের অন্যতম উদ্দশ্যে। প্রশিক্ষণার্থী/শিক্ষার্থী কর্তৃক শ্রেণিতে সম্পাদিত সকল কাজ শ্রেণি কাজের অর্ন্তগত।

শ্রেণি কাজের ক্ষেত্র ব্যাপক। শোনা, পড়া, লেখা ও আঁকা, নির্দেশিত পাঠ, এককভাবে কাজ, জোড়ায় কাজ, দলীয় কাজ, মাথা খাটানো, পোস্টারে লিখে তা প্রদর্শন, গল্প বলা, সাক্ষাৎকার দেওয়া ও নেওয়া, অভিনয় করা, দলীয় কাজের পারস্পরিক মূল্যায়ন, কেস স্টাডি, পর্যবেক্ষণ, চেকলিস্ট ইত্যাদি শ্রেণির কাজের উদাহরণ।

শ্রেণিতে প্রশিক্ষণার্থীরা/শিক্ষার্থীরা যখন এসব কাজ করে তখন প্রশিক্ষক/শিক্ষক তাদের পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে শিখন-শেখানো কার্যক্রম কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে, তা বুঝতে পারেন। ফলাবর্তন এবং প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদের কাজ তত্ত্বাবধান করতে পারেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনার মাধ্যমে বিদ্যমান ধারণা সুস্পষ্ট করতে পারেন।

 

প্রশিক্ষণার্থীদের বিদ্যমান ধারণা চিহ্নিতকরণ ও সুস্পষ্টকরণে গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ের ব্যবহার

 

মৌখিক প্রশ্নকরণ

শ্রেণিতে প্রশিক্ষক/শিক্ষকগণ মৌখিক প্রশ্ন করার মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীরা পাঠের বিষয়ে কী জানে আর কী জানে না তা, নিশ্চিত হতে পারেন। প্রশ্ন করার মাধ্যমে বর্তমান পাঠ থেকে পরবর্তী পাঠে যাওয়ার জন্য তার শিখন- শেখানো কার্যক্রম বেশির ভাগ প্রশিক্ষণার্থী/শিক্ষার্থীর কাছে কতটুকু ফলপসূ হয়েছে, তা যাচাই করে দেখতে পারেন। এছাড়াও প্রশ্ন করার মাধ্যমে পাঠের পূর্বে পাঠ্য বিষয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণার্থী/শিক্ষার্থীদের ধারণা কতটুকু, তা জানতে পারেন। এক্ষেত্রে তাদের বিদ্যমান ধারণা সুস্পষ্টকরণে আরো সহায়তার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, তা শ্রেণিতে মৌখিক প্রশ্নের মাধ্যমে জানা সম্ভব হয়।

লিখিত প্রশ্ন

গঠনকালীন মূল্যযাচাই এর ক্ষেত্রে লিখিত প্রশ্ন একটি বহুল ব্যবহৃত এবং গতানুগতিক কৌশল। এ কৌশলে প্রশিক্ষক/শিক্ষক সহজে শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণার্থী/শিক্ষার্থীদের শিখনের জ্ঞানগত উদ্দেশ্যের অগ্রগতি যাচাই করে তার প্রমাণ সংরক্ষণ করতে পারেন।

মৌখিক উপস্থাপনা

বিভিন্ন বিষয়ের মৌখিক উপস্থাপনার মান ও দক্ষতা পর্যবেক্ষণ করে প্রশিক্ষণার্থীদের/শিক্ষার্থীদের বিদ্যমান ধারণা চিহ্নিত করা যায় এবং প্রশিক্ষক/শিক্ষক সে অনুযায়ী ধারণা সুস্পষ্টকরণে পদক্ষেপ নিতে পারেন। কোন কিছু প্রকাশ ও বর্ণনা করার দক্ষতা, একক কাজ ও দলীয় কাজ উপস্থাপনের নৈপূণ্য ইত্যাদি মৌখিক উপস্থাপনা মূল্যায়নের অন্যতম নির্দেশক ।

বাড়ির কাজ

পাঠের শিখনকে সুদৃঢ় ও প্রয়োগমূখী করতে বাড়ির কাজ গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ির কাজ যাচাই করে শিক্ষার্থীর শিখন সফলতার মানযাচাই করা যায়।

