আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় শিখন সফলতার বিভিন্নতার ভিত্তিতে বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ – যা আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেণিতে সকল শিক্ষার্থীর চাহিদা মেটানোর উপায় এর অন্তর্ভুক্ত।
শিখন সফলতার বিভিন্নতার ভিত্তিতে বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ
শ্রেণিকক্ষ
শ্রেণিকক্ষ বরাবরই একটি জটিল জগৎ (A complex world) হিসেবে আখ্যায়িত। একটি শ্রেণিকক্ষে নানা বৈশিষ্টের শিক্ষার্থীর সমারোহ থাকে। তাদের শিখন সামর্থ্য, শিখনের ধরণ এবং শিখন চাহিদাও বৈচিত্র্যময়। নির্দিষ্ট মাপের একজোড়া জুতা যেমন সবার পায়ে সমানভাবে খাপ খায় না, তেমনি বৈচিত্র্যময় শিখন সামৰ্থ্য এবং শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনায় শিক্ষক কর্তৃক নির্বাচিত ও ব্যবহৃত দু’একটি পদ্ধতি ও কৌশলই কেবল যথেষ্ঠ নয়। এজন্য চাই শিক্ষার্থীদের বিভিন্নতার ভিত্তিতে বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ। এ অধিবেশনে আমরা আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিখন সক্ষমতার বিভিন্নতার ভিত্তিতে বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
বিস্তৃত কার্যক্রম-এর ধারণা
বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ বলতে শ্রেণিকক্ষ ও বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী যাতে কার্যকর ও সফলভাবে শিখতে পারে সে জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতি ও শিক্ষার্থীর চাহিদানুসারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করাকে বোঝায়। শিখন সফলতার বিভিন্নতার ভিত্তিতে বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণের পরিসর বা ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক। এক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকের সাথে সাথে অনেক বিষয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধান, সংশ্লিষ্ট প্রশাসক, শিক্ষার্থীর অভিভাবক এবং সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সংশ্লিষ্টতা ও সহায়তা প্রয়োজন।
শ্রেণিকক্ষের অভ্যন্তরে শিক্ষকের বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ বলতে বিশেষত শিক্ষার্থীর স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যময় শিখন চাহিদা চিহ্নিত করে তা পূরণের উদ্দেশ্যে শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল নির্ধারণ ও শিখন সহায়তায় বৈচিত্র্যের অবতারণা করাকে বোঝায়। বর্তমান অধিবেশনের বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণের আলোচনায় কেবল শ্রেণিকক্ষের ভিতরে অবলম্বনযোগ্য বা প্রয়োগ যোগ্য কার্যক্রম সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন সক্ষমতার শিক্ষার্থী ও তাদের শিখন
শিক্ষার্থীরা নানাভাবে শিখে। একটি শ্রেণিকক্ষে নানা চাহিদা ও নানা বৈশিষ্ট্যের শিক্ষার্থীর সমাবেশ থাকে । তাদের শিখন স্টাইল এবং চাহিদা ও বৈচিত্র্যময়। বুদ্ধিমত্তা, প্রবণতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ, চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বহুমাত্রিক বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য থাকে । শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা মৌখিক বা ভাষা বৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তায় পারদর্শী তারা শোনা, বলা, লেখা ইত্যাদি কৌশলে ভাল শেখে। যৌক্তিক ও গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা প্রবণ শিক্ষার্থীরা যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সহজেই বিমূর্ত বিষয়ের ধারণা লাভ করে।
আবার দৃষ্টি ও অবস্থানমূলক বুদ্ধিমত্তা প্রবণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষণের ক্ষেত্রে চিত্র, প্রতিকৃতি, মানচিত্র, অংকন, চার্ট, ডায়াগ্রাম ইত্যাদির ব্যবহার বেশ কার্যকর। হাতে-কলমে কাজ করে ভাল শেখে অনুভূতি ও শরীর বৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তা প্রবণ শিক্ষার্থীরা। শিখনে ছন্দ, সুর, তাল ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে ছন্দ ও সঙ্গীতমূলক বুদ্ধিমত্তায় চৌকস শিক্ষার্থীরা কার্যকরভাবে শিখে। আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা প্রবণ শিক্ষার্থীরা গভীর চিন্তা-ভাবনা, একক কাজ, মাথা খাটানো ইত্যাদি কৌশলে কার্যকরভাবে শিখে।
আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা প্ৰবণ শিক্ষার্থীরা জোড়ায় কাজ, দলীয় কাজ এবং বিভিন্ন সহযোগিতামূলক শিখন কৌশলে শিখতে পছন্দ করে। প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা প্রবণ শিক্ষার্থীরা প্রাকৃতিক পরিবেশ-এর বিভিন্ন উপাদান থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে শিখতে পছন্দ করে। এছাড়া আবার শ্রেণিকক্ষের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (Learners with special need) বা বিশেষভাবে সক্ষম শিক্ষার্থীদের শিখন সহায়তার জন্য গতানুগতিক পদ্ধতি ও কৌশলের সাথে শিক্ষককে কিছু ভিন্ন কৌশল (যেমন— একীভুত শিখন-শেখানো কৌশলসমূহ) অবলম্বন করতে হয়।
এভাবে শ্রেণিকক্ষের শারীরিক সমস্যা-সম্পন্ন শিক্ষার্থী, শ্রবণ সমস্যা-সম্পন্ন শিক্ষার্থী, বাক সমস্যা-সম্পন্ন শিক্ষার্থী, বুদ্ধি ও আবেগিক সমস্যা-সম্পন্ন শিক্ষার্থী, অনগ্রসর শিক্ষার্থীর শিখন চাহিদা পূরণে আবার বাড়তি কিছুপদ ক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। এভাবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিখন সক্ষমতার বিভিন্নতার প্রেক্ষিতে সব ধরনের শিক্ষার্থীর শিখন চাহিদা পূরণকল্পে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় বিস্তৃতকার্যক্রম গ্রহণ করা অনিবার্য হয়ে পড়ে |
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিখন সক্ষমতার বিভিন্নতার প্রেক্ষিতে বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিখন সক্ষম তার বিভিন্নতার প্রেক্ষিতে বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ এর নানা উপায় আছে। নিম্নে কতিপয় উপায় সম্পর্কে আলোকপাত করা হল:
শ্রেণিকক্ষে শিখন বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি
শ্রেণিকক্ষ হল শিক্ষার্থীদের শিখনের অন্যতম মূল স্থান যেখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সহায়তায় সবাই মিলে শিক্ষা গ্রহণ করে। শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এটি হবে শিখন বান্ধব শ্রেণিকক্ষ। এ প্রসঙ্গে ইউনেস্কো, ঢাকা, প্রণিত (বাংলায় অনুদিত) একটি টুলকিটে উল্লেখ করা হয়েছে: শিখনবান্ধব-এর মূলকথা হল শিক্ষার্থীকে কার্যকরভাবে মূল শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা। একটি শিখনবান্ধব পরিবেশে শিক্ষার্থীরা কেবল নিজেরা শিক্ষা গ্রহণ করেই উপকৃত হয় না বরং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে যেখানে তাদের চাহিদাগুলো বিবেচনা করা হয়, তা থেকেও উপকৃত হয়।
একটি শিখনবান্ধব পরিবেশে শিক্ষার্থীদেরকে তাদের শিখনে অংশগ্রহণ করার পূর্ণ সুযোগ দেয়া হয়। এটি এমন একটি পরিবেশ যেখানে শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করেও মানিয়ে নিতে পারেন এবং যেখানে অভিভাবক এবং সমাজের সদস্যরা তাদের শিক্ষার্থীদের শিখনে সহায়তা করার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে এবং তাদের বিদ্যালয়কে চালু রাখতে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত হয়। এ ব্যাপারে শিক্ষকদের সহায়তা ও ক্ষমতায়ন করা হয় ।
শ্রেণিকক্ষে একীভূত শিখন-শেখানো সংস্কৃতির উন্নয়ন ও পদ্ধতি প্রয়োগ
শিখন সফলতার বিভিন্নতার প্রেক্ষিতে আরবি আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শিখন-শেখানো কাজে বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে শ্রেণিকক্ষে একীভূত শিখন-শেখানো সংস্কৃতির উন্নয়ন ও একীভূত শিক্ষার পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ। কারণ একীভূত শিক্ষা এমন একটি শিক্ষা দর্শন ও পদ্ধতিগত প্ৰক্ৰিয়া যা শিক্ষার্থীর শিখন চাহিদা ও সফলতার বিভিন্নতার প্রেক্ষিতেই সৃষ্ট। রাষ্ট্র, সমাজ, বিদ্যালয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার ভূমিকা বিবেচনায় একীভূতকরণ (Inclusion)-এর ধারণায় ব্যাপকতা রয়েছে।
সামগ্রিকভাবে একীভূত শিক্ষার ধারণা অনেক কিছুকে সামিল করে, যেমন- শিখনে শিশু/শিক্ষার্থীকে সুযোগদান, স্কুল বয়সী সকল সামর্থ্য ও পরিবেশ-পরিস্থিতির শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে অন্তর্ভূক্ত করা, একীভূত শিক্ষা দর্শনের আলোকে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণনয়ন, একীভূত বিদ্যালয় প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা, একীভূত শিক্ষাক্রম, একীভূত বিদ্যালয়, একীভূত শিখন-শেখানো সামগ্রী, একীভূত মূল্যায়ন পদ্ধতি ইত্যাদি।
শ্রেণিকক্ষের প্রেক্ষিতে একীভূত শিক্ষা বলতে শ্রেণিকক্ষে বিদ্যমান সকল সামর্থ্যের শিক্ষার্থীর ভিন্নতাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে মেনে নিয়ে সব ধরণের শিক্ষার্থীর শিখন চাহিদা পূরণ ও শিখন সহায়তাদানের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি, কৌশল ও কার্যক্রম গ্রহণ। এ জন্য শ্রেণিকক্ষে একীভূত শিখন-শেখানো সংস্কৃতির উন্নয়ন ও পদ্ধতি প্রয়োগের সাথে আবার বহু মাত্রিক কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেমন-
- বিষয়/শ্রেণি শিক্ষককে একীভূত শিক্ষকে পরিণত হওয়ার/করার কার্যক্রম। অর্থাৎ, আরবি-এর শ্রেণিকক্ষে একীভূত শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রথম এ বিষয়ের শিক্ষককে একীভূত শিক্ষা দর্শন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন করে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে প্রথমত তাকে একজন ‘একীভূত শিক্ষক’-এ পরিণত হতে হবে । একীভূত শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা অর্জনের কার্যক্রম।
- একীভুত শিখন-শেখানো পদ্ধতি কৌশল অবলম্বনের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম।
- একীভূত শিখন-শেখানো উপকরণ সামগ্রী নির্ধারণ/প্রণয়ন/ব্যবহার সংক্রান্ত কার্যক্রম ।
- একীভূত পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষ মূল্যায়ন, গাঠনিক মূল্যায়ন ও সামষ্ঠিক মূল্যায়ন দক্ষতার উন্নয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম।
- বিশেষভাবে সক্ষম বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যমান শিক্ষাক্রমকে নমনীয় প্রক্রিয়ায় (Flexible way) বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম ইত্যাদি।
অংশগ্রহণমূলক শিখন-শেখানো সংস্কৃতির উন্নন
শিক্ষার্থীদের শিখন সফলতার বিভিন্নতার প্রেক্ষিতে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শিখন-শেখানো কাজে বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণের অন্যতম আরেকটি উপায় হচ্ছে শ্রেণিকক্ষে বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণমূলক কৌশল অবলম্বন। অংশগ্রহণমূলক শিখন-শেখানো পদ্ধতি অন্যান্য পদ্ধতির মত কেবল একক কোনো পদ্ধতির নাম নয়।
এটি এমন একটি শিখন-শেখানো সংস্কৃতি যাতে শিখনে সক্রিয় অংশগ্রহণের বৈচিত্র্যময় কৌশল অবলম্বন করে শিক্ষার্থীদের শিখনে সহায়তা প্রদান করা হয়। অংশগ্রহণমূলক শিখন-শেখানো কৌশলের তালিকা ব্যাপক। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শিখন-শেখানো কাক্রমকে অংশগ্রহণমূলক করার জন্য এবং শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার জন্য নিম্নোক্ত কৌশলসমূহ যথাযথ প্রক্রিয়ায় ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারেন। যেমন-
- একক কাজ (Working Alone);
- জোড়ায় কাজ (Pair Work);
- দলীয় কাজ ( Group Work);
- মাথা খাটানো (Brain Storming);
- সতীর্থ শিক্ষণ (Peer Teaching);
- ভূমিকাভিনয় (Role Play);
- নাটকাভিনয় (Dramatization);
- তূষার বল (Snow Balling );
- বিশেষজ্ঞ কর্তন (Expert Jigsaw);
- ফিস বল (Fish Bowl);
- আটার রোলে বাদাম সাজানো (Doughnut);
- ডাক বাক্স (Post Box);
- স্কাফল্ডিং (Scaffolding);
- মডেলিং (Modeling);
- পর্যবেক্ষণ (Observation);
- প্রদর্শন (Demonstration);
- ধারণা মানচিত্র (Concept Mapping);
- মানসিক মানচিত্র (Mind Mapping);
- মার্কেট প্লেস (Market Place);
- প্রশ্নকরণ (Questioning);
- অনুসন্ধান (Investigation) ইত্যাদি।
সতীর্থ শিক্ষণ-শিখন সংস্কৃতির উন্নয়ন
শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের শিখন সামর্থ্যে পার্থক্য সব সময়েই বিদ্যমান। তাই অনেক সময় শ্রেণিতে সরাসরি শিক্ষকের শিখন-শেখানো কার্যক্রম থেকে সকল শিক্ষার্থী শিখন বিষয়বস্তু একবারেই রপ্ত করতে পারে না। তাছাড়া আবার শ্রেণি শিক্ষককে তার একার পক্ষে শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত শিখন সহায়তা প্রদান করাও সহজ নয়। এক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় শিখন চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের চাহিদাপূরণ তথা শিখন সহায়তার উপায় হিসেবে সতীর্থ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি ও কৌশলসমূহ বেশ কার্যকর।
শ্রেণিকক্ষে অনেক বিষয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের চেয়ে তাদের সতীর্থদের থেকে বেশি শিখে থাকে। সতীর্থদেরকে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পাওয়ার মাধ্যমে এবং তাদেরকে শিখনে সহায়তা করার মাধ্যমে নিজেরা অনুপ্রাণিত, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও উৎসাহী হয়। সতীর্থ শিখন পদ্ধতির সাথে সহযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি ও কৌশলের অনেক ক্ষেত্রে সাদৃশ্য আছে। বিভিন্ন ধরণের অংশগ্রহণমূলক কৌশল যেমন জোড়ায় কাজ, দলীয় কাজ, দলীয় আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে সতীর্থ শিখন পদ্ধতিকে বাস্তবায়ন করা যায়।
এক্ষেত্রে আবার জোড়া গঠন, দল গঠনের ক্ষেত্রে নানা নীতিমালা অবলম্বন করে সতীর্থ শিখন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে হয়। দল গঠনের ক্ষেত্রে যেমন পরিস্থিতি সাপেক্ষে অগ্রসর ও অনগ্রসর শিক্ষার্থীর মিশ্রণ কিংবা সমমনা বা সমগোত্রের (Homogeneous) সমন্বয়ে দল গঠন অথবা নানাধর্মী (Heterogeneous) সামর্থ্যের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে দল গঠন ইত্যাদি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়।
সতীর্থ শিখন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মাঝে পারস্পরিক আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা একে অপরের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন হয়ে ওঠে। আবার এ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি দিতে শিখে। এ সতীর্থ শিখন সংস্কৃতির উন্নয়নে বিভিন্ন রকম কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন-
- শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মাঝে পারস্পরিক ইতিবাচক সম্পর্ক সৃষ্টিতে সহায়তার কৌশল সংক্রান্ত কার্যক্রম;
- শিখন প্রক্রিয়ায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে অনুমোদন দেওয়া ও শিখনে তাদেরকে ক্ষমতায়িত করার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সংক্রান্ত কার্যক্রম;
- তাদের মাঝে পরস্পর সহযোগিতা করার পরিবেশ সৃষ্টি করার উপায় সংক্রান্ত কার্যক্রম;
- অংশগ্রহণ (Participation) ও কাজে জড়িতকরণ (Engagement) নিশ্চিতকরণের নীতি-পদ্ধতি সংক্রান্ত কার্যক্রম;
- সতীর্থ শিক্ষণ পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপায় সংক্রান্ত কার্যক্রম ইত্যাদি।
শ্রেণিকক্ষে সহযোগিতামূলক শিখন সংস্কৃতির উন্নয়নে কার্যক্রম
এ পৃথিবীতে কোন কিছুই নিরঙ্কুষভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। প্রত্যেক জীব ও বস্তুত কোনো না কোনোভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল। সমাজ, সংসার তথা বাস্তবজীবনে পারস্পরিক সহযোগিতা যেমন জীবনকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি শ্রেণিকক্ষে শিখনে শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সহযোগিতা শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে অর্থবহ ও ফলপ্রসূ করে তুলতে সহায়তা করে। একটি শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর শিখন সামর্থ্য এক নয়।
শিক্ষার্থীরদের মাঝে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ও সহযোগিতার মাধ্যমে কেবল অনগ্রসর শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়— এমন নয়, বরং শিখনে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে শ্রেণির অগ্রসর-অনগ্রসরসহ সব ধরনের শিক্ষার্থীই উপকৃত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং নিজেদেরকে প্রকাশ করার প্রকৃতি হিসেবে ৩ ধরণের শ্রেণিকক্ষ দেখা যায়, যেমন-
(ক) প্রতিযোগিতামূলক (Competitive),
(খ) ব্যক্তিতান্ত্রিক (Individualistic) এবং
(গ) সহযোগিতামূলক (Cooperative)।
প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে প্রথমোক্ত দুই ধরণের শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার্থীদের মাঝে অসহযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি করতে থাকে— যা প্রকৃতপক্ষে কাম্য নয়। পক্ষান্তরে, সহযোগিতামূলক (Cooperative) শ্রেণিকক্ষে শিখন সম্পাদিত হয় পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে।
সহযোগিতা বলতে মূলত কোনো একটি যৌথ লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য একত্রে কাজ করাকে বোঝায়। যেমন- Johnson and Johnson (1989) বলেন, “Co-operation is working together to accomplish shared goals”. বহু গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত যে যখন শিক্ষার্থীরা পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তিতে শ্রেণিকক্ষে কাজ করে, তখন তারা আরো কার্যকরভাবে শিখনফল অর্জন করতে পারে। তাই শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতামূলক বা ব্যক্তিতান্ত্রিক পদ্ধতির চেয়ে সহযোগিতামূলক শিখন প্রক্রিয়ায় অধিকতর সফলতা লাভ করে।
এ প্রসঙ্গে Johnson and Johnson, ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মোট ১২২টি গবেষণা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে সহযোগিতামূলক শিখন একটি শক্তিশালী সফল শিখন পদ্ধতি।
তাদের মতে, Co-operation seems to be much more powerful in proceeding achievement than other interaction patterns and results hold for several subject areas and a range of age group from elements school through adult. শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি উন্নতকরণে সহযোগিতামূলক শিখন পদ্ধতি/পদ্ধতিসমূহের ভূমিকা ব্যাপক। যেমন— জনসন ও জনসন, হোপার ও হানাফিন (১৯৮৯) বলেন, এ পদ্ধতি বিভিন্ন বর্ণ, সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাঝে পারস্পরিক উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে।
প্লাভিন (১৯৮৭)-এর মতে, এ পদ্ধতি বৈচিত্র্যময় মূল্যবোধ সম্বলিত শিক্ষার্থীদের প্রতি অন্যান্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্নত করে । কপার (১৯৮৪) উক্তি করেন, এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের যথার্থ সহায়তা করার একটি কার্যকরি উপায় সৃষ্টি করে দেয়।
শ্রেণিকক্ষে শিখনে সহযোগিতার সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষ-পরবর্তী বাস্তব জীবনে পারস্পরিক সহযোগিতার মানসিকতা গড়ে তোলে। শ্রেণিকক্ষে পারস্পরিক সহযোগিতার চর্চা বাস্তব জীবনে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য শিক্ষার্থীকে প্রস্তুত করে দেয়।
বাস্তব জীবন অন্যের সহযোগিতা ছাড়া অচল। এজন্য শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের শিখন সক্ষমতার বিভিন্নতার প্রেক্ষিতে তাদের সবার চাহিদাপূরণে সহযোগিতামূলক শিখন সংস্কৃতির উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণিতে সহযোগিতামূলক শিখনের নানা মডেল ও কৌশল আছে। শ্রেণিকক্ষে এ সহযোগিতামূলক শিখন সংস্কৃতির উন্নয়নে নানা ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করার মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় সক্ষমতা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিখনে সহায়তা করা যায়।
শিখন-শেখানো উপকরণ সামগ্রী অর্থপূর্ণভাবে নির্বাচন, প্রণয়ন ও ব্যবহার সম্পর্কিত কার্যক্রম
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিখন সক্ষমতার বিভিন্নতার প্রেক্ষিতে শিখন-শেখানো উপকরণ ও সামগ্রী অর্থপূর্ণভাবে নির্বাচন, প্রণয়ন ও ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। কারণ, উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে সব ধরনের শিক্ষার্থীর শিখন চাহিদাপূরণ সহজ হয়। বিশেষত বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের আইসিটি মিডিয়া এবং আইসিটিভিত্তিক উপকরণ উন্নয়ন এবং শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন সফ্টওয়ার ও অ্যাপ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ ও তা ব্যবহারের মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় শিখন চাহিদা বিশিষ্ট শিক্ষার্থীদেরকে সহজেই সহায়তা প্রদান করা যায়। এজন্যেও বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ প্রয়োজন ।
শ্রেণিকক্ষে বহুমুখি যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার সংক্রান্ত কার্যক্রম
বিভিন্ন সক্ষমতার শিক্ষার্থীদের শিখন সহায়তাদানে শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন ধরণের যোগাযোগ কৌশল ও দক্ষতার ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কৌশল। তাই শ্রেণিকক্ষে বহুমুখি যোগাযোগ মাধ্যম ও যোগাযোগ দক্ষতা ব্যবহারের বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের কার্যকর শিখনে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক— শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থী যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপায়। শ্রেণিকক্ষে কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যমে শিখন- শেখানো কার্যক্রম গতিশীল ও উদ্দেশ্যপূর্ণ হয়।
এজন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্তঃব্যক্তিক ও যোগাযোগ দক্ষতার উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা আবশ্যক। শ্রেণিকক্ষে নানা মাধ্যমে যোগাযোগ সংঘটিত হয়, যেমন- লেখার মাধ্যমে যোগাযোগ, বলার মাধ্যমে যোগাযোগ, শোনার মাধ্যমে যোগাযোগ, দৃষ্টির মাধ্যমে যোগাযোগ, উপকরণ ব্যবহার বা প্রদর্শনের মাধ্যমে যোগাযোগ ইত্যাদি। এছাড়া শ্রেণিকক্ষে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক নানা যোগাযোগ মাধ্যম উন্নয়ন ও ব্যবহারে কার্যক্রম গ্রহণ করে বিভিন্ন সামর্থ্যের শিক্ষার্থীদের সহায়তাদানে কার্যকর ভূমিকা পালন করা যায়।
সর্বোপরি, শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর শিখন সক্ষমতা এক নয়। শিখন সক্ষমতায় বৈচিত্র্যসত্ত্বেও সকল শিক্ষার্থী একটি শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের সকলের শেখার যেমন অধিকার আছে, তেমনি আবার তারা সকলেই শিখতেও পারে। শিখনে তাদের সকলকে অন্তর্ভুক্ত করেই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষককে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। এজন্য প্রয়োজন তাদের নিজ নিজ বৈচিত্র্যময় চাহিদাসমূহ পূরণ এবং বিভিন্ন উপযোগী পদ্ধতিতে তাদের শিখন সহায়তা দান। আর তাদের এ বৈচিত্র্যময় চাহিদা পূরণের তাগিদেই বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ করা আপরিহার্য।
আরও দেখুনঃ