আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় আরবি ভাষা শিক্ষার মানোন্নয়ন : প্রতিবন্ধকতা ও সমাধান – যা আরবি ভাষা ও সাহিত্য শিখনের বিবেচ্য দিকসমূহ এর অন্তর্ভুক্ত।
আরবি ভাষা শিক্ষার মানোন্নয়ন : প্রতিবন্ধকতা ও সমাধান
বাংলাদেশে আরবি ভাষা চর্চা
ব্যবসায়িক ও ধর্মীয় কারণে আমাদের দেশে আরবিভাষা চর্চা হয়ে আসছে। কালের প্রবাহে আরবিভাষা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে মিলিত হয়েছে আপন স্বকীয়তায়। ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার পেলেও প্রয়োজনীয় ভাষা দক্ষতা তৈরি হয়নি, তৈরি হয়নি আরবি ভাষায় দক্ষ জনশক্তি। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মুসলিম আল-কুরআন তেলাওয়াত করতে পারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করা ছাড়া আরবিভাষাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি বা হয়না। আরবিভাষাকে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে অনেকগুলো সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যাতে করে দেশের অগ্রগতি, উন্নয়নে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সঠিকভাবে আরবি ভাষাকে আয়ত্ত করতে সক্ষম হননি। অর্থনৈতিক দিক থেকে আরবি ভাষাকে অলাভজনক মনে করা হয়। সুতরাং আরবিভাষার দুর্বলতা থেকেই যাচ্ছে।|
বাংলাদেশে আরবি ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে অদক্ষতা ও দুর্বলতার কারণসমূহ—
শিক্ষকের আরবি ভাষা দক্ষতা না থাকা
মাদরাসায় আরবি পাঠদান বাংলা ভাষায় করে থাকেন অনেক শিক্ষক। আরবি ক্লাসে আরবিতে মোটেই কথা বলা হয় না। আরবিতে কথা বলার আগ্রহ দেখানো শিক্ষক যদি আরবি ভাষায় দুর্বল হন বা অনুশীলন না করেন, শিক্ষার্থী কিভাবে উপকৃত হবে? আরবি ক্লাসে শিক্ষকের এই দুর্বলতার কারণেই আরবি ভাষার দক্ষতা অর্জন হয় না।
শিক্ষকের সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব
সময়ের চাহিদা বা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য চাই শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষ, মেধাবী, প্রশিক্ষিত, শিক্ষক ও প্রশিক্ষক। আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য মাত্র একটি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, যা সম্পূর্ণভাবে গুণগতমান সম্পন্ন প্রশিক্ষণের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। লক্ষ লক্ষ শিক্ষকদের জন্য একটি মাত্র প্রশিক্ষণ। প্রতিষ্ঠান সেখানে আরবি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কোনো কার্যক্রম যথাযথভাবে নেই। আবার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দকে বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরবি ভাষার জন্য দক্ষ করে তোলার কোন ব্যবস্থা নেই। এভাবে তৃণমূল থেকে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সব জায়গায় অপ্রতুল সুবিধার কারণে দক্ষ শিক্ষক-প্রশিক্ষক আমরা পাচ্ছি না।
চর্চা ও অনুশীলন করার পরিবেশ অপ্রতুল
বিদেশি ভাষার কারণে আরবি ভাষাকে আমাদের দেশে অনেকে ধর্মীয় ভাষা মনে করেন। ফলে দৈনন্দিন জীবনে তেমন একটা ব্যবহার করেন না। তাই আরবি ভাষার দক্ষতা অর্জনের জন্য যেভাবে চর্চা বা অনুশীলন দরকার, সেভাবে চর্চা অনুশীলন করা হয় না, তাই ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধি পায় না ।
শিক্ষার্থীদের ভাষা ভীতি
আরবি ভাষা শিখতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা ভাষাকে আনন্দ সহকারে মেনে নিতে পারেনি। পড়ার জন্য যে পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন, তা করা হয়নি। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনের গহীনে আরবি ভাষা শেখার একটা ভীতি তৈরি হয়ে আছে। যাতে করে আরবি ভাষাকে তারা জটিল ও কঠিন মনে করছে।
প্রেষণা না থাকা
পাঠদানে শিক্ষার্থীদের জন্য চাই উপযোগী প্রেষণা। শিক্ষার্থীকে ধর্মীয় কারণ ছাড়াও তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থানের তুলনামূলক আলোচনার মধ্যে প্রেষণা দেওয়া প্রয়োজন। আনন্দ ও আগ্রহ থাকা চাই। এগুলো থাকলে শিক্ষার্থী আরবি ভাষাকে সহজেই গ্রহণ করতো এবং দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করতো। আমরা পরিবেশ ও সমাজ অনুযায়ী সেবা দিতে অপারগতার কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রেষণা বঞ্চিত।
মাদরাসা শিক্ষার প্রতি অনীহা
জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে সবাই পড়াশোনা করে। এই জ্ঞানার্জনের ঠিক উল্টো পিঠে অর্থনৈতিক মুক্তির কথাটি লেখা। আমাদের দেশে মাদরাসা পড়ুয়াদেরকে অনেকেই হেয় করে দেখে। চাকরির বাজারে তাদের মূল্যায়ন করা হয় না বা চাকরির সুযোগ কম বলে বা আয় রোজগার করার পথ তেমন নেই বলে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক অনীহার দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করে ।
অভিভাবকদের উদাসীনতা
সাধারণত: শাররিরীক ও মানসিকভাবে সক্ষমতাপূর্ণ সন্তানদের মাদরাসায় না পড়িয়ে তুলনামূলকভাবে দুর্বল মেধা সম্পন্ন সন্তানদের মাদরাসায় পড়ানো হয়। তাছাড়া তাদের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক, মানসিক ও সামাজিক সমর্থন ও দেয়া হয় না। অনেকেই এখানে ‘ফি সাবিলিল্লাহ্’ মানসিকতা পোষণ করেন।
উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য ও প্রতিবন্ধকতা
মাদরাসা শিক্ষার্থীরা দাখিল-আলিম পাশ করার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য যোগ্যতা থাকা সত্বেও পছন্দমতো বিষয়ে ভর্তি হতে নানা রকম বৈষম্য ও প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখী হয়। ফলে তারা অনেক সময় উচ্চতর জ্ঞানার্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
শিক্ষক শিক্ষার্থীর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকা
শ্রেণিকক্ষে ব্যতীত সারাদিন আর কোথাও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আরবি-ভাষা ব্যবহার হয়ে উঠে না। বাড়িতে, মাঠে, হাট-বাজারে কোথাও আরবিতে কথোপকথন হয় না। আবার শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের আরবি বলার জন্য পরিবেশ তৈরি করেন না বা সুযোগ প্রদান করেন না। শিক্ষার্থীর মতামত বা আগ্রহকেও প্রাধান্য দিয়ে আরবি-ভাষা উপস্থাপন করেন না।
শিক্ষাক্রম যথাযথ না হওয়া
রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলিত শিক্ষাক্রমে বিশেষ করে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা আরবি-ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধির উপযোগী না । ২০১৯ সালের আগে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যবহারিক আরবি-ভাষা-এর উপর ভিত্তি করে শিক্ষাক্রম তৈরি হয়নি। আরবি ব্যাকরণ, গল্প, কবিতা ও রচনার উপর করে নির্ভর আরবি-ভাষা পাঠ দান করা হতো, যা শিক্ষার্থীর ব্যবহারিক জীবনে তেমন কাজে আসতো না ।
পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্র না থাকা
আমাদের দেশে মাদরাসায় পড়ুয়াদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্র নেই। যারা কর্ম পাচ্ছেন তাদের কর্মক্ষেত্র অধিকাংশই মাদরাসায় শিক্ষকতা বা ইমামতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। মাদরাসা থেকে যারা পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে বা করতে পারছে তারা উন্নত কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছেন। শুধুমাত্র মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তির জন্য আমাদের দেশে এখনো সীমিতই রয়েছে কর্মক্ষেত্র। অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনে সরকারি-বেসরকারি পর্যাপ্ত সুবিধা ও কর্মক্ষেত্র আমরা প্রত্যক্ষ করি। এতে শিক্ষার্থীর মনে আরবি-ভাষার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হয়।
ভিন্ন ভাষায় আরবি ব্যাকরণ শেখানো
সহজবোধ্য আরবি-ভাষায় আরবি ব্যাকরণ না শিখিয়ে আলিয়া ও কওমি মাদরাসাগুলোতে বাংলা, উর্দু বা ফার্সি ভাষায় আরবি ব্যাকরণ মুখস্থ করানো হয়। এতে করে শিক্ষার্থীরা আরবি ব্যাকরণকে আরবিতে না বুঝে অন্য বিদেশি ভাষায় বুঝতে গিয়ে জটিলতার সম্মুখীন হয়। ফলে তাদের কোন ভাষাই ভালো করে শেখা হয় না, আরবি-ভাষা শিখনে দুর্বলতা থেকেই যায়।
সমস্যা উত্তরণের উপায় ও সরকারের ভূমিকা
আধুনিক শিক্ষাক্রম তৈরি করা
আরবি-ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এবং আরবি কথোপকথনে পারদর্শিতা অর্জন এর জন্য মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণিভিত্তিক গুণগত ও মানসম্পন্ন আধুনিক শিক্ষাক্রম তৈরি করা প্রয়োজন। বিষয়টি উপলব্ধি করে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড-এর উদ্যোগে এনটিআরসি-এর পরিচালনায় মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন ও আরবি-ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৯ সাল থেকে নতুন করে আধুনিক ও যুগোপযুগী মাদরাসা শিক্ষাক্রম তৈরি হচ্ছে।
ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে গতিশীল আধুনিক ও মানসম্পন্ন করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে সরকার ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের সমগ্র মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত। সরকার ২০১০ সালে দেশের নামকরা ৩১টি মাদরাসায় অনার্স প্রোগ্রাম চালু করে। শুরু থেকে নিম্নোক্ত ৫টি বিষয়ে এই প্রোগ্রাম চালু রয়েছে।
১. হাদিস ও ইসলামি শিক্ষা ।
২. আল কুরআন ও ইসলামি শিক্ষা
৩. আদ-দাওয়া ও ইসলামি শিক্ষা ।
৪. আল আদাবুল আরবি (আরবি সাহিত্য)।
৫. ইসলামের ইতিহাস।
এই অনার্স প্রোগ্রাম ছাড়াও মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় ফাজিল (পাস), ফাজিল (স্নাতক) এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) শিক্ষা কার্যক্রম যেগুলো এযাবৎ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধীনে ছিল, এখন সেগুলো ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে পরিচালিত হচ্ছে।
তবে সরকারী কারিকুলাম অনুযায়ী না চলার কারণে দেশের কওমি মাদরাসাগুলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হবে না। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ২০৫টি কামিল মাদরাসা, ৩১টি ফাজিল (সম্মান) ১০৪৯টি ফাজিল (অনার্স/পাস), ৩টি সরকারি মাদরাসাকে অধিভূক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার ৩১ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এদের মধ্যে এক লাখ ৯৭ হাজার ৩৮৫ ছাত্রী।
আরও দেখুনঃ