গঠন শাখার অন্তর্ভুক্ত রূপমূলের শ্রেণিবিভাগ

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-গঠন শাখার অন্তর্ভুক্ত রূপমূলের শ্রেণিবিভাগ

গঠন শাখার অন্তর্ভুক্ত রূপমূলের শ্রেণিবিভাগ

প্রথম শ্রেণির রূপমূল : বিশেষ্য বাক্যকে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করতে প্রয়োজন হয় বিশেষ্য, বিশেষ্যপও, সর্বনাম, বিশেষণের বিশেষণ ও ত্রিয়ার বিশেষণ। বিশেষ্য প্রথম শ্রেণির রূপমূল, কারণ বিশেষ্যপদ বাক্যস্থিত অন্যান্য সকল পদ অর্থাৎ বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়াপদকে নিয়ন্ত্রণ করে।

ক. সম্প্রসারিত রূপবৈশিষ্ট্য

বিশেষ্যবাচক মুক্ত রূপমূলের সঙ্গে প্রত্যয়, বিভক্তি বদ্ধরূপমূল সংযোগের মাধ্যমে বহুবচন ও সমন্ধবাচক সম্প্রসারিত রূপমূল গঠিত হয়। এভাবেই প্রথম শ্রেণির রূপমূল বিশেষ্যবাক্যে অন্তর্ভুক্ত হয়।

বিশেষ্য

প্রত্যয়/বিভক্তি

বহুবচন / সম্বন্ধসূচক

(যুক্তরূপমূল

(বদ্ধরূপমূল

(সম্প্রসারিত রূপমূল)

মানুষ (মানুষ)

মানুডি (বহুবচন নির্দেশ করছে)

পোলা (ছেলে)

পোলারা (বহুবচন নির্দেশ করছে)

বাজান (বাবা)

বাজানের (সম্বন্ধ নির্দেশ করছে)

ছেরি

ছেরিগর (মেয়েদের নির্দেশ করছে)

এখানে ডি, রা বদ্ধরূপমূল বিশেষ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বহুবচন নির্দেশ করছে এবং এর ‘গর’ বদ্ধরূপমূল
যুক্ত হয়ে সম্বন্ধসূচক দিক-নির্দেশ করছে। বাজানের অর্থাৎ বাবার, ছেরিগর, অর্থাৎ মেয়েদের।
বিশেষ্যপদের সঙ্গে আদি প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সম্বন্ধবাচক দিক-নির্দেশ করা হয়।

বদ্ধরূপমূল

আদি প্রত্যয়

যুক্তরূপমূল

বিশেষ্য

ঐ ব্যক্তির বই

অর

বই

ওর বই

(বই এর সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধ নির্দেশ করা হচ্ছে)

তার চিরুনি

তর

কাহই (চিরুনি)

তোর চিরুনি

চিরুনি’র সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধ নির্দেশ করা হয়েছে
এখানে ‘অর’ ‘তর’ ইত্যাদি বন্ধরূপমূল দ্বারা সম্বন্ধ নির্দেশ করা হয়েছে।
বিশেষ্যপদের সঙ্গে অন্ত্যপ্রত্যয় যুক্ত হয়ে সম্বন্ধসূচক দিক-নির্দেশ করা হয়।

ছেরি (মেয়ে)

গর

ছেরিগর

উভয়েই ছেরিগর মা

(সেই মেয়েগুলোর মা)

ছেরির

ছেরির জামা
(মেয়েটার জামা)

এখানে ‘পর’ ‘র’ রূপমূল ছেরি বিশেষ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্বন্ধসূচক দিক-নির্দেশ করছে।

ছেরি (মেয়ে)

নির্দেশক সর্বনামের ব্যবহার

১. এই গুলাম পছা মাছ

২. হেগুলি কি লইছত?

‘পছা’ (পঁচা) বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত

লইছত অর্থ (নেয়া) এখানে ‘কি’ নির্দেশক হিসেবে ব্যবহৃত নিগা অর্থ (জন্য) ‘এগুলো মায়ের জন্য মায়ের সম্বন্ধ

বোঝাচ্ছে

৩. এই গুলাম মায়ের নিগা?

৪. এই পিরানগুলান নয়া।

এই জামাগুলো নতুন। ‘পিরান’ বা ‘জামা’র সঙ্গে বহুবচনগুলান
ব্যবহৃত।

প্রথম বাক্যে ‘এইগুলান’ এরপর ‘পাছা’ (বিশেষণ), দ্বিতীয় বাক্যে ‘হেগুলি’ এরপর ‘কি’ (নির্দেশক), তৃতীয় বাক্যে ‘এইগুলান’ এরপর ‘মায়ের’ (সম্বন্ধবাচক) ও চতুর্থ বাক্যে এই সর্বনামের পর ‘পিরান’-এর
সঙ্গে বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে।

বিশেষ্যপদের সঙ্গে প্রত্যয় বিভক্তি যুক্ত হয়ে অনেক সময় সম্বোধনপদ এবং কারক নির্দেশ করা হয়। ডেমরা অঞ্চলের ভাষায় বিশেষ্যপদের সঙ্গে আদি প্রত্যয় ও অন্ত্যপ্রত্যয় যুক্ত হয়ে সম্বোধনপদ গঠিত হতে দেখা যায়। যেমন-

গঠন শাখার অন্তর্ভুক্ত রূপমূলের শ্রেণিবিভাগ

 

খ. সাধিত রূপবৈশিষ্ট্য

সাধিত রূপবৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিশেষণ, অব্যয় ও ক্রিয়ার সঙ্গে সাধিত প্রত্যয় যুক্ত হয়ে বিশেষ্য গঠিত হয়।
বিশেষণ থেকে বিশেষ্য
বিশেষণ

মিডা (মিষ্টি)

প্রত্যয়

বিশেষ্য

মিডাই (গুড়)

এখানে বিশেষণের ‘মিডা’ অন্তে -ই’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে বিশেষ্য পদ তৈরি হয়েছে ‘মিডাই’ (মিষ্টি)।
ক্রিয়াপদ থেকে বিশেষা

বিশেষ্য

জুগনা (দোলনা)

কটকটি (মিষ্টি জাতীয় খাবার)

কটকট

গ. স্বরভঙ্গি

প্রমিত ভাষার ন্যায় ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায়ও স্বরভঙ্গির জন্য রূপমূলের কোনো পরিবর্তন হয় না।

ঘ. রূপমূলের অবস্থান

বাক্যস্থিত প্রত্যেক শ্রেণির রূপমূল নির্দিষ্ট ক্রমানুযায়ী অবস্থান করে এর সাংগঠনিক অর্থ প্রকাশ করে। রূপমূলের সামান্যতম অবস্থানগত পরিবর্তনের সঙ্গে বাক্যের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। তাই রূপমূলের সুবিন্যস্ত বিন্যাস বাক্য গঠনের প্রধান কাজ। প্রমিত ভাষার ন্যায় ডেমরার স্থানীয় ভাষায়ও ক্রিয়া বাক্যের শেষে বসে এবং ক্রিয়ার আগে বিশেষ্য ব্যবহৃত হয়। যেমন-

বুয়ায় কানতাছে (দাদি কাঁদছে)
বাবু হাসতাছে (বাবু হাসছে
করিম দৌর পারতাছে (করিম দৌড়াচ্ছে)
ক্রিয়ার আগে যেমন বিশেষ্য ব্যবহৃত হয় তেমনি ক্রিয়ার পরেও বিশেষ্য ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ডেমরার ভাষায়। যেমন-

আইতাছনি মা (আসতেছো মা)
যাবিনি মেলাত (যাবে নাকি মেলায় )
খাবিনি পিডা (খাবেনাকি পিঠা)

সাধারণত বিবৃতিমূলক বাক্যের চেয়ে প্রশ্নবোধক বাক্যেই ক্রিয়ার পর বিশেষ্যের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।
ক্রিয়ার পর বিশেষ্য ব্যবহার করে বাক্যের ব্যবহার প্রচুর দেখা যায় ডেমরা অঞ্চলের ভাষায়। রূপমূলের এই অবস্থানগত পরিবর্তন আঞ্চলিক ভাষায় বেশি ঘটে থাকে।

ড. অব্যয়মূলক শব্দ
প্রমিত বাংলার ন্যায় ডেমরার শ্রমিকশ্রেণির ভাষায় ও বিশেষ্যের পূর্বে, পরে অব্যয়মূলক শব্দ এবং বিশেষ্যের সঙ্গে ‘বিশেষ্য-পর শব্দ’ ব্যবহৃত হয়ে বাক্যের রূপগঠনে সহায়তা করে। কিছু সর্বনামও বিশেষ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ব্যবহৃত হয়। যেমন-

পূর্বে ব্যবহৃত অনন্বয়ী অব্যয়

হেই  মানুভা  (ঐ মানুষটি) নির্দেশ করা হচ্ছে।

বইডা (ঐ বইটি) ওরে

মা দুদ লইয়া আইছে   গাছে বইল আইছে  (ঐ মা দুধ নিয়ে এসেছে)

আরে   (আরে, গাছে আমের মুকুল ধরেছে)

 

গঠন শাখার অন্তর্ভুক্ত রূপমূলের শ্রেণিবিভাগ

 

মাঝে ব্যবহৃত সংযোজক অব্যয়

শেলি আর মায়ে যাইবো (শেলি আর মা যাবে)

(রহিম আর তুমি যাও) রহিম আর তুমি যাও

(মা-ই করবে) মায় আলা করবো

শেলি, রহিম ও ‘মা’ তিনটি বিশেষ্যের মাঝখানে ‘আর’ সংযোজক অব্যয় ব্যবহৃত হয়ে বাক্যের রূপগঠনে
সহায়তা করেছে।

শেষে ব্যবহৃত পদদ্বয়ী অব্যয়

জাইতামনা কইলাম তো (যাবো না বললাম তো)

কি কাম করছেন গো (কি কাজ করেছেন গো)

আমি হুদা বাত খাইতারিনা গো (আমি শুধু ভাত খেতে পারি না) ফুকনি দিয়া তুমি কি কাম করলা
(ফুকনি অর্থ লোহার দণ্ড মাঝখানে ফাঁকা। ফুকনি দিয়ে তুমি কি কাজ করলে)
পূর্বে ব্যবহৃত সম্বন্ধসূচক সর্বনাম

১. আমার বাই (আমার ভাই)
২. তুমার বই (তোমার বই)
৩. হের লঙ (তার লুঙ্গি)

এখানে ব্যবহৃত আমার, তুমার এবং হের সম্বন্ধবাচক সর্বনাম বিশেষ্যকে ‘ভাই’, ‘বই’ ‘লঙ’ এর সাথে সম্পর্কিত করে।
পরে ব্যবহৃত সম্বন্ধসূচক সর্বনাম:

১. বাজান আমার (বাপ আমার)
২. মায়না আমার (মা না আমার)

বিশেষ্য মধ্যবর্তী সম্বন্ধসূচক সর্বনাম:

১. বই তোর বেগো দিছি (বই তোর ব্যাগে দিয়েছি)

২. মায় আমার যাইবের চায় না (মা আমার যেতে চায় না )

উল্লেখিত বাক্যে বই এবং মা বিশেষ্যের পর তোর, আমার সম্বন্ধসূচক সর্বনামের প্রয়োগ ঘটেছে।
বিশেষ্য পূর্ব নির্দেশক সর্বনাম

১. তুই হেই বাত দিছত (তুই সেই ভাত দিয়েছিস )

১. উই মামু (সেই মামা)

উল্লেখিত বাক্যে বাত (ভাত), মামু বিশেষ্যের পূর্বে হেই, উই নির্দেশক সর্বনামের প্রয়োগ ঘটেছে।
বিশেষ্য পরবর্তী নির্দেশক সর্বনাম:

১. মাছগুলান কই? (মাছগুলো কোথায়?
২. করিম্যা অই কামডা করতে পারলো না।

উল্লেখিত বাক্যে মাছ ও করিম বিশেষ্যের পর কই, অই নির্দেশক সর্বনামের প্রয়োগ ঘটেছে।

দ্বিতীয় শ্রেণির রূপমূল ক্রিয়া

প্রত্যেক ভাষায়ই ক্রিয়া বাক্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ক্রিয়া বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে বাক্যের বিভিন্ন রূপ গঠনে অংশ নেয় এবং ক্রিয়ার বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার এর আভিধানিক অর্থকে অতিক্রম করে বিস্তৃত অর্থ পরিগ্রহ করে সাংগঠনিক অর্থবৃত্তের মধ্যে। ক্রিয়ার মূল হল ধাতু। ধাতুর সঙ্গে বিভিন্ন বিভক্তি যুক্ত হয়ে ক্রিয়ার নানারূপ গঠিত হয়। কাল ও পুরুষ ভেদে ক্রিয়ার সঙ্গে সম্প্রসারিত রূপমূল অর্থাৎ বন্ধরূপমূল যুক্ত হয়ে ক্রিয়ারূপের গঠনগত
পরিবর্তন সাধন করে।

ক. সম্প্রসারিত রূপ বৈশিষ্ট্য

ডেমরার শ্রমিক শ্রেণির ভাষায় ক্রিয়াবাচক রূপমূলের বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এখানে ক্রিয়াবাচক বদ্ধরূপমূল বাক্য গঠনের সময় নিম্নোক্তভাবে কাল ও পুরুষ নির্দেশক সম্প্রসারিত ক্রিয়ারূপ গঠন করে। উদাহরণস্বরূপ ক্রিয়া- ‘খাই’

কাল

বর্তমান

অতীত

ভবিষ্যৎ

পুরুষ

উম

মধ্যম

নাম

মধ্যম

নাম

উত্তম

মধ্যম

নাম :

বদ্ধরূপমূল

-ই

-ইতাছি

-ইছি

– ইতাছ

– ইছ

ইতাছে

-ইছে

-ছিলাম

-ছিলা

– ইবা

-বি

গঠিত রূপমূল

খাই

খাইতাছি

খাইছি

খাও

খাইতাছ

খাইছ

খাইতাছে

খাইছে

খাইছিলাম

খাইছিলা

খাইছিল

খাইবা

খাবি

খ. সাধিত রূপমূল

যুক্তরূপমূলের সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সাধিত রূপমূল গঠিত হয়। ডেমরার ভাষায় ক্রিয়াবাচক রূপমূলের সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে মূলরূপের পদ শ্রেণিগত পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত প্রচুর রয়েছে।
যুক্তরূপমূল
অন্ত্যপ্রত্যয়
(kha)ia ইয়া ia ইয়া

খাইয়া (khala)খেয়ে

যা (ja) যাইয়া (jaia)

গিয়ে [ (ba)

ইয়া (baia)বসে

ক্রিয়ার সাথে অন্ত্যপ্রত্যয় ‘ইয়া’ যুক্ত হয়ে বাক্যে সাধিত রূপ বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে। উদাহরণ, আমি খাইয়া থামুনে।

(আমি খেয়ে যাব)। আমি যাইয়া লই আমি গিয়ে নেই)।

কানদ (কাঁদ) কানम + আ

কানদা (কান্না) (বিশেষ্য) কান্দার কি দরকার (কাঁদার কি দরকার )

কানন + ন

কানদোন (কাঁদন) (বিশেষ্য) এত কানদোন বালা না (এত কান্না ভাল নয়)

কানम+ ও

কানদো কাঁদো (রিয়া) তুমি কানদো ক্যা। কানদুইন্যা (কাদুনে) (বিশেষণ) ছেরিডা কানদুইন্যা স্বভাবের।

কানদ+উইন্যা

কানদ+উনি

কান্দুনি (কাঁদুনি) (বিশেষণ) যবর কান্দুনি অইছত ।

ক্রিয়ার মূল ‘কানদ” এর সঙ্গে ‘আ’ ও ‘গুন’ যুক্ত হয়ে ‘কানদা’ ও ‘কানদোনা বিশেষ্য রূপ গঠিত হয়েছে। ‘কানদ’ সঙ্গে ‘ও’ যুক্ত হয়ে ‘কানদো’ ক্রিয়ারূপ গঠিত হয়েছে। ‘কানদ’-এর সঙ্গে ‘উইন্যা’ ‘উনি’ যুক্ত হয়ে ‘কান্দুইন্যা’, ‘কান্দুনি’ বিশেষণপদ গঠিত হয়েছে।

 

গঠন শাখার অন্তর্ভুক্ত রূপমূলের শ্রেণিবিভাগ

 

গ. স্বরভঙ্গি

ক্রিয়ার গঠনগত অর্থের তারতম্য ঘটে থাকে স্বরভঙ্গিগত কারণের জন্য। ডেমরা থানার শ্রমিক শ্রেণির প্রচলিত ভাষায় ক্রিয়ামূলক রূপমূলের প্রথম স্বরধ্বনির ওপর গৌণ স্বরাঘাত ও শেষের স্বরধ্বনির ওপর মুখ্য স্বরাঘাত পড়ে।

যেমন- কইরা – Kaira
বইক্যা boikka
খাইয়্যা khala –

ক্রিয়ামূলক রূপমূলের শেষ ধ্বনিতে স্বরাঘাত বেশি পড়লে বাক্যস্থিত ক্রিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। যেমন- তুই খাবি । আমি কর্ম । (আমি বলব
(তুই খাবি

(বি অক্ষরের ওপরে রেখা টেনে স্বরাঘাত বা ঝোক নির্দেশ করা হল) আমি কর্ম—এই বাক্যে ক্রিয়াবাচক রূপমূলের প্রথম ধ্বানিতে স্বরাঘাত বেশি, (আমি বলবো) তাই ক্রিয়ার অভিব্যক্তি সাধারণ।
আমি কর্ম—এই বাক্যে ক্রিয়ার রূপমূলের শেষ ধ্বনিতে স্বরাঘাত বেশি পড়ায় ক্রিয়ার অভিব্যক্তি হিসেবে বক্তার বিরক্ত বা জিদ প্রকাশ পেয়েছে।
আমি কর্ম?-এই বাক্যে ক্রিয়া শেষ ধ্বনিতে স্বরাঘাতের ফলে প্রশ্নবোধক বাক্যের সৃষ্টি হয়েছে।

ঘ. রূপমূলের অবস্থান

১. প্রমিতরীতির ন্যায় ডেমরার ভাষায়ও বাক্য সংগঠনে ক্রিয়া বাক্যের প্রথমে, মাঝে ও শেষে ব্যবহৃত হয়। যেমন- শর্তমূলক বাক্যের ক্ষেত্রে ক্রিয়া প্রথমে ব্যবহৃত হয়।

যেমন পরলে খালতে দিমু (porle karlte dimu )
বাক্যের প্রথমে খাইয়া লইয়া কতা ক (khiya loiya kota ka) খেয়ে নিয়ে কথা বল
বাক্যের মাঝে আমি তো যামু হুনছ নাই (ami to jamu hunoch nai) আমি তো যাব শুননি
বাক্যের শেষে আমগো বাইত যাইছ (amgo bait jaich) আমাদের বাড়িতে যেয়ো

২. ক্রিয়া সাধারণত বাক্যের শেষে ব্যবহৃত হয় এবং বাক্যের সাংগঠনিক অর্থ প্রকাশ করে। তবে ডেমরার প্রচলিত ভাষায় ক্রিয়া উহ্য থেকেও বাক্য পঠিত হয়।

যেমন- হেয় আমার বাই। (সে আমার ভাই)।
এ বাক্যে বাইরের গঠনে কোন ক্রিয়াপদ নেই, কিন্তু অন্তর্ভাগীয় গঠনে ক্রিয়া আছে। যেমন-
সে (হয়) আমার ভাই ।

৩. এ অঞ্চলে এমন কিছু বাক্যের প্রচলন দেখা যায়, যেখানে ক্রিয়াবাচক শব্দ প্রথমে বসে বাক্য তৈরি করে। প্রশ্নবোধক বাক্যেও ক্রিয়া প্রথমে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
১. বইক্যা দিছি।
বকে দিয়েছি

২. মাইরা দিছি। মেরে দিয়েছি/ মেরেছি
। খেয়ে নিয়েছি। খেয়েছি

৩. খাইয়্যা লইছি

৪. যাবি তুই?
যাবি তুই?

৫. খাইছত নি?
খেয়েছ নাকি?

উল্লেখিত উদাহরণ ১, ২, ৩, বাক্য সাধারণ বিবৃতিমূলক। বাক্যের বাইরের গঠনে যার উদ্দেশ্যে ক্রিয়াটি সম্পাদিত তা নেই, কিন্তু অন্তর্ভাগীয় গঠনে আছে (ওরে) বইক্যা দিছি
(ওরে) মাইরা দিছি
(ভাত) খাইয়্যা লইছি।

৪ ও ৫ নং বাক্যটি সাধারণ প্রশ্নবোধক বাক্যে ক্রিয়া প্রথমে বসে বাক্যের অর্থ প্রকাশে নতুন ব্যঞ্জনা দান
করেছে।

৪. কোন কিছুর সম্ভাবনা ও শর্ত বোঝাতে বাক্যের প্রথমে ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়।
যাইবা তুমি আমি যামু
(যাবে তুমি আমি যাবো)
নাহাইতে পারি তুমি নাহাইলে (গোসল করতে পারি তুমি গোসল করলে)
ডেমরার শ্রমিক শ্রেণির ভাষায় বাক্য সংগঠনে ক্রিয়া বাক্যের প্রথমে, শেষে ও মাঝে ব্যবহৃত হয়ে অর্থগত
বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে ।

ড. অব্যয়মূলক শব্দ

প্রমিত বাংলার মতো ডেমরার শ্রমজীবী মানুষের ভাষায় ক্রিয়া সম্পৃক্ত অব্যয়জাত রূপমূল সাধারণত ক্রিয়ার পূর্বে বসে ক্রিয়াবাচক রূপমূলের অর্থকে সমৃদ্ধি দান করে ।
ক্রিয়ার সম্পৃক্ত অব্যয়মূলক শব্দের ব্যবহার

আমি তাইলে যাই গা

(আমি তা হলে চলে যাই)

আমি কইলাম কইয়া দিমু (আমি কিন্তু বলে দেব)

শিলু আলা যাইবো

(শিলু তবে যাবে)

রহিম গুৰি যাইবো

(রহিমও সাথে যাবে)

সাদী ওবি গাছো উঠছে

(সাদীও নাকি গাছে উঠেছে/সাদীও সাথে গাছে উঠেছে)

উপরোক্ত বাকাগুলোতে ক্রিয়াপূর্ব অব্যয় হিসেবে তাইলে (তাহলে), কইলাম (বললাম), আলা (তাহলে), ওবি (সাথে) ব্যবহৃত হয়েছে। ডেমরার প্রচলিত ভাষায় ক্রিয়া অব্যয় হিসেবে ‘আলা’, ‘ওৰি’ রূপমূল খুব বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

তৃতীয় শ্রেণির রূপমূল বিশেষণ

বাক্যের রূপগঠনে বিশেষণের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষণ বাক্যে ব্যবহৃত বিশেষ্য, সর্বনাম ও
ক্রিয়াকে বিশেষিত করে।

ক. সম্প্রসারিত রূপমূল
বিশেষণের পূর্বে এবং অন্তে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সম্প্রসারিত রূপমূল গঠিত হয়।
অন্যপ্রত্যয়

মুক্তরূপমূল

হিংসা

বদমেজাজ

জিদ

মেজাজ (রাগ)

মোদু (মধু)

গাছ (গাছ)

আলাপ (কথাবলা)

(বদ্ধরূপমূল

-উইট্যা

-ই

-ই

-র

– ই

সম্প্রসারিত রূপমূল

হিংশুইট্যা (হিংসুক)

বদমেজাজি (রাগী/জেদি)

জিদি (রাগী)

মেজাজি (রাগী)

মোদুর (মধুর)

গাছি (গাছ থেকে রস আহরণ করে যে ব্যক্তি) আলাপি (মিশুক ব্যক্তি/ সামাজিক)

মূল রূপমূল হিংসা, বদমেজাজ, জিদ, মেজাজ, মোদু, গাছ, আলাপ-এর সাথে যথাক্রমে উইট্যা, – ই -ই র, ই, ই যুক্ত হয়ে বিশেষণ গঠিত হয় এবং এর নতুন অর্থ প্রযুক্ত হয়।
আদি প্রত্যয়
বিশেষণের আদিতে প্রত্যয়যোগে যে সম্প্রসারিত রূপমূল গঠিত হয় তা বিপরীত অর্থ সৃষ্টি করে।
আদিপ্রতায় হিসেবে বিশেষণের সঙ্গে ‘আ’ ‘বে’ যুক্ত হয় এবং মূল অর্থের বিপরীত অর্থ সৃষ্টি করে। যেমন-

মুক্তরূপমূল

কামের (করিৎকর্মা)

হিশাবি

আদিপ্রত্যয়

আ-

বে-

সম্প্রসারিত রূপমূল

আকামের (নিষ্কর্মা)

বেহিশাবি

উদাহরণ

আকামের ডেহি (তুই কোন

তুই কোন কামের অইলি না কাজের হলি না আকাজের ডেকি)

বেহিশাবি অওন বালা না হিশাবি অইতে অইব (বেহিসাবি হওয়া ভাল নয় হিসাবী

হতে হবে)

