আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-অর্থ ও নির্দেশন
অর্থ ও নির্দেশন
অর্থ ও নির্দেশনের পার্থক্যটি বাগর্থবিদ্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এরা দুটি ভিন্ন সমস্যার ইঙ্গিত দেয় । যখন আমরা অর্থের কথা বলি তখন আমরা ভাষার আভ্যন্তরীণ সম্পর্কসমূহের কথা বলি কিন্তু যখন আমরা নির্দেশনের কথা বলি তখন আমরা বলি ভাষার সাথে বাইরের জগতের সম্পর্কের কথা। অর্থ ও প্রকাশনকে আমরা নিম্নরূপে সংজ্ঞায়িত করতে পারি (Hurford & Heasley 1983 অনুসরণে) :
অর্থ : কোন ভাষায় বাগর্থিক সম্পর্কসমূহের সংশ্রয়ে একটি শব্দের যে স্থান তাকে অর্থ বলে
নির্দেশন : যে প্রক্রিয়ায় একজন বক্তা কোন শব্দের মাধ্যমে পৃথিবীর কোন ব্যক্তি বা ঝকঝকে নির্দেশ করে তাকে নির্দেশন বলে ।
কাজেই অর্থ হল ভাষিক উপাদানসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আর নির্দেশন হল ভাষিক উপাদানের সাথে অভাষিক উপাদানের সম্পর্ক। অর্থ যেখানে ভাষার আভ্যন্তরীণ ভুবনে সীমাবদ্ধ থাকে, নির্দেশন সেখানে ভাষাকে অতিক্রম করে চলে যায় বহির্ভুবনে ।
এজন্য অর্থ আকর্ষণ করেছে বিশেষভাবে ভাষাবিজ্ঞানীদের এবং নির্দেশন আকর্ষণ করেছে বিশেষভাবে দার্শনিকদের এবং বাগর্থবিদ্যায় এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে দুটি বিশাল অভিক্রমের, যার একদিকে রয়েছে ভাষাবৈজ্ঞানিক বাগর্থবিদ্যা অন্যদিকে দার্শনিক বাগবিদ্যা বাগর্থবিদ্যার কাজ একদিকে জাগতিক বাস্তবতার নিরিখে ভাষাবিশ্লেষণ অন্যদিকে অর্থ সম্পর্কসমূহের ভিত্তিতে ভাষার ব্যাখ্যা ।
উদাহরণের সাহায্যে অর্থ ও নির্দেশনকে ব্যাখ্যা করা যায়। বাংলায় যুবতী বলতে আমরা বুঝি বিশেষ – বয়সসীমার বিশেষ লিঙ্গের মানুষ। কিছু আমরা এর অর্থ বের করতে গিয়ে দেখবো এর রয়েছে অন্যান্য অনেক শব্দের সাথে সম্পর্ক। যেমন যে যুবতী তার যৌবন আছে সে যুবক, বালিকা বা বৃদ্ধা নয়
বিবাহিত হলে সে কারো স্ত্রী অর্থাৎ তার স্বামী আছে; তার পক্ষে মা হওয়া সম্ভব, কিন্তু বাবা হওয়া সম্ভব নয় ইত্যাদি। এভাবে দেখা যায় ভাষার কোন শব্দই বিচ্ছিন্ন নয়, প্রতিটি শব্দই ভাষা সংশয়ের অন্যান্য শব্দের সাথে নানারূপ সম্পর্কে বিজড়িত । এটিই হল অর্থের বিষয়।
অন্যদিকে আমরা যদি এ বাক্যটির কথা ধরি আমার সন্তান যেন থাকে – দুধেভাতে, এখানে দেখবো আমার সন্তান বলতে পৃথিবীর কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদেরকে বোঝানো হচ্ছে এবং দুধ ও ভাত বলতে পৃথিবীর কোন বস্তুদ্বয়কে বোঝানো হচ্ছে। এটি হল নির্দেশন ।
যে ভাষিক উপাদান দিয়ে পৃথিবীর কোন কিছু নির্দেশিত হয় তাকে বলে নির্দেশী প্রকাশ এবং ভাষিক উপাদান পৃথিবীর যে জিনিস নির্দেশ করে তাকে বলে নির্দেশিত। আলোচ্য উদাহরণে আমার সন্তান, দুধ ভাত হল নির্দেশী প্রকাশ এবং পৃথিবীতে
“The sense of an expression is its place in a system of semantic relationships with other expressions in the language. Jarnies R. Hurford & Brendan Heasley 1983, Semantics a coursebook, p. 28
“By means of reference a speaker indicates which things in the world (including persons) are being talked about.” ibid.
আমার সন্তান বলে পরিচিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা এবং দুধ ও ভাত নামক বন্ধসমূহ হল নির্দেশিত পারিভাষিক কৌশলে বলতে গেলে নির্দেশন হল নির্দেশী প্রকাশ ও নির্দেশিতের মধ্যে সম্পর্ক । । কাজেই
আমরা শব্দ বা শব্দগুচ্ছের অর্থ ও নির্দেশনের কথা বলেছি, একইভাবে আমরা বাক্যের অর্থ ও নির্দেশনের কথাও বলতে পারি ।
যেমন যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হল তার সাথে – এ বাক্য কোন জাগতিক অবস্থা বা ঘটনার কথা নির্দেশ করে যেখানে হয়ত শেষ রাত্রির নিস্তব্ধ মায়াবী পরিবেশে কোন বেদনাবিধুর তরুণী আত্মহননের কথা চিন্তা করছে। অনুরূপভাবে আমরা নিম্নলিখিত বাক্য বা বাক্যযুগলের অর্থের কথা বলতে পারিঃ
(১) বাংলাদেশের রাজধানী কি ঢাকা প্রশ্ন করেন টিনির ছোট কাকা ।
(২) ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল ।
(৩) গাছের ছায়া ছটফটিয়ে এদিক ওদিক চায় ।
(৪) ক. খালেদা অপরূপ সুন্দরী । খ, কেউ খালেদার সৌন্দর্যের প্রশংসা না করে পারবে না।
(৫) ক. জন্মই আমার আজন্ম পাপ । খ. জন্মই আমার আজন্ম পুণ্য ।
(৬) ক. ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল । খ. ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে পাখি ।
(৭) ক. রূপনারানের কূলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগত স্বপ্ন নয়। খ. রূপনারাণের কূলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগত বাস্তব ।
(৮) ক. অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন তার বক্ষে বেদনা অপার ।
খ. বিধাতা কাউকে কাউকে অলৌকিক আনম্পের ডার দিয়ে থাকেন ।
(১) ক. রাত্র পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী ?
২ দিনের আলোতে দুঃখের অবসান হবে ।
উপরের বাক্য বা বাক্য ফুগলগুলো যথাক্রমে (১) স্বার্থকতা (২) স্ববিরোধিতা, (৩) অসামঞ্জস্য, (৪) সহনামিতা, (৫) প্রতিনামিতা, (৬) উপনামিতা, (৭) প্রজ্ঞাপন, (৮) পূর্বধারণা, ও (১) ইঙ্গিতার্থ -এর দৃষ্টান্ত। এগুলো সবই বিভিন্ন ধরনের অর্থ সম্পর্ক। এগুলো আমরা পরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।
এখন শুধু সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে দ্বার্থকতা হলো একই প্রকাশের দুটি অর্থ, স্ববিরোধিতা হলো একই প্রকাশের দুটি পরস্পরবিরোধী অর্থ, অসামঞ্জস্য হলো অর্থের বিরোধজনিত জটিলতা, সহনামিতা হলো দুটি প্রকাশের একই অর্থ, প্রতিনামিতা হলো দুটি প্রকাশের বিপরীত অর্থ, উপনামিতা হলো দুটি প্রকাশের অর্থের অন্তর্ভুক্তি, প্রজ্ঞাপন হলো একটি প্রকাশ থেকে আরেকটি প্রকাশের অনুমান, পূর্বধারণা হলো কথোপকথনে বক্তা-শ্রোতার সাধারণ জ্ঞান এবং ইঙ্গিতার্থ হলো এক কথার মাধ্যমে অন্য কথা বোঝানো ।
আরও দেখুন: