Site icon Language Gurukul [ ভাষা গুরুকুল ] GOLN

অন্যান্য জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে আরবি ভাষার সম্পর্ক

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় অন্যান্য জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে আরবি ভাষার সম্পর্ক – যা আরবি ভাষা ও সাহিত্য শিখনের বিবেচ্য দিকসমূহ এর অন্তর্ভুক্ত।

অন্যান্য জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে আরবি ভাষার সম্পর্ক

 

 

আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন-

‘পড়ুন, আপনার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা আল-আলাক- ১)।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমৃদ্ধ ভাষা আরবি-ভাষা। ধর্মীয় জ্ঞানের আলোয় বিকশিত হয়ে পৃথিবীর বা আল্লাহর সৃষ্টি জগতের নানা বিষয়ে আমরা আরবি-ভাষায় জ্ঞানার্জন করে থাকি ।

আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন আরো বলেন-

“ইয়া-সীন! আল-কুরআন প্রজ্ঞাময় গ্রন্থ’ (সূরা ইয়াসিন, ১-২)।

কোন বিষয় শিক্ষা অর্জনের পর সেই বিষয়ে ধারণা অর্জন হলো জ্ঞান। জ্ঞানকে স্থান-কাল-পাত্রভেদে ব্যবহারের চিন্তন দক্ষতা হলো প্রজ্ঞা। আরবি-ভাষায় আল-কুরআন ও আল-হাদিসের মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা মানব জগতে সুদূরপ্রসারি ভূমিকা রাখে ।

ড. মুরিস বুকাইলী বলেন- ‘আল-কুরআনের এমন একটি বক্তব্যও নাই, যে বক্তব্যকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিচারে খণ্ডন করা যেতে পারে’। বর্তমান বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষকালেও বিজ্ঞানময় মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের কোন বিষয়কে অসার প্রমাণ করতে পারেনি।

বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই, যেখানে মুসলিম মনীষীদের হাতের ছোঁয়া লাগেনি। আরবি-ভাষায় রচিত তাদের কালজয়ী গ্রন্থগুলো শত শত বছর ধরে অদ্যাবধি ইউরোপে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত। বিশেষ করে ৭৫০- ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ- এই সাড়ে তিনশত বছর জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠযুগ হিসেবে বিবেচিত। বলা হয়ে থাকে, স্পেন বা ইউরোপে যদি মুসলিম তথা আরবরা প্রবেশ না করতো তাহলে আধুনিক সভ্যতা আরো কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে যেতো ।

প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয় জ্ঞান লাভের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে আরবি-ভাষা জ্ঞান লাভ করলেও ইসলামি সাম্রাজ্যের প্রসার ও ব্যাপ্তিতে বিভিন্ন বিষয়ে আরবি-ভাষার অবদান ও ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠে। মুসলিম মনীষীদের রচনায় ভাষা হিসেবে আরবি-ভাষা সমাদৃত হয়। ইসলামী শাসনামলের কীর্তি হিসেবে পৃথিবীর নানা প্রান্তের ভাষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যে আরবি-ভাষার প্রভাব দৃশ্যমান। আরবি ভাষী বরেণ্য মনীষীদের জ্ঞান ভান্ডার, সাহিত্য, কলা ও সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় আরব ও ইসলামি সভ্যতায় বৈপ্লবিক চিত্র প্রকাশ পায়।

ইউরোপের পুনর্জাগরণ ও শিল্প বিপ্লবের চেতনায়ও আরব সভ্যতার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। শুধু মুসলিমরা নয়, আরবি-ভাষায় ইহুদি ও খ্রিস্টানদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থও লেখা হয়েছে। ভাষার উদ্ভব, উন্নতি, বিবর্তন ও সংকট ভাষার প্রবাহমান ধারারই অংশ। আরবি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। ইসলামি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আরবি-ভাষার পণ্ডিতগণ যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনি ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায়ও রয়েছে আরবি-ভাষার সমান বিচরণ।

আব্বাসীয় আমলে মুসলমানরা একের পর এক এলাকা বিজয় করতে থাকেন এবং বিভিন্ন জ্ঞান ও কৃষ্টির সম্মুখীন হন। তখন তারা ‘বায়তুল হিকমাহ’ প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, অনুশীলন ও গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেন, যা জ্যোর্তিবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, পদার্থ, চিকিৎসা, দর্শন, ভূগোল শাস্ত্র আবিষ্কারে অসামান্য অবদান রাখে। এর সাথে বিজ্ঞান, শিল্পকর্ম, সমাজকর্ম ইত্যাদি বিষয়েও জ্ঞানচর্চার ফলে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা থেকেও বড় বড় গ্রন্থ আরবি-ভাষায় অনূদিত হয়। ফলে আরবি চর্চা ইসলামি সাম্রাজ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

কালের স্রোত ও সময়ের আবর্তনে আরবি ভাষা স্বমহিমায় ভাস্বর। বর্তমান বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই যেখানে আরবি ভাষার মর্যাদা নেই। আরবি শুধু আরব মুসলিমদের জ্ঞানার্জনের ভাষা নয়,  বিশ্বায়নের গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদাবান ভাষা ।

জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরবি ভাষার বিকাশ ধারা

ধর্মীয় শিক্ষায়

আল-কুরআন, আল-হাদিস, ফিকহ, ইসলামি চিন্তা, দর্শনশাস্ত্রে আরবি ভাষার অবদানও বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং জনপ্রিয়তায় যে সকল রচনাশৈলী ও রচয়িতার অবদান আমরা দেখতে পাই ।

তাফসীর শাস্ত্রে

ধর্মীয় কারণে আল-কুরআনকে বিশদভাবে জানার প্রয়োজনে আল-কুরআনকে মুফাস্সিরগণবিশদভাবে বিশ্লেষণ করেন। এতে আরবি ভাষা বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থসমূহ প্রণয়নে আরো সমৃদ্ধি অর্জন করে। সাহাবীদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ছিলেন বিখ্যাত মুফাস্সির, তাঁকে রয়ীসুল মুফাসীর (তাফসীরকারদের নেতা) ও বলা হয়।

‘তানভির আল মিকবাস মিন তাফসির’ তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। তাবেঈদের মধ্যে সর্বোত্তম তাফসীর জানতেন আরবি ভাষীগণ। কেননা তারা আরবি ভাষা ভালো বুঝার কারণে আল-কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চিন্তন দক্ষতা রাখতেন। ইমাম আযম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফিঈ, ইমাম হাম্বল প্রমূখ সকলেই আরবি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন এবং তাঁদের তাফসীর গ্রন্থগুলোও আরবি ভাষাতেই রচিত।

হাদীস শাস্ত্রে

আল-কুরআনের প্রধানতম ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ হলো হাদিস তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখনিসৃত কথা, বাস্তব জীবনে কর্মানুশীলন কিংবা অন্যের কর্মের প্রতি সমর্থন। যা ধর্মীয় বিষয়কে অত্যন্ত সরল, সহজ ও প্রাঞ্জলভাবে পালনে সহযোগিতা করে। বিদায় হজ্জের ভাষণেও তিনি-এর সংরক্ষণ, প্রতিপালন, প্রচারের বিষয়েও গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি তাঁর পক্ষ থেকে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।

 

 

ফিকাহ শাস্ত্রে

ইসলামী শরীয়তের মূল উৎস আল-কুরআন ও আল-হাদিসের বিশ্লেষণ ও সাধারণ্যে সহজে আমল করার পদ্ধতি হলো ‘আল-ফিকহ্’। যা ইসলামী শরীয়তের ‘আইন শাস্ত্র’ হিসেবে বিবেচিত। আল-কুরআন ও আল-হাদিসের ভাষা যেহেতু আরবি, তাই-এর বিধানাবলীর বর্ণনাও আরবি ভাষায়। আরবি ভাষার উৎকর্ষতায় ফিক্হ শাস্ত্রের ভূমিকা অনস্বিকার্য।

উল্লেখযোগ্য ফিক্‌হ শাস্ত্র বিশারদ ও তাঁদের কর্ম

১. ইমাম আবু হানিফারহমাতুল্লাহ আলাইহি:

যার পুরো নাম আবু হানিফা আল-নোমান বিন সাবেত, তিনি বিখ্যাত ফকিহ ছিলেন এবং হানাফী মাজহাবের স্থপতি। তাঁকে ফিক্হ শাস্ত্রের জনক বলা হয়। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ফিকহুল আকবার।

২. ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহ আলাইহি:

তার পুরো নাম আবু আব্দুল্লাহ মালিক ইবনে আনাস। তার বিখ্যাত গ্রন্থ মুয়াত্তা ইমাম মালেক। তিনি মালেকী মাজহাবের স্থপতি।

৩. ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহ আলাইহি:

তার পুরো নাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আশ শাফেঈ । তার গ্রন্থের নাম উসুল আল ফিকহ । তিনি শাফেয়ী মাজহাবের স্থপতি।

৪. ইমাম হাম্বল রহমাতুল্লাহ আলাইহি:

তার পুরো নাম আবু আব্দুল্লাহ আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন হাম্বল শিবানী । তার বিখ্যাত গ্রন্থের নাম কিতাবুল মাসায়েল। তিনি হাম্বলী মাজহাবের স্থপতি । আরবি ভাষা ও সাহিত্য আইয়্যামে জাহেলীয়ায় আরবি ভাষা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ থাকলেও আল-কুরআন নাযিলের পর তা আরো বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করে। পূর্বে যা ছিল কাসীদা বা পদ্য নির্ভর। ইসলাম পরবর্তীকালে আরবি ভাষা চর্চা ও অনুশীলনের ফলে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সকল ক্ষেত্র তথা-কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, নাটিকা, সংবাদপত্র, গবেষণায়-এর গুরুত্ব ও অবদান লক্ষ্য করা যায়, যা এ ভাষাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে।

 

 

বিভিন্ন যুগে আরবি সাহিত্যিক ও সাহিত্য

জাহেলী যুগ (৫০-৬২২ খ্রিস্টাব্দ)

এ যুগের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকবৃন্দ: ইমরুল কায়েস, ত্বরফা বিন আল-আবদ, জুহায়ের বিন আবি সুলমা, লাবীদ বিন রাবিয়া, আমর বিন কুলসুম, হারিস বিন হিল্লিজা, আনতারা বিন শাদ্দাদ, আশা বাউনিয়া, নাবিগা যুবইয়ানী, সানফারা, ক্কুস বিন সা’আদা আল-আইয়াদী, আমর বিন মা’দিকারব, জুবাইদি প্রমূখ।

আরও দেখুনঃ

 

Exit mobile version