আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-শব্দের গঠন ভূমিকা
শব্দের গঠন ভূমিকা
শব্দের গঠনঃ প্রথাগত, সাংগঠনিক ও সমাজভাষাতাত্ত্বিক বিবেচনা
উপন্যাসসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের কাপালিক, নবকুমারকে নিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কোথায় যাচ্ছেন এ ধরনের এক প্রশ্নের উত্তরে কাপালিক ব্যবহার করেছিলেন একটি শব্দ। শব্দটি হচ্ছে ‘বধার্থ’। ‘
কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের গঠনশৈলী বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেক গবেষক বলেছেন, তৎসম এই ভারি শব্দটির ব্যবহারে কাপালিক চরিত্রের নৃশংস দিক যেভাবে ফুটে উঠেছে একটি দেশি শব্দের ব্যবহারে এভাবে ফুটে উঠতো না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘শাস্তি’ গল্পের শেষ দিকে বিচারক চন্দরার কাছে জানতে চেয়েছিলেন। ফাঁসির আগে সে তার স্বামীকে দেখতে চায় কি না? চন্দরা উচ্চারণ করেছিল ‘মরণ’ শব্দটি।
চন্দরা কি স্বামীকে দেখতে চেয়েছিল? ‘মরণ’ শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে চন্দরা কি স্বামীর প্রতি ঘৃণার প্রকাশ ঘটিয়েছিল? অথবা এ শব্দ ব্যবহারে মাধ্যমে বিচারকের অন্যায় বিচারের অসহায় প্রতিবাদ জানিয়েছিল? এ তিনটির কোনটি সত্য তা কেউ জানেন না।
রবীন্দ্রনাথ হয়তো একটি শব্দ ব্যবহারের মধ্যমে ত্রিমুখী ব্যঞ্জনা আনতে চেয়েছিলেন। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শেক্সপিয়ার তাঁর ‘হ্যামলেট’ নাটকে ব্যবহার করেছিলেন এ বাক্যটি ‘To be or not to be that is the question’। হ্যামলেট উচ্চারিত ‘To be or not to be’ শব্দগুচ্ছের ব্যবহার নিয়ে সাহিত্য সমালোচকগণ আলোচনা করেছেন কয়েক শতাব্দী ধরে। মেলেনি উত্তর।
বাংলা সাহিত্যে একবার ঘুনের মামলা হয়েছিল। শোনা যায় বিদ্রোহী কবি নজরুলের কোনো একটি কবিতায় ‘খুন’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন। এ আপত্তি নিয়ে অন্তত কলমযুদ্ধে খুনোখুনির উপক্রম হয়েছিল। অবশেষে ব্যারিস্টার প্রমথ চৌধুরীর ওকালতিতে বঙ্গ সাহিত্যে খুনের মামলা’র অবসান ঘটেছিল।
কোনো ভাষার শব্দ ব্যবহার নিয়ে শৈলীবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ, সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ, ভাষাতাত্ত্বিক এবং বিবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ হতে পারে। ভাষাতত্ত্বে ব্যবহৃত প্রথাগত ও সাংগঠনিক পদ্ধতিতে বাংলা শব্দের গঠন বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করেছেন। প্রধানত- ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডক্টর সুকুমার সেন, ডক্টর রফিকুল ইসলাম, ডক্টর আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, ডক্টর মনিরুজ্জামান ও আরো অনেকে।
সাংগঠনিক ও সমাজভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা শব্দের গঠন বিশ্লেষণের প্রয়াস চালিয়েছেন ডক্টর পবিত্র সরকার, নাথ, ডক্টর রাজীব হুমায়ুন প্রমুখ। ডক্টর মুগাল, বর্তমান অভিসন্দর্ভে স্থগিত ও সাংগঠনিক পদ্ধতিতে বাংলা শব্দের গঠন বর্ণনা ও বিশ্লেষণে কতিপয় উদাহরণ উপস্থাপনের পর সমাজভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা শব্দের গঠন বর্ণনা ও বিশ্লেষণের প্রয়াস চালানো হয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার শব্দগঠন প্রক্রিয়া প্রায় একই রকম। প্রায় প্রতিটি ভাষার একটি শব্দমূল (root) থাকে। শব্দমূলের আগে অথবা পরে প্রথাগত ব্যাকরণের ভাষায়: উপসর্গ (prefix), প্রত্যয় বিভক্তি (suffix) ইত্যাদি যুক্ত করে নতুন শব্দের গঠন (derivation) ও সম্প্রসারণের (inflection) প্রক্রিয়া চলে। বাংলা শব্দ ও শব্দ গঠন প্রক্রিয়া অনেকটা এরকম।
যেমন- মূল শব্দ ‘ফল’। মূল শব্দ ‘ফল’ এর আগে ‘স’ যোগ করে গঠিত হয় ‘সফল’ (স+ফল সফল)। ‘সফল’ এর পরে ‘তা’ যোগ করে হতে পারে ‘সফলতা’। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, শব্দমূলের আগে পরে উপসর্গ, প্রত্যয়- বিভক্তি যোগ করতে গিয়ে শব্দ গঠন প্রক্রিয়ায় কিছু ধ্বনিতাত্ত্বিক পরিবর্তনঘটতে পারে বা ঘটে থাকে। যেমন- মূল শব্দ ‘জয়’ তার আগে ‘পরা’ যোগ হয়ে গঠিত হয় ‘পরাজয়’। পরাজয় শব্দের পরে ‘এর’ যোগ হয়ে হয় ‘পরাজয়ের ইত্যাদি ।
ইংরেজি ভাষায়ও একই রকমের গঠন সুলভ। (১) মূল শব্দ master। মূল শব্দের আগে ‘head’ যুক্ত করে গঠিত হয় headmaster & headmaster শব্দের পরে “s যোগ করে হয় headmasters । (২) মূল শব্দ shirt মূলশব্দের আগে। half যোগ করে গঠিত হতে পারে halfshirt বলা প্রয়োজন, headmaster এবং halfshirt শব্দ দুটি বাংলা ভাষায় বাংলা শব্দের মত প্রতিনিয়তই ব্যবহৃত হচ্ছে।
সাধারণ নিয়মের বাইরে শব্দগঠনের ব্যতিক্রমধর্মী নিয়মও পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় সুলভ। আরবি ও তুর্কি ভাষা থেকে দু ধরনের ব্যতিক্রমী নিয়ম উপস্থাপিত হলো।
(ক) আরবি ভাষা
পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষায় root বা শব্দমূলভুক্ত শব্দসমূহ একসঙ্গে বসে। আরবি ভাষায় root ভুক্ত বর্ণসমূহ সাধারণত একসঙ্গে বসে না। ভাষাতাত্ত্বিক পরিভাষায় এ ধরণের root কে discontinuous root বা discontinuous morph বলে। উদাহরণঃ d (দাগ), (রে) s (সিন) দাল, রে, সিন এ তিনটি বর্ণ দিয়ে discontinuious morph গঠিত। এ discontinuious morph এর আগে, মাঝে এবং শেষে বিভিন্ন prefix, infix এবং suffix যুক্ত হয়ে বিভিন্ন শব্দ গঠিত হতে পারে। যেমন- মাদ্রাসা শব্দটির গঠন হবে নিম্নরূপঃ
দাল, রে, সিন এর আগে, মাঝে এবং পরে বিভিন্ন prefix, infix এবং suffix যুক্ত হয়ে গঠিত হতে পারে ‘মোদারেস’। মোদারেস শব্দটির গঠন প্রক্রিয়া নিম্নরূপঃ-
(খ) তুর্কি ভাষা
বাংলা ‘ফল’ শব্দের আগে ‘স’ এবং পরে ‘তা’ যোগ এর মাধ্যমে গঠিত সফলতা শব্দের উদাহরণ দেয়া হয়েছে আগে। সফলের সঙ্গে য-ফলা যোগ করলে বাংলা সন্ধির গুণবৃদ্ধির সূত্রানুসারে শব্দটি পরিণত হয় ‘সাফল্য’ শব্দে। পণ্ডিতদের মতে তুর্কিভাষায় prefix, suffix অথবা infix যোগ করলেও ধ্বনিগত কোনো পরিবর্তন হয় না। উত্তর আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ গ্রন্থ থেকে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি উপস্থাপিত হলো।
“যৌগিক ভাষার বহুল প্রসার লক্ষ্য করা যায়। এই শ্রেণীর ভাষায় রূপমূলগত উপাদান পরস্পর সংবদ্ধ হয়ে থাকে। দুটো বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সংহতিমূলক ভাষার সঙ্গে যৌগিক ভাষার পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, প্রত্যেকটি উপাদান। স্বতন্ত্র রূপমূলরূপে লক্ষণীয়, এবং দ্বিতীয়ত, বাক্যের সমস্ত উপাদান একত্ৰবন্ধ হয় না।
প্রথম বৈশিষ্ট্য যৌগিক ভাষার প্রধান প্রকৃত বলে চিহ্নিত করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ তুর্কী ভাষার উল্লেখ করা যেতে পারে। তুর্কী ভাষায় পুরুষ বা বচন ছাড়া ক্রিয়াভাব প্রকাশকরূপ sev mek ‘ভালোবাসা’, নঞর্থক রুপ হচ্ছে sev me mek না ভালবাসা’, আত্মবাচক রূপ sev in mek ‘নিজেকে ভালবাসা’, কর্মবাচ্যমূলক ক্রিয়া sevil mek ভালবাসার জন্য পারস্পরি রূপ sev ish- mek ‘পরস্পরকে ভালবাসা’, সাময়িক রূপ sev dir-mek একজনকে ভালবাসার কারণ’।
উপরোক্ত রূপ ছাড়াও রূপমূলের গঠন প্রকৃতি পরিবর্ধন করা সম্ভব। যেমন, sev dir-il mek: ‘ভালবাসার জন্য আনীত’, sev in diril mek আনন্দ করার জন্য আনীত’, sevish diril mek ‘পরস্পরকে ভালবাসার জন্য আনীত’, sev ish diril-me-mek ‘পরস্পরকে ভালবাসার জন্য আনীত হয়নি’ ইত্যাদি” (আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, ১৯৮৫:১১৪)।
বাংলা শব্দের গঠন ও প্রথাগত পদ্ধতি
বাংলা শব্দের গঠন প্রক্রিয়া বর্ণনা ও বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে যে পরিভাষাসমূহ ব্যবহার করেছেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মৌলিক বা স্বয়ংসিদ্ধ শব্দ, সাধিত শব্দ, প্রত্যয়নিম্পন্ন, সমস্ত, প্রকৃতি বা ধাতু, প্রাতিপদিক, পদ, বৃৎ, তদ্ধিত প্রত্যয়, উপসর্গ, সমাস, শব্দদ্বৈত, শব্দরূপ ইত্যাদি। তাঁর গ্রন্থ থেকে শব্দ গঠনের কয়েকটি উদাহরণ উপস্থাপিত হলো। সংস্কৃত কৃদন্ত শব্দের উদাহরণঃ-
(১) পিপাসা পা+সন্’ = ‘পিপাসা’ + ‘অ’ = ‘পিপাসা’ + ‘আ’ = ‘পিপাসা’ শব্দ ‘পান করিবার ইচ্ছা’ (সুনীতিকুমার; ১৯৪৫ ১৪৩)।
(
২) কৃপা “Vকৃপ + অন্ত + টাপ্ = কৃপা” সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ
“অ = অঙ্ক”, “ভিদ” প্রভৃতি অনেকগুলো ধাতু, সেগুলি প্রত্যয়াও নহে, এবং সেগুলিতে দীর্ঘ স্বরধ্বনিও নাই, সেগুলি হইতে পূর্ববৎ স্ত্রীলিঙ্গময় ভাব-বাচক সংজ্ঞা সৃষ্টি করিতে এই “অঙ” (= অ) “প্রত্যয় যুক্ত হয়। ডক্টর সুনীতিকুমারের গ্রন্থে প্রদত্ত অসংখ্য উচ্চারণে না গিয়ে ডক্টর রামেশ্বর’শ এর গ্রন্থ থেকে ‘আমি’ শব্দের প্রথাগত পদ্ধতি অনুসারে উদাহরণ উপস্থাপিত হলো।
আমিঃ সং অম্মদ শব্দের করণকারকের বহুবচন অস্মাভিঃ > প্ৰা অমহাহি ( বিপর্যাস। মূহ। ভূ= ব + > হঃ এর লোপ) > অপ, অমূহহি (হাইঃ আ- কারের ক্ষীনতা)> প্রা. বা অম হে (আগে, আগ্নে, অক্ষে, অন্তে) (ই> এ স্বরসঙ্গতি হহি> হেঃ একটি ছ-এর লোপঃ সমাক্ষর লোপ) > ম বা আম্মি > আমি (ক্ষ= ম্ + হ ঃ নাসিক্য বাগুনের মহাপ্রাণতার লোপ। অন্মাভিঃ (বহুবচন) > আমি
একবচন)ঃ অর্থসংকোচ অথবা বৈদিক অ্যে (সম্প্রদান / অধিকরণ)> প্রা. অমূহে ( > সঃ বিপর্য্যাস। > মৃহঃ স্-এর হ-কারীভবন) > প্রা বা অমূহে> মা-বা আম্মি> আমি ( = মহ>মঃ মহাপ্রাণ নাসিকোর মহাপ্রাণতার লোপ)।
অথবা বৈদিক ৪র্থ/ ৭মীর বহুবাচনের পদ অ>ে তা অমহে (> > মহ বিপর্য্যাস)> প্রা-বাং আমহে/ অমহে> আমহি> ম আগ্নি> আ. বাং আমি (ক্ষ) মূহ> মঃ মহাপ্রাণ নাসিক্যের মহাপ্রাণতার লোপ) (রামেশ্বর শ: ১৪০৩, ৬৭৮)।
কোনো শব্দের গঠন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রথাগত পদ্ধতির এ ধরনের প্রয়াস কতটা যুক্তিযুক্ত বাংলা ব্যাকরণ রচনায় তা ভেবে দেখার অপেক্ষা রাখে। এমনও হতে পারে কোনো কোনো শব্দের ব্যাখ্যা জরুরি আবার আধিকাংশ শব্দের ব্যাখ্যা অপ্রয়োজনীয়।
কিছু শব্দের গঠন বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নিজেই বলেছেন- ‘বাঙালির পক্ষে কিন্তু এইরূপ বিশ্লেষ নিরর্থক, বাঙ্গালার পক্ষে এই প্রকারে শব্দকে মৌলিক, পূর্ণধি, অবিশ্লিষ্ট বা অবিভক্ত শব্দ বলিয়া ধরাই সঙ্গত হইবে’ (পূর্বোক্ত, সুনীতিকুমার: ২১২)।
বাংলা শব্দের গঠনঃ সাংগঠনিক পদ্ধতি
বাংলা ভাষার শব্দের গঠনপ্রণালী ও তার বর্ণনা বিশ্লেষণে গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীরও দুই তৃতীয়াংশ সময় ধরে ব্যাকরণবিদগণ প্রথাগত ব্যাকরণের কাঠামোর মধ্যেই আবদ্ধ ছিলেন।
বিশ শতকের প্রায় এক চতুর্থাংশ সময় কেটে যাওয়ার পর কালানুক্রমিক তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে অর্থাৎ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯২৬) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৬৩) এবং সুকুমার সেন (১৩৬৪) তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের প্রণালী পদ্ধতি অনুসরণে বাংলা শব্দের কালানুক্রমিক বর্ণনার সূত্রপাত করেন। পরবর্তীকালে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান চর্চার প্রেক্ষিতে সাংগঠনিক কিংবা রূপান্তরমূলক ব্যাকরণের পদ্ধতি অনুসরণ করে বাংলা শব্দের গঠন-প্রণালী বা তার
রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের চেষ্টাও যে হয়নি, তা নয়। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রে সে প্রচেষ্টা শুরু হয় এবং এখন পর্যন্ত তার ফলাফল যৎসামান্য। বাংলা শব্দতত্ত্ব বিষয়ক নিবন্ধ ও গ্রন্থসমূহের পর্যালোচনায় একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হবে৷ উঠে।
আর তা হল- অভিধান সংকলক, বৈয়াকরণ ও ভাষাবিজ্ঞানী যাঁরাই বাংলা শব্দের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হয়েছেন, যে পদ্ধতি তাঁরা অনুসরণ করুন না কেন, সর্বত্রই তাঁদের রচনা ও আলোচনার মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে পৃথক দুটি প্রবণতা লক্ষিত হয়েছে। অধিকাংশ গবেষকই বাংলা শব্দের গঠন কৌশল বর্ণনাই, তার ব্যবহার বিধি প্রণয়নে প্রথাগত ব্যাকরণে বিশেষ করে সংস্কৃত ব্যাকরণে অনুশাসনকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
……….. আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের রূপতত্ত্ব অধ্যায়ের কাজ হলো শব্দের অভ্যন্তরীণ সংগঠন বিশ্লেষণ করা, তার বিভিন্ন উপাদানের বিশেষ করে শাব্দিক ও ব্যাকরণের রূপের প্রকৃতি চিহ্নিত করে উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের আন্তর রহস্য উন্মোচন করা। বর্তমানে শতাব্দীর দুই-তৃতীয়াংশ কেটে যাবার পর মাত্র এই সেদিন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঙালি গবেষকগণ সাংগঠনিক ও সৃষ্টিশীল ব্যাকরণের পদ্ধতিতে বাংলা ভাষার রূপতত্ত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন (শামসুন নাহার গর: ১৯৯৪; ১৪১-১৪৮)।
শব্দগঠন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সাংগঠনিক বা বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের বড় অবদান Morphology বা রূপমূলতত্ত্ব। Morpheme (রূপমূল), Bound morpheme (বন্ধরূপমূল), allomorph (সহরূপমূল) ইত্যাদি পরিভাষা আবিষ্কারের ফলে শব্দের গঠন, বিশ্লেষণ সহজতর হয়েছে।
একটি মুক্তরূপমূলের আগে অথবা পরে বন্ধরূপমূল যুক্ত করে বাংলা ভাষার শব্দ গঠিত হতে পারে। এ ধরনের বক্তব্যে নতুনত্ব হয়তো নেই। ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীগণ অন্য পরিভাষা ব্যবহার করে একথাগুলো অবশ্যই বলেছেন। কিন্তু সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীরা সহরূপমূলের ধারণা প্রদান করে শব্দগঠন সম্পর্কিত অনেক সমস্যা সমাধান
করেছেন। বাংলা বহুবচন সূচক রূপমূলের অনেকগুলো আকার বৈচিত্র্যের মধ্যে রা – এরা গণ এ তিনটি ব্যাখ্যা সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান পূর্ববর্তী ব্যাকরণে খুব একটা নেই বললেই চলে। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীগণ যখন বলেন ‘রা’ বসে স্বরান্ত শব্দের পরে, ‘এরা’ বসে বাগুনাভ শব্দের পরে এবং ‘গণ’ বসে কোনো ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শনের পূর্বে তখন শব্দের গঠন বিশ্লেষণ অনেক সহজ হয়ে পড়ে।
শব্দের সংজ্ঞা এবং সীমা নির্ধারণে সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীগণ যখন বলেন একটি মুক্তরূপমূলের সঙ্গে এক বা একাধিক বন্ধরূপমূল যুক্ত হয়ে শব্দ গঠিত হতে পারে, তখন শব্দের সংজ্ঞা এবং সীমা নির্ধারণ সহজ হয়ে পড়ে। ধরা যাক ‘ছেলে’ একটি মুক্তরূপমূল এবং একটি শব্দ। ছেলেরা ছেলেদেরকে, ছেলেমি, ছেলেমিকে এর প্রত্যেকটি কি এক একটি শব্দ? সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের প্রাথমিক সংজ্ঞানুসারে যেহেতু ‘ছেলে’ এর সঙ্গে একটি মাত্র বন্ধরূপমূল ‘মি’ যুক্ত হয়েছে সেহেতু ‘ছেলেমি’ একটি শব্দ এবং অনুরূপ ‘ছেলেরা’ও একটি শব্দ।
সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের শব্দকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংজ্ঞা থেকে সরল শব্দ, জটিলশব্দ এবং মিশ্র বা যৌগিক শব্দ, নির্ণয়ে কোনো জটিলতা থাকে না।
সরল শব্দ একটি মুক্তরূপমূল
উদাহরণ- ছেলে।
(খ) জটিলশব্দ = একটি মুক্তরুপমূল+ এক বা একাধিক বন্ধরূপমূল।
উদাহারণ- ছেলেরা, ছেলেদেরকে।
(গ) মিশ্র বা যৌগিকশন্স = দুটি বা দুয়ের অধিক মুক্তরূপমূল যদি তারা একটি শব্দের মত কাজ (function) করে।
উদাহরণ: ‘তোমার ছেলেমেয়ে ক’জন’ বাক্যে ‘তোমার সন্তান ক’জন’ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এ বাক্যে ছেলেমেয়ে রূপমূল দুটি একটি শব্দের মত কাজ করেছে। শব্দের derivation এবং Inflection এর ক্ষেত্রে সাংগঠনিক বা বর্ণনামূলক
ভাষাতত্ত্ব সহজ সংজ্ঞা ও পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। Derivation বলতে সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীগণ নতুন শব্দ গঠনের কথা বলেন এবং শব্দের শ্রেণী পরিবর্তনের উপর জোর দেন এবং Inflection বলতে শব্দের সম্প্রসারণের কথা বলেন। ধরা যাক ‘ছেলে’ থেকে সৃষ্ট দুটি শব্দ ‘ছেলেমি’ এবং ‘ছেলেরা’ সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানুসারে সহজে বলা সম্ভব ছেলে এর সঙ্গে মি’ যোগ করে একটি নুতন শব্দ ছেলেমি গঠিত হয়েছে।
ছেলে থেকে সৃষ্ট ছেলেরা শব্দটি সত্যিকার অর্থে কোনো নতুন শব্দ তৈরি করে না। ফলে ছেলেরা শব্দকে ছেলে শব্দের সম্প্রসারণ বলা চলে। বাড়ি বাড়ি করে করে, করে ফেল, গান করা এই শব্দগুলোর গঠন বিশ্লেষণ সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে যথেষ্ট সহজ।।
(ক) বাড়ি বাড়ি = N N
(থ) করে করে = V + V
(গ) করে ফেল = V + V2
(ঘ) গান করা = Nj + V
প্রথাগত এবং সাংগঠনিক পদ্ধতিতে শব্দগঠন সংক্রান্ত আরো অনেক পরিভাষা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য, বিমিশ্রণ (contamination), জোড়কলম শব্দ (portanteau word ), সঙ্কর শব্দ (Hybrid word), মুণ্ডমাল শব্দ (Acrostic word), অনুকার শব্দ (Echo word), তুয়া শব্দ (Ghost word), লোকনিরুক্তি (Folk Etymology), শ্রুতিধ্বনি (Glide), বিষমচ্ছেদ (metanalysis / নিষ্ফালন/ ভ্রান্তিবিশ্লেষ) ইত্যাদি।
(ক) সাদৃশ্য এবং উদাহরণ
টাকার কুমির। মূলে ছিলো টাকার কুবির (কুবের অর্থাৎ যক্ষ)। যেহেতু কুমির শব্দের সঙ্গে বাঙালি বেশি পরিচিত সেজন্য টাকার কুমিরের সাদৃশ্যে টাকার কুবির হয়েছে, টাকার কুমির।
খ) বিমিশ্রণ ও উদাহরণ
ভাষাবিদ ডক্টর দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু ব্যাখ্যা দিয়েছেন- একটি শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে অন্য একটি অধিক পরিচিতি ধ্বনি সাদৃশ্যযুক্ত শব্দ মনে ভেসে ওঠে। এই দুই শব্দের মিলিত একটা তৃতীয় শব্দ গড়ে ওঠে, তখন এই গঠন প্রক্রিয়ার নাম মিশ্রণ’। যেমন > পোর্তুগীজ ‘পাউ’ এবং হিন্দুয়ানী ‘রুটি’ যোগে> পাঁউরুটি (তরুণ ঘোষ, উদ্ধৃত, ১৩৫)
(গ) জোড়কলম শব্দ ও উদাহরণ কোন একটি শব্দ বা তার অংশ বিশেষের সঙ্গে অন্য শব্দ জুড়ে তৈরি হয় জোড়কলম শব্দ। যেমন- আরবি ‘মিল্লং’ সংস্কৃতি বিজ্ঞপ্তি= বাংলা মিনতি (আ. মিল্লা+বাং বিনতি = মিনতি) ।
(ঘ)সঙ্কর শব্দ ও উদাহরণ
ইংরেজি ভাষার একটি শব্দ হেড এর সঙ্গে সংস্কৃত পণ্ডিত’ যুক্ত হয়ে সর শব্দ তৈরি হয়েছে। ইংরেজি হেড পণ্ডিত হেডপণ্ডিত।
(ঙ) মুণ্ডুমালশব্দ ও উদাহরণ
সাধারণত বাক্যাংশ বা নামের শুধু প্রথম অক্ষর যোগে গঠিত হয় মুণ্ডুমাল শব্দ। যেমন- ঢাবি = ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পাউবি= পানি উন্নয়ন বোর্ড, কাবিখা= কাজের বিনিময়ে খাদ্য ইত্যাদি। অনুরূপ ইংরেজিতে
UNESCO – United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization
(চ) অনুকার শব্দ ও উদাহরণ
মূলত সাদৃশ্যের কারণে সৃষ্টি হয় অনুকার শব্দ। একে প্রতিধ্বনি শব্দও বলা হয়। যেমন— শাড়ি টাড়ি, মিষ্টি টিষ্টি।
ছ) ভুয়া শব্দ ও উদাহরণ
উৎস বা মূল নেই এরূপ শব্দই হচ্ছে ভুয়া শব্দ, যেমন- প্রোথিত। সংস্কৃতে প্রোথ নামে ধাতু নেই- অথচ ‘প্রোথিত’ শব্দ পোঁতা অর্থে ব্যবহৃত (তরুণ ঘোষ: ১৩৬)।
(জ)লোকনিরুক্তি ও উদাহরণ
অস্পষ্ট বা কঠিন শব্দকে সহজ ও পরিচিত রূপ দেয়ায় তৈরি হয় লোকনিরুক্ত শব্দ। যেমন- Armchair থেকে আরামকেদারা, হসপিটাল থেকে হাসপাতাল ইত্যাদি। আরামকেদারা আরামদায়ক কেদারা বা চেয়ার, অর্ধশয়ানে থাকবার চেয়ার, স্বাচ্ছন্দবোধ হয় এমন কেদারা।
ইংরেজি arm- chair থেকে শব্দটি বাংলায় এসেছে। যার অর্থ হাতলওয়ালা চেয়ার, easy- chair অর্থে ব্যবহৃত। আমাদের সামাজিক জীবনে আরামে বসবার জন্য কোনো চেয়ার ছিল না। সংস্কৃত চতুষ্কী থেকে বাংলায় চৌকি পাওয়া যায়। ইংরেজদের আগমনের পর ইজিচেয়ার ও আর্মচেয়ারের আগমন ঘটে।
পরে বাংলা ভাষায় বিদেশি উৎসের দেশি উপকরণজাত শব্দ হিসেবে ‘আরামকেদারা’ তৈরি হয়। আরাম বাংলায় ব্যবহৃত ফারসি শব্দ, যার অর্থ সুস্থ্য বা রোগমুক্ত। কেদারা বাংলা শব্দ যার অর্থ চৌকি বা চেয়ার। Arm chair এর আর্ম ধ্বনি সাদৃশ্যে আম> আরম আরাম) তৈরি হয়েছে আরামকেদারা।
(ঝ) বিষমচ্ছেদ ও উদারণ
সংস্কৃত নবরঙ্গ অথবা ফারসি নারাঙ্গ থেকে Orange । ওর সুকুমার সেনের বিশ্লেষণ – “সংস্কৃত ‘নবরঙ্গ’ ফারসি ‘নারাঙ্গ’, তাহা হইতে আরবি ‘নারাণ্ড’, তাহা হইতে আধুনিক ইংরেজিতে an orange এইভাবে Norange শব্দ দাঁড়াইল Orange” (পূর্বোক্ত, তরুণ ঘোষের উদ্ধৃতি, ১৩৮)।
সমাজভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ ও গঠন বিশ্লেষণ
বাংলা শব্দের গঠন, বর্ণনা ও বিশ্লেষণ এর ক্ষেত্রে বাংলার প্রথাগত ভাষাবিজ্ঞানী এবং সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। যে-কোনো পদ্ধতিতেই সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। তাঁদের অবলম্বিত পদ্ধতিতেও স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা ছিল। সমাজভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের অন্যতম সীমাবদ্ধতা ছিল সমাজসূত্রের সঙ্গে ভাষাসূত্রকে সম্পর্কিত না করা।
তাঁদের সীমাবদ্ধতার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এই কথা ভুললেও চলবে না যে সত্যিকার অর্থে সমাজভাষাবিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়েছে ১৯৬০ দশকে। শ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি Competence পরিভাষা ব্যবহার করেছিলেন। সমাজভাষাবিজ্ঞানী ডেল হাইমস বলেছেন Competence এর চাইতে বেশি জরুরি।
Communicative Competence (ভাববিনিময় যোগ্যতা ) Communicative competence এর বাংলা উদাহরণ দিতে গিয়ে ডক্টর রাজীব হুমায়ুন আপনি, তুমি, তুই সর্বনাম এবং সম্পর্কিত ক্রিয়া করেন, করো, কর এর কথা বলেছেন। (রাজীব হুমায়ুন: ২০০১; ১১)। সমাজভাষাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত কয়েকটি পরিভাষা বাংলা শব্দ গঠন বিশ্লেষণের জন্য জরুরি। সেগুলো হচ্ছে ডায়গ্লসিয়া, সঙ্কেত বদল, বাইলিঙ্গুয়ালিজম, পিজিনিকরণ, ক্রেগুলিকরণ, রেজিস্ট্রার, সম্বোধনসূচক রূপমূল ইত্যাদি।
বাংলায় তাহারা তারা, অদ্য-আজ ইত্যাদি জোড়া শব্দ রয়েছে। সমাজভাষাবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে এ জোড়া শব্দের পেছনে রয়েছে সাধুরীতি, চলতিরীতির নিয়মিত ব্যবহার। প্রসঙ্গত আল্লাহ / ঈশ্বর, বেহেশত / স্বর্গ/ সোজা / নরক ইত্যাদি জোড়া শব্দের পেছনে রয়েছে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ।
প্রতিশব্দ ব্যবহারের প্রসঙ্গ এখানে উঠতে পারে। নারী প্রসঙ্গে মহিলা, ভদ্রমহিলা, নারী, ললনা, সুকেশা, সুদম্ভী, অক্ষতযোনি এরকম প্রচুর প্রতিশব্দ বাংলায় রয়েছে। এ প্রতিশব্দ সমূহের ব্যবহার কি আকস্মিক এসব শব্দের ব্যবহার কি সুচিন্তিত? এসব শব্দের নির্বাচনে সমাজ সংস্কৃতির প্রসঙ্গ
