আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় -সামজিক বন্ধন বিয়ে ও স্নেহ ভালোবাসাকেন্দ্রিক শব্দ
সামজিক বন্ধন বিয়ে ও স্নেহ ভালোবাসাকেন্দ্রিক শব্দ
ক. বিয়ে
পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের মধ্যে প্রধান বন্ধন বিবাহবন্ধন। বিয়ে প্রথাকে নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কিন্তু বিয়ে প্রথার বিকল্প আজও আবিষ্কৃত হয়নি। বিয়ের সাথে সম্পর্কিত শব্দ বিবাহ, শাদি, আংটি বদল, কাবিন, বাসর ঘর, বাগদান, গায়েহলুদ, বেনারসি, পাগড়ি, ঘটক, সাতপাকে বাঁধা, তালাক, বিধবা বিবাহ, সিদুর, লিভ টুগেদার, দেবর, ননদ এবং অবশ্যই স্বামী-স্ত্রী সহ অসংখ্য শব্দ।
বিয়েকেন্দ্রিক শব্দাবলীর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় কোনো একটি বিয়ে সম্পর্কিত, ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক রীতিনীতি। বাংলা ভাষার হিন্দু মুসলমান দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিয়ের আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে কিছু কিছু মিল থাকলেও বিয়ে প্রক্রিয়া এবং ধর্মীয় কারণে এসেছে প্রচুর শব্দবৈচিত্র্য।
১. মুসলিম বিয়ে ও প্রাসঙ্গিক শব্দাবলী
বিয়ে-শাদি, শাদি মোবারক, উকিল, উকিল বাপ, গায়েহলুদ, আকদ, কাবিন, এঞ্জিন, বাসর ঘর, কবুল, পানচিনি, বেনারসি, পালকি, পাগড়ি, আসকান, শেরওয়ানি, দেনমোহর, কাজী, উকিল বাপ ইদ্দত, হিলে, হানিমুন, (এটি ইংরেজি শব্দ হলেও এখন প্রচলিত, কেউ কেউ মধুচন্দ্রিমাও ব্যবহার করেন) ওলিমা, বউভাত, তালাক, সতীন, স্বামী, স্ত্রী ইত্যাদি শব্দ মুসলমানদের বিয়ের সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্কিত।
মুসলিম বিয়েতে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কিছু নিয়ম পালনের দরকার না হলে বাংলা ভাষায় এ শব্দগুলো সংযোজিত হতো না। শাদি এবং শাদি মোবারক শব্দটি এখন বহুল প্রচলিত। একসময় শাদি শব্দ বুঝতে অনেকের অসুবিধা হতো বলে দুটি মুক্তরূপমূল মিলে বিয়ে-শাদি শব্দটি সৃষ্ট হয়েছিল। আক্দ শব্দের মূল অর্থ চুক্তিনামা।
বিয়ের কাজী বিয়ের সময় আদ পড়ান। যেহেতু বাংলায় শব্দের শেষে যুক্ত হসনান্ত যুক্তব্যঞ্জন হয় না, সেজন্য প্রচলিত উচ্চারণে আক্দ তার চাইতে বেশি আকৃত শব্দটি শোনা যায়। আদের সাথে সম্পর্কিত শব্দ হলো কবুল কবুল আরবি শব্দ। মূল অর্থ সম্মতি। মুসলমান বর কনেকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় আত্দ কবুল করলেন? তখন অর্থ দাঁড়ায় বিয়ের চুক্তিতে সম্মতি আছে কী? সোজা কথায় রাজী আছেন কী? তারপর প্রচলিত যৌতুক এর উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে।
‘মিয়া বিবি রাজী তো কিয়া করে গা কাজী’। কাজীর দায়িত্ব দুরকম। এখানে কাজীর অর্থাৎ বিয়ের কাজী প্রথম দায়িত্ব বিয়ে রেজিস্ট্রি করা। মাঝে মাঝে বিয়ে পড়াবার দায়িত্বও তাঁর কাঁধে পড়ে। আকদ কবুলের সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটি শব্দ ‘এজিন’। আরবি ইনি থেকে এজিন শব্দটি বাংলায় আসছে।
এ শব্দের অর্থ সম্মতি। পদানশীল বিয়ের পাত্রী অন্দর মহলে অবস্থান করে বলে দুজন সাক্ষী তার এজিন অর্থাৎ সম্মতির কথা বিয়ে মজলিসে এসে জানান। কাবিন এবং কাবিননামা শব্দ দুটি মুসলিম বিয়ের সাথে সম্পর্কিত। কাবিন আরবি শব্দ নামা ফারসি শব্দ অর্থাৎ আরবি ও ফারসি মিলে গঠিত হয়েছে ‘কাবিননামা’ শব্দটি।
কাবিননামা বিয়ের চুক্তিপত্র। এই চুক্তিপত্রে কন্যাকে দেয় ‘মোহরানা’র (লেনদেনের কথা) উল্লেখ থাকে। ভালাক এবং তালাকনামা শব্দের কথা এবার আলোচনা করা যাক। তালাক মানে বিবাহ বিচ্ছেদ। নির্দিষ্ট বাক্য উচ্চারণ করে বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়াকে ‘তালাক দেওয়া’ বলা হয়। তালাক শব্দটির মূল অর্থ কোনো বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়া বা ছাড়া পাওয়া।
বর্জন করাও তালাকের আরেক অর্থ। তালাক তিন প্রকার ‘তালাকে আহসান’, ‘তালাকে হাসান’ এবং ‘তালাকে বিদায়’ (শিশু বিশ্বকোষ, ৮৫; ৩য় খণ্ড)। আরবি ‘তালাক’ ও ফারসি ‘নামা’ দিয়ে গঠিত হয়েছে তালাকনামা শব্দটি। বিয়ে বিচ্ছেদ সংক্রান্ত চুক্তি হচ্ছে তালাকনামা।
তালাকনামা শব্দটি বহুকাল ধরে বাংলায় প্রচলিত। ময়মনসিংহগীতিকাতে এর স্বাক্ষর রয়েছে (তালাকনামা যখন পাইল মদিনা সুন্দরী/ হাসিয়া ওড়াইল কথা বিশ্বাস না করি দেওয়ান মদিনা, মনসুর বয়াতি)। তালাকের সঙ্গে সম্পর্কিত শব্দ ইন্দত। ‘বিধবা বা
তালাক প্রাপ্ত মুসলিম নারীর পুনর্বিবাহের পূর্ববর্তী শরীয়ত মতে নির্দিষ্টকাল। স্বামীর মৃত্যু বা তালাকের পরে সাধারণভাবে তিনমাস তেরো দিন ইদ্দতকাল’ (আহমেদ শরীফ সম্পাদিত বাংলা একাডেমীর সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান; ৬৯)।
মুসলিম সমাজে পুরুষের একাধিক বিয়ের কারণে সৃষ্ট হয়েছে প্রধান মহিষী, বড় বিবি, ছোট বিবি ইত্যাদি শব্দ। পালকি শব্দটি বাংলায় বহুল ব্যবহৃত হলেও পদার কারণে মুসলিম বিয়ের সঙ্গে বিয়ের পালকি শব্দটি সম্পর্কিত। শব্দটি এসেছে ফারসি ফালুকি থেকে। শহরে তো বটেই গ্রামেও এখন বিয়েতে পালকি ব্যবহার কমে যাচ্ছে বলে এই শব্দটির একদিন মৃত্যু হবে বা ভাষার সঞ্চয় থেকে ঝরে পড়বে।
পালকির সঙ্গে মৃত্যু ঘটবে বাঙালিদের বিয়েকেন্দ্রিক একটি চমৎকার সংস্কৃতি। ‘উচ্চারণের সহজতা আনয়নের জন্য যেমন ভাষার ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে তেমনি সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কারণেও শব্দ বা শব্দার্থের পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটে। এমনকি ভাষার ভাণ্ডার থেকে পুরাতন শব্দ ঝরে সেখানে জমা পড়ে নতুন শব্দরাশি’ (সৌরভ সিকদার ২০০২: ২০৬)।
২. হিন্দু বিয়ে এবং সংস্কৃতিকেন্দ্রিক কিছু শব্দ
প্রজাপতি নির্বন্ধ, প্রজাপতয়ে নমঃ, সাত পাকে বাঁধা, বিয়ের পিঁড়ি, গৌরীদান, গান্ধর্ব বিবাহ, বাল্যবিবাহ, বাগদান, সতীদাহ ইত্যাদি। প্রজাপতি নির্বন্ধ বলতে বিধাতা কর্তৃক বিবাহ বন্ধনকে বলা হয়েছে (চলন্তিকা, রাজশেখর বসু: ৪৪৬)। গান্ধর্ব বিবাহ অনেকটা Love marriage বা Court marriage এর প্রতিশব্দ।
দেবতাকে সাক্ষী রেখে বর কন্যার গোপন বিবাহই গান্ধর্ব বিবাহ। ‘সাত পাকে বাঁধা’ দু’জনের পরিধেয় বস্ত্রের কিছু অংশ বেঁধে বিয়ে মণ্ডপের চারদিকে সাতবার ঘুরে আসার সাথে সম্পর্কিত। গৌরীদান শব্দটি সম্পর্কিত আট বছর বয়সে কোনো মেয়ের বিয়ের সঙ্গে। আট বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে না দিলে মেয়ের পিতাকে অনেক অপবাদ শুনতে হতো। আট বছর বয়সী বিয়ের পর কেউ কেউ স্বামীকে হারাত। ফলে সৃষ্ট হয়েছে
আরেকটি শব্দ বাল্যবিধবা অর্থাৎ বালিকা বিধবা। ‘সতীত্ব’ শব্দটি জন্ম হয়েছে সৎ থেকে কিন্তু এই সং এবং সতী শব্দটি মূলত ব্যবহৃত হয় দৈহিক সততার ক্ষেত্রে। যে নারী স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে না সেই সতী। নারীর এই সতীত্ব রক্ষার জন্যে সৃষ্ট হয়েছিল নিষ্ঠুর শব্দ ও প্রথা সতীদাহ প্রথা।
স্বামীর মৃত্যুর পর জীবন্ত সতীকে দাহ করার প্রথায় ‘সতীদাহ প্রথা’। সমাজ বিবর্তনের কারণে একালে সতীদাহ তো নেই এমনকি ‘সতী’ ধারণাও পাল্টে গেছে।
৩. বিয়েকেন্দ্রিক অন্যান্য শব্দ এবং সমাজভাষাতাত্ত্বিক গঠন বিশ্লেষণ
বাগদান
বাগদান= বাক্+দান। আক্ষরিক অর্থ কথা দান। সামাজিক অর্থ বিয়ের জন্য সম্মতি প্রদান। ইংরেজি প্রতিশব্দ এনগেজমেন্ট।
বাগদত্তা
বাগদত্তা= বাক্+নত্ত+আ। আক্ষরিক অর্থ যে নারী কথা দিয়েছে। সামাজিক অর্থ যে নারী বিয়ের জন্য কথা দিয়েছে।
গায়েহলুন
গায়েহলুদ গা+এ+ হলুদ। আক্ষরিক অর্থ গায়ে হলুদ দেয়া। সমাস বন্ধ – শব্দের সমাজ ভাষাতাত্ত্বিক অর্থ বর কনের গায়ে হলুদ মাখানো উপলক্ষে আয়োজিত বিয়ের একদিন বা দুদিন আগের বিশেষ সামাজিক অনুষ্ঠান।
ফুলশয্যা
ফুল+শয্যা নিয়ে গঠিত হয়েছে ফুলশয্যা শব্দটি। সমাজভাষাতাত্ত্বিক অর্থ বিয়ের প্রথম রাত অর্থাৎ বাসর রাতের জন্য ফুল দিয়ে সাজানো শয্যা হচ্ছে ফুল শয্যা।
বাংলা প্রতিশব্দ মধুচন্দ্রিমা। হানিমুন শব্দ থেকে বোঝা যায় হানিমুন প্রথা চালু হয়েছে, পাশ্চাত্যের বা ইংরেজদের অনুকরণে। হানিমুন শব্দের সমাজভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হতে পারে এরকম- আজকের রাতটি মধুময়, আজকের চাঁদটি মধুমাখা। গানের ভাষায় হতে পারে এই মধুরাত শুধু ফুল পাপিয়ার। এই মধুরাত শুধু তোমার আমার।’ পারিবারিক পরিবেশ ছেড়ে বর কনেকে নির্জনে কিছু সময় কাটাবার সুযোগ দেয়ার প্রথা থেকে জন্ম হয়েছে হানিমুন শব্দটির।
বেনারসি
বেনারস। ই। আক্ষরিক অর্থ বেনারসের তৈরি কোনো একটি জিনিশ। সমাজভাষাতাত্ত্বিক অর্থ বেনারসি শাড়ি অর্থাৎ লাল রঙের বিয়ের শাড়ি বিশেষ।
ধানদুর্ব
বিয়ের বরণডালায় ধানদুর্বা ও মাছ দিতে হয়। ধান জীবিকার প্রতীক। দুর্বা জীবনের প্রতীক (দুর্বা ঘাস সহজে মরে না)। ডিমওয়ালা মাছ অধিক সন্তানের প্রতীক। পরিবার পরিকল্পনার যুগে ডিমওয়ালা মাছের প্রতীক অর্থ বুঝতে পারলে বরণ ডালায় মাছ প্রদান সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হতে পারে।
বিয়ে, সতীত্ব একাধিক নারী পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি কেন্দ্রিক উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শব্দ হচেছ কুমারী, অক্ষতযোনি, পরকীয়া, উপপতি, জার, জারজ, উপপত্নী ইত্যাদি। কুমারী শব্দটি ইংরেজি Virgin শব্দের প্রতিশব্দ। মূল অর্থ পুরুষ সংশ্রবহীন। পরকীয়া শব্দের অর্থ পরপুরুষ পরস্ত্রীর সাথে প্রেম।
উপপতি এবং জার শব্দটি থেকে বোঝা যায় স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ হলেও এ ধরনের সম্পর্কের অস্তিত্ব সমাজে রয়েছে। জার শব্দটি বাংলায় প্রায় অপ্রচলিত। ‘জার’ শব্দটি থেকে গঠিত হয়েছে ‘জারজ’ শব্দটি। জারজ শব্দের অর্থ উপপতির জন্ম দেয়া সন্তান অর্থাৎ অবৈধ সন্তান বা যে সন্তানের সামাজিক বৈধতা নেই।
৪. বিয়েকেন্দ্রিক কিছু ইংরেজি শব্দ
বিয়ে সংক্রান্ত ইংরেজি শব্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শব্দ হচ্ছে এনগেজড, এনগেজমেন্ট, লাভ ম্যারেজ, কোর্ট ম্যারেজ, ডিভোর্স, সেপারেশন, লাভ- চাইন্ড, লিভ-টুগেদার ইত্যাদি। এ শব্দগুলো মধ্যে লিভ-টুগেদার শব্দটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এ শব্দের আক্ষরিক অর্থ একসঙ্গে বসবাস করা। আর সমাজভাষাতাত্ত্বিক অর্থ বিয়ে প্রথাকে পাশ কাটিয়ে অর্থাৎ ধর্মীয় বা প্রথা মতে বিয়ে না করে স্বামী- স্ত্রীর মত এক সঙ্গে বসবাস করা।
আমাদের বর্তমান সমাজে লাভ ম্যারেজ তো আছেই সেই সঙ্গে সম্প্রতিককালে যোগ হয়েছে অর্থাৎ কোর্টে ম্যারেজ বা বিয়ে করা। মধ্যবিত্ত পরিবারে ডিভোর্স কম হলেও উচ্চবিত্তদের মধ্যে ডিভোর্স বা স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি, বৃদ্ধি হয়েছে।
খ. স্বজনসূচক শব্দ
স্বজনসূচক কিছু শব্দের ভাষাতাত্ত্বিক ও সমাজভাষাতাত্ত্বিক গঠন ইতোমধ্যেই আলোচিত হয়েছে। প্রাসঙ্গিক কিছু শব্দ এবং কিছু শব্দের ব্যাখ্যা পূর্ণবার প্রয়োজন। ইংরেজিতে father-in-law, mother-in-law, sister-in-law, brother- in-law বলে অনেক সম্পর্ক চালিয়ে দেয়া যায়।
কাজিন বললে মামাতো, ফুফাতো, খালাতো অনেক সম্পর্ককে বুঝাতে পারে। কিন্তু বাংলায় এসব শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে রয়েছে অসংখ্য শব্দ। এসব শব্দকে শুধু প্রতিশব্দ বললেই হবে না। এসব শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেকগুলো ব্যঞ্জনা। জনক শব্দ থেকে বোঝা যায় যিনি জন্ম দিয়েছেন কিন্তু পিতৃদের থেকে বোঝা যায় পিতাকে দেবতার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে আব্বা শব্দটি থেকে অনায়াসে অনুমান করা চলে আব্বা শব্দের ব্যবহারকারীর জন্ম অবশ্যই মুসলিম পরিবারে। প্রায় একই ধরনের কথা প্রযোজ্য জননী, মাতৃদেবী এবং আম্মা শব্দ প্রসঙ্গে। অন্যদিকে মাতৃতুল্য, পিতৃতুলা,
মাতৃস্থানীয়, পিতৃস্থানীয় শব্দসমূহ প্রতিবেশী অথবা দূরসম্পর্কের কারো সাথে অতি সুসম্পর্কের পরিচয়।
খালা, খালু, মামা, মামি, পিসা, পিসি, মাসি, মেসো দিয়ে সংগঠিত শব্দ অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্কের পরিচয়বাহী একথা আগেই বলা হয়েছে। দেবর ননদের কথা সকলের জানা।
কিন্তু তালই, মাসই ঠাকুরজামাই ইত্যাদি শব্দ থেকে বোঝা যায় বাঙালি সমাজের আত্মীয়তার পরিধি অনেক দূর প্রসারিত। অর্থাৎ স্বজনসূচক শব্দের ভাণ্ডার বাংলা ভাষায় বৈচিত্র্যময়, অর্থপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ।
বাংলা সম্বোধনসূচক অনেক রূপমূল এবং বন্ধরূপমূল রয়েছে যেগুলো থেকে সামাজিক বন্ধন সহজে বোঝা যায়। পাড়ার যে কোনো বয়স্ক ব্যক্তিকেই অনায়াসে চাচা, চাচি, আংকেল, আন্টি সম্বোধন করতে শোনা যায়।
বাংলা চাকরানী অর্থে ‘ঝি’ (কন্যা হিসেবে দেখানো হতো) ব্যবহারের কথা বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন সময়ে বহুবার আলোচনা করেছেন। ১৯৮০ দশক বা কাছাকাছি থেকে ‘ঝি’ এর বদলে ‘ধুয়া’ শব্দের ব্যবহার সমাজভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। বুয়া শব্দ এসেছে বুবু থেকে। বাড়ির ছেলেমেয়েদেরকে শিখিয়ে দেয়া হতো কাজের মহিলাকে বুয়া অর্থাৎ বুবু ডাকার কথা।
আম্মাজান, আম্মাজি, আব্বাজান, আব্বাজি, মামনি, দিদিমনি এ ধরনের শব্দ এবং শব্দের বিশ্লেষণ সম্পর্কে মোটামুটি সকলেই অবগত। কিন্তু ‘ফু’ = বা -য়েষু সহরূপমূল এর ব্যবহার নিয়ে কোথাও আলোচনা করতে দেখা যায়নি। শ্রদ্ধাস্পদেষু, কল্যাণীয়াসু, স্নেহভাজনেয়াসু, সুচরিভায়েসু ইত্যাদি শব্দে সু, ধু- স্নেষু ইত্যাদি যদিও সমীপে অথবা to অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার কথা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আদর, স্নেহ ভালোবাসার সূচক রূপমূল হিসেবে এগুলো ব্যবহৃত হয়।
বাংলা ভাষায় এবং বাঙালি সমাজে শ্রদ্ধা জানবার জন্যে কতকগুলো শব্দ বা রূপমূল রয়েছে। কিছু কিছু শব্দের বা অঙ্গের ভাষা জানা আবশ্যিক। নমস্কার করতে হলে দুহাত তুলে কপালে ঠেকিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে হয়। দুহাত কপালে ঠেকাতে হয়, না হয় শ্রদ্ধা জানানো হবে না। প্রণাম করতে হলে মাথানত করে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে হয়।
বাংলার সাষ্টাঙ্গ প্রণাম আরেকটি শব্দ আছে। প্রণামের ভাষাতাত্ত্বিক গঠন এরকমঃ সাষ্টাঙ্গপ্রণাম = স+অষ্ট (আট)+অঙ্গ+প্রণাম। অর্থাৎ আট অঙ্গ মিলিয়ে প্রণাম করতে হবে। আট অঙ্গ মাথা, দুই চোখ, দুই হাত, বুক, দুই হাটু, দুই পা, বাক্য এবং মন। প্রণামের মুসলমানি প্রতিশব্দ কদমবুসি। আক্ষরিক অর্থ পা চুম্বন হলেও পা ছোঁয়ার মাধ্যমে কদমবুসির সার্থকতা।
অগুলি শব্দের আক্ষরিক অর্থ সংযুক্ত কর বা হাত। যুক্ত পাণিদ্বারা অর্পিত পুষ্পজলাদি দেবতাকে দেওয়া (চলন্তিকা, রাজশেখর বসু; ৯)। মাঝে মাঝে অনেক শ্রদ্ধের ব্যক্তিকেও শ্রদ্ধাগুলি প্রদান করা হয়। এই শ্রদ্ধার মধ্যে লুকিয়ে আছে পবিত্র অঞ্জলির বাজনা।
বাংলায় আত্মীয় বা স্বজনসূচক শব্দে তালিকা সুদীর্ঘ। আত্মীয়, পরমাত্নীয়, স্বজন, আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতি, কুটুম, অতিথি, অতিথিপরায়ণ, ইষ্টিকুটুম, সখেরকুটুম ইত্যাদি প্রত্যেকটি শব্দের গঠনের সঙ্গে সমাজের মন-মানসিকতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ‘আত্ম’ থেকে আত্মীয় স্বজন (নিজ) থেকে আত্মীয় স্বজন।
আত্মীয়স্বজন+ আত্মীয় স্বজন। আত্মীয়স্বজন শব্দের সামাজিক অর্থ পরিবারের সাথে সম্পর্কিত সকলকে নিজের লোক বলে মনে করা হচ্ছে। কুটুম, ইস্টিকুটুম, অতিথি ইত্যাদি শব্দ অতিথিপরায়ন বাঙালির কাছে অতিপ্রিয়। লোকশ্রুতি অনুসারে যিনি তিথি (নির্দিষ্ট ক্ষণ) ছাড়াও বাড়িতে আসতে পারেন তিনি অতিথি (অ+তিথি)। এই অতিথিকে ‘স্বাগত’ জানাতে সকল বাঙালি সদা প্রস্তুত। ‘স্বাগত’ শব্দের গঠন নিচে আলোচিত হলো-
হিন্দি ‘সোয়াগড় থেকে বাংলায় স্বাগত শব্দ এসেছে। হিন্দির অন্তস্থ-ব (ওয়া) উচ্চারণ বাংলায় নেই বলে দন্ত-স এর নিচে বসে দন্ত্য-স ব-ফলা আকার হয়েছে। বাঙালিদের অসচেতনতার কারণে বা বাংলার ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে দম্ভা-স ব ফলা আকারের উচ্চারণ শোনা যায় ‘শা’ হিসেবে। ফলে সোয়াগত পরিণত হয়েছে
শাগত-এ।
গ. সম্প্রীতিসূচক কয়েকটি শব্দের ভাষাতাত্ত্বিক গঠন ও বিশ্লেষণ
১. সৌজন্য
সৌজন্য= সু+ জন +
‘জন’ শব্দের সঙ্গে য-ফলা বা ঞ-ফলা যুক্ত হওয়ার কারণে গুণবৃদ্ধি সূত্রানুসারে (উ ঔ) ‘সু’ পরিণত হয়েছে ‘সৌ’- তে। ফলে সৌজন্য শব্দের অর্থ দাঁড়ালো ‘সু’ অর্থাৎ ভালো ব্যক্তির ভদ্র ব্যবহার।
২. সৌহার্দ্য
সৌহার্দ শব্দের গঠনটি খুব জটিল। প্রথম গঠন সুश+ ফলা দ্বিতীয় পরিবর্তন সু+হার দ+য-ফলা য-ফলার কারণে হৃদ এর ‘হ’ ‘হার’ এ পরিণত হয়েছে। হার এর ‘র’ রেফ এ পরিণত হয়েছে হার্ন। শব্দটি এবার দাঁড়ালো সুহানা। গুণবৃদ্ধির সূত্রানুসারে আবার য-ফলার প্রভাবে ‘সু’ পরিণত হয়েছে সৌ-তে সবশেষে পরিণত হল সৌহার্দ্য শব্দে।
৩. হার্দিক
হার্দিক = হল+ইক। ‘ইক’ এর প্রভাবে ‘হ’ পরিণত হয়েছে ‘হার’ এ এবং হার এর ‘র’ টি রেফ এ পরিণত হয়ে শেষ পর্যন্ত শব্দটি হল হার্দিক।
৪. প্রাসঙ্গিক অন্যান্য শব্দ
সবশেষে বাংলার কিছু মেলা, কিছু সামাজিক অনুষ্ঠান এমনকি কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাঙালি সমাজের সামাজিক বন্ধনের ইঙ্গিতবাহী। আজকাল অনেক বিয়ের কার্ডেও লেখা থাকে প্রীতিভোজ শব্দটি। শব্দের গঠন অত্যন্ত সহজ। প্রীতি+ভোজ। কিন্তু ভোজের আগে প্রীতি শব্দটির সংযোজন এবং দুটি শব্দের ব্যঞ্জনা গভীর তাৎপর্যবহ।
বাংলাদেশের কোনো কোনো গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত ‘মেজবান’ অথবা ‘মেজবানি’ শব্দটিও এরূপ তাৎপর্যপূর্ণ। একই সঙ্গে ‘বৌভাত’ শব্দটিও বিশ্লেষণ করা যায়। নতুন বৌকে বরণ করার জন্য আগত অতিথিদের উদ্দেশ্যে পরিবেশিত ভাত বা খাদ্য।
নববর্ষের মেলা থেকে হিন্দুনের আড়ং এবং আরো কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক মেলার মধ্যে মিলনমেলার ঈঙ্গিত রয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি মেলা পরিণত হয় সামাজিক মানুষের মিলনক্ষেত্রে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের শব্দভাণ্ডারে রাখীবন্ধন, ভাইফোঁটা ইত্যাদি শব্দ রয়েছে। রাখীবন্ধন শব্দ আসছে রক্ষাবন্ধন থেকে।
সাধারণত ভাইকে সকল বিপদ থেকে রক্ষার কামনায় বোন ভাইয়ের হাতে বেঁধে দেয় রঙিন সুতো। ধর্মীয় গণ্ডি পেরিয়ে রাখীবন্ধন সামাজিক প্রীতিবন্ধনের উৎসবে পরিণত হয়েছে এবং এর মূলমন্ত্র দাঁড়িয়েছে ভাই ভাই এক ঠাঁই। ভাইফোঁটা সাধারণত সহোদর ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেওয়া হয় এবং বোনের মুখে শোনা যায় “ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যাক চলে যাক যমের কাটা” এ জাতীয় ছড়া।
ভাইফোঁটা সম্প্রীতি পরিবারের গণ্ডি এমনকি ধর্মীয় গণ্ডি অতিক্রম করেছে। হিন্দু সমাজে যে-কোনো কন্যা মুসলমান সমাজের কাউকে ভাই হিসেবে মনে করলে আনায়াসে ভাইফোঁটা দিতে পারে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন রাখীবন্ধন এবং ভাইফোঁটার ব্যঞ্জনা বাঙালি সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়বে। আর ধর্ম-বর্ণ ভেদে বাঙালির জাতিগত সম্প্রীতি চেতনার কারণেই তা সম্ভব হবে।
আরও দেখুন: