আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্র বিশ্লেষণ-১
একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্র বিশ্লেষণ-১
একাডেমিক শ্রেণির নমুনা পাওয়াতপত্র বিশ্লেষণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার কর্তৃক আয়োজিত ‘পাণ্ডুলিপি বিষয়ক কর্মশালা-২০১৮’র দাওয়াতপত্রটি নির্বাচন করা হয়েছে। বিশ্লেষণের জন্য দাওয়াতপত্রটি নিচে সংযোজিত হলো।
ক. সার্লের বাককৃতি তত্ত্ব অনুসারে একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্রের বাককৃতি বিশ্লেষণ
বিশ্লেষিত দাওয়াতপত্রটির উক্তিমালা বা ডিসকোর্স বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দাওয়াতপত্রটিতে ৪টি কাঠামোগত অংশ রয়েছে, যেমন- i) সম্বোধন ii) বর্ণনা iii) অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য বিনীত অনুরোধ এবং iv) বিনম্রতাসূচক শব্দের মাধ্যমে নিজের পদবিসহ নাম উল্লেখ।
একটি একাডেমিক দাওয়াতপত্রের এই চারটি অংশে কোন ধরনের ভাষাগত উপাদান থাকে তা নিচের সারণিতে
উল্লেখ করা হলো।
সারণি: ১৭ একাডেমিক (পাণ্ডুলিপি বিষয়ক কর্মশালা) নমুনা দাওয়াতপত্রের কাঠামোগত অংশ
উল্লিখিত দাওয়াতপত্রটির প্রস্তাব কৃতির শুরুতেই আমন্ত্রণকারী আমন্ত্রিত অতিথিকে সম্বোধন করে ‘সুধী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আমাদের সংস্কৃতিতে কাউকে আনুষ্ঠানিক পরিবেশে সম্বোধনের জন্য এ ধরনের বিনম্রতাসূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়। প্রস্তাব কৃতির পরবর্তী অংশে রয়েছে তথ্য বা বিষয়ের বর্ণনা। এ অংশে দাওয়াতকারী আমন্ত্রিত অতিথিকে অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য বেশ কিছু তথ্য প্রদান করেন।
এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে দিন, তারিখ, সময় উল্লেখপূর্বক কী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে কে অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করবেন প্রভৃতি। তৃতীয় অংশে আমন্ত্রণকারী আমন্ত্রণগ্রহিতাকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ করেছেন এবং সবশেষে একাডেমিক দাওয়াতপত্রের রীতি অনুসারে
আমন্ত্রণকারী বিনীতভাবে নিজের নাম, পদবি উল্লেখ করেছেন। আমন্ত্রণপত্রের উল্লিখিত কাঠামোগত অংশসমূহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তথ্য বা বিষয়ের বর্ণনা। এ অংশটির মাধ্যমে আমন্ত্রণগ্রহিতা অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করেন।
এই দাওয়াতপত্রের লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমেও কাজ নির্দেশিত হয়েছে। কেননা এখানে আমন্ত্রণকারীর মনোগত ইচ্ছা আমন্ত্রণগ্রহিতার নিকট প্রকাশিত হয়েছে। সার্ল (Searle, 1969 ) এই মনোগত অভিপ্রায়কে নির্দেশ করেছেন “নিবেদন কৃতি’ হিসেবে।
এই দাওয়াতপত্রটির ক্ষেত্রে আমন্ত্রণকারীর মনোগত ইচ্ছা বা নিবেদন কৃতি হলো উক্ত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণগ্রহিতাকে আমন্ত্রণ জানানো। মূলত প্রস্তাব কৃতির ‘আগামী ২২ চৈত্র অধ্যাপক ড. এস.এম জাবেদ আহমেদ’ অংশটি ‘বিবৃতিমূলক নিবেদন কৃতি’ কারণ এখানে লেখক অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে পাঠককে কিছু সাধারণ তথ্য বা বিবৃতি দিয়েছেন।
পরবর্তী অংশ ‘অনুষ্ঠানে আপনার . কামনা করছি’ অংশটি ‘আদেশমূলক নিবেদন কৃতি’। এখানে অনুরোধের মাধ্যমে আমন্ত্রণকারী অতিথিকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য বলেছেন। ‘অনুরোধের মাধ্যমে আদেশমূলক নিবেদন কৃতি প্রকাশ পেয়েছে। ‘একান্ত আন্তরিকতায়’ প্রকাশমূলক নিবেদন কৃতি যেহেতু এর মাধ্যমে আমন্ত্রণকারীর মানসিক অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে।
এই দাওয়াতপত্রের আমন্ত্রণগ্রহিতা যদি আমন্ত্রণকারীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন বা কোনো কারণে অপারগতা প্রকাশ করেন তাহলে সংজ্ঞাপন কর্মটি সম্পন্ন হবে। সার্ন (Searle, 1969 ) একে বলেছেন ‘প্রতিক্রিয়া কৃতি। আমাদের সংস্কৃতিতে সাধারণত দেখা যায়, আমন্ত্রণগ্রহিতা, আমন্ত্রণকারীর অনুরোধের সাড়া প্রদান করে উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বা অপারগতা প্রকাশ করে ‘প্রতিক্রিয়া কৃতি’ বা সংজ্ঞাপন সম্পন্ন করে থাকেন।
খ. ব্রাউন ও লেভিনসনের বিনম্রতার তত্ত্ব অনুসারে একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্রের বিনম্রতা বিশ্লেষণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার কর্তৃক আয়োজিত পাণ্ডুলিপি বিষয়ক কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্রটিতে গ্রন্থাগারিক আমন্ত্রণকারী হিসেবে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই দাওয়াতপত্রে
আমন্ত্রণকারী কিছু সংখ্যক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন, যেমন- ‘সুধী’, ‘মাননীয়’, “উপস্থিতি কামনা করছি’, ‘একান্ত আন্তরিকতায়’ প্রভৃতি। আমাদের সমাজের প্রচলিত রীতি অনুসারে বিধিগত পরিবেশে কাউকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে সম্মানসূচক শব্দাবলি ব্যবহার করা হয়।
উল্লিখিত দাওয়াতপত্রে আমন্ত্রণকারী আমন্ত্রিতগ্রহিতাকে সম্বোধন করেছেন বিনম্রতাসূচক ‘সুধী’ শব্দের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে আমন্ত্রণকারীর বিনম্রতা যেমন প্রকাশ পায়, তেমনি আমন্ত্রণগ্রহিতা ও সম্মানিত বোধ করেন। পূর্বেই ব্রাউন ও লেভিনসনের তত্ত্বমতে (Brown and Levinson, 1987) ‘সুধী’ ইতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ। এর মাধ্যমে আমন্ত্রণকারীকে মনোযোগ প্রদান করা হয়েছে।
একই সাথে এই ইতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ ব্যবহারে আমন্ত্রণকারীর অভিব্যক্তি (face) বৃদ্ধি পেয়েছে। একাডেমিক দাওয়াতপত্র যে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আয়োজন করা হয় রীতি অনুসারে তার উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে তা উদ্বোধন করা হয়। পাণ্ডুলিপি বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য’ উদ্বোধন করবেন বলে উল্লেখ রয়েছে।
এ কারণে তাঁকে সম্মান জানিয়ে রীতি অনুসারে ‘উপাচার্য” এর পূর্বে “মাননীয়’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘মাননীয় নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দটি বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পদবির পূর্বে ব্যবহার করে তাঁর পদবিকে রীতি অনুসারে সম্মান জানানো হয়। ‘মাননীয়’, ‘সদয় উপস্থিতি কামনা করছি’, ‘একান্ত আন্তরিকতায়’ বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ ব্রাউন ও লেভিনসনের তত্ত্বমতে (Brown and Levinson, 1987) নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ। আমন্ত্রিত অতিথিকে উদ্দেশ্য করে আমন্ত্রণকারী দাওয়াতপত্রে এই শব্দ/বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন।
আমন্ত্রণগ্রহিতা যেন মনে না করেন যে তাকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেন নাই, এই কারণে আমন্ত্রণকারী আমন্ত্রিত অতিথিকে সম্মান জানিয়ে উপরিউক্ত নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশসমূহ ব্যবহার করেছেন। মূলত এই নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ ব্যবহারের মাধ্যমে আমন্ত্রণকারী আমন্ত্রণগ্রহিতার এবং অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির নিকট ‘অভিব্যক্তি ভীতিকারী কর্ম (অভীক) হ্রাস করেছেন (Brown and Levinson, 1987) |
গ. লিচের বিনম্রতার রীতি অনুসারে একাডেমিক নমুনা দাওয়াপত্রের বিনম্রতা বিশ্লেষণ
একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্রের বিনম্রতা বিশ্লেষণের জন্য উক্তিমালা বা ডিসকোর্স বিশ্লেষণ করে দেখা
যায়, এক্ষেত্রে ‘সুধী’, ‘মাননীয়’, ‘মহান’, ‘বিশিষ্ট’, ‘সদয় সম্মতি জ্ঞাপন’, ‘অলংকৃত করবেন’, উপস্থিতি কামনা করছি’, ‘একান্ত আন্তরিকতায়, উপস্থিতি আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করছি”, “ধন্যবাদসহ
প্রভৃতি বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ ব্যবহার করা হয়েছে।
একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আমন্ত্রণকারী আনুষ্ঠানিক পরিবেশে ‘সুধী’ বিনম্রতাসূচক শব্দটি আমন্ত্রণগ্রহিতার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন সামাজিক রীতি অনুসারে। এ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে আমন্ত্রিত অতিথির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে।
লিচের বিনম্রতার রীতি অনুসারে এটি ‘অনুমোদিত রীতি’। ‘মাননীয়’ বিনম্রতাসূচক শব্দটি দাওয়াতপত্রে আমন্ত্রণকারী অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধান অতিথি/বিশেষ অতিথিকে সম্মান জানিয়ে ব্যবহার করেছেন। ‘বিশিষ্ট’ শব্দটিও আমন্ত্রণকারী অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথির ক্ষেত্রে সম্মান জানিয়ে বিশেষণ হিসেবে প্রয়োগ করেছেন। এ কারণে
মাননীয়’, ‘বিশিষ্ট’ দুইটি বিনম্রতাসূচক শব্দই লিচের অনুমোদিত রীতি নির্দেশ করে। ‘মহান’ শব্দটি ভাষা আন্দোলনে শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাঁদের অবদানকে কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্মরণ করে একুশের পূর্বে ‘মহান’ বিনম্রতাসূচক শব্দটি আমন্ত্রণকারী দাওয়াতপত্রে ব্যবহার করেছেন, এটি অনুমোদিত রীতি। ‘
সদয় সম্মতি জ্ঞাপন’ বিনম্রতাসূচক বাক্যাংশটি আমন্ত্রণকারী অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধান/বিশেষ অতিথিকে উদ্দেশ্য করে ব্যবহার করেছেন। এটি মিতচারিতা রীতি। এ রীতির মাধ্যমে আমন্ত্রণকারী নিজেকে তুচ্ছ করে প্রধান/বিশেষ অতিথিকে সম্মান প্রদর্শন করেছেন। ‘অলংকৃত করবেন’ বাক্যাংশটিও এ অনুষ্ঠানের প্রধান/বিশেষ অতিথিকে সম্মান জানিয়ে আমন্ত্রণকারী দাওয়াতপত্রে প্রয়োগ করেছেন, তাই এটি ‘অনুমোদিত রীতি’।
‘সদয় উপস্থিতি কামনা করছি’ বাক্যাংশটি আমন্ত্রণকারী আমন্ত্রিত অতিথিকে উদ্দেশ্য করে ব্যবহার করেছেন। আমন্ত্রণকারী নিজে তুচ্ছ হয়ে বিনম্রতা প্রকাশ করেছেন অতিথির প্রতি। নিচের রীতি অনুসারে এটি “মিতচারিতা রীতি’।
‘একান্ত আন্তরিকতায়’, ‘ধন্যবাদসহ’ ‘সহানুভূতি রীতি’, কেননা এই দুইটি বিনম্রতাসূচক বাক্যাংশের মাধ্যমে আমন্ত্রণকারী ও আমন্ত্রণগ্রহিতার মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘উপস্থিতি আন্তরিকভাবে কামনা করছি বিনম্রতাসূচক বাক্যাংশটি আমন্ত্রিত অতিথিকে সম্মান জানিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জ্ঞাপন করে আমন্ত্রণকারী দাওয়াতপত্রে প্রয়োগ করেছেন। এটি লিচের বিনম্রতার রীতি অনুসারে ‘অনুমোদিত রীতি’।
আরও দেখুন: