সংস্কৃতি কথা ১

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সংস্কৃতি কথা ১

সংস্কৃতি কথা ১

 

সংস্কৃতি কথা ১

 

সংস্কৃতি কথা ১

ভূমিকা

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধটিতে প্রবন্ধকারের সংস্কৃতি সম্বন্ধীয় চিন্তা-ভাবনা যুক্তি ও তর্কের ভেতর দিয়ে মুক্তবুদ্ধির আলোকে প্রকাশিত। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ‘সাহিত্য-সমাজ’ নামে যে প্রতিষ্ঠানটি ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলো মোতাহের হোসেন চৌধুরী ছিলেন তার সঙ্গে সংশিষ্ট। তাঁর সংস্কৃতি চিন্তার মূলেও রয়েছে মূলত মুক্তবুদ্ধির আহ্বান। জ্ঞানের আড়ষ্টতা ও বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা থেকে বৌদ্ধিকমুক্তির প্রত্যাশা ব্যক্ত মোতাহের হোসেন চৌধুরীর প্রবন্ধে ।

লেখক পরিচিতি

মোতাহের হোসেন চৌধুরী ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ এবং ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিলো নোয়াখালি জেলার কাঞ্চনপুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে এম.এ. পাশ করে অধ্যাপনায় যোগ দেন। তিনি ছিলেন সুরুচিসম্পন্ন, সংস্কৃতিবান, উদার, যুক্তিবাদী মানুষ।

ঢাকার ‘সাহিত্য-সমাজ’ (১৯২৬) প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ছিলো তাঁর গভীর যোগাযোগ। তিনি মূলত প্রাবন্ধিক হিসেবেই খ্যাত। প্রথম জীবনে কবিতা লেখার কারণে বন্ধু ও পরিচিতমহলে ‘কবি’ হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিলো। পরবর্তীকালে কবিতা লেখা ত্যাগ করে বাংলা ভাষায় যুক্তিশিষ্ঠ ও মুক্তবুদ্ধি-দীপ্ত প্রবন্ধ রচনায় তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর গদ্যে একটি বিশিষ্টতা আছে। সরল ও আকর্ষণীয় গতিশীল গদ্য তিনি রচনা করেছেন।

কৃত্রিম আড়ষ্টতা নয়, বরং অনুপলব্ধ চিন্তাকে রসসমৃদ্ধ করে পরিবেশনের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। শিল্পীর একাগ্রতা ও অধ্যবসায়ে তিনি তাঁর ভাষা ও রচনাশৈলী গড়ে তুলেছেন। জীবনদর্শনে তিনি ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০) ও ক্লাইভ বেল (১৮৮১-১৯৬৪)- এর ভাবানুসারী। স্বাধীন ও মুক্ত ব্যক্তিত্বের বিকাশ তাঁর অন্বিষ্ট ছিলো, কিন্তু তা তিনি করতে চেয়েছেন সামাজিক অনুষঙ্গকে সংস্কারের মাধ্যমে।

বুদ্ধির মুক্তির পথ ধরে তিনি যাত্রা করলেও হৃদয়ধর্মকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সংস্কৃতি-সাধনার গভীরে এ বোধই কার্যকর। জীবদ্দশায় তাঁর কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। মৃত্যুর পর ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর একমাত্র বাংলা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রকাশিত হয়। এছাড়া প্রকাশ পায় ক্লাইভ বেলের Civilization -এর অনুবাদ ‘সভ্যতা’ (১৯৬৫) ও ‘Conquest of Happiness’-এর অনুবাদ ‘সুখ’ (১৯৬৮)।

পাঠ-পরিচিতি

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর একমাত্র প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সংস্কৃতি-কথা’ (১৯৫৮) থেকে ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে প্রবন্ধকারের সংস্কৃতি সম্বন্ধীয় ভাবনা যৌক্তিক যুক্তির পারম্পর্যে ও তর্কের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত। মুক্তবুদ্ধির যে আন্দোলন তাঁরা শুরু করেছিলেন, এ প্রবন্ধেও তার প্রভাব কার্যকর। বিষয় ও শিল্পরীতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সাহিত্য শিল্পের নামকরণ করা হয়ে থাকে।

বর্তমান প্রবন্ধের নামকরণের ক্ষেত্রে সে দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়েছে। কারণ এখানে সংস্কৃতির মৌল উপাদান চিহ্নিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে মানব জীবনে এর প্রভাব বিস্তার সম্পর্কে উল্লেখ আছে। প্রবন্ধটির মূল বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেই এর নামকরণ যথার্থ হয়েছে কিনা তা বুঝা যাবে। ‘সংস্কৃতি’ অভিধাটি বিশাল ও বহুমাত্রিক। এর সংজ্ঞা ও স্বরূপ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কম হয়নি। বহু মণীষী এ নিয়ে গভীর ও পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন।

মোতাহের হোসেন চৌধুরীও এ প্রসঙ্গে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন বর্তমান প্রবন্ধে। তিনি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীচেতনা, মতবাদ-অন্ধত্ব ও ধর্মীয় অনুভূতির গন্ডিবদ্ধতা শনাক্ত করে সংস্কৃতির যথার্থ পরিচয় তুলে ধরেছেন। প্রবন্ধের প্রথম বাক্যটিতেই যেন প্রথাবিরোধী বিদ্রোহী এক বক্তব্য তিনি প্রদান করেন, ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম।’ আসলে সংস্কৃতি হলো প্রেম, সৌন্দর্য ও মার্জিত জীবনবোধের পরিশীলিত সমন্বয়।

মানুষের আত্মিক প্রশান্তির মূলে রয়েছে তার সুস্থ সংস্কৃতিচেতনা। অন্যায় ও কলুষতার সঙ্গে সংস্কৃতিবান মানুষ সহবাস করতে পারে না। মুক্ত বুদ্ধি, উদার মানবতাবোধ, মার্জিত শিক্ষা ও পরিশীলিত জীবনচর্চা যেখানে নিঃসংশয়ভাবে প্রকাশিত সেখানেই প্রকৃত সংস্কৃতির প্রজ্বলন। সাধারণ মানুষ এর সমন্বয় সহজে করতে পারে না। তাই ধর্মই হয়ে ওঠে তাদের কালচার। তারা ধর্মের পথে বিচরণ করে সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠে।

তবে ধর্ম পরমত সহিষ্ণু নয়, যেমন নয় কোন মতবাদ। মতবাদিগণ অন্যের মতকে সহ্য বা স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু সংস্কৃতি তা নয়। সংস্কৃতি হলো সত্য, সুন্দর আর আনন্দের পথে ধাবমানতা অন্যের মত ও পথকে অবহেলা না করেই এই অকৃত্রিম অনুভব লাভ করেন সংস্কৃতিবান মানুষ। কল্যাণ ও সাম্যকে সংস্কৃতি স্বীকার করে, সেই সঙ্গে চিন্তার স্বাতন্ত্র্যকেও গুরুত্ব দেয়।

কৃপএভুকতা থেকে মুক্তি দিয়ে সংস্কৃতি মানুষকে উদার, সহনশীল, ও মানবতাবাদী করে তোলে। সে পৃথিবীতে স্বর্গীয় সুখ ও আনন্দ লাভ করতে প্রয়াসী হয় বলেই পারলৌকিক স্বর্গে তার আস্থা কমে আসে। সব মানুষের মধ্যে আত্মিক বন্ধন অন্বেষাই একজন সংস্কৃতিবান মানুষের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে।

মূলপাঠ

ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা – সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা। ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। মার্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কাচারের মারফতেই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করে।

বাইরের আদেশ নয়, ভেতরের সূক্ষ্মচেতনাই তাদের চালক, তাই তাদের জন্য ধর্মের ততটা দরকার হয় না। বরং তাদের উপর ধর্ম তথা বাইরের নীতি চাপাতে গেলে ক্ষতি হয়। কেননা তাতে তাদের সূক্ষ্ম চেতনাটি নষ্ট হয়ে যায়, আর সূক্ষ্মচেতনার অপর নাম আত্মা । সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কাচারের উদ্দেশ্য নয় – – উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আলাহ সৃষ্টি করা।

যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়। বাইরের ধর্মকে যারা গ্রহণ করে তারা আলাকে জীবনপ্রেরণা রূপে পায় না, ঠোঁটের বুলি রূপে পায়।

তাই শ’র উক্তি: Beware of the man whose God is in the skies – আলা যার আকাশে তার সম্বন্ধে সাবধান। কেন না, তারারা যে কোন অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ হতে পারে। আলাকে সে স্মরণ করে ইহলোকে মজাসে জীবন যাপন করবার জন্য আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে, অথবা স্বর্গে একটা প্রথম শ্রেণীর সিট্ রিজার্ভ করার আগ্রহে অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহকালে ও পরকালে সর্বত্রই একটা ইতর লোভ ।

অপর দিকে কাল্‌চার্ড লোকেরা সব চেয়ে বেশী ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে; অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গত ভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। নিষ্ঠুর হয়ো না – এই তাদের ভেতরের দেবতার হুকুম আর সে হুকুম তারা তামিল না করে পারে না, কেন না নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই একটা ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন বা স্বধর্ম সৃষ্টি করা কাচারের উদ্দেশ্য।

যেখানে তা নেই সেখানে আর যাই থাক্ কাচার নেই । কাচার একটা ব্যক্তিগত ধর্ম। ব্যক্তির ভেতরের ‘আমি’কে সুন্দর করে তোলাই তার কাজ। কাচার সমাজতান্ত্রিক নয়, ব্যক্তিতান্ত্রিক। নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো এ-ই কাচারের আদেশ। এবং এই আদেশের সফলতার দিকে নজর রেখেই তা সমাজতন্ত্রের সমর্থক। সমাজতন্ত্র তার কাছে লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ।

কাচার ব্যক্তিতান্ত্রিক এ কথা বললে এ বুঝায় না যে, কালচার্ড মানুষ সমাজের ধার ধারে না, সে দলছাড়া, গোত্রছাড়া জীব। তা নয়, সমাজের ধার সে খুবই ধারে।

নইলে প্রাণ পাবে কোত্থেকে? ব্যক্তি তো নদী, সমাজ সমুদ্র। সমুদ্রের সঙ্গে যোগ-যুক্ত না হলে সে বাঁচবে কী উপায়ে? সুতরাং নিজের স্বার্থের দিকে নজর রেখেই কালচার্ড মানুষ সমাজের কথা ভাবে, এমন কি দরকার হলে সমাজের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত থাকে। সংস্কৃতিবান মানুষ ব্যক্তিতান্ত্রিক এই অর্থে যে, সমাজ বা অর্থনীতির কথা ভেবে সে নিজের অসৌন্দর্যকে ক্ষমা করে না।

এই সমাজে, এই অর্থনীতির অধীনে এর চেয়ে বেশী সুন্দর হওয়া যায় না, এ কথা বলে নিজেকে কি অপরকে সান্ত্বনা দিতে সে লজ্জাবোধ করে। সে চায় নিজের সৌন্দর্যবোধের সম্পূর্ণ উন্মোচন, নিজের প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ। নিজের কাছ থেকে ষোল আনা আদায় করে না নিতে পারলে সে খুশী হয় না। এই জন্য শুধু সমাজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা তার মনঃপূত নয়।

কেননা তাতে জীবনের গভীরতর স্তরের ধ্যানকল্পনার সম্পূর্ণ প্রকাশ ব্যাহত হয়, এবং নিভৃতবাসী অন্তর-পুরুষের সাক্ষাৎকার সম্ভব হয় না। জীবনের শ্রেষ্ঠ ও বহুভঙ্গিম প্রকাশ নিজের দিকে তাকিয়েই হয়, সমাজের দিকে তাকিয়ে নয়। অত্যধিক সমাজচেতনা মানুষকে একপেশে ও প্রমাণ সাইজ করে রাখে। মানুষের চূড়ান্ত বৃদ্ধিতে অন্তরায় ঘটায়। সমাজের আদেশ: দশের মধ্যে এক হও, এগারো হয়ো না।

এগারোদের সে সহ্য করে না – – যদিও গৌরবের জন্য মাঝে মাঝে মাথায় করে নাচে। কাচারের আদেশ: দশের মধ্যে এগারো হও, দশের মধ্যে থেকেই নিজেকে নিজের মতো করে, সর্বাঙ্গ সুন্দর করে ফুটিয়ে তোল। তাতেই হবে তোমারমারা সমাজের শ্রেষ্ঠ সেবা, যদিও সমাজের বিরক্তি-ভাজন হওয়াই হবে তোমার ভাগ্য। সমাজ সাধারণভাবে মানুষকে সৃষ্টি করে, মানুষ আবার নিজেকে গড়ে তোলে শিক্ষাদীক্ষা ও সৌন্দর্যসাধনার সহায়তায়।

এই যে নিজেকে বিশেষভাবে গড়ে তোলা এরি নাম কাচার। তাই কালচার্ড মানুষ স্বতন্ত্র-সত্তা, আলাদা মানুষ। নিজের চিন্তা, নিজের ভাবনা, নিজের কল্পনার বিকাশ না হলে কালচার্ড হওয়া যায় না। চিন্তা বা বিশ্বাসের ব্যাপারে সমতা স্থাপন করে মানুষের স্বাতন্ত্র্য্য লুপ্ত করতে চায় বলে ধর্ম অনেক সময়ে কালচারের পরিপন্থী। মতবাদীও এ দোষে দোষী, তাই মতবাদী ও ধার্মিকের মধ্যে একটা সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। উভয়েই সরকারী গলায় কথা বলে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যের উপরে ষ্টীমরোলার চালাতে ভালোবাসে।

 

সংস্কৃতি কথা ১

 

শব্দার্থ ও টীকা

কালচার – ইংরেজি শব্দ (Culture)। বাংলা অর্থ ‘সংস্কৃতি’ বা ‘কৃষ্টি’। জীবনে চর্চিত অনুশীলনলব্ধ রীতি-নীতি বা আচার-আচরণ এবং বিদ্যাবুদ্ধি। উন্নত রুচিবোধ, শিল্পস্পৃহা, মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ এই কালচারের অঙ্গীভূত।

মার্জিত আলোকপ্রাপ্তরা – সুশিক্ষার ফলে উৎকর্ষপ্রাপ্ত বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কাচারের উদ্দেশ্য নয়, উপায় – ‘উদ্দেশ্য’ শব্দের অর্থ ‘লক্ষ্য’ বা ‘অভিপ্রেত’ বা ‘উদ্দেশ করা হয় এমন কিছু। আর ‘উপায়’ শব্দের অর্থ ‘অভীষ্টলাভের বা কার্যসাধনের পন্থা বা প্রণালী’। এখানে বলা হয়েছে যে, সাহিত্য, শিল্প বা সঙ্গীত চর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ যাপিত জীবনে প্রকৃত সংস্কৃতিমান হয়ে ওঠে। এর অর্থ এই নয় যে, সাহিত্য বা সঙ্গীতচর্চা মানেই সংস্কৃতি

কালচার্ড – অর্থাৎ সংস্কৃতিমান। সংস্কৃতিতে যিনি একাত্ম হয়েছেন।

অভিধা- নাম, সংজ্ঞা, উপাধি । স্বর্গে একটি প্রথম শ্রেণীর সিট্ রিজার্ভ করা • পরকালে প্রশান্তিতে থাকার নিশ্চয়তা। ধর্ম বিশ্বাসীগণ মৃত্যুর পর সুখে শান্তিতে থাকতে চান। এখানে প্রবন্ধকার ‘সিট্ রিজার্ভ’ কথাটি ব্যঙ্গাত্মকভাবে ব্যবহার করেছেন। অনেকে মনে করেন যে, শুধু সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনার মধ্যেই ইহজাগতিক সুখভোগ ও পারলৌকিক প্রশান্তি প্রাপ্তি সম্ভব। পরলোকে নিজের জন্যে একটি সর্বসুখপ্রদায়ী চিরস্থায়ী আসন নিশ্চিত করতে তাদের এ ধরনের প্রার্থনায় অবতীর্ণ হওয়ার মধ্যে মহত্ত্বের চেয়ে স্বার্থসিদ্ধির মনোবাসনাই লেখক আবিষ্কার করেছেন।

ইতর লোভ — ‘লোভ’ একটি খারাপ প্রবৃত্তি। ‘ইতর’ বিশেষণ ব্যবহার করে এই প্রবৃত্তির নেতিবাচকতা অধিকতর সুস্পষ্ট করা হয়েছে। নীচ বিষয়তৃষ্ণা বা সব কিছু আত্মসাৎ করার প্রবৃত্তি ।

ন্যায় নিষ্ঠুরতা – ‘নিষ্ঠুরতা’ অর্থ ‘নির্দয়তা’। ন্যায়ভাবেও এই নির্দয়তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। যেমন, হত্যাকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড। — এখানে মৃত্যুদন্ড কার্যকর সামাজিকভাবে ন্যায়পথে নিষ্ঠুরতা প্রকাশ।

তামিল – পালন। ব্যক্তিগত ধৰ্ম – একান্ত নিজের জীবন-দর্শন ।

সমাজতান্ত্রিক – একটি রাজনৈতিক মতবাদ। এই মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্রের সমস্ত সম্পদের মালিক জনগণ।

কিন্তু প্রবন্ধে – ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটির ব্যবহার ‘সমাজ ভিত্তিক’ বা ‘সমাজ নির্ভর’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

ব্যক্তিতান্ত্রিক — এই শব্দটিও ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য্য’ অর্থে ব্যবহৃত; কোন মতবাদ প্রকাশক নয়।

দশের মধ্যে এক হওয়া – গতানুগতিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা। যা প্রচলিত ও বহুকাল ধরে চর্চিত তার বাইরে না যাওয়া। স্বতন্ত্র-সত্তা – অন্যদের থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া।

মনের জগতে লেফট্-রাইট্ — তত্ত্ব বা কতিপয় নিয়মের অনুসারী হয়ে মনের জগতকে সুনির্দিষ্ট ও গন্ডিবদ্ধ করে ফেলা।

বস্তু-সংক্ষেপ

শিক্ষিত ও মার্জিতরুচির ব্যক্তির সঙ্গে সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার প্রধান পার্থক্য হলো, কালচার যেখানে শিক্ষিত লোকের ধর্ম, সেখানে ধর্মই সাধারণ মানুষের কালচার। শিক্ষিত ব্যক্তি সৌন্দর্য, প্রেম, জ্ঞান ইত্যাদির সাধনা করে। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীতের মতো উপায়ের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে কালচার্ড করে তোলে। কালচার্ড ব্যক্তি আত্মার আনন্দের লক্ষ্যে মানুষ্যত্ব ও মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়।

কিন্তু ধার্মিক ব্যক্তি পরলোকে সুখ সুনিশ্চিত করতে অথবা শাস্তির ভয়ে ধর্ম চর্চা করেন। কালচার্ড ব্যক্তির কাছে নিষ্ঠুরতা মাত্রই পরিত্যাজ্য, এবং তা যদি ন্যায় নিষ্ঠুরতা হয়, তবুও। কালচার বা সংস্কৃতির মূল কথাই হচ্ছে ব্যক্তিসত্তার বিকাশ। এই বিকাশটি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে প্রকাশিত হয়। সমাজের অন্যদের সঙ্গে এর সম্পর্ক সামান্যই। কেননা, কালচারের মূল বৈশিষ্ট্য সৌন্দর্যবোধ, প্রেম, সত্য, মহত্ত্ববোধ ইত্যাদি ব্যক্তিভেদে পার্থক্য হতে বাধ্য।

কালচার্ড বা সংস্কৃতিমান মানুষ সমাজের প্রথাবদ্ধতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী হন; কিন্তু সমাজ তাকে পারিপার্শ্বের আর দশজনের মধ্যেই আটকে রাখতে চায়। ধার্মিকেরা সমাজের প্রচলিত বিধিবদ্ধতা আরও কঠিন করতে চান। কোন নির্দিষ্ট মতবাদের অনুসারীরাও ধার্মিকদের মতোই নির্দিষ্টতায় আবর্তিত হয়। ধর্ম ও মতবাদ মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, কিন্তু কালচার তা করে না।

কালচার বা সংস্কৃতি মানুষকে নিজের মতো মুক্ত চিন্তা করতে অনুপ্রেরণা ও স্বাধীনতা দেয়। ধর্ম মানুষকে স্বর্গের লোভ ও নরকের ভয় দেখিয়ে নির্দিষ্ট পথে রাখতে চায়। কিন্তু সংস্কৃতি বা কালচার কোন ভয় বা লোভ দেখায় না, মনুষ্যত্ব বিকাশ ও আনন্দ এর একমাত্র লক্ষ্য।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের উত্তর লিখুন

১. ‘সংস্কৃতি’ কি?

২. ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির পার্থক্য কোথায়?

৩. স্বর্গে একটি প্রথম শ্রেণীর সিট্ রিজার্ভ করা’ – বলতে প্রবন্ধকার কি বুঝিয়েছেন?

৪. ধার্মিক ও মতবাদীদের সঙ্গে সংস্কৃতিবান মানুষের পার্থক্য কোথায়?

৪ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর

ধর্ম যেমন মানুষকে কতিপয় নিয়ম ও প্রথায় আবদ্ধ করে ফেলে, তেমনি মতবাদও মানুষের জন্যে নির্দিষ্ট গন্ডি বেঁধে দেয়। ধার্মিক ও মতবাদীরা নিজেদের অনুসৃত পথ ছাড়া অন্য সবকিছুকে ভ্রান্ত মনে করে। এ কারণে নিজের সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী ছাড়া অন্যদের উপর তারা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। ধার্মিক এই নিষ্ঠুরতা করে ধর্মগ্রন্থের সমর্থনে, আর মতবাদীরা সাহায্য নেয় বিজ্ঞানের।

কিন্তু সংস্কৃতি পরের মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শেখায়। সংস্কৃতিতে যেহেতু জ্ঞানেন্দ্রিয়ের চর্চা হয় বেশি, সেহেতু সংস্কৃতিবান মানুষ সত্যদর্শন ও যৌক্তিক যুক্তির পারম্পর্যে প্রেমময় দৃষ্টিতে বিচার করে সব কিছু। তার কাছে অন্যায় নিষ্ঠুরতার মতো ন্যায় নিষ্ঠুরতাও অবশ্য পরিত্যাজ্য। ধার্মিক ও মতবাদীরা যেখানে বাইরে থেকে বেঁধে দেয়া দর্শন গ্রহণ করে, সংস্কৃতিবান সেখানে বহু নিষ্ঠায় নিজের ভেতর থেকে একটা জীবনদর্শনের জন্ম দেয়- মূল পার্থক্য। এখানেই হচ্ছে

প্রসঙ্গ উলেখ করে ব্যাখ্যা লিখুন

১. ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম।

২. সাহিত্য শিল্প সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয় উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আলাহ্ সৃষ্টি করা।

৩. মতবাদীও এ দোষে দোষী, তাই মতবাদী ও ধার্মিকের মধ্যে একটা সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।

৪. গোলাপের সঙ্গে যদি দুএকটা কাঁটা এসেই যায়, তো আসুক না, তাতে ক্ষতি নেই, দেখতে হবে শুধু ফুল ফুটল কিনা -এ-ই কালচারের অভিমত।

 

সংস্কৃতি কথা ১

 

২ নং ব্যাখ্যার নমুনা-উত্তর:

ব্যাখ্যেয় অংশটুকু বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচিত ‘সংস্কৃতি-কথা’ নামক প্রবন্ধ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে সংস্কৃতির সঙ্গে সাহিত্য, শিল্প ও সঙ্গীতের আন্তঃসম্পর্ক কীভাবে ও কতটুকু সে সম্পর্কে প্রবন্ধকার মন্তব্য করেছেন।
কালচার বা সংস্কৃতি একটি অধরা প্রতীতি, যা অর্জন করতে হয়। সংস্কৃতি মানুষের রুচি উন্নত করে, বিবেককে করে জাগ্রত।

এই উন্নত রুচি ও জাগ্রত বিবেকেরপারা মানুষ সত্য, ন্যায়, জ্ঞান, প্রেম ও দয়াকে বরণ করে আর মিথ্যা অন্যায়, অজ্ঞান ও হিংসাকে ঘৃণা করে। এতে মানুষের নিজের ভেতরে একটি নৈতিক অবস্থান সৃষ্টি হয় – — যারারা সে নিজে পরিচালিত হতে পারে। এটাই ঈশ্বর বা আলাহ্’র সৃষ্টি। এই ঈশ্বর বা আলাহ কোন আরোপিত বহিঃশক্তির প্রতিক্রিয়া নয়।

সাহিত্য, শিল্প বা সঙ্গীত সাধনার মাধ্যমেও মানুষ রুচিকে উন্নত করতে পারে, জন্ম দিতে পারে নিজের মধ্যে দায় ও নীতিবোধের। তাই বলে কোন গ্রন্থের প্রণেতা কিংবা সঙ্গীতশিল্পীমাত্রই সংস্কৃতিবান মানুষ এমন নাও হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, সংস্কৃতি হলো একটি মানবিক পরিবর্তন ; যা মানুষকে সুশীল ও উন্নততর জীবন গড়ার ইঙ্গিত দেয়। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত মানুষকে এ-পথে এগিয়ে যেতে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে।

আরও দেখুন :

Leave a Comment