আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-আধুনিক বাগর্থবিদ্যা এবং তত্ত্বায়নের সমস্যা ও মূলনীতি প্রসঙ্গ
আধুনিক বাগর্থবিদ্যা এবং তত্ত্বায়নের সমস্যা ও মূলনীতি প্রসঙ্গ
আমরা আধুনিক বাগবিদ্যা : তত্ত্বায়নের সমস্যা ও মূলনীতি শীর্ষক অভিসন্দর্ভের ভূমিকাংশের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, অথচ এখনো বলা হয়নি আধুনিক বাগর্থবিদ্যা বলতে আমরা কি বোঝাচ্ছি এবং এটি কিভাবে অনাধুনিক বা ঐতিহ্যবাহী বাগথবিদ্যার সাথে পার্থক্য সূচিত করে।
বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে সুইস ভাষাবিজ্ঞানী ফেদিন দ্য সোস্যুর ভাষাবিজ্ঞানকে দুইভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিলেন। ক্রমকালিক ও সমকালিক । তিনি – ঘোষণা করেছিলেন ক্রমকালিক নয়, সমকালিক মাত্রায় ভাষাকে বিশ্লেষণ করতে হবে যাতে সেই বিশ্লেষণ হয়। বিজ্ঞানসম্মত ।
সেদিন থেকেই ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের মৃত্যুঘন্টা বেজে ওঠে এবং সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়। সোস্যুরের বিভাজন সাধারণভাবে ভাষাবিজ্ঞানকে এবং বিশেষভাবে বাগর্থবিদ্যাকে প্রভাবিত করেছিল । সোস্যুরের ঘোষণায় বাগর্থবিদ্যাও আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠেছিল এবং প্রচুর সন্দেহ সত্ত্বেও ধীরে ধীরে আধুনিক হওয়ার পথে পা বাড়িয়েছিল ।
কাজেই বর্তমান শতাব্দীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অনৈতিহাসিক ধারায় বাগর্থবিদ্যার যে বৈচিত্র্যপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে আধুনিক বাগধবিদ্যা বলতে আমরা তাকেই বুঝবো । বিংশ শতাব্দীর সূচনাকেই আমরা আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী বাগর্থবিদ্যার বিভাজন রেখারূপে ধরে নিবো।
ঐতিহাসিক পথ পরিত্যাগ করে বাগর্থবিদ্যা প্রথমে প্রবেশ করে সংগঠনবাদের চৌহন্দিতে আচরণবাদের বলয়ে, কিন্তু এতে লাভের চেয়ে বরং ক্ষতিই হয়েছে বেশি। আচরণবাদের ছত্রছায়ায় সংগঠনবাদ বাগর্থবিদ্যাকে সমৃদ্ধ করার বদলে
করেছে রিক্ত, সুগঠিত করার বদলে করেছে পঙ্গু, শেভিত করার বদলে করেছে শ্রীহীন। বাগর্থবিদ্যা সেদিন এমন কানাগলিতে আটকে পড়েছিল যে তাকে অনেকে অবাঞ্চিত ও পরিত্যাক্ত ঘোষণা করেছিল । এই কঠিন অবস্থা থেকে বাগর্থবিদ্যাকে মুক্তি এনে দেয় সঞ্জননবাদ।
মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি এই শতাব্দীর মাঝামাঝি ঘোষনা করেন যে ভাষার সামগ্রিক সংগঠনে বাগধিক সংগঠনের একটি স্থান রয়েছে এবং সেই সংগঠনের স্বরূপ সন্ধান বাগর্থবিদদের কাজ। এরপর থেকে সাননী বাগর্থবিদগণ নানারকম তত্ত্ব দিয়ে বাগর্থবিদ্যাকে করে তোলেন প্রাণবন্ত ও মুখরিত ।
অন্যদিকে একদল দার্শনিক, যাদের মধ্যে ফ্রেজ, কারন্যাপ, টার্সকি, কোয়াইন, ডেভিডসন, মনটেগের নাম উল্লেখযোগ্য, দর্শনের সমস্যা সুরাহার প্রয়াসে ভাষার অর্থের সমস্যা সমাধানে ব্রতী হন । বাগর্থবিদ্যা আজ সত্যিকার অর্থে তাদের অবদানে ধন্য। আর একদল মনোবিজ্ঞানী অর্থের মানসিক রূপটি কেমন তা জানার প্রয়াসে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটন করেন ।
এখানেই শেষ নয় । সাধারণ ভাষা দর্শনের পথ ধরে ভিটগেনস্টাইন, অস্টিন, সাল, গ্রাইস প্রমুখ দার্শনিকগণ অর্থকে যোগাযোগের সমস্যারূপে চিহ্নিত করেন এবং তাদের প্রয়োগবাদী মতবাদের মাধ্যমে বাগর্থবিদ্যার এক নতুন দিগন্ত উম্মোচিত করেন । এভাবেই নানাবৃত্তে পাক খেয়ে বর্তমানে বাগধবিদ্যা তার স্বর্ণযুগে এসে পৌঁছেছে।
আমরা বর্তমান অভিসন্দর্ভে এসবই আলোচন করবো যতদূর সম্ভব বর্ণনায় সারল্য বজায় রেখে । ভূমিকা ও উপসংহার বাদ দিলে অভিসন্দর্ভটিকে আমরা সহজে উপলব্ধ ছয়টি বৃহৎ অভিক্রম অনুসারে ছয়টি ভাগে বিভক্ত করেছি : (ক) ঐতিহাসিক বাগর্থবিদ্যা, (খ) সাংগঠনিক বাগর্থবিদ্যা (গ) যৌক্তিক বাগর্থবিদ্যা, (ঘ) জ্ঞানাত্মক বাগর্থবিদ্যা (ঙ) রূপান্তরমূলক বাগর্থবিদ্যা এবং (চ) প্রয়োগাত্মক বাগর্থবিদ্যা ।
প্রথম ভাগটি যদিও আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী আধুনিক বাগর্থবিদ্যায় পড়ে না, তথাপি এটি যেহেতু অন্যান্য ধারার পূর্বগামী এবং অন্যান্য ধারার বিকাশে বিরুদ্ধ নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে সেজন্য আমরা সংক্ষেপে এর আলোচনা করবো যাতে পাঠক এর সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করতে পারেন এবং অন্যান্য ধারার সাথে এর মূলগত পার্থক্য তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। অন্যান্য বিভাগের ব্যাপারে আপত্তির কিছু নেই, এরা তাদের নিজগুণে আধুনিক বাগর্থবিদ্যায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ার যোগ্য ।
এবার তত্ত্বায়নের সমস্যা ও মূলনীতি প্রসঙ্গে আসা যাক । তত্ত্বায়ন সমস্যার বিস্তারিত পরিচয় দেয়া এক কষ্টসাধ্য কাজ। কারণ তত্ত্ব গড়ে ওঠে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন পরিকাঠামোর ভিতর । তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, বিশ্লেষণ প্রণালী আলাদা। একেক তত্ত্ব নীতিগতভাবে একেক সমস্যার সম্মুখীন হয় ।
যেমন সত্যশর্তমূলক কোন তত্ত্বের দৃষ্টি বাক্যের সত্যাসত্যের উপর নিবদ্ধ থাকে বলে তা যোগাযোগের সমস্যাকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না । আবার কোন প্রয়োগবাদী তত্ত্বের দৃষ্টি যোগাযোগের নিয়মনীতির উপর কেন্দ্রীভূত থাকে বলে তা ভাষা ও জগতের সম্পর্ককে পর্যাপ্তরূপে ব্যাখ্যা করতে পারে না।
কাজেই যখন কোন তত্ত্ব আলোচনা করা হয় তখন সেই তত্ত্বের সমস্যাবলী আলোচনা করা সুবিধাজনক । আমরাও তাই করবো । তবে সব বাগার্থিক তত্ত্বই সাধারণভাবে কতকগুলি সম্যার সম্মুখীন হয় । আমরা এখানে তার কয়েকটি উল্লেখ করছি :
প্রথমত, অর্থ অনির্দিষ্ট প্রকৃতির । এর রয়েছে নানা অর্থ। একজন তাত্ত্বিক কোন অর্থ নিয়ে আলোচনা
করবেন তা নির্ধারণ করা অনেক সময় কষ্টকর। আবার এক তত্ত্বে সমস্ত অর্থ আলোচনা করাও দুরত্ব । দ্বিতীয়ত, শব্দের যেমন অর্থ রয়েছে তেমনি অর্থ রয়েছে বাক্যের বচনের উক্তির ও সম্পর্কের ।
বাগর্থবিদ এর যে কোনটির অর্থ বিশ্লেষণে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে তাকে অন্যান্য ভাষিক উপাদানের অর্থের সাথে তার বিশ্লেষ্য উপাদানের অর্থের সম্পর্ক দেখাতে হবে যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত জটিল কর্ম
তৃতীয়ত, অর্থের সাথে মানুষের চিন্তন প্রক্রিয়া, বিশেষতঃ স্নায়ুগত প্রক্রিয়াটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত । কিন্তু মনোবিজ্ঞান এসব প্রক্রিয়া সম্পর্কে এখনো সুনিশ্চিত উক্তি করার পর্যায়ে পৌঁছেনি বলে অর্থ সম্পর্কে কোন বিবৃত্তিও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থেকে যায় ।
চতুর্থত, ভাষা ও জগতের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে এটি নিশ্চিত, কিন্তু জাগতিক পরিবেশ ভাষাকে কিভাবে ও কতটুকু প্রভাবিত করে এবং ভাষা মানুষের জাগতিক দৃষ্টিকে কিভাবে ও কতটুকু প্রভাবিত করে তা আজও রহস্যে ঢাকা ও বিতর্কের বিষয়। এ ব্যাপারে সাপির হোয়প প্রকল্প এবং প্রকল্পকেন্দ্রিক তানুশীলন উল্লেখযোগ্য। এ অবস্থায় যে কোন বাগার্থিক তত্ত্ব অস্বস্তি বোধ করবে ।
পঞ্চমত, বাগধিক তত্ত্বায়নের এখন পর্যন্ত কোন শক্তিশালী অভিজ্ঞতামূলক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় নি । তত্ত্ব নির্মানের সময় বাগর্থবিদগণ তাদের গভীর অভিনিবেশ, উপলব্ধি ও অন্তর্দৃষ্টিকে কাজে লাগিয়ে থাকেন যার ফলে চরিত্রগতভাবে তা হয়ে ওঠে ব্যক্তিনিষ্ঠ। বস্তুনিষ্ঠ বিবেচনার অভান এখনো বিষয়টির বিজ্ঞান হয়ে ওঠার পথে প্রধান অন্তরায় ।
তত্ত্বায়নের সমস্যার ব্যাপারে আমরা প্রথমে যে কথাগুলো বলেছি তা মূলনীতির বেলায়ও প্রযোজ্য । একেক তত্ত্ব একেক মূলনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। তাই মূলনীতির আলোচনা তত্ত্বগুলোর আলোচনার সাথে হওয়া উচিত। আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হবে না।
তত্ত্বালোচনর সময় আমরা প্রয়োজন অনুসারে কোন তত্ত্ব যে মুলনীতির উপর ভিত্তিশীল তা উল্লেখ করবো । কিন্তু যেখানে তাত্ত্বিক কাঠামোতেই মূলনীতি স্পষ্টরূপে প্রকাশিত, সেখানে তা অনুল্লেখ্য থাকতে পারে । আমরা এখানে একটি সাধারণ নীতিমালার উল্লেখ করবো যেগুলি সব বাগার্থিক তত্ত্বকে মেনে চলা উচিত। আমাদের প্রস্তাবিত মূলনীতি সমূহ নিম্নরূপ :
(১) ভাষার অনেকরকম অর্থ রয়েছে। বাগার্থিক তত্তকে স্পষ্ট ভাষায় বিবৃত করতে হবে যে কোন বা কোন্ কোন্ অর্থ নিয়ে এটি আলোচনা করছে। যে তত্ত্ব যতো বেশি অর্থ ব্যাথা করতে পারে সে তত্ত্ব ততো বেশি শক্তিশালী বলে গণ্য হবে ।
(২) অর্থ শব্দ, বাক্য ও সম্পর্ক পর্যায়ে অবস্থান করে। এদের যে কোনটির অর্থ বিশ্লেষণের সময় বাগার্থিক তত্ত্বকে অন্যান্যগুলির অর্থের সাথে তার সম্পর্ক দেখাতে হবে। যে তত্ত্ব যতোবেশি ভাষিক উপাদানের
অর্থ বিশ্লেষণে সক্ষম সে তত্ত্ব ততো বেশি সন্তোষজনক বলে গণ্য হবে।
(৩) বাগর্থিক তত্ত্বকে অভিজ্ঞতামূলকভাবে যাচাইযোগ্য হতে হবে । যে তত্ত্বের যাচাইযোগ্যতা কম সেটি দুর্বল তত্ত্ব ।
(৪) বাগার্থিক তত্ত্বের নিজেকে সাংগঠনিকভাবে সুসংহত হতে হবে এবং তাকে আত্মবিরোধী হলে চলবে
না।
(৫) দ্ব্যর্থকতা, বিরোধাভাস, অসাম্যস্য, সহনামিতা, প্রতিনামতা, উপনামিতা, প্রজ্ঞাপন, পূর্বধারণা, ইঙ্গিতার্থ এসব অর্থসম্পর্কসমূহ বিশ্লেষণে বাগার্থিক তত্ত্বকে পারঙ্গম হতে হবে। কম অর্থ সম্পর্ক বিশ্লেষণে সক্ষম তত্ত্ব অপূর্ণাঙ্গ বলে গণ্য হবে ।
(৬) বাগধিক তত্ত্বকে ভাষা ও তার অর্থের সাথে জাগতিক ঘটনার সম্বন্ধ প্রদর্শন করতে হবে ।
(৭) মানুষের ভাষিক আচরণের পরিব্যাপ্তি সমুদ্রতুল্য । যে বাগর্থিক তত্ত্ব যতোবেশি বাস্তবিক ভাষিক আচরণের সাথে খাপ খায় সে তত্ত্ব ততো বেশি গ্রহণযোগ্য ।
(৮) একটি ভালো বাগধিক তত্ত্ব প্রচলিত তত্ত্বসমূহের দোষত্রুটি মুক্ত থাকে এবং অন্যান্য প্রতিযোগী
তত্ত্বের তুলনায় তার সুবিধা প্রমান করে ।
এই নীতিমালাকে তত্ত্বের সুগঠিততার শর্ত বলা যেতে পারে । আমরা এই নীতিমালার আলোকে যে কোন বাগধিক তত্ত্বের সবলতা-দুর্বলতা বিচার করতে পারি এবং তার প্রেক্ষিতে তত্ত্বটির সফলতা-ব্যর্থতা পরিমাপ করতে পারি । প্রসঙ্গটি আমরা উপসংহারে পুনরুত্থাপন করবো ।
আরও দেখুন: