ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ভূমিকা

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ভূমিকা

ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ভূমিকা

মানব-সম্প্রদায়ের পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের সক্রিয় মাধ্যম হল ভাষা। সংস্কৃত ভাষ্ ধাতু থেকে ভাষা শব্দটির উৎপত্তি, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘কথা বলা’। প্রধানত ভাষা হচ্ছে কণ্ঠনিসৃত ধ্বনি, যার অর্থগত দিক বিদ্যমান এবং বিশেষ সম্প্রদায় দ্বারা ব্যবহৃত।

উপভাষা হলো কোনো নির্দিষ্ট জনসম্প্রদায়ের দ্বারা ব্যবহৃত ধ্বনিগত রূপগত ও বাক্যগঠনগত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভাষা, যা সেই ভাষার অন্তর্গত অন্য জনসম্প্রদায় দ্বারা ব্যবহৃত ভাষা অথচ পরস্পর বোধগম্য। ভাষাতাত্ত্বিক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের মতে, কোনো অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী একটা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে বসবাস করেন তখন ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, পেশাগত কারণে চলিত ভাষার বিভিন্ন ধারিক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলের চলিত ভাষার পাশাপাশি তার ব্যতিক্রমধর্মী রূপ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

অতএব উপভাষা হচ্ছে চলিত ভাষার একটা উপরূপ, যা ভাষার চেয়ে কম ভাষাভাষীদের অঞ্চলে নিজস্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবহৃত হয়। (আধুনিক ভাষাতত্ত্ব, ১৯৯৭, পৃ. 182)
ভাষার সঙ্গে ব্যক্তি, সমাজ, সভ্যতা এবং সামগ্রিক মানবজীবন প্রবাহ পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। ভাষার ওপর বিভিন্ন সামাজিক আঞ্চলিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই স্থান-কাল-পাত্রভেদে সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাও নিয়ত পরিবর্তনশীল। সমাজের বিভিন্ন রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, সাংস্কৃতিক- সামাজিক ঘটনাবলি সবই ভাষার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়।

 

ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ভূমিকা

 

একটি সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার লোক বাস করে। সমাজে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত, ধর্মগত, লিঙ্গ, বয়স, ব্যক্তিগত প্রভাব-প্রতিপত্তি, পেশাগত ইত্যাদি বিভিন্নতার কারণে সমাজে ভাষার বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য দেখা যায়। আর এই পার্থক্য ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক স্তরে যেমন বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে, তেমনি রূপতাত্ত্বিক ও বাক্যতাত্ত্বিক স্তরেও ভাষা বৈচিত্র্য দান করে।

তাই কোনো অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করার আগে সে অঞ্চলের ভৌগোলিক, সামাজিক ও মানুষের জীবন-জীবিকা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। নিচে গবেষণা এলাকার ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো ।

ভৌগোলিক অবস্থান

বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তরপাড়ে অবস্থিত ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। বৃটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ পূর্ববঙ্গ বা পূর্ববাংলা নামে পরিচিত ছিল এবং ঢাকা ছিল এ পূর্ববাংলার প্রধান শহর। ঢাকা জেলার উত্তরে ময়মনসিংহ জেলা, পূর্বে ত্রিপুরা, দক্ষিণে বাকেরগঞ্জ ও পশ্চিমে ফরিদপুর জেলা অবস্থিত।

অসম ত্রিভুজ আকৃতিসম্পন্ন ব-দ্বীপিয় ঢাকা অঞ্চলের শীর্ষদেশ তিনটি মোহনায় আবৃত। ঢাকা জেলার একদিকে গঙ্গা নদী, ব্রহ্মপুত্র নদ ও অন্যদিকে মেঘনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল। আর পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রসারিত সর্বনিম্ন অংশে প্রবাহিত বেশ কয়েকটি ছোট-বড় নদী।

এসব অসংখ্য নদ-নদীর মধ্যে অধিকাংশ নদ-নদী গ্রীষ্মকালে থাকে শুষ্ক, আর বর্ষাকালে নাব্য। তাই ঢাকার অধিকাংশ ভূমির গঠন প্লাবন-পলিতে, আর পলিমাটির সঞ্জীবনী সুধায় উর্বর এই ব-দ্বীপ ঢাকা প্রাকৃতিক সম্পদ, অনুকূল আবহাওয়া ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কৃষিপণ্যে এতই সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল যে এ অঞ্চলকে ব্রিটিশ আমলে বাংলার শস্যভাণ্ডার নামে আখ্যা দেয়া হয়েছিল।

পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য উপনদীগুলোর পলিমাটি পূর্ববাংলাকে কেবল সমৃদ্ধই করেছিল তাই নয়, এ নদীগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াতের সুবিধাও করে দিয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল জেমস রেনেল (James Rennell) ১৭৬৫ সালে বাংলার নদীগুলো জরিপ করেছিলেন।

জরিপের পর ঢাকা ও নদীগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে তার উপলব্ধি নিম্নোক্ত মন্তব্য থেকে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায়-
‘বাংলা রাজ্যটি বিশেষ করে এর পূর্বাঞ্চল প্রাকৃতিক নানাবিধ সুবিধার কারণে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পরিচালনার জন্য পৃথিবীর যেকোন দেশের চে’ উত্তম। কেননা এখানকার নদীগুলো শাখা-প্রশাখায় এমনভাবে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে যে এখানকার অধিবাসীরা যেকোনো জলপথে অনায়াসেই কোনো এক প্রধান স্থান থেকে অন্য এক প্রধান স্থানে চলে যেতে পারে।’

 

ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ভূমিকা

 

(ঢাকা ইতিহাস ও নগরজীবন ১৮৪০-১৯২১, শরীফ উদ্দিন আহমেদ, পৃ. ১৩)
পূর্ববাংলার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ঢাকা এই গুরুত্বপূর্ণ নদীপথকে অত্যন্ত সার্থকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিল। বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর মাধ্যমে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার মতো নাব্য নদ-নদীগুলোর সঙ্গে ঢাকার সংযোগ তৈরি হয়, যার ফলে আশেপাশের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক নিবিড় হয়ে ওঠে। প্রায় ২৬ মাইল দীর্ঘ বুড়িগঙ্গা নদী নারায়ণগঞ্জের কাছে পুনরায় ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিশে গেছে।

ঢাকা জেলার পূর্ব-উপকণ্ঠে ডেমরা থানা অবস্থিত। পরিসংখ্যানগতভাবে এটি একটি মেট্রোপলিটন এলাকা, যেটি ১৯৭৬ সাল থেকে বিদ্যমান। কেউ নিশ্চিতভাবে জানেন না এটির সূচনা কোথায় থেকে হয়েছে। সাধারণ মানুষের ধারণা, এই নামটি মৌজা থেকে এসেছে, যেটি সদর দপ্তর থেকে নির্দেশিত।

ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ভূমিকা

 সীমানা এবং অবস্থান

ডেমরা থানার আয়নত ৩৯.৬৬ বর্গকিলোমিটার। এটার অবস্থান উত্তর অক্ষাংশের ২৩°৪১ ও ২৩°৪৬ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের ৯০°২৫ এবং ৯০°৩১ এর মধ্যে। থানাটির সীমানা উত্তরে গুলশান থানা, পূর্বে নারায়ণগঞ্জ সদর থানা, দক্ষিণে শ্যামপুর থানা এবং পশ্চিমে মতিঝিল ও সূত্রাপুর থানা। (তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ আদমশুমারি ২০০১; কমিউনিটি সিরিজ, জেলা ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭)

আরও দেখুন:

Leave a Comment