যৌবনে দাও রাজটিকা ২

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় যৌবনে দাও রাজটিকা ২

যৌবনে দাও রাজটিকা ২

 

যৌবনে দাও রাজটিকা ২

 

যৌবনে দাও রাজটিকা ২

মূল পাঠ

পাছে লোকে ভুল বোঝেন বলে এখানে আমি একটি কথা বলে রাখতে চাই। কেউ মনে করবেন না যে, আমি কাউকে সংস্কৃত কাব্য বয়কট করতে বলছি কিংবা নীতি ও রুচির দোহাই দিয়ে সে কাব্যের সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশ করবার পরামর্শ দিচ্ছি। আমার মতে যা সত্য তা গোপন করা সুনীতি নয় এবং তা প্রকাশ করাও দুর্নীতি নয়। সংস্কৃতকাব্যে যে যৌবনধর্মের বর্ণনা আছে তা যে সামান্য মানবধর্ম, এ হচ্ছে অতি স্পষ্ট সত্য; এবং মানবজীবনের উপর তার প্রভাব যে অতি প্রবল, তাও অস্বীকার করবার জো নেই।

তবে এই একদেশদর্শিতা ও অত্যুক্তি ভাষায় যাকে বলে একরোখামি ও বাড়াবাড়ি, তাই – হচ্ছে সংস্কৃত কাব্যের প্রধান দোষ। যৌবনের স্থূল শরীরকে অত আশকারা দিলে তা উত্তরোত্তর স্থূল হতে স্থূলতর হয়ে ওঠে, এবং সেই সঙ্গে তার সূক্ষ্ম শরীরটি সূক্ষ্ম হতে এত সূক্ষ্মতম হয়ে ওঠে যে, তা খুঁজে পাওয়াই ভার হয়।

সংস্কৃত সাহিত্যের অবনতির সময় কাব্যে রক্তমাংসের পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে, তার ভিতর আত্মার পরিচয় দিতে হলে সেই রক্তমাংসের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করা ছাড়া আর আমাদের উপায় নেই। দেহকে অতটা প্রাধান্য দিলে মন-পদার্থটি বিগড়ে যায়; তার ফলে দেহ ও মন পৃথক্ হয়ে যায় এবং উভয়ের মধ্যে আত্মীয়তার পরিবর্তে জ্ঞাতিশত্রুতা জন্মায়।

সম্ভবতঃ বৌদ্ধধর্মের নিরামিষের প্রতিবাদস্বরূপ হিন্দু কবিরা তাঁদের কাব্যে এতটা আমিষের আমদানি করেছিলেন। কিন্তু যে কারণেই হোক প্রাচীন ভারতবর্ষের চিন্তার রাজ্যে দেহমনের পরস্পরের যে বিচ্ছেদ ঘটেছিল, তার প্রমাণ – – প্রাচীন সমাজের একদিকে বিলাসী অপরদিকে সন্ন্যাসী, একদিকে পত্তন অপরদিকে বন, একদিকে রঙ্গালয় অপরদিকে হিমালয়; এক কথায় এক দিকে কামশাস্ত্র অপরদিকে মোক্ষশাস্ত্র।

মাঝামাঝি আর কিছু জীবনে থাকতে পারত, কিন্তু সাহিত্যে নেই। এবং এ দুই বিরুদ্ধ- মনোভাবের পরস্পর-মিলনের যে কোনো পন্থা ছিল না, সে কথা ভর্তৃহরি স্পষ্টাক্ষরে বলেছেন – একা ভার্যা সুন্দরী বা দরী বা এই হচ্ছে প্রাচীনযুগের শেষ কথা। যাঁরা দরী-প্রাণ তাঁদের পক্ষে যৌবনের নিন্দা করা যেমন স্বাভাবিক, যাঁরা সুন্দরী-প্রাণ তাঁদের পক্ষেও তেমনি স্বাভাবিক। যতির মুখের যৌবন-নিন্দা অপেক্ষা কবির মুখের যৌবন-নিন্দায়, আমার বিশ্বাস, অধিক ঝাঁজ আছে।

তার কারণ, ত্যাগীর অপেক্ষা ভোগীরা অভ্যাসবশতঃ কথায় ও কাজে বেশি অসংযত। যাঁরা স্ত্রীজাতিকে কেবলমাত্র ভোগের সামগ্রী মনে করেন তাঁরাই যে স্ত্রী-নিন্দার ওস্তাদ, এর প্রমাণ জীবন ও সাহিত্যে নিত্য পাওয়া যায়। স্ত্রী-নিন্দুকের রাজা হচ্ছেন রাজকবি ভর্তৃহরি ও রাজকবি সোলোমন। চরম ভোগবিলাসে পরম চরিতার্থতা লাভ করতে না পেরে এঁরা শেষ বয়সে স্ত্রী-জাতির উপর গায়ের ঝাল ঝেড়েছেন।

যাঁরা বনিতাকে মাল্যচন্দন হিসাবে ব্যবহার করেন তাঁরা শুকিয়ে গেলে সেই বনিতাকে মাল্যচন্দনের মতই ভূতলে নিক্ষেপ করেন, এবং তাকে পদদলিত করতেও সংকুচিত হন না। প্রথমবয়সে মধুর রস অতিমাত্রায় চর্চা করলে শেষ বয়সে জীবন তিতো হয়ে ওঠে। এ শ্রেণীর লোকের হাতে শৃঙ্গার-শতকের পরেই বৈরাগ্য-শতক রচিত হয়। একই কারণে, , যাঁরা যৌবনকে কেবলমাত্র ভোগের উপকরণ মনে করেন তাঁদের মুখে যৌবন-নিন্দা লেগে থাকবারই কথা।

যাঁরা যৌবন জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেন, তারা ভাটার সময় পাকে পড়ে গত জোয়ারের প্রতি কটুকাটব্য প্রয়োগ করেন। যৌবনের উপর তাঁদের রাগ এই যে, তা পালিয়ে যায় এবং একবার চলে গেলে আর ফেরে না। যযাতি যদি পুরুর কাছে ভিক্ষা করে যৌবন ফিরে না পেতেন তা হলে তিনি যে কাব্য কিংবা ধর্মশাস্ত্র রচনা করতেন, তাতে যে কি সুতীব্র যৌবন- নিন্দা থাকত তা আমরা কল্পনাও করতে পারি নে।

পুরু যে পিতৃভক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, তার ভিতর পিতার প্রতি কতটা ভক্তি ছিল এবং তাতে পিতারই যে উপকার করা হয়েছিল তা বলতে পারি নে, কিন্তু তাতে দেশের মহা অপকার হয়েছে; কারণ নীতির একখানা বড় গ্রন্থ মারা গেছে। যযাতি-কাঙ্ক্ষিত যৌবনের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ এই যে, তা অনিত্য। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণ ও শ্রমণ, নগ্নক্ষপণক ও নাগরিক, সকলেই একমত।

‘যৌবন ক্ষণস্থায়ী”, এই আক্ষেপে এ দেশের কাব্য ও সংগীত পরিপূর্ণ – ফাগুন গয়ী হয়, বহুরা ফিরি আয়ী হয় গয়ে রে যোবন, ফিরি আওত নাহি এই গান আজও হিন্দুস্থানের পথে-ঘাটে অতি করুণ সুরে গাওয়া হয়ে থাকে। যৌবন যে চিরদিন থাকে না, এ আপসোস রাখবার স্থান ভারতবর্ষে নেই।যা অতি প্রিয় এবং ক্ষণস্থায়ী, তার স্থায়িত্ব বাড়াবার চেষ্টা মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। সম্ভবতঃ নিজের অধিকার বিস্তার করবার উদ্দেশ্যেই এ দেশে যৌবন শৈশবের উপর আক্রমণ করেছিল।

বাল্যবিবাহের মূলে হয়তো এই যৌবনের মেয়াদ বাড়াবার ইচ্ছাটাই বর্তমান। জীবনের গতিটি উলটো দিকে ফেরাবার ভিতরও একটা মহা আর্ট আছে। পৃথিবীর অপরসব দেশে লোকে গাছকে কি করে বড় করতে হয় তারই সন্ধান জানে, কিন্তু গাছকে কি করে ছোট করতে হয় সে কৌশল শুধু জাপানিরাই জানে। একটি বটগাছকে তারা চিরজীবন একটি টবের ভিতরে পুরে রেখে দিতে পারে। শুনতে পাই, এই সব বামন-বট হচ্ছে অক্ষয়বট।

জাপানিদের বিশ্বাস যে, গাছকে হ্রস্ব করলে তা আর বৃদ্ধ হয় না। সম্ভবত: আমাদেরও মনুষ্যত্বের চর্চা সম্বন্ধে এই জাপানি আর্ট জানা আছে, এবং বাল্যবিবাহ হচ্ছে সেই আর্টের একটি প্রধান অঙ্গ। এবং উক্ত কারণেই, অপর-সকল প্রাচীন সমাজ উৎসন্নে গেলেও আমাদের সমাজ আজও টিকে আছে।

মনুষ্যত্ব খর্ব করে মানবসমাজকে টবে জিইয়ে রাখায় যে বিশেষ কিছু অহংকার করবার আছে, তা আমার মনে হয় না। সে যাই হোক, এ যুগে যখন কেউ যৌবনকে রাজটিকা দেবার প্রস্তাব করেন তখন তিনি সমাজের কথা ভাবেন, ব্যক্তিবিশেষের কথা নয়। ব্যক্তিগত হিসেবে জীবন ও যৌবন অনিত্য হলেও মানবসমাজের হিসেবে ও-দুই পদার্থ নিত্য বললেও অত্যুক্তি হয় না। সুতরাং সামাজিক জীবনে যৌবনের প্রতিষ্ঠা করা মানুষের ক্ষমতার বহির্ভূত না হলেও না হতে পারে ।

কি উপায়ে যৌবনকে সমাজের যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করা যেতে পারে তাই হচ্ছে বিবেচ্য ও বিচার্য। এ বিচার করবার সময় এ কথাটি মনে রাখা আবশ্যক যে, মানবজীবনের পূর্ণ অভিব্যক্তি- – যৌবন । যৌবনে মানুষের বাহ্যেন্দ্রিয় কর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় সব সজাগ ও সবল হয়ে ওঠে, এবং সৃষ্টির মূলে যে প্রেরণা আছে মানুষে সেই প্রেরণা তার সকল অঙ্গে সকল মনে অনুভব করে । দেহ ও মনের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধের উপর মানবজীবন প্রতিষ্ঠিত হলেও দেহমনের পার্থক্যের উপরেই আমাদের চিন্তারাজ্য প্রতিষ্ঠিত।

দেহের যৌবনের সঙ্গে মনের যৌবনের একটা যোগাযোগ থাকলেও দৈহিক যৌবন ও মানসিক যৌবন স্বতন্ত্র। এই মানসিক যৌবন লাভ করতে পারলেই আমরা তা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারব। দেহ সংকীর্ণ ও পরিচ্ছিন্ন ; মন উদার ও ব্যাপক। একের দেহের যৌবন অপরের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেবার জো নেই; কিন্তু একের মনের যৌবন লক্ষ লোকের মনে সংক্রমণ করে দেওয়া যেতে পারে। পূর্বে বলেছি যে, দেহ ও মনের সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য।

একমাত্র প্রাণশক্তিই জড় ও চৈতন্যের যোগ সাধন করে। যেখানে প্রাণ নেই সেখানে জড়ে ও চৈতন্যে মিলনও দেখা যায় না। প্রাণই আমাদের দেহ ও মনের মধ্যে মধ্যস্থতা করছে। প্রাণের পায়ের নীচে হচ্ছে জড়জগৎ আর তার মাথার উপরে মনোজগৎ। প্রাণের ধর্ম যে জীবনপ্রবাহ রক্ষা করা, নবনব সৃষ্টির সারা সৃষ্টি রক্ষা করা – এটি সর্বলোকবিদিত। কিন্তু প্রাণের আর একটি বিশেষ ধর্ম আছে, যা সকলের কাছে সমান প্রত্যক্ষ নয়।

সেটি হচ্ছে এই যে, প্রাণ প্রতি মুহূর্তে রূপান্তরিত হয়। হিন্দুদর্শনের মতে জীবের প্রাণময় কোষ, অন্নময় কোষ ও মনোময় কোষের মধ্যে অবস্থিত। প্রাণের গতি উভয়মুখী। প্রাণের পক্ষে মনোময় কোষে ওঠা এবং অন্নময় কোষে নামা দুই সম্ভব। প্রাণ অধোগতি প্রাপ্ত হয়ে জড়জগতের অন্তর্ভূত হয়ে যায়; আর উন্নত হয়ে মনোজগতের অন্তর্ভূত হয়। মনকে প্রাণের পরিণতি এবং জড়কে প্রাণের বিকৃতি বললেও অত্যুক্তি হয় না।

প্রাণের স্বাভাবিক গতি হচ্ছে মনোজগতের দিকে; প্রাণের স্বাধীন স্ফূর্তিতে বাধা দিলেই তা জড়তাপ্রাপ্ত হয়। প্রাণ নিজের অভিব্যক্তির নিয়ম নিজে গড়ে নেয়; বাইরের নিয়মে তাকে বন্ধ করাতেই সে জড় জগতের অধীন হয়ে পড়ে। যেমন প্রাণিজগতের রক্ষার জন্য নিত্যনূতন প্রাণের সৃষ্টি আবশ্যক, এবং সে সৃষ্টির জন্য দেহের যৌবন চাই, তেমনি মনোজগতের এবং তদধীন কর্মজগতের রক্ষার জন্য সেখানেও নিত্য নব সৃষ্টির আবশ্যক, এবং সে সৃষ্টির জন্য মনের যৌবন চাই।

পুরাতনকে আঁকড়ে থাকাই বার্ধক্য অর্থাৎ জড়তা। মানসিক যৌবন লাভের জন্য প্রথম আবশ্যক – – প্রাণশক্তি যে দৈবী শক্তি – এই বিশ্বাস। পারে, তাই হচ্ছে এই মানসিক যৌবনই সমাজে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য। এবং কি উপায়ে তা সাধিত হতে আলোচ্য।

শব্দার্থ ও টীকা

একদেশদর্শিতা – কোনো বিষয়ের একাংশমাত্র বিবেচনা না করা, সংকীর্ণতা, পক্ষপাতদুষ্টতা।

মোক্ষশাস্ত্র — ভববন্ধন হতে মুক্তির আচরণবিধি ।

ভর্তৃহরি — সংস্কৃত কবি। রাজা বিক্রমাদিত্যের পিতা গন্ধর্ব সেনের দাসীপুত্র।

সোলোমন — একজন রাজকবি ।

শৃঙ্গার-শতক ও বৈরাগ্য-শতক — সংস্কৃত কবি ভর্তৃহরি কর্তৃক রচিত দুটো কাব্যগ্রন্থ। ‘নীতি-শতক’ নামে তাঁর আরও একটি কাব্যগ্রন্থ আছে।

কুটকাটব্য — কড়া কথা, গালমন্দ ।

যযাতি-কাঙিক্ষত – যযাতি যা কামনা করেছেন।

শ্রমণ — বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, ভিক্ষু।

নগ্নক্ষপণক — উলঙ্গ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীবিশেষ। – ‘ফাগুন গয়ী হয়, বহুরা ফিরি আয়ী হয় / গয়ে রে যৌবন, ফিরি আওত নাহি— ফাল্গুন চলে যায় সত্যি, কিন্তু তা বার বার ফিরে আসে। যৌবন চলে গেলে তা আর কখনো আসে না ফিরে।

অক্ষয়বট – ভুবনেশ্বর, প্রয়াস, পুরী প্রভৃতি তীর্থস্থানের প্রাচীন বটবৃক্ষ। মনে করা হয়, এই বটবৃক্ষের মূলে জলসেচন
করে প্রার্থনা করলে অক্ষয় পূণ্য লাভ হয়।

অভিষিক্ত — গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির জন্যে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানকে বলে অভিষেক। অনুষ্ঠান সমাপনান্তে ওই –
ব্যক্তিটি হল অভিষিক্ত।

বাহ্যেন্দ্রিয়- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক- – এই পঞ্চ ইন্দ্ৰিয়।

কর্মেন্দ্রিয় — যে সব ইন্দ্রিয়শারা কর্ম সম্পাদন করা হয়। যেমন, বাক্, , পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ।

অন্তরিন্দ্রিয় — মন, অন্তকরণ।

পরিচ্ছিন্ন — সীমাবদ্ধ।

 

যৌবনে দাও রাজটিকা ২

 

বস্তুসংক্ষেপ

সংস্কৃত সাহিত্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার প্রবন্ধকারের লক্ষ্য নয়, বরং সেখানে মানবধর্মের অতি সামান্য অংশ দেহজ যৌবনের যে বাড়াবাড়ি সে কথাই তিনি ব্যক্ত করেছেন। যৌবন মানেই শুধু স্থূল শরীর নয়, এসত্যটি সংস্কৃত কবিগণ বুঝতে চান নি। পরে অবশ্য এই রক্তমাংসের বাড়াবাড়ির একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ভারতের প্রাচীন সাহিত্যে তাই একদিকে কাম অন্যদিকে মোক্ষ বা পরিত্রাণের কথা আছে, এর মাঝামাঝি কিছু নেই।

ভর্তৃহরি, সোলোমান প্রমুখ রাজকবিও শুধু দেহের বন্দনা করেছেন ও স্ত্রী-জাতিকে ভোগের সামগ্রী করে তুলেছেন। যৌবন থেকে পালিয়ে গুহা- আশ্রয়ী সন্ন্যাসী যেমন যৌবনের নিন্দা করেছেন, তেমনি ভোগে পরিতৃপ্ত না হয়ে ভোগীও যৌবন-নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। কিন্তু তবুও এ দেশের মানুষ যৌবনের পরিধি বিস্তৃতির জন্যে বাল্যবিবাহ সমর্থন করে। অথচ এই যৌবনকে বার্ধক্য পর্যন্ত প্রসারিত করার কোন উদ্যোগ নেই তাদের।

প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিজীবন থেকে সমাজজীবনে যদি এই যৌবন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়, তা হলেই এই ইতিনেতির অবসান হতে পারে। কিন্তু এ এক কঠিন পাঠ। মানবজীবনের পূর্ণ অভিব্যক্তি তার যৌবন, যখন তার বাহ্য, কর্ম ও অন্তরিন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে। এ সময় তার মনোজগতেরও বিকাশ ঘটে। এতোদিন শরীরকে নির্ভর করে যৌবনের প্রশস্তি রচনা করা হয়েছে, যেখানে মন ছিলো সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত।

অথচ দেহ সংকীর্ণ ও পরিচ্ছিন্ন, অন্যদিকে মন উদার ও ব্যাপক। এই মানসিক যৌবন লাভ করতে পারলেই তা সমাজে প্রতিষ্ঠা সম্ভব। দেহের যৌবন অন্যের দেহে সংক্রমিত করা যায় না, কিন্তু মনের যৌবন দিয়ে অন্যকে মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত করা যায়। দেহের যৌবন ও মনের যৌবন পরস্পর বিরোধী কোন কিছু নয়। প্রাণিজগত রক্ষা ও প্রাণের সৃষ্টির জন্যে যেমন দেহের যৌবন দরকার, তেমনি মনোজগত ও কর্মজগত রক্ষার জন্যে প্রয়োজন মনের যৌবন।

প্রমথ চৌধুরী ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতায়, যুক্তির শাণিত ধারায় ও বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্যে প্রবন্ধে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করে স্পষ্ট বলেছেন যে, সমাজে মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠাই তাঁর উদ্দেশ্য। এ মানসিক যৌবনের সাহায্যেই কর্মে ও জ্ঞানে সামাজিক মানুষের মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ ফল লাভ করা সম্ভব। এরূপ যৌবনের রাজটিকা পরিয়ে অভিষিক্ত করতে নিশ্চয়ই কেউ আপত্তি করবে না, শুধু জড়বাদী ও মায়াবাদীগণ ছাড়া। কারণ এরা প্রাণের স্বতন্ত্র মূল্যে বিশ্বাসী নয় ।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

সংক্ষিপ্ত-উত্তরমূলক প্রশ্ন

১. প্রথম চৌধুরীর বিচারে সংস্কৃত কাব্যের প্রধান দোষ কি?

২. গুহাবাসী সন্ন্যাসীর যৌবন পরিত্যাগ ও যৌবনে অতি দেহভোগকারী উভয়েই যৌবন-নিন্দা করে, কেন?

৩. দেহের যৌবন থেকে মনের যৌবন স্বতন্ত্র, কোন অর্থে? ৪. সমাজের মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠার উপায় কি?

২ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর:

মানবজীবন দেহ ও মনের সংযোগে গঠিত। তারপরও একথা বলা যায় যে, মানুষের চিন্তার জগত দেহসম্পৃক্ত নয়। যৌবন মনুষ্যকালের সর্বশেষ্ঠ সময়। মানুষের বাহ্যেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয় এ সময় অধিক সজাগ ও কর্মঠ থাকে। দৈহিক যৌবন এরপারা অনেকটা প্রকাশিত হয়। কিন্তু অন্তরিন্দ্রিয় বলেও মানুষের একটি বিশেষ দিক থাকে। এ সময় তারও জাগরণ ঘটে। দেহের যৌবন একটি নির্দিষ্ট বয়ঃসীমা অতিক্রান্তির পরই অস্তমিত হয়; শিথিল হয়ে পড়ে ইন্দ্রিয়-শক্তি।

তাছাড়া দেহ এক অর্থে সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধও বটে। কিন্তু মানুষের অন্তরিন্দ্রিয় অর্থাৎ মনোজাগতিক যৌবন বয়সে সীমাবদ্ধ নয় বলে মৃত্যুর পূর্ব অবধি এই যৌবন ধারণ করা সম্ভব। তাছাড়া দেহের মতো মন সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ নয়। এতে উদারতা ও ব্যাপকতার স্থান রয়েছে। মনের যৌবন এক থেকে বহুজনে সংক্রমিত করা যেতে পারে, কিন্তু দেহের যৌবন একদেহেই স্থাণু।

আবার ওই দেহের বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যৌবন নিশ্চিতভাবে অন্তগামী হয়ে পড়ে। মনের যৌবন সামাজিক বহুমানুষের মধ্যে সংক্রমিত করে সমাজে যৌবশক্তি সঞ্চার ঘটানো যায়। কিন্তু ব্যক্তিদেহের যৌবন থেকে তা একেবারেই অসম্ভব। এ সব কারণেই বলা চলে দেহের যৌবন ও মনের যৌবন স্বতন্ত্র।

