আদর্শরূপ তত্ত্ব

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-আদর্শরূপ তত্ত্ব

আদর্শরূপ তত্ত্ব

মনোবিজ্ঞানী রশ (১৯৭৫), রিপন (১৯৭৫) সিথ (১৯৭৭), প্রমুখ এ তত্ত্ব প্রচার করেন। এটি বাচ্যার্থমূলক তত্ত্বের পরিপূরক । এ তত্ত্ব অনুসারে কোন শ্রেণীবাচক শব্দের বাচ্যার্থ সুনির্দিষ্ট নয়। যেমন পাখি বললে উড়তে সক্ষম এমন প্রাণীকে হয়তো বুঝাবে, কিন্তু এমন পাখিও থাকতে পারে (যেমন উটপাখি) যা উড়তে পারে না এবং এমন অনেক প্রাণী আছে যেমন তেলাপোকা, ফড়িং উড়তে পারা সত্ত্বে যাদের কেউ পাখি বলবে না ।

তাহলে মানুষ বিশেষ শ্রেণীর বন্ধু সনাক্ত করে কিভাবে ? এর উত্তরে আদর্শরূপ তত্ত্ব বলে, মানুষের মনে প্রতিটি শ্রেণীর একটি আদর্শ নমুনা থাকে যার সাথে তুলনা করে সে বিশেষ বন্ধুকে বিশেষ শ্রেণীর বলে সনাক্ত করতে পারে । এই দৃষ্টান্ত স্থানীয় নমুনাকে বলা হয় আদ রিপ।

এই আদর্শরূপের সাথে তুলনা করে বলা যায় কোন বিশেষ প্রাণী বিশেষ শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কতটুকু দাবিদার। মানুষ আদর্শরূপের সাথে কতগুলো বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে । এই বৈশিষ্ট্য গুচ্ছকে পারিভাষিভাবে বলে বৈশিষ্ট্যরূপ (Hurford & Heasley 1983; 98) । বৈশিষ্ট্যরূপই সাধারণভাবে শ্রেণীকরণের মাপকাঠি। এটি হলো নিক্তিস্বরূপ যার ভিত্তিতে কোন বন্ধ বা প্রাণীর জাতপাত নির্ধারিত হয় ।

বৈশিষ্টারাপের নিরিখে হিসাব করে বলে দেয়া হয় কোনটি কতটুকু দৃষ্টান্তস্থানীয় বা অদৃষ্টান্তস্থানীয়। যেমন আমরা পাখির বৈশিষ্ট্যরূপ হিসাবে বলতে পারি :

(১) এটির ডানা আছে বা উড়তে পারে ।

(২) এটি বিপদ

(৩) এটি স্তন্যপান করে না:

(৪) এর আবাস জলের তলে নয় ।

এই বৈশিষ্ট্যরূপের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি দোয়েল, টিয়া, ফিঙ্গে, চড়ুই, বক এসব পাখি, কারণ এগুলো আমাদের বৈশিষ্ট্যরূপের চারটি শর্তই পূরণ করে। এখন উটপাখির কথা ধরা যাক। এটি আমাদের ২,৩৩৪ নং শর্ত ভালোভাবে পূরণ করলেও ১নং শর্ত আংশিকভাবে পূরণ করে, কারণ এটি উড়তে পারে না।

ফলে এটি দৃষ্টান্তস্থানীয় পাখি নয়, দৃষ্টান্তস্থানীয় পাখি থেকে একটু দূরে। আবার উড়তে পারলেও তেলাপোকা, মশা, মাছি, প্রজাপতি আমাদের ২নং শর্ত লঙ্ঘন করে। ফলে এসব পাখি শ্রেণী থেকে বাদ পড়বে। আবার ১২ ৪ নং শর্ত মানলেও ৩নং শর্ত লঙ্ঘন করে বলে বিজ্ঞানীরা বাদুড়কে পাখি বলেন না (যদিও অনেক সাধারণ মানুষের কাছেই এটি পাখি)।

আবার ১ ও ৩ নং শর্ত পুরণ করলেও ৪ নং শর্ত লঙ্ঘনের পায়ে সমুদ্রের উঁকু মাছ পাখি বলে গণ্য হবে না। কাজেই দেখা যায় আদর্শরূপ ও বৈশিষ্ট্যরূপ মানুষের জাগতিক বোধ ও জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত। মানুষ আদর্শরূপ ও বৈশিষ্ট্যর পকে কাজে লাগিয়েই বলতে পারে কোন শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত কোন সদস্য কতটুকু দৃষ্টান্তস্থানীয়।

এ সম্পর্কিত নিয়মটি হলো : কোন শ্রেণীর একটি সদস্য যতো বেশি দৃষ্টাखস্থানীয় সেটি ততো বেশি আদর্শরূপের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ রশ আসবাবপত্র, ফল, পাখি ও পরিধেয় এসবের আদর্শরূপ নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন এবং দৃষ্টান্তস্থানীয়তার একটি ক্রম তৈরী করেন। ক্লার্ক ও ক্লার্কের বই থেকে আমরা সেই ক্রমের তালিকাটি তুলে ধরছি যেখানে প্রতিটি শ্রেণীর আটটি করে দ্রব্যের নাম উপর থেকে নীচে অধিক কম দৃষ্টান্ত স্থানীয়তার মাত্রায় সাজানো আছে:

 

আদর্শরূপ তত্ত্ব

 

আমাদের দেশে আদর্শরূপ নিয়ে কোন সমীক্ষা এখনো হয়নি। হলে জানা যেতো আমাদের ভূখণ্ডে আমাদের পরিবেশে দৃষ্টান্তস্থানীয়তার ক্রমটি কিরকম ।

দৃষ্টান্তস্থানীয়তার মাত্রাকে বৃত্তচিত্রে প্রদর্শন করা যায় যেখানে কেন্দ্রীয় বৃত্তে অবস্থিত থাকবে আদর্শরূপ এবং কোন সদস্য যতোবেশি অদৃষ্টান্তস্থানীয় হবে তা ততোবেশি দূরবর্তী বৃত্তে অবস্থান নেবে। এইচিনসন (১৯৮৭ : ৫৪) বিভিন্ন ধরনের পাখিকে এরকম একটি বৃত্তচিত্রে প্রদর্শন করেন :

 

আদর্শরূপ তত্ত্ব

 

প্রতিটি মানুষের মনে এভাবে শ্রেণী সম্পর্কে একটি ধারণা থাকে এবং ব্যক্তিভেদে আদর্শরূপ ও বৈশিষ্ট্যরূপে পার্থক্য দেখা দেয় । যেমন আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে দৃষ্টান্তস্থানীয় পাখি যেরকম অন্যের দৃষ্টিতে সেরকম না-ও হতে পারে । আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে দৃষ্টান্তস্থানীয় পাখি হতে পারে বাবুই, আরেকজনের কাছে তা হতে পারে ময়না কিংবা চিল ।

কারণ প্রতিটি লোক আদর্শরূপের জন্য তাদের নিজের মতো করে বৈশিষ্ট্যরূপ নির্ধারণ করতে পারেন । যেমন শুধু আকার আকৃতির বিচারে নীচের পাখি গুলোর মধ্যে কোনটি কতটুকু দৃষ্টান্তস্থানীয় তা নির্ধারণ করতে বললে একেকজন একেক ভাবে করবেন (দুজনের বিচার যে একইরকম হতে পারে আমরা সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছিনা । সেক্ষেত্রে উভয়ের আদর্শরূপ ও দৃষ্টান্তরূপ সমাপতিত হয়) :

হ্যাচ ও ব্রাউন (১৯৯৫ : ৫২) আদর্শরূপ সম্পর্কে চারটি দাবি প্রাসঙ্গিক মনে করেন। এগুলো হলো:
১. অদৃষ্টান্তস্থানীয় সদস্যের তুলনায় দৃষ্টান্ত স্থানীয় সদস্যদের অধিকতর সহজে শ্রেণীবিভক্ত করা যায়।

২. শিশুরা দুষ্টান্তস্থানীয় সদস্যদের প্রথমে জানে ।

৩. কাউকে কোন শ্রেণীসদস্যের নাম উল্লেখ করতে বললে সে প্রথমে আদর্শরূপের কথা বলে । ৪. আদর্শরূপ জ্ঞানাত্মক নির্দেশন বিন্দুরূপে কাজ করে, অর্থাৎ এর নিরিখে মানুষ ধারণাগত অঞ্চলে বিশেষ ব্যক্তি বা প্রাণীর অবস্থান নির্ণয় করে।

আদর্শরূপের একটি স্তরক্রমিক মাত্রা রয়েছে । যেমন ফলের আদর্শরাপ হতে পারে আম, আমের আদর্শরূপ হতে পারে ফালি, আবার ফজলির আদর্শরূপ হতে পারে রাজশাহীর ফজলি। সম্পর্কটি এভাবে দেখানো যায় ও

স্তরক্রমকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়: উচ্ছ্বন্তর মৌলিক স্তর এবং অধঃ মৌলিকার। যেমন ইটাকে মৌলিক স্থানে রেখে আমরা নড়াচড়া সংক্রান্ত শব্দকে তিনটি স্তরে সাজাতে পারি :

উত্তর : নড়া

মৌলিক স্তর: হাঁটা, দৌড়ানো লাফানো, পাক খাওয়া, ডিগবাজি খাওয়া।

অমৌলিকার : আস্তে হাঁটা, হনহন করে হাঁটা, উদ্দেশ্যহীনাভাকে হাঁটা, বুড়িয়ে হাঁটা, বুকটান করে হাঁটা, বিড়ালের মতো হাঁটা স্টেজের উপর কোন মডেলকে ক্যাটওয়াক করতে দেখে কেউ বলতে পারে লোকটি নড়ছে অথবা লোকটি হাঁটছে অথবা লোকটি বিড়ালের মতো ইটিছে।

যতোই উপর দিকে যাওয়া যায়, বর্ণনা ততোই সুনির্দিষ্ট হয় । অনেক ভাষাবিজ্ঞানী দাবি করেন যে শিশুরা মৌলিক বা উর্ধ্ব স্তরের শব্দ প্রথমে আয়ত্ত করে। কিন্তু শিশুরা অধঃমৌলিকত্তরের শব্দ প্রথমে শিখে এর স্বপক্ষেও প্রমানের অভাব নেই (Hatch & Brown 1995:55 ) ।

এটি অনেক সময় নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে যে একটি সদস্য কোন শ্রেণীতে পড়বে । যেমন কাকে আমরা ঘটি বলবো ? সেটি কি গোল না লম্বাটে হবে, হাতা থাকবে না থাকবে না, মাটি নির্মিত হবে না ধাতু নির্মিত হবে, আয়তনে কতটুকু বড় বা ছোট হবে, সেটিতে কি পানি না অন্য কিছু রাখা যাবে ? আবার এর সাথে লোটা জগ এ মটকির পার্থক্য কি হবে ? এগুলো ঠিক অংকের হিসাবে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না ।

কাজেই আমাদের মানতে হবে ঘটি শব্দটি অস্পষ্ট। কোন কোন গবেষক দাবি করেন যে প্রাকৃতিক ভাষার সব শব্দের অর্থই কম বেশি অস্পষ্ট। অর্থের এই অস্পষ্টতাকেই অনেকে বলেন ঝাপসাভার (Hatch & Brown

1995 58 Hofman 1993 297 Leech 1981 119 ) । আদর্শরূপের দিকে তাকালেও আমরা এই ঝাপসাভাব দেখতে পাবো। খচ্চর কি গাধা না ঘোড়া তা নিয়ে অন্তহীন বিতর্ক চলতে পারে। গদ্য ও পদ্যের সীমানা রেখাটি কোথায় তা নির্ধারণ করা যে কতো দুঃসাধ্য তা সাহিত্যিক মাত্রই জানেন।

দুটি শ্রেণীর সীমান্তবর্তী অঞ্চল সব সময়ই ঝাপসা। এজন্য আমাদের আদর্শরূপ থেকে একটু ভিন্ন অথবা দুটি আদর্শরূপের মাঝামাঝি কোন নমুনা দেখলে আমরা তার শ্রেণীকরণে বিরাট সমস্যায় পড়ি। আমরা নীচের ছবির দিকে লক্ষ্য করি :

 

 

এখানকার চতুর্থ চিত্রটির মতো কোন প্রাণী দেখিয়ে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় এটি বিড়াল না কুকুর না ভেঙা তবে গত্যিই সে মুশকিলে পড়বে। কাজেই আমরা দেখছি বিড়াল, কুকুর, ভেতা ইত্যাদি ঝাপসা শ্রেণী এবং তাদের অর্থও ঝাপসা অর্থ। খুঁটিয়ে বিবেচনা করলে শেষ পর্যন্ত এটাই প্রমানিত হবে যে অর্থ ঝাপসা । এবং আদর্শরূপ তত্ত্বও এভাবে স্পষ্ট থেকে ঝাপসা হয়ে আসে এবং তার মহিমা হারায়।

আমরা দেখলাম যে এ তত্ত্ব মানুষের সাংসারিক জ্ঞানের সাথে যুক্ত এবং এটি শিশুর ভাষা শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। তবে এটি ভাষার অর্থ ব্যাখ্যার ব্যাপকভিত্তিক কোন তত্ত্ব নয়। ফলে এর গ্রহণযোগ্যতাও সীমিত ।

আরও দেখুন:

 

Leave a Comment