আরবি ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়আরবি ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা – যা আরবি ভাষা ও সাহিত্য শিখনের বিবেচ্য দিকসমূহ এর অন্তর্ভুক্ত।

আরবি ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

 

আরবি ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

 

আরবি ভাষার গুরুত্ব

ভাষা হিসেবে আরবি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা এটি। বিশ্বের ২৮টি দেশের মাতৃভাষা ছাড়াও ভাষা ব্যবহারকারী জনসংখ্যার হিসাবে ষষ্ঠ স্থানে আরবি ভাষার অবস্থান। নানা কারণে আরবি ভাষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভাষা ।

ধর্মীয় দিক থেকে

ধর্মীয় দিক থেকে আলোচনা করলে আমরা যা পাই আমাদের পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ্ আল হাদিস ও অন্যান্য ইসলামি সহায়ক গ্রন্থের মূল ভাষা আরবি।
প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের নিকট আরবি একটি পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। আরবি ভাষা না জানলে আল- কুরআন ও আল-হাদিস অধ্যয়ন করে সঠিকভাবে বুঝা ও জ্ঞান অর্জন অসম্ভব। তাই সমগ্র পৃথিবীতে মুসলিমদের কাছে আরবি ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:

আলিফ লাম মিম এটি এমন কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য পথ প্রদর্শক ।

“নিশ্চয়ই আমি আরবি ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পারো ।

‘আরবি ভাষায় এ কুরআন বক্রতা মুক্ত, যাতে তারা সাবধানতা অবলম্বন করে ।

  • ‘এইভাবে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি বিধান রূপে আরবি ভাষায়’ সূরা রাদ ১৩, আয়াত ৩৭।
  • ‘এইরূপে আমি কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় এবং তাতে বিশদভাবে বিবৃত করেছি সতর্কবাণী, যাতে তারা ভয় করে অথবা এটাকে উপদেশ হিসেবে গ্রহণ করে’। সূরা ২০ তাহা, আয়াত: ১১৩

ধর্মীয় সকল কাজেই আমরা আল-কুরআন ও আল-হাদিসকে অনুসরণ করি বিধায় আরবি ভাষা আমাদের নিত্য দিনের ভাষা। আমাদের সকল কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আরবি ভাষা একান্তভাবে জড়িয়ে আছে। দুনিয়ার সকল ভাষার শ্রেষ্ঠ ভাষা আরবি ভাষা। জান্নাতের ভাষাও আরবি ভাষা ।

পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআনের বিখ্যাত ভাষ্যকার ইবনে কাসীর-এর মতে— “সর্বাধিক মর্যাদাবান ফেরেশতার মাধ্যমে, সর্বাধিক মর্যাদাবান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের-এর প্রতি, সর্বাধিক মর্যাদাবান ভাষায়, সর্বাধিক মর্যাদাবান গ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।

আরবি ভাষাকে সকল ভাষার জননী বলা হয়। আল-কুরআন, আল-হাদিস, ফিক্‌হশাস্ত্র শিক্ষাগ্রহণ ও জীবনে তার সঠিক বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক মুসলিমের আরবি ভাষা জানা অপরিহার্য। আল্লাহর নির্বাচিত ভাষা, কুরআনের ভাষা, ইবাদতের ভাষা, ইসলামি শিক্ষার ভাষা আরবি ভাষা ।

জ্ঞানার্জনের ভাষা

আগেই বলেছি আরবি সকল ভাষার জননী। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন ছাড়াও বিজ্ঞান, কলা, গণিত, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখার জন্য আরবি ভাষা গুরুত্বপূর্ণ। আল-কুরআনকে রিসার্চ করেই আজকের আধুনিক বিশ্ব, উড়োজাহাজ, সামুদ্রিক জাহাজ, কম্পিউটার, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সফলতা পেয়েছে। এগুলো আল-কুরআন ও ইসলামী জ্ঞানের বিশ্লেষণমূলক চিন্তা-চেতনার ফসল।ইমাম বায়হাকী সূত্রে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর উক্তি—‘আরবি শেখো, কেননা এটি হৃদয়কে দৃঢ়তা দান করে এবং সাহস বৃদ্ধি করে।

ব্যবসা বাণিজ্যের ভাষা

একটা সময়ে অবহেলিত মরুভূমি আজ সমগ্র বিশ্বের চমক। তেল উৎপাদনের সাথে সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে বিপ্লব ও উৎকর্ষ সাধিত হয়, তারই পরিক্রমায় আজ পুরো আরব দুনিয়ার ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র। লক্ষ লক্ষ মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশসমূহে কাজ করছে। এমনকি ভারতের ১৫ লক্ষ হিন্দু শিক্ষার্থী মাদরাসায় অধ্যয়ন করছে আরবী ভাষা, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের জন্য। তারা জানে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ভাষা। তাই আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে তারা আরব দেশসমূহে ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ পায়।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির এ যুগে ব্যবসায়ীদের ভূ-স্বর্গ মধ্যপ্রাচ্য। তাই সবার কাছেই আরবি ভাষার কদর ও সম্মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরবি ভাষাও দিন দিন তার ব্যাপ্তি আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করছে। পৃথিবীর সকল বিখ্যাত পণ্যের প্যাকেট সহ নানা বিজ্ঞাপনে আজ তারা আরবি ভাষাকে ব্যবহার করছে। আমাদের বাংলাদেশের যে সকল শ্রমিক ভালো আরবি জানেন, তারা আরব বিশ্বে ভালো চাকরি করতে পারেন। আবার আরবি না জানার কারণে অনেকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভালো কাজে যোগদান করতে পারছেন না ।

আরবি আন্তর্জাতিক ভাষা

জাতিসংঘের চারটি দাপ্তরিক ভাষার মধ্যে আরবি অন্যতম ভাষা। বিস্তৃত পরিসর নিয়ে আরবি ভাষা স্রোতস্বিনী নদীর মতো বহমান। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশের জাতীয় বা প্রধান ভাষা আরবি।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরবি ভাষার ব্যাপক প্রচলন-এর ফলে হয়তো অচিরেই আমরা দেখতে পাবো যে পৃথিবীর এক নম্বর ভাষা আরবি। চলমান বিশ্বের সবগুলো স্তরেই আরব বিশ্বকে প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। ধর্মীয়, আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় আরবি ভাষাকে গ্রহণ করে তারা সাফল্য লাভের কারণে সবার কাছেই আরবি সু-উচ্চাসনে অবস্থিত। আরবি ভাষা এখন আর ধর্মীয় ভাষা নয়, এটি বিশ্বব্যাপী কমার্শিয়াল ভাষাও। বিশ্বের ৪২২ মিলিয়ন আরব জনগোষ্ঠী এবং ১৫০ কোটিরও বেশি মুসলিম তাদের দৈনন্দিন জীবনে আরবি ভাষা ব্যবহার করছে।

 

আরবি ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

 

আরবি ভাষার বৈশিষ্ট্য

  • আরবি ভাষার শব্দমূল ৩ বর্ণ বিশিষ্ট ।
  • শব্দের প্রথম ও মধ্যের অক্ষর-এর বর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থের পরিবর্তন সাধিত হয়।
  • এ ভাষায় যৌগিক ক্রিয়া নেই। তবে সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার রূপ বিদ্যমান।
  • আরবি ভাষায় একমাত্র দ্বিবচন আছে, যা অন্য কোন ভাষাতে নেই ।
  • এ ভাষায় তিনটি কারকের ব্যবস্থা আছে
  • ক্রিয়াপদের পরে সেই ক্রিয়ার ধাতুজাত শব্দ দ্বারা ক্রিয়া বিশেষণের কাজ সম্পাদন করা হয়।
  • বিশেষ্য ও ক্রিয়ায় ‘ইরাব এর বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে।
  • বাক্য সংযোজন অব্যয়দ্বারা সু-স্পষ্ট নির্দেশ করে।
  • পৃথিবীর সর্বাধিক সমার্থক শব্দের সমাহার রয়েছে এ ভাষাতে।
  • পৃথিবীর সর্বাধিক শব্দভাণ্ডারের ভাষাও আরবি।
  • স্বল্প বাক্যে ব্যাপক অর্থ প্রকাশের ভাষা আরবি।
  • একটি শব্দের বহু বিপরীত শব্দ ও অর্থবোধক শব্দ রয়েছে।
  • পশুপাখির বিভিন্ন ধ্বনির অনুকরণে শব্দ রয়েছে।
  • প্রবাদ-প্রবচন ও বাগধারায় পরিপূর্ণ।
  • এ ভাষায় বিশেষণের শব্দ পরবর্তীতে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

আরবি ভাষার প্রয়োজনীয়তা

পৃথিবীতে বিদ্যমান ভাষাগুলোর মধ্যে আরবি ভাষার প্রয়োজনীয়তা সর্বাগ্রে। আরবি ভাষা জানা ও আরবি ভাষার দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কিভাবে সার্বিক উন্নতি সম্ভব, তা আমরা বর্তমান বিশ্বের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বুঝতে পারি । ধর্মীয় জ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে ও পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে হলে একমাত্র আরবি ভাষা জানার মাধ্যমেই সম্ভব। আমাদের জীবন বিধান সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:

তারপর আল-হাদিস সম্পর্কে জ্ঞানার্জন ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগে অবশ্যই আমাদের আরবি ভাষা জানা প্রয়োজন। আমাদের ইবাদত-বন্দেগী, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমন যে কোনো মাধ্যমের জ্ঞান আল-কুরআন-এর মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব।

শুধু মুসলিমদের জন্য নয় আল-কুরআন যেহেতু সমগ্র মানব জাতির জন্য দিশারী তাই সকলেরই আরবি জানা আবশ্যক।ড. মরিস বুকাইলি মদিনায় দীর্ঘ আট বছর অবস্থান করে আরবি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধি করার পর আল- কুরআন নিয়ে গবেষণা করেন এবং পরবর্তীতে মুসলিম হয়ে যান। আরবি ভাষা জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আধার। এ যেন জ্ঞানের এক মহাসমুদ্র। আরবি ভাষা জানার মাধ্যমে সেই সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের কিছুটা অর্জন করা সম্ভব।

আজকের বাংলাদেশ যে বৈদেশিক রেমিটেন্স নিয়ে অহংকার করছে, তার সিংহভাগ আসে আরব দেশসমূহ থেকে। আমরা যদি ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করতে পারি তাহলে আরও বেশি জনশক্তি রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।

আরব দেশসমূহের আইসিটি বিভাগের নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয়রা। আরব দেশসমূহের মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বেশিরভাগ শিল্প-কারখানার নিয়ন্ত্রণ প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের হাতে। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে তাদের পদক্ষেপসমূহের মধ্যে কমিউনিকেটিভ ল্যাঙ্গুয়ের হিসেবে প্রাধান্য দেওয়া কাজের দক্ষতার পাশাপাশি ভাষায় দক্ষতার কারণে তাদের উত্থান। অথচ বিশাল জনগোষ্ঠীর মুসলিম দেশ বাংলাদেশ সেখানে অনেকটা পিছিয়ে আছে আরবী ভাষা না জানার কারণে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরবি ভাষার গুরুত্বের কারণেই-এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বর্তমানে যত প্রকার Trade আছে সবখানে আরবিকে Trade Language হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে হলে চাই আরব দেশগুলোর সাথে ব্যাপক আরবি ভাষা চর্চা ও সংস্কৃতি বিনিময়ের পরিকল্পনা। এমনিতেই আরব দেশসমূহ আমাদের সামাজিক ধর্মীয় ও উন্নয়নমূলক খাতে প্রচুর পরিমাণে আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। তাই দক্ষ আরবি ভাষী হয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য আরবি ভাষা জানা প্রয়োজন।

 

 

আরবি ভাষা জানার ফলে অনেক ধর্মীয় বিষয়ের জ্ঞান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়, আর ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়। আল-কুরআন ও হাদীস উপস্থাপন সহজ হয়। পৃথিবীতে কত ভাষার জন্ম হলো আর পতন হলো, কিন্তু আরবি ভাষা আজও আপন মহিমায় দণ্ডায়মান। মুসলিম-প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশে আরবি ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত ব্যাপক।

আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিশ্ব দরবারে স্থান করে নিয়েছে। আরবি কবিতা বর্তমান বিশ্বের প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শন, যার বাস্তব সংযোজন আমরা ‘সাবউল মুয়াল্লাকাত’-এর মাধ্যমে পেয়ে থাকি। পরবর্তীতে আরবি ব্যাপক চর্চার ফলে সমগ্র বিশ্বে আরবি ভাষার সৌন্দর্য উপভোগ করা হয়। আরবি ভাষার সংস্পর্শে এসে অন্যদের ভাষা সাহিত্য সমৃদ্ধ হতে পারে। তাই আরবি ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

আরও দেখুনঃ

 

Leave a Comment