প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা লিখুন

১. মনুষ্যত্ব খর্ব করে মানবসমাজকে টবে জিইয়ে রাখায় যে বিশেষ কিছু অহংকার করার আছে, তা আমার মনে হয় না।

২. একের দেহের যৌবন অপরের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেবার জো নেই; কিন্তু একের মনের যৌবন লক্ষ লোকের মনে সংক্রমণ করে দেওয়া যেতে পারে।

৩. প্রাণের স্বাভাবিক গতি হচ্ছে মনোজগতের দিকে; প্রাণের স্বাধীন স্ফূর্তিতে বাধা দিলেই তা জড়তাপ্রাপ্ত হয়।

৪. মানসিক যৌবন লাভের জন্যে প্রথম আবশ্যক – প্রাণশক্তি যে দৈবী শক্তি এই বিশ্বাস।

৫. সমগ্র সমাজের এই জীবন প্রবাহ যিনি নিজের অন্তরে টেনে নিতে পারবেন, তার মনের যৌবনের আর ক্ষয়ের আশঙ্কা নেই ।

৪ নং ব্যাখ্যার নমুনা-উত্তর

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক প্রথম চৌধুরীর ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধ থেকে উপর্যুক্ত বাক্যটি উদ্ধৃত করা হয়েছে। এখানে প্রবন্ধকার বলেছেন যে, মানসিক যৌবন লাভের জন্যে দৈবশক্তির মতো একটি অমিত তেজ মনুষ্যপ্রাণে অনুভূত হওয়া জরুরি। গতিশীলতা ও পরিবর্তনশীলতাই প্রাণের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কারণ প্রাণ জড় পদার্থ নয়। তবে পৃথিবীর বস্তু ও প্রাণিজগতের সান্নিধ্যে নানা লীলাবৈচিত্র্যের মধ্যদিয়েই প্রাণের বহুবিচিত্র বিকাশ ঘটে।

প্রাণ নিজের তৈরি নিয়মেই যথাযথভাবে অভিব্যক্ত হয়, বাইরের বা জড়জগতের প্রথাবদ্ধ নিয়মে তা স্থবির হয়ে পড়ে। মানসিক যৌবন মানুষের অন্তর্জগতের পরিবর্তন ঘটায় এবং তা অন্যের মনে যেহেতু সঞ্চারিত করা যায় সেহেতু সমাজও যৌবশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে। কিন্তু এই মানসিক যৌবন লাভের জন্যে নিজের আত্মশক্তি বা প্রাণশক্তিতে একনিষ্ঠ থাকা জরুরি। একনিষ্ঠতা দৈবী শক্তির মতো প্রচন্ড ও প্রভাববিস্তারী হলেই মানসিক যৌবন লাভ সম্ভব হতে পারে।

 

যৌবনে দাও রাজটিকা ২

 

রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর লিখুন

১. ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী প্রকৃত যৌবন বলতে কি বুঝিয়েছেন? সমাজে যৌবন রক্ষা করা যায় কিভাবে প্রবন্ধটি অবলম্বনে তা লিখুন।

২. প্রথম চৌধুরী তাঁর ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে দৈহিক যৌবন নয়, মানসিক যৌবনের কথা বলে সমাজদেহে তা কেন সংক্রমণ করতে চেয়েছেন – – বিস্তৃতভাবে বুঝিয়ে লিখুন।

৩. ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে সংস্কৃত সাহিত্য সম্পর্কে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা বিবৃত করুন।

৪. “প্রবন্ধ রচনায় প্রমথ চৌধুরী একটি বিশিষ্ট রীতির অনুসারী। ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধেও এর পরিচয় লভ্য।” – বক্তব্যটি প্রতিষ্ঠা করুন।

আরও দেখুন :

 

Leave a Comment