নির্ধারিত কাজ/অর্পিত কাজ: Assignment

নির্ধারিত কাজ হচ্ছে শ্রেণির বাইরে করণীয় প্রশিক্ষক/শিক্ষক কর্তৃক আরোপতি কাজ। এটি এক ধরণের বাড়ির কাজ। তবে সাধারণ অর্থে বাড়ির কাজ থেকে এটি ভিন্ন প্রকৃতির কাজ। এ কাজে অনেক সময় প্রশিক্ষণার্থী/শিক্ষার্থীকে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বিভিন্ন তথ্য- উপাত্ত ব্যবহার করতে হয়। অনেক সময় আবার এ কাজের লিখিত প্রতিবেদন প্রণয়ন করতে হয়। নির্ধারিত কাজ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। আকাইদ ও ফিকহ সংশ্লিষ্ট নির্ধারিত কাজের একটি উদাহরণ নিম্নে দেয়া হল:

বিষয়: উগ্র ও ভ্রান্ত ধর্মীয় আকীদার সামাজিক ক্ষতি ও এর প্রতিকার ।

[প্রশিক্ষার্ণীরা/শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে মসজিদের অভিজ্ঞ ইমামসহ উপযুক্ত উত্তরদাতাদের নিকট থেকে একটি প্রশ্নমালার মাধ্যমে প্রশ্ন করে উগ্র ও ভ্রান্ত ধর্মীয় আকীদা কীভাবে সামাজিক ক্ষতি সাধন করছে এবং উত্তরদাতাদের মতামতের ভিত্তিতে এ সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো লিপিবদ্ধ করে প্রতিবেদন তৈরি করবে।]

অনুসন্ধানের ধাপ

ক. শিরোনাম
খ. তথ্য সংগ্রহের প্রশ্নমালা তৈরি;
গ. তথ্য সংগ্রহ;
ঘ. তথ্য শ্রেণিবিন্যাস;
ঙ. প্রতিবেদন তৈরি।

প্রতিবেদন তৈরির সংকেত

ক. ভূমিকা;
খ. অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য; গ. তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি;
ঘ. তথ্য পর্যালোচনা/বিশ্লেষণ/প্রাপ্ত ফলাফল ;
ঙ. উপসংহার।
এ ধরণের প্রতিবেদন থেকে বিষয়বস্তু সংক্রান্ত বিদ্যমান ধারনা চিহ্নিত করা যায় এবং সে অনুযায়ী ধারণা সুস্পষ্টকরণে পদক্ষেপ নেয়া যায় ।

চেকলিস্ট/ইনভেনটরি ব্যবহার

চেকলিস্ট/ইনভেনটরি আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক উভয় ধরনের হতে পারে। চেকলিস্ট ব্যবহার করে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির পরিবর্তনের মাত্রা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও মূল্যায়ন করতে পারেন।

অভীক্ষার ব্যবহার

বিভিন্ন ধরনের অভীক্ষার সাহায্যে যেমন: প্রান্তিক বা সামষ্টিক মূল্যায়ন করা যায়, তেমনি আবার গাঠনিক মূল্যায়নেও বিভিন্ন প্রকার অভীক্ষা প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির মান নির্ধারণ করা যায়। শ্রেণি অভীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর চিন্তন দক্ষতার অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়।

শ্রেণি অভীক্ষার মাধ্যমে বিশেষত শিক্ষার্থী কর্তৃক শিখনীয় বিষয় স্মরণ করতে পারা, অনুধাবন করতে পারা, লব্ধ ধারনা নিজের ভাষায় প্রকাশ করতে পারা, তথ্যকে শ্রেণিবিন্যাস করতে পারা; সারসংক্ষেপ তৈরি অথবা সম্প্রসারণ বা ব্যাখ্যা করতে পারা, অর্জিত জ্ঞানকে নতুন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করতে পারা, ধারনা বা যুক্তিকে বিশ্লেষণ করতে পারা এবং কোনো বিষয়ে যুক্তি সহকারে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করতে পারার দক্ষতা ও সামর্থ্যকে মূল্যায়ন করা হয়।

শিক্ষকের পর্যবেক্ষণ

গাঠনিক মূল্যায়নে পর্যবেক্ষণ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়। প্রশিক্ষক/শিক্ষক হিসেবে শ্রেণিকক্ষে পর্যবেক্ষণের নানা ইস্যু রয়েছে, যেমন— শিক্ষক শিক্ষার্থীর মাঝে প্রশ্নোত্তর, একক, জোড়ায়, দলীয় কাজসহ বিভিন্ন কাজ, পাঠে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের মাত্রা, বিভিন্ন কাজের শৃঙ্খলা, পঠন, লিখন, শ্রবণ দক্ষতা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণের অন্যতম বিষয়।

এছাড়াও বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। সুক্ষ্ম ও নৈর্ব্যক্তিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ের নৈপুণ্য ও দক্ষতা পরিমাপ করা সম্ভব। তবে পর্যবেক্ষণ হতে হবে নির্ভরযোগ্য ও পদ্ধতিগত। এজন্য ব্যক্তি শিক্ষকের পরিবর্তে কিছু কিছু বিষয়ে সকল শিক্ষকের যৌথ পর্যবেক্ষণ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। নতুবা তা পক্ষপাতদুষ্টু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার পর্যবেক্ষণ হতে হবে রেকর্ড ভিত্তিক ।

টার্ম পেপার

এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বোঝার ধরণ, পরিমাণ ও বিস্তৃতি মূল্যায়ন করা যায় ।

রেটিং স্কেল

এর সাহায্যে জানা যায় শিক্ষার্থী কী বোঝেনি এবং কতটুকু বোঝেনি।

কুইজ

দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন।

গৃহ পরিদর্শন

গৃহপরিদর্শন করে শিক্ষার্থী/প্রশিক্ষণার্থী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তাকে মূল্যায়ন করা যায়। গৃহপরিদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর রুচিবোধ, নান্দনিকতা, স্বাভাবিক প্রবণতা, কর্মদক্ষতা, আচার-আচরণ, প্রবণতা ইত্যাদি পরিমাপপূর্বক তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়।

সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলী

শ্রেণিকক্ষের বাইরে বিদ্যালয়ে এবং বিদ্যালয়ের বাইরে বিভিন্ন রকম সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলীর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটে। এজন্য শিক্ষার্থীদের যথার্থ মূল্যায়নে সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলী গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড ।

 

প্রশিক্ষণার্থীদের বিদ্যমান ধারণা চিহ্নিতকরণ ও সুস্পষ্টকরণে গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ের ব্যবহার

 

বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম

শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আবেগিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ইত্যাদি ক্ষেত্রের বিকাশ সাধন করা হয়। কিন্তু কেবল শ্রেণিকক্ষ থেকেই এসব অর্জনের মাত্রা নিরূপণ করা যায় না। তাই শ্রেণিকক্ষের বাইরের বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড বিচার বিশ্লেষণপূর্বক প্রশিক্ষণার্থী/শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা আবশ্যক।

এ জন্যে শ্রেণিকক্ষের বাইরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড যেমন- আবৃত্তি, অভিনয়, ধর্মীয় সংগীত, খেলাধুলা, অংকন, সমাজ সেবা, শিক্ষা ভ্রমণ, আরবি ভাষা ও সাহিত্যের কক্ষ সাজানো, উপকরণ সংগ্রহ, উপকরণ প্রণয়ন, বিভিন্ন প্রজেক্ট প্রভৃতিকে ও মূল্যায়নের সময় গুরুত্বসহ বিবেচনায় রাখা দরকার। গাঠনিক মূল্যায়নের এসব কৌশলে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা, কর্মদক্ষতা, মানসিক প্রবণতা, আগ্রহ, চিন্তাশক্তি, অভিরুচি প্রভৃতির প্রতিফলন ঘটে ।

উল্লেখিত কৌশল ছাড়াও শ্রেণিকক্ষে বিষয়ের গঠনকালীন মূল্যযাচাইয়ে বোর্ডের কাজ, দৈনিক হাজিরা বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ডায়েরি লেখা, বিষয় সংশ্লিষ্ট গল্প বলা, সবলদের দিয়ে দুর্বলদের শিক্ষা দেওয়া, শুনাবার পরে তা বলানো, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পরীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে গাঠনিক মূল্যযাচাই করতে পারেন। উল্লেখ্য যে, গাঠনিক মূল্যায়ন যেভাবেই করা হোক না কেন এর উদ্দেশ্য হবে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের তদারকি বা মনিটর করার মাধ্যমে তা উন্নয়নের জন্য ফলাবর্তন প্রদান, যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীতাদের দুর্বলতা সনাক্ত করে নিরাময় বা প্রতিবিধানমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন ।

আরও দেখুনঃ

 

Leave a Comment