প্রমিত বাংলায় এক বা একাধিকের তুলনার মান বোঝাতে অব্যয়মূলক রূপমূল ব্যবহৃত হয়। প্রমিত ভাষার ন্যায় ডেমরার প্রচলিত ভাষায়ও এক বা একাধিকের তুলনা বোঝাতে কিছু রূপমূল ব্যবহৃত হয়। রূপমূলগুলো হলো-

১. হগলতির চাইয়া
২. চাইয়া
৩. থাইক্যা

উদাহরণ

১. হ্যায় হগলতির চাইয়া বালা (সে সকলের চেয়ে ভাল )
২. হ্যার চাইয়া বেশি ডহের বারি বানামু (তার থেকে বেশি সুন্দর বাড়ি বানাবো
৩. এই বাজার থাইক্যা শারুলিয়ার বাজারো তরকারি হছতা। (এই বাজার থেকে শারুলিয়ার বাজারে তরকারি সস্তা )

১ সংখ্যক বাক্যে একজন ব্যক্তিকে একাধিক ব্যক্তির থেকে আলাদা করে ভালো বোঝাতে ‘হগলতির চাইয়া’ (চেয়ে) ২নং বাক্যে ‘চাইয়া’ (চেয়ে) অব্যয় ব্যবহার করে তুলনার মান বোঝানো হয়েছে। ৩ নং বাক্যে ‘থাইক্যা’ (থেকে) রূপমূল ব্যবহার করে দুই বাজারে মধ্যকার দামের তুলনা বোঝানো হয়েছে।

খ. সাধিত রূপ বৈশিষ্ট্য

প্রমিত বাংলার ন্যায় ডেমরার ভাষায়ও বিশেষ্যবাচক রূপমূলের শেষে বদ্ধরূপমূল যুক্ত হয়ে বিশেষণ গঠিত
হয়।

বিশেষ্য বদ্ধরূপমূল

বিশেষণ

মউত (মৃত্যু) তা

মউতা

প্রযুক্ত অর্থ

(মৃতপ্রায় ব্যক্তি)

এখানে ‘মউত’ রূপমূলের সঙ্গে ‘তা’ বন্ধরূপমূল যুক্ত হয়ে নতুন রূপমূল ‘মউতা’ (বিশেষণ) সৃষ্টি করে এবং ‘মৃত্যু’ অর্থ পরিবর্তিত হয়ে মুমূর্ষ রোগি’ নতুন অর্থ সৃষ্টি হয়।

 

বিশেষণ থেকে

জাত

কুজাত

(খারাপ স্বভাব)

বাংগা (ভাঙ্গা)

কু

আবাংগা

(নিখুঁত/আস্ত/সম্পূর্ণ)

আশিদদো (কাঁচা/অসিদ্ধ)

শিদদো আ

‘জাত’ ও ‘ভাঙ্গা’ বিশেষণের সঙ্গে কু, আ যুক্ত হয়ে বিপরীত অর্থ প্রকাশ করছে। উল্লেখিত সব রূপমূলই
বিশেষ্য ও সর্বনামের বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

গ. শব্দের অবস্থান

বাংলা বাক্যের নির্দেশক ও বিশেষ্যের মাঝখানে বিশেষণ ব্যবহৃত হয়। কোনো বাক্যে নির্দেশক না থাকলে বিশেষ্যের আগে বিশেষণের ব্যবহারই হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। উদাহরণস্বরূপ-
এউগা… বিলাই গেলো গা।

উইয়ে… মানু হে কুনো সুময়… কাম করতো না।
উল্লেখিত বাক্য দুটির মধ্যে প্রথম বাক্যে ‘এউগা’র পর ‘কালা, সুন্দর, মোটা’ ইত্যাদি রূপমূল ব্যবহৃত হতে পারে। দ্বিতীয় বাক্যে ‘উইয়ে’র পরে ‘ভালো, সৎ ইত্যাদি ‘সুময়ে’র পর ‘খারাপ, মন্দ’ ইত্যাদি রূপমূল ব্যবহৃত হতে পারে।

ঘ. অব্যয়মূলক রূপমূল

বিশেষণের পূর্বে গুণ সম্পর্কমূলক অব্যয়সূচক রূপমূল ‘হুমানে (অনেক), চাইতে (চেয়ে)’ ইত্যাদি ব্যবহৃত
হয়ে বাক্যের অর্থের সম্প্রসারণ ঘটায়। যেমন:

পুস্কুনিত হুমানে মাছ (পুকুরে অনেক মাছ)

এখানে ‘হুমানে’ ব্যবহৃত হয়ে পুকুরের মাছের পরিমাণ বোঝাচ্ছে।

মেলাত ম্যালা মানু আইছে। (মেলায় অনেক মানুষ এসেছে)

এখানে ‘ম্যালা’ ব্যবহৃত হয়ে মেলায় মানুষের আধিক্য বোঝাচ্ছে।

তুই হ্যার চাইতে বালা (তুই তার থেকে ভাল ) এখানে ‘চাইতে’ রূপ ব্যবহৃত হয়ে দুজন মানুষের মধ্যে তুলনা বুঝানো

হয়েছে।

চতুর্থ শ্রেণির রূপমূল ক্রিয়া বিশেষণ

ক. সম্প্রসারিত রূপ বৈশিষ্ট্য

যুক্তরূপমূল যখন বিভিন্ন বদ্ধরূপমূল সংযোগের মাধ্যমে বৃহত্তর রূপ পরিগ্রহ করে তখন এসব রূপমূলের ধ্বণি ও অর্থগত ভূমিকা বদলে যায়। ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় -এ, ত, আয় প্রত্যয়যোগে ক্রিয়া
বিশেষণ গঠিত হয়।

রূপমূল

উপর

নিচ

আনন্দ

গণ্ডগোল

শুক (সুখ)

-ত প্রত্যয়যোগে

নামা (নিচ)

-আয় প্রত্যয়যোগে

টনটন

প্রত্যয়

-এ

-এ

-এ

-এ

ক্রিয়া বিশেষণ

উপরে

নিচে

আনন্দে

গণ্ডগোলে

শুকে (সুখে)

নামাত (নিচে)

বাক্য

তুমি উপরে ওঠো
তুই নিচে নাইম্যা আয়
আনন্দে হুমানে আসতাছে
গণ্ডগোলের সময় পলায় আছিলো
কত শুকে আছি দেহ না

ত প্রত্যয়যোগে

নামাত (নিচে)

নামা (নিচ)

-ত

-আয় প্রত্যয়যোগে

টনটন

-আয়

টনটনায়

বইগুলান নামাত রাখ

আঙুল টনটনাইতাছে

উদাহরণে ক্রিয়া বিশেষণ গঠিত হবার সময় বদ্ধরূপমূল ‘-এ’, ‘-ত’, ‘-আয়’ প্রত্যয় যোগে ক্রিয়া বিশেষণ গঠিত হয়েছে এবং রূপমূলে অর্থগত পরিবর্তন ঘটেছে। উপরে, নিচে, আনন্দে, গণ্ডগোলের, শুকে নামাত, টনটনায় রূপমূল দ্বারা ‘অবস্থা’গত দিক বোঝাচ্ছে। নিচে নেমে আসা, আনন্দে থাকা, গণ্ডগোলের অবস্থা, সুখে থাকার অবস্থা, ব্যথার অনুভূতি ইত্যাদি।

খ. সাধিত রূপ বৈশিষ্ট্য

বাংলা ক্রিয়াবিশেষণের ক্ষেত্রে অনেক সময় রূপমূলের সঙ্গে অন্য একটি মুক্ত বা বদ্ধ রূপমূলযোগে এই শ্রেণির রূপমূল গঠনের প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। যেমন-হুনামাত্র, চিনামাত্র, নাছতে নাছতে, গানের লগে
ইত্যাদি।

রূপমূল

হোনার লগে/ হোনামাত্র
হোনা ( শোনা )

যুক্ত/বদ্ধরূপমূল

লগে / মাত্র
কওন (বলা)
লগে লগে
কওনের লগে লগে
কাশ (কাশি)
-তে
কাশতে কাশতে

গ. স্বরভঙ্গি

প্রমিত বাংলার ন্যায় ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায়ও ক্রিয়া বিশেষণের কোনো স্বতন্ত্র স্বরভঙ্গি নেই।

ঘ. রূপমূলের অবস্থান

প্রমিত ভাষার ন্যায় এ অঞ্চলের ভাষায়ও ক্রিয়াবিশেষণের অবস্থানগত বৈচিত্র্য বিদ্যমান। বাক্যে এ শ্রেণির রূপমূল একস্থান হতে অন্যস্থানে স্থানান্তর করা যায়। যেমন-

আরও দেখুন:

Leave a Comment