মাথায় রাখা যেতে পারে। ভদ্রমহিলা অর্থে ‘মাতারি’ শব্দটি কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যে নারীর চুল সুন্দর নয় তাকে সুকেশা বলা আর কানা ছেলেকে পদ্মলোচন বলা একই কথা। ইংরেজি Virgin অর্থ বাংলা অভিধানে অক্ষতযোনি শব্দটি রয়েছে। এ শব্দটি তথাকথিত সতীত্ব চিন্তার ধারক বাহক। পুরুষ ও পুরুষশাসিত সমাজের কুরুচির পরিচায়ক। প্রসঙ্গত আপামোর শব্দটির কথা বলা যেতে পারে।
আপামোর মিলে গঠিত হয়েছে আপামোর শব্দটি। ‘পামোর’ শব্দটি যদি তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হয়। তাহলে আধুনিক শ্রেণীসাম্যের দৃষ্টিকোণ থেকে আপামোর শব্দটি ব্যবহার যুক্তিযুক্ত নয়। সমাজভাষাবিজ্ঞানী লোভ ‘কাহ’ এবং ‘কার’ ব্যবহার প্রসঙ্গে Code switching এর কথা উত্থাপন করেছেন। বাংলায় মারা গেছে অর্থে Code Switching এর কথা বলেছেন মুহম্মদ আব্দুল হাই এবং আরো কেউ কেউ ( রাজীব হুমায়ুন: পুর্বোক্ত)।
কথা বাংলায় সম্বোধনসূচক রূপমূল হিসেবে ব্যবহৃত হয়- মনি, জান, ঘু -য়ে ইত্যাদি। ভাষাতত্ত্বের দশজন ছাত্রের মাঝে আঘোষিত জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, কাকামনি, ভাবিজান, কল্যাণীয়েসু, কল্যাণীয়াসু ইত্যাদি শব্দে ব্যবহৃত সম্বোধনসূচক রূপমূল সম্পর্কে অনেকেই সচেতন নন।
সালাত/নামায, সাওম/ রোযা, কিতাব, মক্তব ইত্যাদি শব্দের গঠন সম্পর্কে মাথা ঘামান না আনেকেই। গায়েহলুদ, চাষাভুষো, ছোটলোক ইত্যাদি শব্দকে সাধিত শব্দ হিসেবে বলাই কি শেষ কথা হবে? না কি এসব শব্দের গঠনের পেছনে রয়েছে সমাজ সংস্কৃতি ও সমাজ মানসের একটি ধারাবাহিকতা? মোগলরা ভারতবর্ষে না এলে হয়তো নামায, রোযা শব্দ বাংলায় প্রচলিত হতো না।
অন্যদিকে বিয়ে উপলক্ষে বর কনের গায়ে হলুদ মাখানোর প্রথা এবং সম্পর্কিত অনুষ্ঠান না থাকলে গায়ে হলুদ শব্দটির জন্ম হতো না। ‘ছোটলোক’ শব্দটির গঠন নিয়ে কী বলা যেতে পারে? ছোটলোক ছোটলোক। ছোটলোক কি? ছোট কি ইংরেজি small অথবা বাংলা কমবয়সীর প্রতিশব্দ। বাংলাদেশের সকলেই ছোটলোক শব্দের প্রচলিত অর্থ জানে।
ছোটলোক ব্যবহৃত হয় সমাজের অবহেলিত এবং তথাকথিত অনভিজাতদের ক্ষেত্রে। ছোটলোকের বিপরীত শব্দ বড়লোক। বড়লোক মানে লম্বা লোক নয়। এমন এক সময় আসবে বাংলা ভাষায় বড়লোক ছোট লোকদের গঠন সম্পর্কে এবং তার অন্ত নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে হয়তো সকলেই সচেতন হবেন।
শব্দের ভাগৎ একই সঙ্গে আকর্ষণীয় এবং জটিল। শব্দ সৃষ্টির ভেতরের রহস্য সাধারণ মানুষ জানে না। তাঁরা শুধু শব্দ ব্যবহার করেন ভাব বা তথ্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। ভাষাবিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে এখানে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের একটি সাধারণ শ্রেণীবিন্যাস করে আলোচনা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে সীমিত পরিসরে এবং বলা যায় বর্তমান অভিসন্দর্ভে শব্দের গঠন বিশ্লেষণে সমাজভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ ব্যবহারের সূচনামাত্র।
আরও দেখুন: