আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় যৌবনে দাও রাজটিকা ১
যৌবনে দাও রাজটিকা ১
যৌবনে দাও রাজটিকা ১
ভূমিকা
বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে একক ও অনন্য। শুধু গদ্যভঙ্গিই নয়, বিষয় নির্বাচনেও তিনি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। তিনি ছিলেন মূলত যৌবন বন্দনাকারী। জড়তাগ্রস্ত স্থবির বাঙালি সমাজজীবনে প্রাণসঞ্চার ও নবজীবন প্রতিষ্ঠাই ছিলো তাঁর কাম্য।
‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী দৈহিক যৌবনের চেয়ে সামাজিক যৌবনের অধিক প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে একে রাজসম্মানে ভূষিত করতে বলেছেন। প্রবন্ধটিতে প্রমথ চৌধুরীর স্বতন্ত্র গদ্যরীতির পরিচয়ও লভ্য।
লেখক পরিচিতি
প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট পাবনা জেলার হরিপুরে জমিদার চৌধুরী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দুর্গাদাস চৌধুরী। প্রমথ চৌধুরীর শিক্ষাজীবন বিচিত্র ধারায় অগ্রসর হয়। তিনি কলিকাতা ডেভিড হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে প্রথম শ্রৌণতে বি.এ পাশ করেন। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শ্রেণীতে ইংরেজি বিষয়ে এম.এ পাশ করে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আইন পড়তে যান ইংল্যান্ড।
সেখান থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে কলিকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। পরে আইন কলেজেও অধ্যাপনা করেন। বিবাহ করেন ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে; কনে ইন্দিরা দেবী। ইন্দিরা দেবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা। প্রথম চৌধুরী আইনজীবী হলেও সুকুমার সাহিত্যচর্চাকে তিনি সর্বদা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং নিজেও ছিলেন সে-পথের পথিক। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনায় প্রথম চৌধুরী যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ভাষায় সুষম বিন্যাস ও অলঙ্কারের যথাযথ প্রয়োগ তাঁর রচিত কবিতাকে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করে। সনেট রচয়িতা হিসেবেও তাঁর পরিচয় সমধিক। মূলত ইটালীয় সনেট রীতিকে তিনি অনুসরণ করেছেন। শব্দচয়ন, তীক্ষ্ণ, উজ্জ্বল ও চাপা ব্যঙ্গের সরসতায় তাঁর কাব্যদেহ গঠিত। ছোটগল্প রচনাতেও তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভা ও উজ্জ্বল ভাষাশিল্পের দুর্লভ সমন্বয় ঘটেছে।
তিনি কিছুটা আয়াস-সাধ্য রীতিতে গল্প উপস্থাপন করলেও সে কৃত্রিমতা স্পষ্ট না হয়ে বরং অধিক হৃদয়গ্রাহ্য হয়ে উঠেছে তাঁর কারুকার্যময়তা। তিনি যে প্রবন্ধাবলী রচনা করেন তাতে চলিত কথ্যভাষার মার্জিত প্রয়োগ দেখা যায়। প্রখর বুদ্ধিদীপ্তি, অপূর্ব বাকচাতুর্য, পরিশীলিত রুচি, বলিষ্ঠ যুক্তিপ্রবণতা এবং সুমধুর অথচ ধারালো হাস্যরসাত্মক ভঙ্গির সাহায্যে তিনি বাংলা গদ্যকে নতুন করে প্রাণদান করেন।
‘ভারতী’ (১৮৭৭) পত্রিকায় প্রকাশিত ‘হালখাতা’ তাঁর চলিত রীতির প্রথম রচনা। পরে তা ‘বীরবলের হালখাতা” নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক ‘সবুজপত্র’ নামক সাহিত্য পত্রিকা। পত্রিকাটি বাংলা গদ্যের উন্নতি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রমথ চৌধুরীর উলে- খযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে: ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ (১৯১৩), ‘বীরবলের হালখাতা’ (১৯১৬), ‘চার-ইয়ারী কথা’ (১৯১৬), ‘পদ- চারণ’ (১৯১৯), ‘প্রবন্ধ-সংগ্রহ’ (১৯৫২-৫৩)।
পাঠ পরিচিতি
প্রমথ চৌধুরীর নিজের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার ১৩২১ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ নামক তাঁর প্রবন্ধ প্রথম মুদ্রিত হয়। প্রবন্ধটি মূলত সমালোচনাধর্মী। ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর কবিতা ‘সবুজ পাতার গান। এতে কবি যৌবনের জয়গান করেন এবং যৌবনকে রাজটিকা পরাবার প্রস্তাব দেন। এর সমালোচনায় মুখর হন তৎকালীন কতিপয় ব্যক্তি।
প্রমথ চৌধুরী এই সমালোচকদের বক্তব্যের জবাবে ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধটি রচনা এবং তা ‘বীরবল’ ছদ্মনামে ‘সবুজপত্রে’ প্রকাশ করেন। পরে তা ‘বীরবলের হালখাতা’ গ্রন্থভুক্ত হয়। প্রমথ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর প্রবন্ধগুলোর সমন্বয়ে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হয় অতুলচন্দ্র গুপ্ত সংকলিত ‘প্রবন্ধ-সংগ্রহ’ নামক গ্রন্থ। প্রবন্ধটি এর দ্বিতীয় খন্ডের ‘বিচিত্র’ শিরোনামের অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।
এখানে মূলত যৌবনের জয়গান করা হয়েছে। মানব জীবনে যৌবনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে প্রবন্ধকার দেখাতে চেয়েছেন যে, যৌবন বয়সের ব্যাপার নয়, মনের ব্যাপার। তিনি মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। ব্যক্তি-জীবনে যেমন, তেমনি সামাজিক জীবনেও এই মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠার কথা ব্যক্ত হয়েছে প্রবন্ধটিতে। সেদিক থেকে প্রবন্ধটির নামকরণ যথাযথ হয়েছে বলা চলে।
প্রবন্ধের সূচনায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা প্রসঙ্গে জনৈক টীকাকারের বক্তব্যের কিছু অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমথ চৌধুরী নিজের অভিমত তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। আমাদের সমাজ জড়তাগ্রস্ত ও স্থবির। কারণ এখানে যৌবনের চতুর্দিকে অদৃশ্য দেয়াল তুলে রাখা হয়। এ সমাজ যৌবনকে আত্তীকরণের বদলে অতিক্রম করতে চায়। ব্যক্তির দৈহিক যৌবন ক্ষণস্থায়ী ও সামান্য। কিন্তু মানসিক যৌবন অপরিসীম এবং এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী।
এই মানসিক যৌবনকে সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি। অথচ, আমাদের শিল্প-সাহিত্যে এর আয়োজন নেই। সংস্কৃত সাহিত্যে যৌবন আছে, কিন্তু তা একান্তই দেহ নির্ভর। সেখানে সৃষ্টিধর্মের চেয়ে ভোগস্পৃহাই অধিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কৌশাম্বির যুবরাজ উদয়ন ও কপিলাবস্তুর যুবরাজ সিদ্ধার্থ উভয়েই সমসাময়িক ছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্যে সিদ্ধার্থ অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের স্থান অতি সামান্য হলেও উদয়ন-কথকতা এর বহু স্থান জুড়ে।
গৌতম বুদ্ধ ত্যাগ ও নির্বাণ লাভের পথ অনুসরণ করেছেন, আর উদয়ন ছিলেন কামকেলিতে মত্ত। সংস্কৃত সাহিত্যে কামের স্থান হলো, কিন্তু ত্যাগধর্ম মূল্য পেলো না । আমরা যৌবনকে সন্দেহের চোখে দেখি। কারণ সেখানে সৃষ্টিশীলতা কেউ আবিষ্কার করেন নি। যৌবন আমাদের বিচারে উন্মত্ততার প্রতীক, তাই বিপদজনক। পন্ডিতগণ তাই তাঁদের শিল্প-সাহিত্যে শৈশব থেকে এক লাফে বার্ধক্যে পৌঁছতে পরামর্শ দেন।
তাঁদের শিক্ষানীতি ছাত্রদের রাতারাতি ইঁচড়ে পাকা বানাবার জন্যে তৈরি। এর ফলে আমাদের সমগ্র জাতি যেন এক অকাল-বার্ধক্য আর অন্তঃসারশূন্য জ্ঞানভারে নুয়ে পড়ছে এবং এটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে সবার কাছে। অথচ যৌবনে কামের পাশাপাশি আছে প্রেম, ইন্দ্রিয়বিলাসের পাশাপাশি সৃষ্টির প্রেরণা, অদম্য আবেগের পাশাপাশি শান্তির স্থিতি। যৌবনে যাঁরা শুধু নেতি ও উশৃঙ্খলতার গন্ধ খোঁজেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে এর ইতিবাচক দিকটি কৌশলে এড়িয়ে যেতে চান।
কারণ তাঁরা ভয় পান যৌবনকে। এই আতঙ্কগ্রস্ততার ফলে আমাদের জীবন নামক গ্রন্থটির ভূমিকা (শৈশব) আছে, উপসংহার (বার্ধক্য) আছে কিন্তু ভেতরের সব কিছুই পরিত্যাজ্য। অর্থাৎ যৌবন নেই। প্রমথ চৌধুরী এই যৌবনকে যথাযোগ্য মর্যাদা দানের কথা বলেছেন। দৈহিক যৌবন অনিত্য বলে মানসিক যৌবনের বন্দনা করেছেন তিনি। দেহের যৌবন অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করা যায় না, কিন্তু মনের যৌবন দিয়ে অন্যকে উদ্দীপ্ত করা সম্ভব।
সমাজজীবনে প্রতিনিয়ত নতুন চিন্তাধারা, নতুন আশা-আকাক্ষা এবং আত্ম-প্রণোদনা জাগিয়ে একে প্রগতিমুখী করার মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে সম্ভব যথাযথ যৌবন-বন্দনার।
মূলপাঠ
গত মাসের সবুজপত্রে শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যৌবনকে রাজটিকা দেবার প্রস্তাব করেছেন। আমার কোনো টীকাকার বন্ধু এই প্রস্তাবের বক্ষ্যমাণ-রূপ ব্যাখ্যা করেছেন — ‘যৌবনকে টিকা দেওয়া অবশ্যকর্তব্য, তাহাকে বসন্তের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য। এ স্থলে রাজটিকা অর্থ – – রাজা অর্থাৎ যৌবনের শাসনকর্তা কর্তৃক তাহার উপকারার্থে দত্ত যে টিকা, সেই টিকা। উক্ত পদ তৃতীয়াতৎপুরুষ সমাসে সিদ্ধ হইয়াছে।
উলিখিত ভাষ্য আমি রহস্য বলে মনে করতুম যদি-না আমার জানা থাকত যে, এ দেশে জ্ঞানী ব্যক্তিদিগের মতে মনের বসন্তঋতু ও প্রকৃতির যৌবনকাল- – দুই অশায়েস্তা, অতএব শাসনযোগ্য। এ উভয়কে জুড়িতে জুতলে আর বাগ মানানো যায় না; অতএব এদের প্রথমে পৃথক্ ক’রে পরে পরাজিত করতে হয়। বসন্তের স্পর্শে ধরণীর সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে; অবশ্য তাই বলে পৃথিবী তার আলিঙ্গন হতে মুক্তিলাভ করবার চেষ্টা করে না, এবং পোষ-মাসকেও বারোমাস পুষে রাখে না।
শীতকে অতিক্রম করে বসন্তের কাছে আত্মসমর্পণ করায় প্রকৃতি যে অর্বাচীনতার পরিচয় দেয় না, তার পরিচয় ফলে। প্রকৃতির যৌবন শাসনযোগ্য হলেও তাকে শাসন করবার ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই; কেননা, প্রকৃতির ধর্ম মানবধর্মশাস্ত্রবহির্ভূত। সেই কারণে জ্ঞানীব্যক্তিরা আমাদের প্রকৃতির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে বারণ করেন, এবং নিত্যই আমাদের প্রকৃতির উলটো টান টানতে পরামর্শ দেন; এই কারণেই মানুষের যৌবনকে বসন্তের প্রভাব হতে দূরে রাখা আবশ্যক।
অন্যথা, যৌবন ও বসন্ত এ দুয়ের আবির্ভাব যে একই দৈবশক্তির লীলা – এইরূপ একটি বিশ্বাস আমাদর মনে স্থানলাভ করতে পারে।
এ দেশে লোকে যে যৌবনের কপালে রাজটিকার পরিবর্তে তার পৃষ্ঠে রাজদন্ড প্রয়োগ করতে সদাই প্রস্তুত, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। এর কারণ হচ্ছে যে, আমাদের বিশ্বাস মানবজীবনে যৌবন একটা মস্ত ফাঁড়া – কোনোরকমে সেটি কাটিয়ে উঠতে পারলেই বাঁচা যায়।
এ অবস্থায় কি জ্ঞানী, কি অজ্ঞানী সকলেই চান যে, একলক্ষে বাল্য হতে বার্ধক্যে উত্তীর্ণ হন। যৌবনের নামে আমরা ভয় পাই, কেননা তার অন্তরে শক্তি আছে। অপরপক্ষে বালকের মনে শক্তি নেই, বৃদ্ধের দেহে শক্তি নেই, বালকের জ্ঞান নেই, বৃদ্ধের প্রাণ নেই। তাই আমাদের নিয়ত চেষ্টা হচ্ছে দেহের জড়তার সঙ্গে মনের জড়তার মিলন করা, অজ্ঞতার সঙ্গে বিজ্ঞতার সন্ধিস্থাপন করা।
তাই আমাদের শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে ইঁচড়ে পাকানো, আর আমাদের সমাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে জাগ দিয়ে পাকানো। আমাদের উপরোক্ত চেষ্টা যে ব্যর্থ হয়নি তার প্রমাণ আমাদের সামাজিক জীবন।
আজকের দিনে এ দেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে একদিকে বালক, অপরদিকে বৃদ্ধ; সাহিত্যক্ষেত্রে একদিকে স্কুলবয়, অপরদিকে স্কুলমাস্টার; সমাজে একদিকে বাল্যবিবাহ, অপরদিকে অকালমৃত্যু; ধর্মক্ষেত্রে একদিকে শুধু ইতি ইতি, অপরদিকে শুধু নেতি নেতি ; অর্থাৎ একদিকে লোষ্ট্রকাষ্ঠও দেবতা, অপরদিকে ঈশ্বরও ব্রহ্ম নন। অর্থাৎ আমাদের জীবনগ্রন্থে প্রথমে ভূমিকা আছে, শেষে উপসংহার আছে; ভিতরে কিছু নেই।
এ বিশ্বের জীবনের আদি নেই, অন্ত নেই, শুধু মধ্য আছে; কিন্তু তারই অংশীভূত আমাদের জীবনের আদি আছে, অন্ত আছে; শুধু মধ্য নেই । বার্ধক্যকে বাল্যের পাশে এনে ফেললেও আমরা তার মিলনসাধন করতে পারি নি; কারণ ক্রিয়া বাদ দিয়ে দুটি পদকে জুড়ে এক করা যায় না। তাছাড়া যা আছে তা নেই বললেও তার অস্তিত্ব লোপ হয়ে যায় না। এ বিশ্বকে মায়া বললেও তা অস্পৃশ্য হয়ে যায় না, এবং আত্মাকে ছায়া বললেও তা অদৃশ্য হয়ে যায় না।
বরং কোনো-কোনো সত্যের দিকে পিঠ ফেরালে তা অনেক সময়ে আমাদের ঘাড়ে চড়ে বসে। যে যৌবনকে আমরা সমাজে স্থান দিই নি, তা এখন নানা বিকৃতরূপে নানা ব্যক্তির দেহ অবলম্বন করে রয়েছে। যাঁরা সমাজের সুমুখে জীবনের শুধু নান্দী ও ভরতবচন পাঠ করেন, তাঁদের জীবনের অভিনয়টা যবনিকার অন্তরালেই হয়ে থাকে। রুদ্ধ ও বদ্ধ করে রাখলে পদার্থমাত্রই আলোর ও বায়ুর সম্পর্ক হারায়, এবং সেইজন্য তার গায়ে কলঙ্ক ধরাও অনিবার্য। গুপ্ত জিনিসের পক্ষে দুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক।
আমরা যে যৌবনকে গোপন করে রাখতে চাই, তার জন্য আমাদের প্রাচীন সাহিত্য অনেক পরিমাণে দায়ী। কোনো বিখ্যাত ইংরেজ লেখক বলেন যে, literature হচ্ছে criticism of life; ইংরেজি সাহিত্য জীবনের সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্য হচ্ছে যৌবনের আলোচনা। সংস্কৃত সাহিত্যে যুবকযুবতী ব্যতীত আর কারও স্থান নেই। আমাদের কাব্যরাজ্য হচ্ছে সূর্যবংশের শেষ নৃপতি অগ্নিবর্ণের রাজ্য, এবং সে দেশ হচেছ অষ্টাদশবর্ষদেশীয়াদের স্বদেশ।
যৌবনের যে ছবি সংস্কৃত দৃশ্য কাব্যে ফুটে উঠেছে, সে হচ্ছে ভোগবিলাসের চিত্র। সংস্কৃত কাব্যজগৎ মাল্যচন্দনবনিতা দিয়ে গঠিত এবং সে জগতের বনিতাই হচ্ছে স্বর্গ, ও মাল্যচন্দন তার উপসর্গ। এ কাব্যজগতের স্রষ্টা কিংবা দ্রষ্টা কবিদের মতে প্রকৃতির কাজ হচ্ছে শুধু রমণীদেহের উপমা জোগানো, পুরুষের কাজ শুধু রমণীর মন জোগানো।
হিন্দুযুগের শেষ কবি জয়দেব নিজের কাব্যসম্বন্ধে স্পষ্টাক্ষরে যে কথা বলেছেন, তাঁর পূর্ববর্তী কবিরাও ইঙ্গিতে সেই একই কথা বলেছেন। সে কথা এই যে, , ‘যদি বিলাস-কলায় কুতূহলী হও তো আমার কোমলকান্ত পদাবলী শ্রবণ করো।’ এককথায় যে যৌবন য্যাতি নিজের পুত্রদের কাছে ভিক্ষা করেছিলেন, সংস্কৃত কবিরা সেই যৌবনেরই রূপগুণ বর্ণনা করেছেন।
এ কথা যে কত সত্য, তা একটি উদাহরণের সাহায্যে প্রমাণ করা যেতে পারে। কৌশাম্বির যুবরাজ উদয়ন এবং কপিলাবস্তুর যুবরাজ সিদ্ধার্থ উভয়ে সমসাময়িক ছিলেন। উভয়েই পরম রূপবান্ এবং দিব্য শক্তিশালী যুবাপুরুষ; কিন্তু উভয়ের মধ্যে প্রভেদ এইটুকু যে, একজন হচ্ছেন ভোগের আর একজন হচ্ছেন ত্যাগের পূর্ণ অবতার।
ভগবান গৌতমবুদ্ধের জীবনের ব্রত ছিল মানবের মোহনাশ করে তাকে সংসারের সকল শৃঙ্খল হতে মুক্ত করা; আর বৎসরাজ উদয়নের জীবনের ব্রত ছিল ঘোষবর্তী বীণার সাহায্যে অরণ্যের গজকামিনী এবং অন্তঃপুরের গজগামিনীদের প্রথমে মুগ্ধ ক’রে পরে নিজের ভোগের জন্য তাদের অবরুদ্ধ করা। অথচ সংস্কৃত কাব্যে বুদ্ধচরিতের স্থান নেই, কিন্তু উদয়নকথায় তা পরিপূর্ণ ।
সংস্কৃত ভাষায় যে বুদ্ধের জীবনচরিত লেখা হয়নি, তা নয়; তবে ললিতবিস্তরকে আর কেউ কাব্য বলে স্বীকার করবেন না, এবং অশ্বঘোষের নাম পর্যন্তও লুপ্ত হয়ে গেছে। অপরদিকে উদয়ন – বাসবদত্তার কথা অবলম্বন করে যাঁরা কাব্যরচনা করেছেন, যথা ভাস গুণাঢ্য সুবন্ধু ও শ্রীহর্ষ ইত্যাদি, তাঁদের বাদ দিলে সংস্কৃত সাহিত্যের অর্ধেক বাদ পড়ে যায়।
কালিদাস বলেছেন যে, কৌশাম্বির গ্রামবৃদ্ধেরা উদয়নকথা শুনতে ও বলতে ভালোবাসতেন; কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কেবল কৌশাম্বির গ্রামবৃদ্ধ কেন, সমগ্র ভারতবর্ষের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই ঐ কথা-রসের রসিক। সংস্কৃত সাহিত্য এ সত্যের পরিচয় দেয় না যে, বুদ্ধের উপদেশের বলে জাতীয় জীবনে যৌবন এনে দিয়েছিল, এবং উদয়নের দৃষ্টান্তের ফলে অনেকের যৌবনে অকালবার্ধক্য এনে দিয়েছিল।
বৌদ্ধধর্মের অনুশীলনের ফলে রাজা অশোক লাভ করেছিলেন সাম্রাজ্য; আর উদয়নধর্মের অনুশীলন করে রাজা অগ্নিবর্ণ লাভ করেছিলেন রাজযক্ষ্মা। সংস্কৃত কবিরা এ সত্যটি উপেক্ষা করেছিলেন যে, ভোগের ন্যায় ত্যাগও যৌবনেরই ধর্ম। বার্ধক্য কিছু অর্জন করতে পারে না ব’লে কিছু বর্জনও করতে পারে না। বার্ধক্য কিছু কাড়তে পারে না ব’লে কিছু ছাড়তেও পারে না – দুটি কালো চোখের জন্যও নয়, বিশ কোটি কালো লোকের জন্যও নয়।
শব্দার্থ ও টীকা
সবুজপত্র – প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষায় চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় এই পত্রিকা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে এক লেখক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন পত্রিকাটির নিয়মিত লেখক।
সত্যেন্দ্ৰনাথ দত্ত – জন্ম ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে, মৃত্যু ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কবি, তবে রবীন্দ্রানুসারী নন। কবিতায় নানা ধরনের ছন্দের সফল ব্যবহারের জন্যে তিনি ‘ছন্দের যাদুকর’ বলে পরিচিত।
রাজটিকা – রাজ্যাভিষেককালে রাজার ললাটে অঙ্কিত তিলক। এখানে স্বীকৃতি’ অর্থে।
জুড়িতে জুতলে— একত্রে গ্রহণ করলে। এখানে প্রাকৃতিক যৌবন বসন্তকাল ও মানবের যৌবনকে গাড়ির পাশাপাশি দুই গরুর মতো সম্মিলনের কথা বলা হয়েছে। মানবধর্মশাস্ত্রবহির্ভূত – মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও আচরিত রীতিনীতির বাইরে। প্রযোজ্য।
রাজদন্ড – রাজপদের নিদর্শনস্বরূপ রাজা যে দন্ড হস্তে বহন করেন; রাজবিধি অনুযায়ী শাস্তি। — এখানে দ্বিতীয় অর্থটি
লোষ্ট্রকাষ্ঠ – পাথর ও গাছপালা ইত্যাদি।
নান্দী – নাটকের প্রারম্ভে মঙ্গলাচরণ।
ভরতবচন – নাটক শেষে মঙ্গল কামনা।
অগ্নিবর্ণ – সংস্কৃত কবি কালিদাস রচিত ‘রঘুবংশ’ মহাকাব্যের একটি চরিত্র। এখানে উলেখ আছে, রাজা সুদর্শনের পুত্র – অগ্নিবর্ণ অর্থাৎ রাম। তাঁর রাজ্যে দৈহিক যৌবনের বড় বাড়াবাড়ি ছিলো।
অষ্টাদশবর্ষীদেশীয়াদের স্বদেশ— অগ্নিবর্ণের রাজ্য। সেখানে আঠার বছর বয়সী যুবতীদের প্রাধান্য ছিলো এবং তারা
কামকেলিতে মত্ত থাকতো ।
মাল্যচন্দনবনিতা— মালা চন্দন ও নারী।
জয়দেব—মাদশ শতকের সংস্কৃত কবি। তিনি রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি ছিলেন। ‘গীতগোবিন্দম্ তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থে রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়লীলাকে উপলক্ষ করে আদিরসই প্রাধান্য পেয়েছে।
বিলাস-কলায় কুতূহলী হওয়া— মিলন বা প্রমোদের চরম মুহূর্ত সম্পর্কে অধিকতর আগ্রহান্বিত হওয়া।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের উত্তর লিখুন
১. আমাদের সমাজে প্রাচীনপন্থী পন্ডিতগণ যৌব-ধৰ্ম বলতে প্রধানত কী বুঝিয়ে থাকেন ?
২. সমাজে যৌবনের দুষ্ট প্রকাশ ঘটে কেন?
৩. সংস্কৃত কবিগণ যৌবনের কোন্ দিকটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন?
৪. যৌবনের প্রকৃত ধর্ম কি?
২ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর:
‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন যে, গুপ্ত জিনিসের পক্ষে দুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। যৌবনকে গুপ্ত অবস্থায় রাখলে সে-ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের জীবনে তার যৌবনকাল আগমন এক অনিবার্য সত্য। প্রকৃতিতে যেমন বসন্তকাল আসে মানবজীবনেও তেমনি আসে যৌবনকাল। কিন্তু প্রাচীনপন্থী পন্ডিত বা সমাজপতিদের বিবেচনায় মানুষের যৌবন অনেক ক্ষেত্রে ধর্মশাস্ত্রবহির্ভূত কার্যে লিপ্ত হয়।
তাই তারা পারতপক্ষে যৌবধর্মকে গুপ্ত রাখতে চান। তাদের তৈরি সমাজ বা শিক্ষানীতিতে বালককে এক ধাপে বার্ধক্যে পৌঁছে যাবার পরামর্শ দেয়া হয়। এ কারণে যৌবন থেকে যায় গুপ্ত আর বালক প্রকৃত যুবক হবার বদলে হয়ে ওঠে ইঁচড়ে পাকা। এরাই সমাজে ও ব্যক্তিজীবনেও নানা অপরাধের জন্ম দিয়ে থাকে। পদার্থের ধর্ম যেমন, মানুষের মনোগত বৈশিষ্ট্যও তেমনি- এর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হলে তার উল্টো ফল ফলে।
প্রসঙ্গ উলেখ করে ব্যাখ্যা লিখুন
১. যৌবনের টিকা দেওয়া অবশ্যকর্তব্য, তাহাকে বসন্তের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য।
২. আমাদের জীবনগ্রন্থে প্রথমে ভূমিকা আছে, শেষে উপসংহার আছে, ভিতরে কিছু নেই ।
৩. গুপ্ত জিনিসের পক্ষে দুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। ৪. ভোগের ন্যায় ত্যাগও যৌবনের ধর্ম।
২ নং ব্যাখ্যার নমনা-উত্তর
উদ্ধৃতাংশটুকু প্রথম চৌধুরীর ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এই বাক্যটির মাধ্যমে প্রবন্ধকার আমাদের যৌবধর্ম পরিত্যাগী অন্তঃসারশূন্য জীবনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, কোন গ্রন্থের রূপকাশ্রয়ে। সমাজপতি ও তথাকথিত পণ্ডিতদের দেয়া ধারণা অনুসারে জীবন সম্পর্কে আমাদের এক অদ্ভুত বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের এই জীবনদৃষ্টিতে মনুষ্যকালের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকে উপেক্ষার কথা আছে।
যৌবন সমস্ত অনাসৃষ্টির মূলে এবং যৌবন ধর্মশাস্ত্রবহির্ভূত যাবতীয় কর্মের উদ্গাতা। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে আমরা প্রাচীন পন্ডিতদের মত মান্য করে ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবন থেকে যৌবনকে নির্বাসন দিয়েছি। এর ফলে আমাদের বাল্য ও বার্ধক্যকাল থাকলেও যৌবনবিহীন জীবনযাপন চলছে দিনের পর দিন। প্রাবন্ধিক একটি গ্রন্থের রূপকে আমাদের জীবনের প্রসঙ্গ এনেছেন ।
এখানে বাল্যকালস্বরূপ ভূমিকা, বার্ধক্যকালস্বরূপ উপসংহার থাকলেও যৌবধর্মবিহীন অন্তঃসারশূন্যতা বিরাজিত। প্রমথ চৌধুরী উপর্যুক্ত বাক্যের মাধ্যমে জীবনের এই অন্তঃসারশূন্যতার বিরুদ্ধে শেষ প্রকাশ করেছেন।
আরও দেখুন :