আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় আরবি ভাষার উন্নয়নে আল-কুরআন ও আল-হাদিসের প্রভাব – যা আরবি ভাষা ও সাহিত্য শিখনের বিবেচ্য দিকসমূহ এর অন্তর্ভুক্ত।
আরবি ভাষার উন্নয়নে আল-কুরআন ও আল-হাদিসের প্রভাব
আরবি ভাষার সাথে আল-কুরআনের সম্পর্ক
আরবি ভাষা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এ ভাষার আধুনিকায়ন, মর্যাদা, শব্দ ভাণ্ডারের ব্যাপকতায় আল-কুরআন-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভাষার চলমান গতিতে ইসলামের আবির্ভাবের সাথে আরবি ভাষা উচ্চমানের আসন লাভ করে। শ্রুতিমধুর ও সহজে উচ্চার্য এবং ভাষার নান্দনিক কারুকার্য আল-কুরআনের মাধ্যমেই আরবি ভাষা সমৃদ্ধি লাভ করে।
আরবি ভাষা ও কুরআনের ভাষা একই ভাষা
আপনি ভালো আরবি জানলে কুরআনকে ভালোভাবে জানা ও বোঝা সম্ভব । কুরআনকে ভালোভাবে বুঝার জন্য, জানার জন্য, হৃদয়ঙ্গম করার জন্য আরবি ভাষা চর্চা প্রয়োজন। কুরআনকে কুরআনের ভাষায় বুঝাই সহজ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- অর্থাৎ আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি বুঝার জন্য (সূরা যুমার)।
আল্লাহর বাণীকে আল্লাহর ভাষায় আয়ত্ত করা
আরবি ভাষা ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের কাছেই মর্যাদাবান। আরবি ভাষাকে আল-কুরআনের মুখোমুখি না করে উভয়ে উভয়ের সম্পূরক হিসেবেই বিবেচিত। ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে আল-কুরআনকে বুঝতে হলে আরবি ভাষাকে ভালোভাবে জানা দরকার। তাহলেই ধর্ম বা শরীয়তের দিক-নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ সম্ভব। আল-কুরআন তেলাওয়াত করতে জানা মানে- মুখস্ত আরবি জানা। অর্থ বা ভাবার্থ কিছুই এখানে বোধগম্য হয়না। কুরআন বুঝা যেখানে বেশি জরুরি, তাই আরবি জানাও জরুরি। আরবি ছাড়া কোরআন যেমন বুঝা অসম্ভব, তেমনি কুরআন ছাড়াও আরবি অসম্পূর্ণ।
আল-কুরআনের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
অর্থাৎ ‘এটি একটি বরকতময় কিতাব যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষের আয়াতসমূহ লক্ষ করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে’ (সূরা সোয়াদ)।
“তারা কি কুরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না, না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?’ (সূরা মুহাম্মদ)
সম্পূর্ণ আল-কুরআনে শব্দ আছে ৭৭,৪৬৯টি-এর মধ্যে পুনরাবৃত্তি ও একই শব্দের বিভিন্ন ব্যবহার বাদ দিলে শব্দ সংখ্যা হয় ৪৮৪৫টি। তন্মধ্যে বহুল ব্যবহৃত ৬০টি শব্দের অর্থ জানলে সম্পূর্ণ কুরআনের ৫০ ভাগ শব্দের জ্ঞান অর্জন সম্ভব। আরো ২৫ ভাগ শব্দের অর্থ জানতে ২৬০ শব্দের সাথে পরিচিত হতে হবে। বিস্ময়কর গ্রন্থ আল-কুরআন কতো অল্প শব্দ দিয়ে আল্লাহ তা সাজিয়েছেন। যে কোনো ভাষা ভালোভাবে জানতে তার শব্দ ভাণ্ডার বেশি করে জানা দরকার।
আল-কুরআনের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন –
- “নিশ্চয় আমি এটিকে কোরআন রূপে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পারো’। (সূরা ইউসুফ ২)
- ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও তোমাদের বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয়-এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য’। সূরা আর রুম, আয়াত ২২
মক্কা পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্র তাই সমগ্র পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থান হিসেবে আরবের ভাষা আরবিতেই আল-কুরআন নাযিল করা হয়। এতে আরবি ভাষা ভাষীরা খুব সহজেই ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়।
এ প্রসঙ্গে মহান তা’য়ালা আল্লাহ বলেন-
‘আর এটি একটি কিতাব, যা আমি নাযিল করেছি— বরকতময়, যা তাদের সামনে আছে তার সত্যায়নকারী। আর যাতে তুমি সতর্ক কর উম্মুল কুরা (মক্কাবাসী) ও তার আশ-পাশে যারা আছে তাদেরকে। আর যারা আখেরাতের প্রতি ও এ কিতাবের প্রতি ঈমান আনে এবং তারা তাদের সালাতের উপর যত্নবান থাকে। সূরা আল-আনআম আয়াত: ৯২ ।
- ‘আমি আপনার নিকট কিতাব নাযিল করেছি, যাতে সকল বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে (সূরা নাহল আয়াত ৮৯)।
পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম আলাইহিস সাল্লাম ছিলেন বস্তুজগতের সকল জ্ঞানের অধিকারী। এ প্রসঙ্গে মহান তা’য়ালা আল্লাহ বলেন-‘আর তিনি আদমকে সব নামসমূহ শিক্ষা দিলেন তারপর তা ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। সুতরাং বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’ (সূরা আল-বাকারা আয়াত ৩১)। ‘করুণাময় আল্লাহ, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে (মানুষকে) শিখিয়েছেন বর্ণনা’ (সূরা আর-রহমান আয়াত ১-৪)।
অর্থ্যাৎ ‘আমি সব নবী ও রাসূলদেরকেই তাদের স্বজাতির ভাষা ভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারে, অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন, তিনি মহাপরাক্রান্ত-প্রজ্ঞাময়’ (সূরা-ইব্রাহিম, আয়াত ০৪)।
মহান রাসূলগণ (স:)-এর প্রতি যে সকল আসমানি কিতাব তাঁদের নিজ ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে—
ক. তাওরাত কিতাবের ভাষা ছিল হিব্রু।
খ. জাবুর কিতাবের ভাষা ছিল ইউনানী ।
গ. ইঞ্জিল কিতাবের ভাষা ছিল সুরিয়ানী
ঘ. আল-কুরআনের ভাষা হলো আরবি
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন-
‘এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবি ভাষায় কুরআন নাযিল করেছি যাতে আপনি মক্কা ও তার আশ পাশের লোকদের সতর্ক করেন সমাবেশের দিন সম্পর্কে যাতে কোন সন্দেহ নেই, এক দল জান্নাতে আরেক দল জাহান্নামে প্রবেশ করবে’ (সূরা আশ্- শুরা, আয়াত ০৭)।
যদি আরবি ভাষায় আল-কুরআন নাজিল না হতো, তাহলে তাদের বুঝতে, অনুধাবন ও ধর্মীয় অনুশাসন পালন করতে অসুবিধা হতো। প্রত্যেকটি ভাষার অলংকৃত রূপ হলো সাহিত্য। আর আল-কুরআনের সাহিত্যমান মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন প্রদত্ত ।
ফরাসি পণ্ডিত ড. মরিস বুকাইলি বলেন- ‘আল-কুরআনকে সুসংগতভাবেই বলা যায় বিজ্ঞানীদের জন্য একটি বিজ্ঞান সংস্থা, ভাষাবিদদের জন্য একটি শব্দকোষ, বৈয়াকরণদের জন্য একখানা ব্যাকরণ গ্রন্থ, কবিদের জন্য একখানা ছন্দ সাহিত্য এবং কানুন বা বিধানের বিশ্বকোষ’।
আরবি ভাষার চ্যালেঞ্জ
আরবি ভাষা ভালোভাবে জানলে আল-কুরআন বুঝা সহজ হয়।
‘যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি তবে তার মতো একটি সূরা রচনা করে নিয়ে আস’ (সূরা আল-বাকারাহ্, আয়াত-২৩)।
আল-কুরআনের রচনাশৈলী ও পদবিন্যাসও একটি মু’জিজা। আরবদের তৎকালীন বাগধারা, বাক্য বিন্যাসে কুরআনের অনুরূপ রচনাশৈলীর কোন নমুনা পাওয়া যায় না। আল-কুরআন নাযিল হওয়ার পরবর্তীতে আরবি ভাষার অলংকারে আসে নিত্য নতুন সংস্করণ। কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে বাক্য, বাক্য প্রয়োগে অনুপম কৌশল ও নৈপুণ্য ছিল মানুষের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। কুরআনের যে প্রকাশভঙ্গিগুলো আরবি ভাষায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, তা হলো ছন্দময়তা, প্রশ্নের প্রয়োগ, সুস্পষ্টতা, সংক্ষিপ্ত অথচ বর্ণনামূলক অর্থ প্রকাশ, সহজ করে উপস্থাপন, উপমার যথার্থ ব্যবহার, প্রয়োজনে কাহিনীর শৈল্পিক সমাবেশ ইত্যাদি। আল-কুরআন শুনে আরবের কবি সাহিত্যিক ও পণ্ডিতরা হতবাক হয়েছেন। তারা আল-কুরআনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হয়েছে পরাজিত, আরবের জ্ঞানী-গুণী, ছোট-বড় সবাই আল-কুরআনের অলৌকিক বাচনভঙ্গি, অপূর্ব ভাবধারা এবং এর প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করেছে।
আরবি ভাষার সাথে আল-হাদিসের জ্ঞান-এর সম্পর্ক
মানব জীবনের সৌন্দর্যের অন্যতম দিক হলো ভাষা। ভাষার মাধ্যমে বিকশিত হয় ব্যক্তি ও সমাজের বাস্তব চিত্র। ইসলামে ব্যক্তি জীবনের মধুর বাচনভঙ্গি ও ভাষা ব্যবহারকে গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘নিশ্চয় কিছু কথা জাদুময়’ (সহিহ বুখারী: ৫১৪৬)।
প্রত্যেক নবী ও রাসূল সাল্লাহু সাল্লামকে যে সকল সহিফা বা আসমানী কিতাব দেওয়া হয়, যা তাদের স্ব-স্ব ভাষাতেই নাযিলকৃত । হযরত আবুজর রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন— ‘আল্লাহ তাঁর প্রত্যেক নবীকে তার স্বজাতিয় ভাষায় প্রেরণ করেছেন’ (মুসনাদে আহমদ: ২১৪১০)।
আল্লামা ইবনে কাসির রহমাতুল্লাহ আলাইহিবলেন, নবী-রাসূলরা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাতৃভাষা ভাষী হওয়ার কারণ হচ্ছে, যেন তাঁদের জাতি রসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য এবং তারা কি নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন, , তা বুঝতে পারেন ‘তাফসির ইবনে কাসির ৪/৪৭৭.’।
মাতৃ ভাষায় নবী ও রাসূলদের দক্ষতা
নিরেট বিশুদ্ধ ভাষা ভাষী ছিলেন প্রত্যেক নবী-রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তারা নিজ নিজ ভাষায় পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবলেন- ‘আমি আরবদের মাঝে সর্বোত্তম বিশুদ্ধভাষী’।
আল-কুরআনের পরেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের হাদিস-এর অবস্থান। এর মাধ্যমে আরবি ভাষার বিশুদ্ধতা ও আধুনিকতা বৃদ্ধি পায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর এবং বিশেষ অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন। যার ফলে আরবি গদ্য সাহিত্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁর সান্নিধ্য যারা পেয়েছেন, তাঁরা রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু/আনহা আরবি ভাষার শ্রীবৃদ্ধি করেছেন নিয়মিতভাবেই। ফলে আরবি ধর্মীয় ভাষা ছাড়াও সমগ্র বিশ্বে একটি আদর্শ ভাষা হিসেবে তার অবস্থান নিশ্চিত করে।
তিনি উত্তম ভাষায় মার্জিত শব্দে কথা বলতেন। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটি শব্দ, বাক্য, বাক্যের অলংকার, উপকরণ, উচ্চারণ ভঙ্গিমা সবকিছুই ছিল বিশুদ্ধতার প্রতীক। তিনি গুছিয়ে কথা বলতেন। তিনি কথা বলার সময় তাড়াহুড়ো করতেন না। যা বলতেন স্পষ্টভাষায় ধীরে ধীরে বলতেন। তাঁর এই পন্থা সাহাবীগণও অনুসরণ করতেন। এতে তাঁরা সহজেই যে কোন বার্তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- “নিশ্চয় আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি’। (ইবনে মাযাহ: ২২৯)
রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম যেমন নিজে ভাষার বিশুদ্ধতার প্রতি যত্নবান ছিলেন, তেমনি অন্যদের বিশুদ্ধ ভাষী হওয়ার জন্য উৎসাহ ও নির্দেশ দিতেন। ভুল বা বিকৃত হতে দেখলে তিনি সঠিক করে বলে দিতেন । কোথাও কোন বাক্য বা শব্দ প্রয়োগ করতে হবে তার নির্দেশনা ও ব্যবহারের জন্য বলতেন। যেমন ‘আলিজু’ শব্দের পরিবর্তে ‘আ-আদখুলু’ এবং আঙ্গুরকে ‘ই’নাব বা হাবালাহ বলা। দাস শব্দের পরিবর্তে চাকর, মনিবকে প্ৰভু না বলে সরদার বলা ইত্যাদি।
এ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ইমাম মুসলিম রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু/আনহা তার মুসলিম শরীফে ‘আল-লাফজু মিনাল আদাব’ শিরোনামে একটি অধ্যায় এনেছেন।
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন-
‘আপন পালনকর্তার প্রতি আহবান করুন, জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে, উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দযুক্ত পন্থায়’। বিশুদ্ধ আরবি ভাষী হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপস্থাপনা বা যে কোনো বিষয়ে বলার
ভঙ্গি ও ভাষা ছিল বিশুদ্ধ এবং প্রাঞ্জল, যা আরবি ভাষা ও সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ ও মানসম্মত । ইসলামি যুগের আবির্ভাবের ফলে আল-কুরআন ও আল-হাদিস আরবি ভাষাকে নতুন প্রাণ দিয়েছে, যা কেয়ামত পর্যন্ত অবিকল থাকবে, এই ভাষায় কোন বিকৃতির ছোঁয়া লাগবে না ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সান্নিধ্যে থেকে সাহাবাগণ বিশুদ্ধ আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন, যা পরবর্তীতেও চলমান থাকে। সে সময়ের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ইবনে জুহায়ের, কা’ব ইবনে মালিক, হাস্সান বিন সাবিত, লাবিদ, আলী ইবনে আবি তালেব প্রমুখ জ্ঞানী ব্যক্তিদের রচনা বিশুদ্ধ আরবির পরিচয় বহন করে।
ইসলামি সাহিত্য চর্চাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমর্থন করেন এবং উৎসাহ প্রদান করেন। খন্দকের যুদ্ধে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামস্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু/আনহা হতে বর্ণীত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম মুসলিম কবিদের উৎসাহ দিয়ে বলেন— ‘যারা অস্ত্র হাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাহু সাল্লামকে সাহায্য করে তাদেরকে নিজ কথা (রচনা) দ্বারা সাহায্য করতে কী নিষেধ করেছে?’
হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু/আনহা বলেন- তাঁর জন্য আমার বাবা-মা উৎসর্গ হোক, আমি তার চেয়ে উত্তম শিক্ষক আগে ও পরে কখনও দেখিনি। ভাষার সর্বোত্তম ব্যবহার, শিষ্টাচার তিনি শিখিয়েছেন।
ভাষা দেহ ও মনের সমন্বয়
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন বিষয়ের অবতারণা করলে, তাঁর দেহ-মনের সমন্বিত ভাষায় পাঠদান করতেন। এতে বিষয়ের প্রতি মনোযোগ, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শ্রোতা আকর্ষিত হতো। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বক্তব্য দিতেন তাঁর চোখ লাল হয়ে যেতো, আওয়াজ উঁচু হতো এবং ক্রোধ বৃদ্ধি পেতো, যেন তিনি (শত্রু) সেনা সম্পর্কে সতর্ককারী (মুসলিম ৪৩)।
তিনি বৈচিত্র্যময় জ্ঞানের অধিকারী ও পণ্ডিত ছিলেন। শিক্ষার প্রয়োজন অনুযায়ী তিনি পাঠদানের মধ্যেও বৈচিত্র্যময়তা আনয়ন করতেন। তিনি এমনভাবে গল্প ও কবিতা বলতেন যেন শ্রোতার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত সে বর্ণনা । উপমার ব্যবহারেও তাঁর ছিলো সুনিপূণ দক্ষতা। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও উত্তরদানে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। কখনো রেখাচিত্র অংকন-এর সাহায্য নিতেন। জীবন ও জীবন-এর সীমাবদ্ধতা উপস্থাপন করতেন ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষাদান পদ্ধতি
আরবি ভাষা ও সাহিত্যকে পরিপূর্ণতার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষাদান পদ্ধতিও অবদান রাখে।
উপস্থাপনা, বিষয়ের গুরুত্ব, বারবার বলা, ভুল সংশোধন করা, উৎসাহিত করা, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বুঝানো, প্রশ্নগ্রহণ ও জবাব প্রদান, আমলের মাধ্যমে শিক্ষাদান, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকা, প্রত্যাশা ও ভয়ের মধ্যে বিরাজমান রাখা, মুক্ত আলোচনা ও মতবিনিময়, শাস্তিদানের (শারীরিক শাস্তি না দিয়ে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতেন) মাধ্যমে শিক্ষাদান। [রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষাদান-এর পদ্ধতি: আতাউর রহমান খসরু]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখনিসৃত কথা ছিল ভাষা ও সাহিত্যের মানদণ্ডে সর্বোত্তম। অসংখ্য হাদিস আরবি ভাষার উন্নয়নে অতুলনীয় অবদান রাখে। যাযাবর আরবদের ভাষাকে পৌত্তলিকতার বেড়াজাল থেকে বিশ্বমানে প্রতিষ্ঠা করেন। মাতৃভাষার প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালোবাসা, সম্মান ও প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেন ।
আরও দেখুনঃ