আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-ব্যঞ্জন ধ্বনি
ব্যঞ্জন ধ্বনি
ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত বাগধ্বনিগুলো স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি নামে শ্রেণিকরণ করা হয়। ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই ধ্বনি বিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘স্বাভাবিক পদ্ধতিতে কথাবার্তা বলার সময়ে ফুসফুস নির্গত বাতাস গলনালী, মুখবিবর কিংবা মুখের বাইরে (ঠোঁটে) বাধা পাওয়ার ফলে কিংবা শ্রুতিগ্রাহ্য চাপা খাওয়ার ফলে যেসব ধ্বনি উদ্গত হয় সেগুলোই ব্যঞ্জনধ্বনি।’
(২০১০ : 36)
ভাষাতাত্ত্বিক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ ব্যঞ্জনধ্বনি সম্পর্কে বলেছেন, ‘ব্যঞ্জনধ্বনি গঠনের সময় শ্রুতিগ্রাহ্য শব্দ উৎপাদিত হয় এবং সেই সঙ্গে ফুসফুস থেকে বাতাস বেরুনোর সময় বিভিন্ন বাক-প্রতঙ্গের সংস্পর্শের জন্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং বাতাস ঘষা খেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। (১৯৯৭: ২১৫)
ব্যঞ্জনধ্বনি হচ্ছে মূলত সেই বাগধ্বনি যে ধ্বনির সৃষ্টিতে ফুসফসের বায়ু বাগযন্ত্রে বাধা পেয়ে নির্গত হয় । ব্যঞ্জনধ্বনি বিশ্লেষণ ও শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে পাঁচটি দিক বা প্রক্রিয়া বিশেষভাবে বিবেচ্য। যথা-
১. উচ্চারণ স্থানগত প্ৰক্ৰিয়া
২. উচ্চারণ রীতিগত প্রক্রিয়া
৩. নরম তালুর অবস্থান
৪. স্বরযন্ত্রের অবস্থা
৫. স্বল্পপ্রাণতা ও মহাপ্রাণতা বিচার (বাতাসের চাপের অবস্থা )
উচ্চারণ স্থান
উচ্চারণ স্থান হল মুখের ভেতর বাগযন্ত্রের কোন না কোন স্থানে শ্বাসবায়ু আংশিকভাবে অথবা সম্পূর্ণভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার অবস্থা উচ্চারণস্থান অনুসারে বাংলা ব্যঞ্জনধ্বনি হল :
ক. কণ্ঠনালীয়: স্বরতন্ত্রীদ্বয়ের সংকোচনে বায়ুপথ সংকীর্ণ হয় ও একেবারে বন্ধ না হয়ে আংশিক খোলা অবস্থায় যে ধ্বনি সৃষ্টি হয় তা হল / ২/ ধ্বনি। ডেমরার ভাষায় এই ধ্বনির ব্যবহার প্রচুর পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। যেমন- হাপ (সাপ), হাগ (শাক), রেহুন (রসুন) ইত্যাদি।
খ. জিহ্বামূলীয় কোমলতালুজাত : জিভের মূল বা পশ্চাৎ ভাগ উঁচু করে কোমলতালুতে স্পর্শ করে। শ্বাসবায়ুকে বাধা দিয়ে জিহবামূলীয় কোমলতালব্য ধ্বনি উচ্চারণ করা হয়। যেমন: /ক/ // /গ/- / / /3/ ডেমরা অঞ্চলে ঘ/ ধ্বনির /
গ/ রূপে উচ্চারিত হতে দেখা যায়। গর (ঘর), গাশ (ঘाস)
গ. প্রশস্ত তালু দস্তম্লীয় জিভের পাতার দুই পাশ চওড়া হয়ে উপরের দাঁতের মাড়ি ও কঠিন তালুর
মাঝে স্পর্শ করে যে ধ্বনি উচ্চারিত হয়-যথা। /৫/ // // /ঝ/ পশ্চাৎ দন্তমূলীয় //
ঘ. প্রতিবেষ্টিত দন্তমূলীয় : জিভের ডগা উল্টিয়ে কঠিন তালুর সম্মুখভাগ স্পর্শ করে যে ধ্বনি উচ্চারিত হয়, যেমন-/ট/, /ঠ/ // // ডেমরায় /৮/ ধ্বনির প্রয়োগ দেখা যায় না সেক্ষেত্রে / ড/ ব্যবহৃত হয়। ডাকা (ঢাকা) ডোল (ঢোল)
ঙ. দন্তমূলীয় জিভের ডগা (প্রান্তভাগ) উপরের দাতের গোড়া সংলগ্ন মাড়িতে লাগিয়ে যে ধ্বনি উচ্চারণ করা হয় যেমন: // // //
চ. দন্ত্যধ্বনি উপরের পাটি দাঁতের পেছনে জিভের ডগা স্পর্শ করে যে ধ্বনির সৃষ্টি হয় তা দন্ত্যধ্বনি।
যথা- /৩/, // // // //
ছ. ওষ্ঠ্যধ্বনি দুটি ঠোঁট স্পর্শ করে যে ধ্বনি সৃষ্টি হয়। যথা /// // // // //
উচ্চারণ-রীতি
মুখবিবরে বায়ু প্রবাহ কি ধরনের বাধাপ্রাপ্ত হয় আংশিক না সম্পূর্ণ বাধার এই প্রকৃতি অনুসারে ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো যথাক্রমে-
ক. স্পর্শ বা দৃষ্টধ্বনি নিচের ঠোঁট, জিভ উপরের ঠোঁট, দাঁত এবং স্বরতন্ত্রী দুটো পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে শ্বাসবায়ুর গতিপথ ক্ষতিকালের জন্য সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ করে ও সেই অবস্থায় অবস্থান করে সহসা বাধাযুক্ত হয়ে শ্বাসবায়ু নির্গত হলে যে ব্যঞ্জনধ্বনি উৎপন্ন হয় তা স্পৃষ্টধ্বনি। সৃষ্টধ্বনি উচ্চারণে তিনটি স্তর বিদ্যমান
১) বাগযন্ত্র দুটি দ্বারা সম্পূর্ণ বাধা
২) বাগযন্ত্র দুটি শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় থাকা
৩) সহসা বাধামুক্ত হয়ে বের হওয়াঃ।
‘বাংলায় যে চারটে জিহ্বামূলীয় সৃষ্টধ্বনি আছে (ক, খ, গ, ঘ) সেগুলো গঠনের সময় জিভের পশ্চাৎভাগ শত্রুতালু নরমতালু স্পর্শ করে। তালব্য স্পষ্টধ্বনি (চ, ছ, জ, ঝ) গঠনের সময় জিভের পশ্চাৎভাগ শক্ততালু স্পর্শ করে উচ্চারিত হয়। জিভের ডগা পেছনদিকে বাঁকা করে শক্ত তালু স্পর্শের সাহায্যে মূর্ধন্য স্পষ্ট ধ্বনিগুলো (ট, ঠ, ড, ঢ) গঠিত হয়। জিভের ডগা বা সামনের অংশ ওপরে উত্তোলিত হয়ে কর্তক
দন্ত স্পর্শ করে গঠিত হয় দন্ত্য স্পৃষ্টধ্বনি (ত, থ, দ, ধ)। নিচের ঠোঁট ওপরের ঠোঁট সংস্পর্শের পর মুখের ভেতর বায়ুপ্রবাহ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ অবস্থায় গঠিত হয় ওষ্ঠ্যধ্বনি (প, ফ, ব, ভ)।’ (মোরশেদ, আধুনিক ভাষাতত্ত্ব, ১৯৯৭, পৃ.২২০) ডেমরায় আঞ্চলিক ভাষায় // // // // /ভ/, স্পৃষ্ট ধ্বনির উচ্চারণ শোনা যায় না।
খ. দৃষ্ট বা ঘর্ষণজাতধ্বনি :
প্রমিত বাংলায় খৃষ্টধ্বনির উচ্চারণ নেই, তবে আঞ্চলিক ভাষায় এ ধ্বনির উচ্চারণ প্রচলিত। যদি কোনো ধ্বনি উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ুর গতিপথে প্রথমে স্পর্শধ্বনির মতো পূর্ণ বাধার সৃষ্টি হয় এবং কিছু পরে সেই বাধা কমে উষ্মধ্বনির মতো আংশিক বাধায় পরিণত হয়ে খৃষ্টধ্বনি উচ্চারিত হয়। যেমন- /চ/ / ছ/ /জ/ /ঝ/ । ডেমরা থানার মাতুয়াইল এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে // // // /// ধ্বনির ঘৃষ্ট উচ্চারণ লক্ষ্য করা যায়। যেমন- চ্চাচা, কই জাইতাছেন?” “উনো জ্জাইবেননি। ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় /ঝ/ ধ্বনি উচ্চারণ খুব বেশি নয় ।
গ. উষ্মধ্বনি বা শিসজাতধ্বনি
শ্বাসবায়ু বেরিয়ে যাবার সময় গলনালী থেকে ঠোঁট পর্যন্ত মুখগহ্বরে নানা জায়গায় বায়ুপথ সংকীর্ণ হয়ে ঘষা লেগে বা চাপা খেয়ে এক প্রকার শিসধ্বনি সৃষ্টি করে। ঘর্ষণজাত এরকম শিসধ্বনিই উষ্মধ্বনি বলে পরিচিত। যেমন-/শ/ /// /2/, ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় /শ/, /২/ ধ্বনির প্রচলন আছে।
ঘ. পার্শ্বিকধ্বনি :
জিভের অগ্রভাগ দন্তমূলে আবদ্ধ হলে জিভের দু’পাশ ফাঁকা থাকে। জিভ সরে এলে শ্বাসবায়ু দু’পাশ দিয়ে নির্গত হয় তখন পার্শ্বিকধ্বনি সৃষ্টি হয়। যেমন- /ল/ ।
ঙ. কম্পনজাতধ্বনি :
শ্বাসবায়ু যাতায়াতের পথে জিভের অগ্রভাগ দন্তমূলের কাছে উঠে বারবার বাধা দেয় ও শ্বাসবায়ু বারবার বাধাগ্রস্ত হয়ে কম্পনের সৃষ্টি হয়। তার ফলে কম্পনজাতধ্বনির সৃষ্টি হয়। যেমন: /র/
চ. তাড়নজাতধ্বনি :
জিভের অগ্রভাগের উল্টো দিক ও দাঁতের গোড়ার সামান্য স্পর্শে তাড়নজাত ধ্বনির সৃষ্টি হয়। যেমন- // // ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় এই দুটি ধ্বনির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
ছ. নাসিক্যধ্বনি
শ্বাসবায়ু ফুসফুস থেকে নির্গত হওয়ার পথে মুখের কোন জায়গায় বাধা পেয়ে নাক দিয়ে বের হবার পথে নাকের গহবরের অনুরণিত হয়ে বের হয়, এর ফলে নাসিক্যধ্বনির সৃষ্টি হয়। যেমন: /ঙ/ // //
ধ্বনি উচ্চারণের সময় স্বরযন্ত্রের অবস্থা, নরমতালু অবস্থা এবং শ্বাসবায়ুর চাপের পরিমাণগত তারতম্যের কারণে উচ্চারিত ধ্বনিতেও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়-
নরম তালুর অবস্থা নরমতালুর অবস্থানগত দিক থেকে বিচার করতে দেখা যায় নরমতালু খোলা বা বদ্ধ অবস্থায় থাকতে পারে। নরমতালু খোলা অবস্থায় বাতাস মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, ফলে মৌখিক ধ্বনির সৃষ্টি হয়। নরমতালু বন্ধ অবস্থায় নিচে নেমে আসে ফলে নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনির সৃষ্টি হয়।
স্বরযন্ত্রের অবস্থা : ধ্বনি উচ্চারণের সময় স্বরযন্ত্রের অবস্থা বিচার করে ব্যঞ্জনধ্বনিকে দু’ ভাগে ভাগ করা যায়: (ক) ঘোষধ্বনি (খ) অঘোষধ্বনি।
ঘোষধ্বনি: যে ধ্বনি উচ্চারণে স্বরতন্ত্রীর কম্পনজাত সুর মিশে থাকে, তা ঘোষধ্বনি। গ, ঘ, জ, ঝ, ড চ, দ, ধ, ব, ভ, হ: নাসিক্যধ্বনি, ন, ম, কম্পিত ধ্বনি র, পার্শ্বিক ল, তাড়িত ড়, ঢ় ইত্যাদি।
অঘোষধ্বনি: যেসব ধ্বনির সঙ্গে স্বরতন্ত্রীর কম্পনজাত সুর মিশে থাকে না, তাই অঘোষধ্বনি। যেমন ক, খ, চ, ছ, ট, ঠ, ত, থ, প, ফ, শ, স, ষ ।
ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময় বাতাসের চাপের স্বল্পতা ও আধিক্যের দিক থেকে ব্যঞ্জনধ্বনিগুলোকে দু’ ভাগে ভাগ করা যায় অল্প প্রাণ ও মহাপ্রাণ ।
অল্পপ্রাণ : উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ু অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে নির্গত হয় অল্পপ্রাণ ধ্বনিতে। বাংলা স্পষ্টধ্বনির মধ্যে বর্গের প্রথম ও তৃতীয় ধ্বনিগুলো অল্পপ্রাণ ধ্বনি, যেমন- ক, গ, চ, জ, ট, ড, ত, দ, প,
মহাপ্রাণ উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ু বেশি পরিমাণে এবং জোরে নির্গত হয় যেসব ধ্বনি উচ্চারণে সেগুলো হল মহাপ্রাণ ধ্বনি। বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধ্বনি মহাপ্রাণধ্বনি, যেমন- খ, ঘ, ছ, ক, ঠ, ঢ, থ,
ধ, ফ, ভ
প্রত্যেক ভাষায় প্রতিটি ধ্বনিরই একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। উচ্চারণগত প্রয়োগগত দিক থেকে তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে আত্মপ্রকাশ করে। তাই প্রমিত ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষার ধ্বনি উচ্চারণে পার্থক্য লক্ষণীয়। ধ্বনি উচ্চারণের ক্ষেত্রে প্রমিতভাষার চেয়ে আঞ্চলিক ভাষার উচচারণ অনেক বেশি হালকা বা লঘু, আর এর কারণ উচ্চারণ স্থান ব্যবহারের পার্থক্য।
গ্রামের নিরক্ষর, স্বল্পশিক্ষিত মানুষের অজ্ঞতাবশত এবং বাকযন্ত্রসমূহের আড়ষ্টতার জন্য ধ্বনি উচ্চারণের সময় যথাযথ স্থান স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়, তাই উচ্চারণস্থানগত তারতম্য সৃষ্ট হয়। গ্রামের মানুষেরা যে ধ্বনিগুলো সহজে উচ্চারণ করতে পারে তুলনামূলকভাবে সে ধ্বনি উচ্চারণের প্রতি আগ্রহবোধ করে।
ডেমরা অঞ্চল মূলত কলকারখানা সমৃদ্ধ শিল্পপ্রধান এলাকা। তাই এ অঞ্চলে শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। ডেমরার বসবাসরত স্বল্পশিক্ষিত নিরক্ষর দরিদ্র শ্রেণির মানুষ কথোপকথনে সহজবোধ্য উচ্চারণ প্রক্রিয়ার জন্য সৃষ্টধ্বনির উচ্চারণ বেশি করে থাকে। যেমন- প, ফ, ট, চ, ক, খ ইত্যাদি।
কণ্ঠনালীয় ধ্বনির আঞ্চলিক উচ্চারণের ক্ষেত্রে স্বরতন্ত্রীদ্বয় সংকুচিত হয়, ফলে শ্বাসবায়ু কণ্ঠনালির প্রশস্ত পথে প্রবাহিত হয়ে জিভ, তালু, দাঁত ও ঠোঁট সামান্য স্পৃষ্ট হয়ে বেরিয়ে যায়, ফলে উচ্চারিত ধ্বনিগুলো লঘু ও হালকা ধরনের হয়ে থাকে।
কন্ঠনালীয় ‘হ’ ধ্বনির উচ্চারণ ডেমরা অঞ্চলের ভাষায় প্রমিতভাষায় ন্যায় গাম্ভীর্যপূর্ণ নয়, একটু লঘুভাবে উচ্চারিত হয়। প্রশস্ত দন্তমূলীয় ভালব্যধ্বনির (চ, ছ, জ, ঝ) প্রমিত উচ্চারণ হয় উপরের পাটির দন্তমূল ও মধ্যতালুতে জিভের পাতার স্পর্শে। ডেমরার আঞ্চলিক উচ্চারণও প্রমিত ভাষার ন্যায়।
কিন্তু ডেমরা থানার সারুলিয়া ও রাণীমহল এলাকায় বহিরাগত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ‘চ’, ‘ছ’, ‘জ’, ‘ঝ’ উচ্চারণে জিভের পাতা দন্তমূলকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে জিভের ডগাও দাঁতের মাড়িকে স্পর্শ করে থাকে।
সৃষ্ট ঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলো – // // // ডেমরায় স্পষ্ট ঘোষ অল্পপ্রাণ ধ্বনিরূপে /গ/ // // উচ্চারিত হয়। ভাত > বাত, দুধ > দুদ, ঘাস > গাশ ইত্যাদি।
দন্তমূলীয় মূর্ধন্য ধ্বনির /ট/ /১/ /৬/ /৩/ উচ্চারণ স্থান প্রমিত বাংলা এবং আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় একই রকম, তবে ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় প্রমিতভাষার ন্যায় জিভের ডগা উল্টিয়ে দন্তমূলকে স্পর্শ করে না, বরং জিভের ডগা সামান্য বাঁকা হয়ে দাঁতকে স্পর্শ করে উচ্চারিত হয়।
ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় মূর্ধন্য ণ’ ধ্বনির ব্যবহার নেই সেক্ষেত্রে সর্বত্রই দন্ত্য ন’ ধ্বনি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন-হরিণ > অরিন, ঋণ > রিন ইত্যাদি। ডেমরার ভাষায় তাড়নজাত ধ্বনি ‘ড়’ এর প্রচলন নেই। // সবসময় / র/ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়ে ব্যবহৃত হয়।
শব্দমধ্যস্থিত ‘প’ ধ্বনি ‘ফ’ উষ্ম ধ্বনিরূপে উচ্চারিত হতে দেখা যায়। যেমন আপা > আফা, আপনের >
আফনের।
ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় শুধু একটি তালব্য-শ ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায়। /স/ও/ষ/ ধ্বনির প্রচলন ডেমরার ভাষায় দেখা যায় না।
গ্রামের সাধারণ মানুষ সহজ উচ্চারণযোগ্য ধ্বনির প্রতি আকর্ষণবোধ করে, তাই স্পৃষ্ট ঘোষধ্বনি, কম্পনজাত ধ্বনির উচ্চারণ জটিল হওয়ায় এ ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ আঞ্চলিক ভাষায় দেখা যায় না।
ব্যঞ্জনধ্বনির অবস্থানগত ব্যবহার
প্রমিত বাংলা বর্ণমালায় ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯টি, কিন্তু ডেমরার আঞ্চলিক উচ্চারণে এই ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণের অস্তিত্ব দেখা যায় না। ডেমরায় আঞ্চলিক ভাষায় ঘ, ঝ, ট, ণ, ধ, ভ, ষ, স, ড়, ঢ় প্রভৃতি বর্ণগুলো উচ্চারণ করার প্রবণতা দেখা যায় না। ২৫টি ব্যঞ্জনধ্বনি ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় ব্যবহৃত হয়। রূপমূলে আবস্থানিক দিক থেকে এই ব্যঞ্জনধ্বনি রূপমূলের আদি, মধ্য ও অন্তে অবস্থান করে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায়। নিচে ব্যঞ্জনধ্বনির অবস্থানগত ব্যবহার দেখান হয়েছে।
রূপমূলে ধ্বনির অবস্থান বিচার
ধ্বনি রূপমূলের আদিতে
/ক/
কাইজা (ঝগড়া
কাম (কাজ)
করাল (অঙ্গীকার)
কাউয়া (কাক)
কুনো (কোথায়)
করাল (প্রতিজ্ঞা)
কইতর (কবুতর)
কুনো (কোথায়)
কুয়ারা (ডং)
কেওর (দরজা)
/খ/
খামছি (চিমটি)
খেতা (কাঁথা)
খেত- (জমি/ ক্ষেত)
রূপমূলে মধ্যে
চটকনা (চড়)
আকাল (বুদ্ধি )
অকত (সময়)
কুচকুচানি (শখ নাইকল
(নারিকেল) উটকি
(বমি) কনক’ইনা
(তীব্র ঠাণ্ডা)
আউত্থা
(আখের গুর প্যাখনা
(ঢং করা) খুনখুইন্যা
(অতিবৃদ্ধ)
রূপমূলের অস্তে
রনডক (ভাগ করা)
মুক (মুখ)
আচানক (আশ্চর্য )
শুক (সুখ)
চৌক (চোখ)
বলক (ফুটানো)
বৈশাক (বৈশাখ)
দক (ঝাঝালো গন্ধ) অশুক (অসুখ)
প্যাথ (কাদামাটি)
কখনো কখনো রূপমূলের অস্তে /ক/ ধ্বনি ঘোষ জিহ্বামূলীয় দৃষ্ট ধ্বনি /গ/ ধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়।
গাও (ক্ষত/ঘা)
গপশা (মোটা)
গলা (নরম)
গাই (খোচা দেয়া)
শুনা (তার)
গিডু (পায়ের গোড়ালি )
গিলাপ (চাদর )
/6/
প্রমিত বাংলার ন্যায়
ডেমরার ভাষায় /ঙ/
রূপমূলের আদিতে
ব্যবহৃত হয় না।
চটকনা (চড় থাপ্পর)
15/
চাকা (ঢিল)
চলন (বিয়ের বরযাত্রা)
চুক্কা (টক)
চটান ( রাগানো)
চারা (নখ)
আমাগর (আমাদের)
গোপেগাপে (সুবিধামত)
গুংগান (ঝিমানো)
অগা (বোকা)
অগো ( ওদের)
এউগা (একটা)
হিগা (শেখা)
বেগার (কাজহীন অবস্থা )
হগলে (সকলে)
আঙো (আমাদের)
তোঙো (তোমাদের)
আড়া (হুক)
চঙো (মই)
একচাইটা (একতরফা
আচানক (আশ্চর্য)
পানচিনি (বিয়ের পাকাকথা হওয়া)
হাগ (শাক)
বগ (বক)
বাগ (বাঘ)
মেগ (মেঘ)
দাগ
মাগ (মাঘ মাস)
রঙ (রং)
ডঙ (ঢং)
হ্যাচ (সেচা)
প্যাচ (জটিলতা)
মোচ (মোছ)
মাচ (মাছ)
আচ (অনুমান করা )
আচ (আগুনের তাপ )
চিতনা (চ্যাপ্টা)
চাইড্ডা (অল্প পরিমাণ)
ছেরা (ছেলে)
ছেমরি (মেয়ে)
ছিলকা (খোসা)
ছিল্যা (খোসা ছাড়ানো)
ছেবলা (ছোচা ) ছাল (চামড়া)
জলা (হিংসা)
জেয়াফত (নিয়ন্ত্রণ)
জমা দেয়া (পরোয়া করা )
জিয়া (চাচি )
জিগাও (জিজ্ঞাসা করা )
জিবলা (জিহবা
//
যাহা (ঝাঁকা দেয়া)
যেরতেনে (যার কাছে)
যেতম (যখন)
টনক (শক্ত) টাসকি (চুপ হয়ে থাকা )
টেলকা (ঠান্ডা)
ট্যাটনামি (চালাকি)
টাকা/ টেকা (টাকা)
/ঠ/
ঠোলা (মাটির পাতিল )
ঠুলা (নেরামাথা)
ঠাডা (রাজপরা)
ঠুয়া (মাথায় ধাক্কা দেয়া)
ছেছা (মার দেয়া)
পিছা (ঝাডু)
কিছছা (গল্প)
জুপ্পা জোপ্পা (থোকা থোকা )
জুলজুলা (ডোলা) আজাইরা (
কর্মহীন) বাজান (বাবা)
গুইনযা (গুঁজে রাখা)
টনটন (ব্যথা) টরটইরা
(চালাক/দুষ্ট)
টেটায় ( হিংসা) গুইটা
(নাড়া দেয়া) মটকি
(চাল রাখার মাটির পাত্র)
ঠেলাঠেলি
(চাপাচাপি)
পোছ (মোছা)
গোছ (মাংস)
হাজ (সন্ধ্যা)
হাজ (সাজা)
লাজ (লজ্জা
কটকট (বেশি কথা বলা )
ডলা (কাপর ইস্ত্রি করা/পেষা)
ডনডি (জরিমানা)
ডক (সুন্দর)
ডাবের (মাটির পাত্র হুকায় ব্যবহৃত
ডুমা / ডোমা (ময়লা পরিষ্কার করার
ডেহি (ঢেকি)
ডেম (নতুন পাতা)
ডেকা (ধাক্কা)
তফন (লুঙ্গি /জামা)
তামুক (তামাক)
তেলাই (গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান)
আতায়/আতানো (হাত ছোঁয়ানো) অতিত (অতিথি)
/et/
থাপ্পর (চড়)
থাউক (থাক)
দুইফর (দুপুর)
দোয়াপাকলি (ধোয়া মোছা
দর (কলিজা)
দোনাইল্যা (দুই মুখ ওয়ালা)
দোনো (দুইজন )
দান (ধান)
/ন/
নাল (সমান / সমতল / সোজা )
নাগা (বন্ধ করা)
নিগরা (তলানি)
কতখন (কতক্ষণ)
কতা (কথা)
ষ্ঠান) ফাতরা (বাজে লোক )
য়ানো) জুত (ভাল, সুবিধা)
এইতলাক (এই পর্যন্ত)
থুরথইয়া (অতিবৃদ্ধ)
আথকা (হঠাৎ)
বদলা (বোকা)
বাদাইলা (মেঘলা)
বিদি কিছছি (বিশি)
শিদা (সোজা)
বোদাই (বোকা)
আদামাদা (অসম্পূর্ণ)
মদু (মধু)
আদোয়া (অপরিষ্কার)
পুশকুনি (পুকুর)
পোরানি (জ্বালা যন্ত্রণা)
বনডক (ভাগ করা)
বাত (ভাত)
জিফত (দাওয়াত)
আত (হাত)
তেলান ( তোষামোদ করা )
হিতান (বিছানা )
বলদ (বোকা)
বাদ ( বাতিল )
পোলাপান (ছোট ছেলেমেয়ে) ফুরণ (বাগার দেয়া)
বান (বর্ষা)
নিডাল (চুপচাপ)
বনদো (
নিয়া (নতুন)
বগনদা
নিনদান (ঘৃণা করা)
নকতা (ডং করা)
নাছ (নিচু
ন্যাওর (পায়জামার ফিতা)
নাডা (খাটো)
মাহান (গোসল)
নাগল (দেখা পাওয়া /সাক্ষাৎ )
নগে (সঙ্গে)
101/
পয়লা (প্রথম)
পচচিম (পশ্চিম)
পানশা (লবনহীন)
পাচহানো (নানাদিকে)
পলান (লুকিয়ে থাকা )
পহর (পাহারা)
পাখনা (চালাক )
পেক (কাদামাটি)
পাতালি (সোজা)
পিরোন (জামা)
পোকখি (পাখি)
ফিরি (পিডি)
/ফ/
ফুরন (বাগার দেয়া)
ফ্যাপশা (কুমকুম)
ফুইল্যা (রেগে থাকা )
বনদো (জমি/ক্ষেত)
বপনদা (পলানো )
পাইজন
সাক্ষাৎ )
আপিতত্যি (আপত্তি)
পাউপা (পেপে)
পাটিহাপড়া (পাটিশাপটা পিঠা)
আপুর (হামাগুড়ি)
উফরি (ঘুম)
আফা (আপা)
আফনে (আপনে) পাউফা (পেপে)
পাইজন (গরু তাড়ানোতে ব্যবহৃত বেত বা লাঠি)
পলপ (প্ৰলেপ) আদদোপ (ভদ্রতা/ আদব-কায়দা)
পিঠা)
পেশাপ (পস্রাব
ছ্যাপ (ধুধু)
লোপ ( লোভ )
হাপ (সাপ)
ফাগ (ফাক করা)
ফুট (ছবি)
ফরফর (চঞ্চল)
ফালাইন্যা (ফেলে দেয়া)
বকতি (আগ্রহ/প্রবৃত্তি)
বটকি (কান ধরে ওঠবস করা)
বেততমিজ (অসভ্য)
বননত (দ্রুত/চট করে )
বরকি (ছাগল)
বরতা (ভর্তা (চাটনি)
বনডক (ভাগ করা)
বিলাই (বিড়াল)
বশলের কাল (যৌবন সময়
বাইগ্য (ভাগ্য)
বাইল (ফাঁকি) বাও (অবস্থা )
বাউয় (ভাবী)
বার (মেঘলা)
/ম/
মেজবান (মেহমান)
মেলা (অনেক)
মুত (প্রস্রাব )
মামু (মামা
বগরবগর (বেশি কথা)
ৰোগ (সব)
বাহাবহি (বকাঝকা)
আবে (সম্বোধন)
শাবা (পরিষ্কার
দাবরি (ভাড়া দেয়া)
আবডাল (আড়াল)
বেবুদা (বোধহীন)
আমগো (আমাদের)
কামলা (ক্ষেতমজুর)
হেমুরা ( ওদিকে হেমুমকা
(তখন) মামানি (মামী
লোব ( লোভ )
পুৰ (পূর্ব) বুবু (দাদি)
ব্যারাম (রোগ/অসুখ
ওম (গরম)
গমগম (অনেক, আধিক্য)
হামদুম (হৈচৈ)
শ্রমিকশ্রেণির বেশিরভাগই অশিক্ষিত, তাই তাদের উচ্চারণসহায়ক বাগযন্ত্রের আড়ষ্টতা দ্রুত কথনভঙ্গি ও অজ্ঞতাবশতার জন্য ধ্বনি যথাযথভাবে উচ্চারিত হয় না। তাই অশিক্ষিতজনের মুখের উচ্চারণে কিছু কিছু ধ্বনি কোন না কোন ধ্বনির পরিপূরক ধ্বনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন-
ন ধ্বনি ব্যবহৃত হয় মূর্ধন্য ‘ণ’ ধ্বনির পরিপূরক হিসেবে।
জ ধ্বনি ব্যবহৃত হয় য, ঝ ধ্বনির পরিপূরক হিসেবে
শ ধ্বনি ব্যবহৃত হয় স, ষ, ধ্বনির পরিপূরক হিসেবে
র ধ্বনি ব্যবহৃত হয় ঢ় ড্র, ধ্বনির পরিপূরক হিসেবে
১.ডেমরা থানার আঞ্চলিক ভাষায় ধ্বনির অবস্থানগত দিক থেকে ব্যঞ্জনধ্বনির ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য নিচে তুলে ধরা হল:
২. ‘ক’ এর সঙ্গে ‘র’ ফলা থাকলে ‘ক’ প্রায়ই ‘এ’ ‘র’ ‘এ্যা’ পরিবর্তিত হয়ে উচ্চারিত হয়। যথা: চক্র>চক্কোর, ঘ্রাণ>গেরান ।
পদান্তের ‘ক’ এর উচ্চারণ ‘উয়াউক এ পরিণত হয়। যথা: কাক> কাউয়া যাক যাউক
৩. পদমধ্যে ও পদান্তে ব্যবহৃত /ক/ কখনও কখনও /গ/ তে পরিণত হয়-শাক হাগ।
8. পদান্তের ‘খ’ ডেমরার ভাষায় ‘ক’ তে পরিবর্তন হয়। যেমন সুখ>তক, অসুখ> শুশুক, মুখমুক ।
৫. ডেমরার ভাষায় ‘ঘ’ ও ‘ঢ’ ধ্বনির ব্যবহার নেই।
৬।প্রমিত বাংলার ন্যায় ‘ঙ’ ধ্বনিটি ডেমরার ভাষায় শব্দের মধ্য ও শেষে বসে, কিন্তু আদিতে বসে না।
…’ছ’ এর উচ্চারণ ‘চ’ এর মত উচ্চারিত হয়। মাছ মাচ
৮।’ষ’ এর উচ্চারণ ‘জ’ রূপে হয়।
৯।ডেমরার ভাষায় অনেক সময় ‘ট’, ‘ঠ’ এর উচ্চারণ ‘ড’-এ পরিণত হয়। খাট>খাড়, পাট> পাড, পিঠ>পিড, কাঠ কাট
10. “ধ’ ধ্বনিটি ডেমরা অঞ্চলের ব্যবহৃত হতে দেখা যায় না। সেক্ষেত্রে এই মহাপ্রাণ ধ্বনিটি অল্পপ্রাণরূপে উচ্চারিত হয়। এক্ষেত্রে মহাপ্রাণতা লোপ ঘটে। যেমন- দুধ > দুত, ‘ত’ বর্ণের প্রথম ধ্বনি।
বন্ধু > বনদু ‘দ’ বর্ণের তৃতীয় ধ্বনি ।
১১।ডেমরার ভাষায় ভবিষ্যৎকালের উত্তম পুরুষের ক্রিয়াপদ রূপমূলের শেষে ‘ব’ স্থানে ‘ম’ হয়। যেমন- যাবো > যামু, খাব> খামু, বসবো > বসু, বলবো > কমু, ওষ্ঠ্যধ্বনির স্থান নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি অধিকার করে।
১২.ডেমরার ভাষায় আদি, মধ্য ও অন্তে ব্যবহৃত প্রমিত ‘ভ’-এর উচ্চারণ ‘ব’ হয়। মহাপ্রাণ
অল্পপ্রাণ ধ্বনিতে পরিণত হয়।
১৩. রূপমূলে ‘র’ অনেক ক্ষেত্রে ‘ল’ উচ্চারিত হয়। যেমন শরীর > শইল ।
১৪, তিনটি ‘শ’, ‘খ’, ‘স’ এর মধ্যে শুধু একটি ‘শ’-এর ব্যবহার দেখা যায়। রূপমূলের প্রথমে শ, স, ষ থাকলে প্রায়ই তা ‘হ’ রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন-
সকাল > হকাল, সাপ > হাপ সে > হে, সেই > হেই, শোনা > হোনা, শুকান > হুগান, শিয়াল> হিয়াল, সত্য > হাচা ইত্যাদি।
১৫. বাংলা ক্রিয়াপদের ‘স’ ডেমরার ভাষায় লোপ পেয়ে ‘স’ এর স্থলে ‘ই’ এবং ‘হ’ হয় যেমন আসিল > আইল, এসেছে > আইছে, বসেছে > বইছে, বস > বহ, আস > আহ।
১৬. শব্দের আদিতে অবস্থিত ‘হ’ লোপ পায়। ‘হ’-এর সঙ্গে যুক্ত স্বরবর্ণের কোন পরিবর্তন হয় না। যেমন- হাত>আত, হাতি আতি, হাঁস আশ।
১৭. ডেমরার ভাষায় দুই স্তরের মধ্যবর্তী ‘খ’ ও ‘স’ ধ্বনি ‘হ’ হতে দেখা যায়। যেমন-লেখা>ল্যাহা, মাথা>মাহা, বসা বহা, আসস আহ ।
১৮ // ধ্বনি রূপমূলের অন্তে তুলনামূলক কম ব্যবহৃত হয়। // // ধ্বনি রূপমূলের অে
ব্যবহার নেই।
ব্যঞ্জনধ্বনির পরিবেশ বন্টন
- শব্দের শেষে মহাপ্রাণ ধ্বনির মহাপ্রাণতা লোপ ঘটে, অর্থাৎ শব্দের শেষে মহাপ্রাণধ্বনি উচ্চারিত
পথ > পত, মধু > মদু দুধ > দুদ - কখনো কখনো শব্দের শেষের অঘোষধ্বনি ঘোষধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। যেমন শাক হাগঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি মহাপ্রাণতা ত্যাগ করে কন্ঠনালীয় স্পর্শযুক্ত তৃতীয় ধ্বনিতে পরিণত হয়।
ঘর > গর, ধান > দান, ভয় > বয় । শ, ষ, স ধ্বনি ‘হ’ রূপে উচ্চারিত হয়। এবং
সে > হে, সকল > হুগল, শুনে > হুইনা - ডেমরার ভাষায় চন্দ্রবিন্দু ব্যবহৃত হয় না। ডেমরার ভাষায় ড়, ঢ়. ধ্বনি ‘র’ রূপে উচ্চারিত হয়। 5.
- . ডেমরার ভাষায় তিনটি // // /স/-এর স্থলে সর্বত্র একটি ‘শ’ ব্যবহৃত হয়। ‘ণ’ ডেমরার ভাষায় উচ্চারিত হয় না। সে ক্ষেত্রে দন্ত্য ‘ন’ উচ্চারিত হয়।
- ব্যঞ্জনধ্বনিগুলোর মধ্যে ‘ও’ রূপমূলের আদিতে কখনো বসে না। এর ব্যবহার রূপমূলের
অন্ত্য অবস্থানে সীমাবদ্ধ থাকে। - রূপমূলের অবস্থানভেদে একই ধ্বনি বিভিন্নরূপে অর্থাৎ রূপমূলের আদি, মধ্য ও অন্ত্য অবস্থানে ব্যবহৃত হয়। যেমন-‘হ’ ধ্বনির ব্যবহার আদি, মধ্য ও অন্য অবস্থানে হাচা (সত্য), বা
(বসা), আহ (আস)। - ডেমরার ভাষায় বর্গের প্রথম ধ্বনি তৃতীয় ধ্বনিতে পরিণত হতে দেখা যায়। অর্থাৎ
- ঘোষধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। যেমন- সাপ> হাপ, শাক>হাগ, সকল হল।
ব্যঞ্জনধ্বনির পরিবর্তন
প্রমিত ভাষা থেকে ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় ব্যঞ্জন ধ্বনির পরিবর্তনগুলো সূত্রাকারে নিচে দেখানে
হয়েছে।
মহাপ্রাণ ধ্বনির অল্পপ্রাণ ধ্বনিতে রূপান্তর
অঘোষধ্বনি
প্রমিত
অসুখ
‘ক’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত ‘খ’ ধ্বনি
গ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত ‘ঘ’ ধ্বনি
‘চ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত ‘ছ’ ধ্বনি
‘জ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত ‘ঝ’ ধ্বনি
‘ট’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত ‘ঠ’ ধ্বনি
‘ড’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত ‘ঢ’ ধ্বনি
‘
দ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত ‘ধ’ ধ্বনি
‘প’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত ‘ফ’ ধ্বনি
‘প’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত ‘ছ’ ধ্বনি ‘ব’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত ‘ভ’ ধ্বনি
পরোক<পরখ
বকশিশ <বখশিস
আগাত <আঘাত
ঘুষ<গুরি
বাগ<বাঘ
মার্চ<মাছ
গাচ<গাছ
মাজারো <মেঝো
সাজ<জালাফালা
ঝালাপালা<
কাট<কাঠ
পাঠিয়েপাটাইয়া>
ঢাকনা<ডাকনা
ডিল <ঢিল
দোয়া <ধোয়া
গোপ <গোঁফ
হেলোপ <হলফ
পোলা <ছেলে
বদদর <ভদ্র
বাগা <ভাঙ্গা
সবাই<ভাই
বাগগো <ভাগ্য
বিননো <ভিন্ন
বাপ<ভাপ
ছিলবর <সিলভার
বর্তন<খেতা
মহাপ্রাণতা (Aspiration )
বাংলা বর্ণমালায় সাধারণত বর্ণের ২য়, ৪র্থ ধ্বনি এবং ‘হ’ হল মহাপ্রাণ ধ্বনি। আর বর্ণের প্রথম ও তৃতীয় ধ্বনি অল্পপ্রাণ ধ্বনি। অল্পপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনি যখন মহাপ্রাণ ধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হয় অথবা (বর্ণের ১ম ও ৩য়) মহাপ্রাণ ধ্বনির সংস্পর্শে (বর্ণের ২য় ও ৪র্থ) এসে মহাপ্রাণ ব্যঞ্জনে রূপান্তরিত হয় তাকে মহাপ্রাণীভবন বলে।
ধ্বনির পরিবর্তন
প্রমিত আঞ্চলিক
নাচ > মাছ (nach) অল্পপ্রাণ ‘চ’ মহাপ্রাণ ‘ছ’ ধ্বনিতে রূপান্তরিত। হাত > হাথ (hath) অল্পপ্রাণ ‘ত’ মহাপ্রাণ ‘থ’
ধ্বনিতে রূপান্তরিত।
ত> ধ

মহাপ্রাণহীনতা (Deaspiration)
রূপমূলের মধ্যে অনেক সময় মহাপ্রাণ ধ্বনি মহাপ্রাণতা হারিয়ে অল্পপ্রাণতা লাভ করে। মহাপ্রাণ ধ্বনি গঠনের সময় ফুসফুস থেকে বাতাস বের হওয়ার সময় বাতাসের প্রবাহ হয় বেশি, কিন্তু যদি বহির্গামী বাতাসের চাপ কম থাকে তখন ধ্বনিগুলো মহাপ্রাণতা হারিয়ে ফেলে। ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় মহাপ্রাণহীন ধ্বনির প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়।
এ ভাষায় রূপমূলের আদি, মাঝে ও শেষে মহাপ্রাণধ্বনি লোপ পায়। যেমন-
ক. রূপমূলের আদিতে
ডেমরা অঞ্চলের ভাষায় শব্দের শুরুতে ঘোষ মহাপ্রাণ বর্ণ (ঘ, ঝ, ঢ, ধ, ড) যথাযথভাবে উচ্চারিত হয় না। ঘোষ মহাপ্রাণধ্বনি (ঘ, ঝ, ঢ, ধ, ভ) মহাপ্রাণতা ত্যাগ করে ঘোষ অল্পপ্রাণধ্বনি (গ, জ ড দ ব ) রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন-
ঘর
গর (ghor > gar),
দান (dhan > dan),
ধ্বনির পরিবর্তন ঘ> গ
ধ্বনির পরিবর্তন ধ>
ভয় >
ঢাকা >
বয় (bhay >bay),
ধ্বনির পরিবর্তন ড>ব
ডাহা (dhakadaha) ধ্বনির পরিবর্তন ঢ>ড
ঝড়>জর (jhor)
ভাত>ধাক্কা
ৰাত (bat) ডেকা (dekka)
ধবনির পরিবর্তন ড এব
ধবনির পরিবর্তন ধ>ড
রূপমূলের মাঝে
ডেহি (dehi)
ধবনির পরিবর্তন চ>ড
ঢেকি >
কাঠাল >কাডল (kadal)
ধবনির পরিবর্তন ঠ >
গ. রূপমূলের শেষে
উচ্চারণের সময় শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাত থাকলে শব্দের অন্তে অবস্থিত মহাপ্রাণ ধ্বনির মহাপ্রাণতা লোপ ঘটে। অর্থাৎ অল্পপ্রাণ ধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়। যেমন:
প্রমিত
আঞ্চলিক
বাঘ > বাগ (bagh bag) >
ধ্বনির পরিবর্তন ঘ
দুধ >দুদ (dudh > dud)
ধ্বনির পরিবর্তন ধ
ধ্বনির পরিবর্তন ধ >
মধু > মদু (modhu>madu
পথ>পত (poth > pot)
ধ্বনির পরিবর্তন এ >ত
শুক (fuk)
ধ্বনির পরিবর্তন খ এক
Λ মটি (mat) माঠ
ধ্বনির পরিবর্তন ঠ >ট
কাঠ >ঢেকি
ধ্বনির পরিবর্তন ঠ >ট
ধ্বনির পরিবর্তন চ>ড
কাট (kat) ডেহি (dehi)
গ. ডেমরার ভাষায় / ২/ মহাপ্রাণধ্বনি বেশি ব্যবহৃত হয়।
রূপমূল মধ্যস্থিত অঘোষ অল্পপ্রাণ ‘ক’ /k/ ও অঘোষ মহাপ্রাণ খ / kh/ ধ্বনি সাধারণত ঘোষ মহাপ্রাণ
‘হ’ /h/ ধ্বনিতে উচ্চারিত হয়। যেমন:
দেখি > দেহি খ>হ (dekhi > dehi) kh> h
পুকুর > পুহুর (pukur pahur) কই (kh)।
স/শ/ষ ধ্বনি রূপমূলে প্রথমে থাকলে ‘হ’ / h/ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। মাঝখানে বা শেষে থাকলেও
এ পরিবর্তন দেখা যায়।
রূপমূলের প্রথমে-
শালা > হালা (Falahala)
সে > হ্যায় / হে (fe hay / he
রূপমূলের মাঝে-
আসেন > আছেন (afenahen
বসেন > বহেন (bajen bahen
রূপমূলের শেষে-
বস > বহু (baja baba)
আস > আহ (aja> aho) ইত্যাদি।
সংযুক্ত ব্যঞ্জন
শ্রমিকশ্রেণির ভাষায় সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। প্রমিত ভাষায় সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি গঠনে দুটো ব্যঞ্জনধ্বনি একই প্রয়াস উচ্চারিত হয়, কিন্তু ডেমরা অঞ্চলে সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি দুটো অংশে ভেঙে উচ্চারিত হয় এবং স্বরধ্বনি দিয়ে শেষ হয়। সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি সবসময় অসমশ্রেণির ব্যঞ্জনধ্বনি দ্বারা গঠিত। সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি ডেমরার আঞ্চলিক উচ্চারণে রূপমূলের প্রথমে, মধ্যে ও শেষে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ব্যবহৃত হয়।
১. রূপমূলের প্রথমে ব্যবহৃত সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি
প্রমিত
ক্লান্ত >
আঞ্চলিক
কেলানতো (kelanto)
ইশতিরি (iftiri)
প্রায় > পরায় (poral)
প্রাণ > পরান (poran)
ঘ্রাণ>গেরান (geran)
সৃষ্টি > শিরিশটি (firifti)
A স্মৃতি শিরিতি (firiti)
বিরিশটি (birijti)
২. রূপমূলের মাঝে ব্যবহৃত সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি
বিশ্রাম >বিছরাম (bichram)
৩. রূপমূলের শেষে ব্যবহৃত সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্ব
প্রমিত আঞ্চলিক
ক্লান্ত > কেলানতো (kelanto)
স্ত্রী > ইশতিরি (ijtiri)
আরও দেখুন: