আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সংস্কৃতি কথা ২
সংস্কৃতি কথা ২
সংস্কৃতি কথা ২
মূলপাঠ
বিকাশকে বড় করে দেখেনা বলে ধর্ম সাধারণতঃ ইন্দ্রিয় সাধনার পরিপন্থী। অথচ ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবনসাধনারই অপর নাম কাচার। মন ও আত্মার সঙ্গে যোগযুক্ত করে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বকের নবজন্মদানই কাচারের উদ্দেশ্য। অবশ্য এই ইন্দ্রিয়নিচয়ের সবকটিই যে সমমূল্য তা নয়। ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে চক্ষু আর কানই সেরা। তাই তাদের স্থান সকলের আগে দেওয়া হয়েছে। চোখের মানে ছবির সাধনা, কানের সাধনা গানের।
(সাহিত্যের মধ্যে চোখ ও কান উভয়েরই কাজ রয়েছে, কেননা তা ছন্দ ও ছবি উভয়ের মিলন।) চোখ ও কানের পরেই নাসিকার স্থান- – নিঃশ্বাস গ্রহণের সহায়তায় বাঁচবার সুযোগ দেয় বলে নয়, সুগন্ধ উপলব্ধিরারা আত্মাকে প্রফুল রাখবার সুযোগ দেয় বলে। চোখ ও কান ‘আত্মার’ জিহ্বা, এদের মারফতেই সে তার খাদ্য চয়ন করে। অথচ, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, কোন কোন ধর্ম এই চোখ ও কানের সাধনারই পরিপন্থী, সেখানে তারা পতনের ফাঁদ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না।
তাই আমরা চোখ থাকতেও কানা, কান থাকতেও কালা। সুর বা ছবির সূক্ষ্মতা আমাদের প্রাণে দাগ কাটে না । চোখ ও কানের প্রতি বেখেয়াল থাকা যে আত্মার প্রতিই বেখেয়াল থাকা, সংস্কৃতিবানরা তা বুঝলেও ধার্মিকের মাথায় তা সহজে ঢোকে না। তাই তারা শুধু ঈশ্বরের নাম নেয়, ঐশ্বর্য উপলব্ধি করে না। ইন্দ্রিয়ের সাধনা বলে কাচারের কেন্দ্র নারী। নারীর চোখ মুখ, স্নেহ-প্রীতি, শ্রী ও হ্রী নিয়েই কাচারের বাহন শিল্প- সাহিত্যের কারবার।
ইন্দ্রিয়গ্রামের জাগরণ ও নিয়ন্ত্রণের মূলেও নারী। ‘বোধকলি’ তার প্রসাদেই ফোটে, জীবনের শক্তি, সাহস ও সাধনার প্রেরণা নারী থেকেই আসে। তাই কবির মুখে শুনতে পাওয়া যায়, ‘আমি হব না তাপস, হব না, হব না, যদি না পাই তপস্বিনী’ জীবনে তপস্যা করতে চায় বলে নারী-সঙ্গ কালচার্ড মানুষের এতো কাম্য। বৈরাগীরা নারীকে পর করে সংস্কৃতিকেও পর করে। তাই তাদের জীবনে বৃদ্ধি নেই, তারা নিঃস্ব – নব-নব বুদ্ধি ও প্রীতির স্বাদ থেকে বঞ্চিত।
কী মানসিক, কী সাংসারিক সর্বপ্রকার সমৃদ্ধির গোড়ায় নারী। যাত্রাপথে নারীর জয়ধ্বনিই পুরুষের জীবন-পথের শ্রেষ্ঠ পাথেয়। যে জাতি নারীকে সম্পূর্ণ রূপে আলাদা রাখতে চায় সে জাতি জীবনে মৃত্যুর আরাধনা করে – ইতিহাসের খাতায় সে মরা-জাতির পৃষ্ঠায় নাম লেখায়। তার জীবনে আত্ম-নির্যাতন আছে, আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই। আর আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই বলে সংস্কৃতিও নেই। কেন না সংস্কৃতি মানেই আত্মনিয়ন্ত্রণ – নিজের আইনে নিজেকে বাঁধা ।
ধর্মের মধ্যে বৈরাগ্যের বীজ উপ্ত রয়েছে। কোন কোন ধর্ম নারীকে দেখেছে বিষের নজরে, আর কোন কোন ধর্ম ততটা না গেলেও সঙ্গীত-নৃত্যের মারফতে নারীকে ঘিরে যে ইন্দ্রজাল সৃষ্টি তাতে জানিয়েছে ঘোর আপত্তি। সঙ্গীত-নৃত্য ইত্যাদি তার কাছে কামেরই আয়োজন, কামের উন্নয়ন নয়। ফলে সূক্ষ্ম উপভোগের সহায় না হয়ে নারী স্থুল ভোগের বস্তু হয়েই রইল, নব নব উন্মেষশালিনী বুদ্ধির প্রেরক ও উচ্চতর জীবনের সহায় হতে আর পারলে না।
যৌন ব্যাপারে বিশেষ ও কড়া শাসনের ফলে মানুষ তাতেই আকৃষ্ট হয়ে রইল- যৌন সম্ভোগকে অতিক্রম করে যে প্রেম ও আনন্দ তা অনুভব করতে পারলে না বলে। নিষিদ্ধ বস্তু সাধারণত: ভীতি ও অতিরিক্ত আকর্ষণ – এই দুই মনোবৃত্তির সংঘর্ষ বাধিয়ে জীবনে বিকৃতি ঘটায়। এখানেও তাই হল, যৌন ব্যাপারে মন্দ, একথা না বলে যদি বলা হত প্রেম ভালো, আনন্দ ভালো, প্রেমের জন্য প্রতীক্ষা ভালো, আনন্দের জন্য প্রতীক্ষা ভালো, তা হলে পৃথিবীর চেহারা হয়তো এতো কদর্য হত না।
প্রেমেরসারা কাম নিয়ন্ত্রিত হ’ত বলে ব্যভিচার ও বিরোধ উভয়ের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ সহজ ও সুন্দর হতে পারত। কিন্তু তা না বলে নীতিবিদরা মানুষকে সংযম শিক্ষা করতে বললেন, অথচ কোন্ বড় জিনিসের দিকে তাকিয়ে তা করতে হবে তা বালালেন না। কেবল স্বর্গের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আর স্বর্গের যে চিত্রটি আঁকা হল তাতে, এখানে যা ভয়ঙ্কর বলে সাব্যস্ত, সেই ইন্দ্রিয় বিলাসেরই জয় জয়কার ঘোষিত হল।
তাই ইন্দ্রিয়-ভীতি সত্ত্বেও মানুষ ইন্দ্রিয়-সর্বস্বতার দিকে ঝুঁকলে – মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলবার মতো বড় কিছুর আশ্রয় খুঁজে পেলে না। নীতিবিদদের জানা উচিত ছিল, সংযম বলে কোন স্বাস্থ্য প্রদায়ী বস্তু নেই, আছে বড় জিনিষের জন্য প্রতীক্ষা আর সেই বড় জিনিষ হচ্ছে প্রেম। যে প্রেমে পড়েছে, অথবা প্রেমের মূল্য উপলব্ধি করেছে সে-ই প্রতীক্ষা করতে শিখেছে, অর্থাৎ সে-ই সহজে সংযমী হতে শিখেছে, অপরের পক্ষে সংযম মানে পীড়ন আর পীড়ন নিষ্ঠুরতার জনয়িত্রী।
যে বিনা কারণে নিজেকে দুঃখ দেয়, অপরকে দুঃখ দিতে তার তিলমাত্রও বাধে না। ঝধফরংস-এর গোড়ায় আত্মপীড়ন, একথা মনে রাখা চাই। ধার্মিক আর কালচার্ড মানুষে আরেকটা লক্ষ্যযোগ্য পার্থক্য এই যে, ধার্মিকের চেয়ে কালচার্ড মানুষের বন্ধন অনেক বেশী। উল্টা কথার মতো শোনালেও, কথাটি সত্য। ধার্মিকের কয়েকটি মোটা বন্ধন, সংস্কৃতিবান মানুষের বন্ধনের অন্ত নেই। অসংখ্য সূক্ষ্মচিন্তার বাঁধনে যে বাঁধা সেই তো ফ্রি-থিংকার আর ফ্রি থিংকিং কাচারের দান।
যেখানে ফ্রি থিংকিং নেই সেখানে কাচার নেই । প্রশ্ন হবে: ধর্ম আর কাচারকে যেভাবে আলাদা করে দেখা হল তাতে মনে হচ্ছে নাকি ধার্মিক কখনো প্রকৃত অর্থে কাচার্ড হতে পারে না? কিন্তু কথাটি কি সত্য? ধার্মিকদের মধ্যেও তো অনেক কাল্চার্ড লোক দেখতে পাওয়া যায়। উত্তরে বলব : তা বটে, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই টের পাওয়া যাবে, সেখানেও কাচারই কালচার্ড হওয়ার হেতু। অনুভূতি, কল্পনার সাধনা করেছেন বলেই তাঁরা কালচার্ড, অন্য কারণে নয়।
সংস্কৃতি মানে জীবনের Values সম্বন্ধে ধারণা। ধর্মের মতো মতবাদ বা আদর্শও তা ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই সে সম্বন্ধে সাবধান হওয়া দরকার। অতীতে ধর্ম ঈশ্বরকে আচ্ছন্ন করেছিল, বর্তমানে মতবাদ বা আদর্শ মনুষ্যত্বকে আচ্ছন্ন করতে পারে। লোকটা মোটের উপর ভালো কি মন্দ সেদিকে আমাদের নজর নেই, তার গায়ে কোন্ দলের মার্কা পড়েছে সেদিকেই আমাদের লক্ষ্য।
মার্কাটি নিজের দলের হলে তার সাতখুন মাফ, না হলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার দোষ বের করা আমাদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই মনোবৃত্তি থেকে মুক্তি না পেলে কাল্চার্ড হওয়া যায় না। মনে রাখা দরকার, ধর্মের সমস্ত দোষ মতবাদের ঘাড়ে এসে চেপেছে। মতবাদী ধার্মিকের মতই অসহিষ্ণু ও সংকীর্ণ, ধার্মিকের মতোই দলবদ্ধতায় বিশ্বাসী, অধিকন্তু ধার্মিকের চেয়েও নিষ্ঠুর। ধার্মিকের নিষ্ঠুরতার সহায় ছিল ধর্মগ্রন্থের সমর্থন, মতবাদীর সহায় বিজ্ঞান।
আমি আমার জন্য নিষ্ঠুর হচ্ছি না, পৃথিবী-উন্নয়নের বিজ্ঞানসম্মত আদর্শের জন্যই নিষ্ঠুর হচ্ছি। অতএব এখানে আমার গৌরব নিহিত, কলঙ্ক নয়। নিষ্ঠুরতা ব্যাপারে এই যুক্তিই মতবাদীর আত্মসমর্থনের উপায়। সৌভাগ্যের বিষয় সত্যিকার সংস্কৃতিকামীরা কখনো মতবাদী হতে চায় না, মতবাদকে তারা যমের মত ভয় করে। কেননা তাদের কাজ বাইরের থেকে কোন দর্শন গ্রহণ করা নয়, বহু বেদনায় নিজের ভিতর থেকে একটা জীবনদর্শনের জন্ম দেওয়া, এবং দিনদিন তাকে উন্নতির পথে চালনা করা।
আইডিয়ার গোঁড়ামি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় নিজের বা নিজের দলের অভ্রান্ততা সম্বন্ধে একটুখানি সন্দেহ রাখা। এই সন্দেহটুকুই মানুষকে সুন্দর করে তোলে, আর সৌন্দর্যই সংস্কৃতির লক্ষ্য। স্কেপটিসিজমের প্রভাব না থাকলে যে সভ্যতা সৃষ্টি হতে পারে না, এতো এক রকম অবিসংবাদিত সত্য। মনে রাখা দরকার, সংস্কৃতিবান হওয়ার কোন ধরাবাঁধা পথ নেই, বিচিত্র পথ।
কার জন্য কোন্ পথটি সার্থক কে বলবে? সেকালে বলা হত যত জীব, তত শিব; একালে বলা যেতে পারে যত সংস্কৃতিবান মানুষ তত সংস্কৃতি – · পন্থা। যে-পথটি ধরে মানুষ কালচার্ড হয় তা অলক্ষ্য না হলেও দুর্লক্ষ্য। তা পরে আবিষ্কার করা যায়, আগে নয়। তাই সংস্কৃতিবান মানুষটি একটা আলাদা মানুষ, স্বতন্ত্র-সত্তা। তার জীবনের একটি আলাদা স্বাদ, আলাদা ব্যঞ্জনা থাকে। সে মতবাদীর মতো বুলি আওড়ায় না। তার প্রতিকথায় আত্মা স্পন্দিত হয়ে – উঠে।
প্রেমের ব্যাপারে, সৌন্দর্যের ব্যাপারে, এমন কি সাধারণতা-ধর্মী কল্যাণের ব্যাপারেও তার আত্মার ঝকানি দেখতে পাওয়া যায়। নিজের পথটি নিজেই তৈরি করে নেয় বলে সে নিজেই নিজের নবী হয়ে দাঁড়ায়। তাই সে স্বাতন্ত্র্যধর্মী, গোলে হরিবোলের জগতে তার নিশ্বাস বন্ধ আসে। কল্যাণের ব্যাপারে সাম্যকে স্বীকার করলেও প্রেমের ব্যাপারে, সৌন্দর্যের ব্যাপারে, চিন্তার ব্যাপারে সে স্বাতন্ত্র্য তথা বৈচিত্র্যের পক্ষপাতী।
সত্যকার সংস্কৃতিকামীরা নিজেদের ছাঁচে ঢালাই করতে চায় না। নকল যীশু, নকল বুদ্ধ, নকল মার্কস বা নকল লেনিন হওয়া তাদের মনঃপূত নয়। ক্ষুদ্র হলেও তারা খাঁটি কিছু হতে চায়। কিন্তু পথের বিভিন্নতা থাকলেও তাদের লক্ষ্যের সাম্য রয়েছে — – সকলেই অমৃত তথা আত্মাকে চায়। যীশুখৃষ্ট যখন বলেন: For what is man profited if he shall gain the whole word, and lose his own soul ?— তখন সংস্কৃতিকামীর অন্তরের কথাই বলেন।
এই খ্রিষ্টবাণীরই ঔপনিষদিক ভাবান্তর হচ্ছে ‘যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম’ – যা দিয়ে আমি অমৃত লাভ করবনা তা দিয়ে আমি কি করব? অমৃতকে কামনা, তথা প্রেমকে কামনা, সৌন্দর্যকে কামনা, উচ্চতর জীবনকে কামনা, এই তো সংস্কৃতি। এই জন্য সংস্কৃতিকে একটা আলাদা ধর্ম, উচ্চস্তরের ধর্ম বলা হয়েছে। প্রাণী-জীবনের ঊর্ধ্বে যে জীবন রয়েছে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়ে, এবং তারমারা প্রাণী-জীবনকে মন্ডিত করে দিয়ে, তা মানুষের অন্তরে মুক্তির স্বাদ নিয়ে আসে।
তাই বলে প্রাণী-জীবনের তথা ক্ষুৎপিপাসার মূল্য যে তা দেয় না তা নয়। খুবই দেয়। Man does not live by bread alone এই কথাটার মধ্যেই ক্ষুৎপিপাসার স্বীকৃতি রয়েছে। তবে মর্যাদাভেদ আছে। যা নিয়ে বাঁচা যায়, আর যার জন্য বাঁচতে হয়, তা কখনো এক মর্যাদা পেতে পারে না। তাই সংস্কৃতিকামীদের ইচ্ছা: ক্ষুৎপিপাসার জগটি তৈরি করা হোক ক্ষুৎপিপাসার ঊর্ধ্বে যে জগৎটি রয়েছে তারি পানে লক্ষ্য রেখে।
নইলে সংস্কৃতি ব্যাহত হবে। সংস্কৃতিকামীরা আরো কামনা করে: ক্ষুৎপিপাসার জগৎ তথা কল্যাণের জগৎ নির্মাণে লক্ষ্যের চেয়ে উপায়কে যেন কম বড় স্থান দেওয়া না হয়। কেননা উপায়ই চরিত্রের স্রষ্টা- লক্ষ্য নয়।
শব্দার্থ ও টীকা
ইন্দ্রিয় সাধনা— যে সকল দেহ-যন্ত্র বা শক্তিদ্বারা বাহ্য বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান বা বিভিন্ন ক্রিয়াসম্পাদনে সামর্থ্য জন্মে তার সাধনা। ইন্দ্রিয় চৌদ্দটি। যথা: বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ — এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়; চক্ষু, কর্ণ, নাসা, জিহ্বা, ত্বক – এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়; মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, চিত্ত— এই চারটি অন্তরিন্দ্রয় ।
পঞ্চপ্রদীপ— পাঁচটি মুখ বিশিষ্ট প্রদীপ। সাধারণত আরতি করতে ব্যবহৃত হয়।
ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবনসাধনা — চক্ষু কর্ণ নাসা জিহ্বা ত্বক এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটিকে যথাযথ
ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী হয়ে জীবন পরিচালনা। ঐশ্বর্য ঈশ্বরত্ব, প্রভুত্ব; যোগলব্ধ শক্তি, বিভূতি। শব্দটি গঠিত হয়েছে এভাবে – সং.ঈশ্বর+য (ভা)।
শ্রী— সৌন্দর্য, লাবণ্য, শোভা ।
হী— লজ্জা।
তপস্বিনী— যে নারী সংসার ত্যাগ করে (অরণ্যবাসী হয়ে) কঠোর নিয়মে দেবতার আরাধনা করেন।
উন্মেষশালিনী— উন্মীলনকারিণী, উদ্রেককারিণী।
জনয়িত্রী— জন্মদাত্রী, জননী, মাতা। Sadism— ধর্ষকাম; নিষ্ঠুরতায় যে যৌন আনন্দলাভ হয়; Sexual delight in cruelty.
স্কেপটিসিজম— আত্মমুক্তির মতবাদ।
শিল্পোদর পরায়ণ— কামপ্রবৃত্তি ও উদরের তৃপ্তিই যার একমাত্র লক্ষ্য ।
অর্থগৃধু— অর্থলোভী।
বস্তুসংক্ষেপ
জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মধ্যে মানুষের চোখ ও কান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সংস্কৃতি বা কালচার এই দুয়ের বিকাশ ঘটাতে চাইলেও ধর্ম তা অনুমোদন করে না। ধর্ম বরং সত্যদর্শন ও যুক্তি শ্রবণকে সংযমের কথা বলে বাধা দেয়। সংস্কৃতিবান মানুষ কিন্তু সত্যদর্শন ও যুক্তির আলোকে এগিয়ে যান। মানব সমাজের অর্ধাংশ নারীকে সংস্কৃতি অবজ্ঞা করতে চায় না। বরং নারী কালচারের অপরিহার্য উপাদান। কেননা, সুর ও সৌন্দর্যের অন্যতম উৎস হলো নারী। নারীতে কাম আছে সন্দেহ নেই।
কিন্তু কামের চেয়ে প্রেম, ভোগের চেয়ে উপভোগই সংস্কৃতিবান মানুষের কাছে অন্বিষ্ট। অথচ, নারীকে নরকেরলার হিসেবে চিহ্নিত করে ধর্ম। সমাজও মূল্যবোধ রক্ষার নামে নারীব্যক্তিত্ব বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে। অজানাকে জানা, নিষিদ্ধকে জয় করা মানুষের সহজাত আকাঙ্ক্ষা। যেহেতু ধর্ম নারীর মধ্যে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তাই পুরুষ নারীভোগে এতোটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে; যাতে সমাজ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে।
কিন্তু উচিত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বিকাশের মাধ্যমে পুরুষ ও নারীর উপর আরোপিত পরস্পর বিরোধী সম্পর্ককে সহজতর করে তোলা। ধার্মিক ও মতবাদীদের মধ্যে পার্থক্য নেই । কেননা, তারা উভয়েই মনে করেন যে, ,নিজ নিজ ধর্ম বা মতবাদ অভ্রান্ত আর বাকী সব মিথ্যা। কিন্তু সংস্কৃতিবান মানুষ প্রজ্ঞা ও যুক্তিরারা পরমত বিশেষণ করে সেখানে সভ্যতার প্রগতিমুখীনতা অনুসন্ধান করেন।
সে দিক থেকে কালচার্ড মানুষ ধার্মিক ও মতবাদী যে-কারো চেয়ে যথেষ্ট গোঁড়ামিমুক্ত হন। প্রেমের সাধনার মাধ্যমে অর্জিত হয় সুসংস্কৃতি এবং ব্যক্তিমাত্রই স্বতন্ত্র পথে এ গন্তব্যে পৌঁছুতে পারেন। সৌন্দর্য, সত্য আর জ্ঞানের পথে প্রেমের সাধনাই এখানে প্রথম এবং প্রধান। কালচার্ড মানুষ তাই ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্তির জন্যে বাঁচেন না, মহত্তর জীবন যাপনের জন্যে খাদ্যাহার গ্রহণ করেন। প্রগতি ও সভ্যতা এক নয় – – যদিও অনেকেই অভিন্ন মনে করেন।
উৎপাদনের সঙ্গে প্রগতির সংশ্লিষ্টতা; এখানে সৌন্দর্য ও কল্যাণের সম্পর্ক অত্যাবশ্যকীয় নয়। কিন্তু সভ্যতা হলো প্রগতির সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সৌন্দর্য ও কল্যাণের সমন্বয়, উপরন্তু প্রেমের যথাযথ সংশেষ। কালচার্ড মানুষ স্বভাবতই সভ্যতাকামী হন। তবে সভ্যতার পাশাপাশি মূল্যবোধের ব্যাপ্তি জরুরি। মূল্যবোধের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর ভর করে মানুষের সংস্কার মুক্তি ঘটে থাকে।
সংস্কার মুক্তি অর্থ যথেচ্ছাচার নয়। অবাধ যৌনাচার তাই কালচার্ড মানুষের কাম্য হতে পারে না। কামনার স্থূলত্ব নয়, প্রেমের মহত্ত্বই সংস্কৃতিবান মানুষের কাছে বড়। মানুষ সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে পরিপূর্ণ বা ত্রঢ়ব হন। তিনি মহৎ, সুন্দর ও যথাযথভাবে বেঁচে থাকেন বিবেক জাগ্রত করে — প্রেমময় হয়ে ।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের উত্তর লিখুন
১. “ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপক জ্বেলে জীবনসাধনা’ বলতে লেখক কি বুঝিয়েছেন?
২. নারী কালচারের অপরিহার্য উপাদান কেন? ৩. সভ্যতা বলতে এখানে কি বুঝানো হয়েছে?
৪. মানুষের সংস্কারমুক্তি ঘটে কিভাবে?
২ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর
মনুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের স্বাধীনতা ও নবজন্মদানের ব্যাপারে কালচার সর্বাপেক্ষা অধিক উৎসাহ প্রদান করে। নারী এই ইন্দ্রিয় সাধনার জাগরণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নারীর চোখ-মুখ, স্নেহ-প্রীতি, সৌন্দর্য ও লজ্জা নিয়েই শিল্প-সাহিত্যের কারবার। আর এই শিল্প-সাহিত্যই হলো কালচারের বাহন। মানুষের, বিশেষত পুরুষের সুশীলবোধ নারীর সান্নিধ্যেই জাগ্রত হয় এবং জীবনে শক্তি সাহস ও প্রেরণা লাভ করে।
মানসিক সমৃদ্ধি আর সাংসারিক সর্বপ্রকার অগ্রবর্তিতার মূলেও হলো নারী। কালচার যেহেতু মানুষের মনোজাগতিক উন্নয়নের মাধ্যমে তার মধ্যে প্রেম-আনন্দ ও ন্যায়বোধের সৃষ্টি করে সেহেতু নারী কালচারের অপরিহার্য উপাদান হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করুন
১. সংস্কৃতি মানেই আত্মনিয়ন্ত্রণ – নিজের আইনে নিজেকে বাঁধা।
২. যদি বলা হত প্রেম ভালো, আনন্দ ভালো, প্রেমের জন্যে প্রতীক্ষা ভালো, আনন্দের জন্য প্রতীক্ষা ভালো, তাহলে পৃথিবীর চেহারা হয়তো এতো কদর্য হতো না। ।
৩. অমৃতকে কামনা, তথা প্রেমকে কামনা, সৌন্দর্যকে কামনা, উচ্চতর জীবনকে কামনা, এইতো সংস্কৃতি
৪. জ্ঞানের ক্ষেত্রেই পরিবর্তনশীলতা অবধারিত, সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে নয়।
৫. বাঁচা, বাঁচা, বাঁচা। প্রচুরভাবে গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।
৩ নং ব্যাখ্যার নমুনা-উত্তর
আলোচ্য অংশটুকু মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচিত ‘সংস্কৃতি-কথা’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে। এখানে সংস্কৃতি সাধনায় প্রার্থিত উপাদান সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্কৃতি ব্যক্তিমনকে বিকশিত করে ও মুক্তি দেয়। ধর্ম যেখানে অবিশ্বাসীদের উপর নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে, মতবাদ যেখানে পরমত সহ্য ও স্বীকার করে না, সেখানে সংস্কৃতি সত্যদর্শন ও মুক্তির আলোকে অন্যকে মেনে নেয়।
প্রেম ও সৌন্দর্যই একজন সংস্কৃতিবানের কাছে বড়ো। উচ্চতর জীবন গড়ার লক্ষ্যে মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধ অর্জন প্রধান হয়ে ওঠে তার সামনে। সংস্কৃতি মানুষকে ‘মানুষ’ ভাবতে শেখায়। কারণ জ্ঞানেন্দ্রিয় সাধনায় প্রেম ও সৌন্দর্য তার সামনে বড় হয়ে ওঠে। এই প্রেম ও সৌন্দর্যের আলোকে উচ্চতর জীবনের সোপান তৈরি করে সংস্কৃতি।
রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর লিখুন
১. মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য বিবৃত করুন।
২. ধার্মিক ও মতবাদীদের সঙ্গে কালচার্ড মানুষের পার্থক্য কোথায়? ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধের অনুসরণে লিখুন ।
৩. মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধ অবলম্বনে সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রদান করুন।
৪. ‘সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎ ভাবে বাঁচা — আলোচনা করুন।
আরও দেখুন :