Site icon Language Gurukul [ ভাষা গুরুকুল ] GOLN

এক রাত্রি

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় এক রাত্রি

এক রাত্রি

 

এক রাত্রি

পাঠ-পরিচিতি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ গল্পসমূহের মধ্যে ‘একরাত্রি’ বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। একটি নিটোল ও সর্বাঙ্গসুন্দর ছোটগল্পের দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘একরাত্রি’ গল্পের নামোলেখে বাঙালি সমালোচকবৃন্দ কুণ্ঠাহীন। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১২৯৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ‘সাধনা’ পত্রিকায়। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘ ছোটগল্প’ শীর্ষক রবীন্দ্র গল্পগ্রন্থে এটি প্রথম গ্রন্থিত হয়।

১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মজুমদার এজেন্সী কর্তৃক প্রকাশিত ‘গল্পগুচ্ছ: প্রথম খন্ড’ গ্রন্থেও এটি সংকলন করা হয়েছিলো। ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউজ প্রকাশিত ও পাঁচ ভাগে বিভক্ত ‘গল্পগুচ্ছে’র দ্বিতীয় ভাগে (১৯০৮) একরাত্রি’ গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে তিন খন্ডে পরিকল্পিত বিশ্বভারতী প্রকাশিত ‘গল্পগুচ্ছে’র প্রথম খন্ডেই (১৯২৬) একরাত্রি’ সংকলিত হয়েছে।

উনিশ শতকে রচিত রবীন্দ্রনাথের সব গল্পই সাধুভাষায় বিন্যস্ত। ‘একরাত্রি’ গল্পও এর ব্যতিক্রম নয়। ভাষারীতিগত অভিন্নতা সত্ত্বেও, উনিশ শতকে লেখা গল্পগুলির মধ্যে উপস্থাপনা কৌশলের স্বাতন্ত্র্যে ‘একরাত্রি’ বিশিষ্ট। এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি গল্পে ‘আমি’ বা উত্তম পুরুষের ভাষ্য ব্যবহার করেছিলেন। ‘একরাত্রি’ গল্পের অনামা নায়ক নিজের জীবনকথা নিজে উপস্থাপন করেছে।

ফলে গল্পোক্ত সকল ঘটনা ও চরিত্র তার রুচি-বিশ্বাস ও বোধ সাপেক্ষে অভিব্যক্তি পেয়েছে। স্মরণ রাখা আবশ্যক যে এ ধরনের উপস্থাপনায় গল্পোক্ত বিষয়ের সঙ্গে গল্পস্রষ্টার দূরত্ব বজায় থাকে। ‘একরাত্রি’ গল্পে আত্মভাষ্যে উপস্থাপিত হয়েছে অনামা নায়কের জীবনের ব্যর্থতার ইতিহাস।

গল্পের শেষে মহাদুর্যোগের এক বিশেষ রাত্রিকে সে যে তার জীবনে ‘অনন্তরাত্রির উদয়’ বা ‘তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা’ রূপে গ্রহণ করলো – তা যে ব্যর্থ জীবনের গানিকে ভোলার জন্য এক আত্মপ্রতারণামূলক সান্ত্বনা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ব্যর্থতার গানিকে সান্ত্বনার প্রলেপে আবৃত রেখে অনাগত ভবিষ্যৎ যাপনার বেদনাময় প্রস্তুতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে এই ব্যর্থ নায়কের জীবনমুখিতা।

মূলপাঠ

সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি, এবং বউ-বউ খেলিয়াছি। তাহাদের বাড়িতে গেলে সুরবালার মা আমাকে বড়ো যত্ন করিতেন এবং আমাদের দুইজনকে একত্র করিয়া আপনা-আপনি বলাবলি করিতেন, “আহা, দুটিতে বেশ মানায়। ” ছোটো ছিলাম, কিন্তু কথাটার অর্থ একরকম বুঝিতে পারিতাম। সুরবালার প্রতি যে সর্বসাধারণের অপেক্ষা আমার কিছু বিশেষ দাবি ছিল, সে ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল।

সেই অধিকারমদে মত্ত হইয়া তাহার প্রতি যে আমি শাসন এবং উপদ্রব না করিতাম তাহা নহে। সেও সহিষ্ণুভাবে আমার সকলরকম ফরমাশ খাটিত এবং শাস্তি বহন করিত। পাড়ায় তাহার রূপের প্রশংসা ছিল, কিন্তু বর্বর বালকের চক্ষে সে সৌন্দর্যের কোনো গৌরব ছিল না। – আমি কেবল জানিতাম, সুরবালা আমারই প্রভুত্ব স্বীকার করিবার জন্য পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, এই জন্য সে আমার বিশেষরূপ অবহেলার পাত্র।

আমার পিতা চৌধুরী-জমিদারের নায়েব ছিলেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, আমার হাতটা পাকিলেই আমাকে জমিদারি- সেরেস্তার কাজ শিখাইয়া একটা কোথাও গোমস্তাগিরিতে প্রবৃত্ত করাইয়া দিবেন। কিন্তু আমি মনে মনে তাহাতে নারাজ ছিলাম। আমাদের পাড়ার নীলরতন যেমন কলিকাতায় পালাইয়া লেখাপড়া শিখিয়া কালেক্টর সাহেবের নাজির হইয়াছে, আমারও জীবনের লক্ষ্য সেইরূপ অত্যুচ্চ ছিল- কালেক্টারের নাজির না হইতে পারি তো জজ আদালতের হেডক্লার্ক হইব, ইহা আমি মনে নিশ্চয় স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম।

সর্বদাই দেখিতাম, আমার বাপ উক্ত আদালতজীবীদিগকে অত্যন্ত সম্মান করিতেন : — নানা উপলক্ষে মাছ-তরকারিটা টাকাটা-সিকেটা লইয়া যে তাঁহাদের পূজার্চনা করিতে হইত তাহাও শিশুকাল হইতে আমার জানা ছিল; এইজন্য আদালতের ছোটো কর্মচারী এমন কি পেয়াদাগুলোকে পর্যন্ত হৃদয়ের মধ্যে খুব একটা সম্ভ্রমের আসন দিয়াছিলাম। ইহারা আমাদের বাংলাদেশের পূজ্য দেবতা; তেত্রিশ কোটির ছোটো ছোটো নূতন সংস্করণ।

বৈষয়িক সিদ্ধিলাভ সম্বন্ধে স্বয়ং সিদ্ধিদাতা গণেশ অপেক্ষা ইঁহাদের প্রতি লোকের আন্তরিক নির্ভর ঢের বেশি; সুতরাং পূর্বে গণেশের যাহা-কিছু পাওনা ছিল আজকাল ইঁহারাই তাহা সমস্ত পাইয়া থাকেন। আমিও নীলরতনের দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হইয়া এক সময় বিশেষ সুবিধাযোগে কলিকাতায় পালাইয়া গেলাম। প্রথমে গ্রামের একটি আলাপী লোকের বাসায় ছিলাম, তাহার পরে বাপের কাছ হইতেও কিছু কিছু অধ্যয়নের সাহায্য পাইতে লাগিলাম। লেখাপড়া যথানিয়মে চলিতে লাগিল ।

ইহার উপরে আবার সভাসমিতিতেও যোগ দিতাম। দেশের জন্য হঠাৎ প্রাণবিসর্জন করা যে আশু আবশ্যক, এ সম্বন্ধে আমার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু, কী করিয়া উক্ত দুঃসাধ্য কাজ করা যাইতে পারে, আমি জানিতাম না, এবং কেহ দৃষ্টান্তও দেখাইত না। কিন্তু তাহা বলিয়া উৎসাহের কোনো ত্রুটি ছিল না। আমরা পাড়াগেঁয়ে ছেলে, কলিকাতার ইঁচড়ে পাকা ছেলের মতো সকল জিনিসকেই পরিহাস করতে শিখি নাই; সুতরাং আমাদের নিষ্ঠা অত্যন্ত দৃঢ় ছিল।

আমাদের সভার কর্তৃপক্ষীয়েরা বক্তৃতা দিতেন, আর আমরা চাঁদার খাতা লইয়া না-খাইয়া দুপুর-রৌদ্রে টো-টো করিয়া বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতাম, রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া বিজ্ঞাপন বিলি করিতাম, সভাস্থলে গিয়া বেঞ্চি চৌকি সাজাইতাম, দলপতির নামে কেহ একটা কথা বলিলে কোমর বাঁধিয়া মারামারি করিতে উদ্যত হইতাম। শহরের ছেলেরা এই-সব লক্ষণ দেখিয়া আমাদিগকে বাঙাল বলিত।

নাজির-সেরেস্তাদার হইতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু মাসীনি গারিবাড়ি হইবার আয়োজন করিতে লাগিলাম । এমন সময়ে আমার পিতা এবং সুরবালার পিতা একমত হইয়া সুরবালার সহিত আমার বিবাহের জন্য উদ্‌যোগী হইলেন । আমি পনেরো বৎসর বয়সের সময় কলিকাতায় পালাইয়া আসি, তখন সুরবালার বয়স আট; এখন আমি আঠারো। পিতার মতে আমার বিবাহের বয়স ক্রমে উত্তীর্ণ হইয়া যাইতেছে।

কিন্তু এ দিকে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, আজীবন বিবাহ না করিয়া স্বদেশের জন্য মরিব – বাপকে বলিলাম, বিদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ সমাধা না করিয়া বিবাহ করিব না। দুই-চারি মাসের মধ্যে খবর পাইলাম, উকিল রামলোচনবাবুর সহিত সুরবালার বিবাহ হইয়া গিয়াছে। পতিত ভারতের চাঁদা আদায়কার্যে ব্যস্ত ছিলাম, এ সংবাদ অত্যন্ত তুচ্ছ বোধ হইল । এন্ট্রেন্স পাস করিয়াছি, ফার্স্ট আর্টস্ দিব, এমন সময় পিতার মৃত্যু হইল।

সংসারে কেবল আমি একা নই; মাতা এবং দুটি ভগিনী আছেন। সুতরাং কলেজ ছাড়িয়া কাজের সন্ধানে ফিরিতে হইল। বহু চেষ্টায় নওয়াখালি বিভাগের একটি ছোটো শহরে এন্ট্রেন্স স্কুলের সেকেন্ড মাষ্টারি পদ প্রাপ্ত হইলাম । মনে করিলাম, আমার উপযুক্ত কাজ পাইয়াছি। উপদেশ এবং উৎসাহ দিয়া এক-একটি ছাত্রকে ভাবী ভারতের এক- একটি সেনাপতি করিয়া তুলিব । কাজ আরম্ভ করিয়া দিলাম।

দেখিলাম, ভাবী ভারতবর্ষ অপেক্ষা আসন্ন এগ্‌জামিনের তাড়া ঢের বেশি। ছাত্রদিগকে গ্রামার অ্যালজেব্রার বহির্ভূত কোনো কথা বলিলে হেডমাস্টার রাগ করে। মাস দুয়েকের মধ্যে আমারও উৎসাহ নিস্তেজ হইয়া আসিল।

আমাদের মতো প্রতিভাহীন লোক ঘরে বসিয়া নানারূপ কল্পনা করে, অবশেষে কার্যক্ষেত্রে নামিয়া ঘাড়ে লাঙল বহিয়া পশ্চাৎ হইতে লেজ-মলা খাইয়া নতশিরে সহিষ্ণুভাবে প্রাত্যহিক মাটি ভাঙার কাজ করিয়া সন্ধ্যাবেলায় এক-পেট জানা খাইতে পাইলেই সন্তুষ্ট থাকে; লক্ষে ঝক্ষে আর উৎসাহ থাকে না। অগ্নিদাহের আশঙ্কায় একজন করিয়া মাস্টার স্কুলের ঘরেতেই বাস করিত।

আমি একা মানুষ, আমার উপরেই সেই ভার পড়িয়াছিল। স্কুলের বড়ো আটচালার সংলগ্ন একটি চালায় আমি বাস করিতাম। স্কুলঘরটি লোকালয় হইতে কিছু দূরে একটি বড়ো পুষ্করিণীর ধারে। চারি দিকে সুপারি নারিকেল এবং এক রাত্রি মাদারের গাছ, এবং স্কুলগৃহের প্রায় গায়েই দুটা প্রকাণ্ড বৃদ্ধ নিম গাছ গায়ে গায়ে সংলগ্ন হইয়া ছায়া দান করিতেছে। একটা কথা এতদিন উল্লেখ করি নাই এবং এতদিন উল্লেখযোগ্য বলিয়া মনে হয় নাই।

এখানকার সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের বাসা আমাদের স্কুলঘরের অনতিদূরে। এবং তাঁহার সঙ্গে তাঁহার স্ত্রী- – আমার বাল্যসখী সুরবালা ছিল, তাহা আমার জানা ছিল। রামলোচন বাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হইল। সুরবালার সহিত বাল্যকালে আমার জানাশোনা ছিল তাহা রামলোচনবাবু জানিতেন কি না জানি না, আমিও নূতন পরিচয়ে সে সম্বন্ধে কোনো কথা বলা সংগত বোধ করিলাম না।

এবং সুরবালা যে কোনো কালে আমার জীবনের সঙ্গে কোনো রূপে জড়িত ছিল, সে কথা আমার ভালো করিয়া মনে উদয় হইল না।
একদিন ছুটির দিনে রামলোচনবাবুর বাসায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছি। মনে নাই কী বিষয়ে আলোচনা হইতেছিল, বোধ করি বর্তমান ভারতবর্ষের দুরবস্থা সম্বন্ধে। তিনি যে সেজন্য বিশেষ চিন্তিত এবং ম্রিয়মাণ ছিলেন তাহা নহে, কিন্তু বিষয়টা এমন যে তামাক টানিতে টানিতে এ সম্বন্ধে ঘণ্টাখানেক -দেড়েক অনর্গল শখের দুঃখ করা যাইতে পারে।

এমন সময়ে পাশের ঘরে অত্যন্ত মৃদু একটু চুড়ির টুংটাং, কাপড়ের একটুখানি খখস্ এবং পায়েরও একটুখানি শব্দ শুনিতে পাইলাম; বেশ বুঝিতে পারিলাম, জানালার ফাঁক দিয়া কোনো কৌতূহলপূর্ণ নেত্র আমাকে নিরীক্ষণ করিতেছে। তৎক্ষণাৎ দুখানি চোখ মনে পড়িয়া গেল বিশ্বাস সরলতা এবং শৈশব-প্রীতিতে ঢলঢল দুখানি বড়ো বড়ো চোখ কালো কালো তারা, ঘনকৃষ্ণ পলব, স্থিরশিদ্ধ দৃষ্টি। সহসা হৃৎপিন্ডকে কে যেন একটা কঠিন মুষ্টিরমারা চাপিয়া ধরিল এবং বেদনায় ভিতরটা টনটন করিয়া উঠিল।

বাসায় ফিরিয়া আসিলাম, কিন্তু সেই ব্যথা লাগিয়া রহিল। লিখি পড়ি, যাহা করি, কিছুতেই মনের ভার দূর হয় না; মনটা সহসা একটা বৃহৎ বোঝার মতো হইয়া বুকের শিরা ধরিয়া দুলিতে লাগিল । সন্ধ্যাবেলায় একটু স্থির হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, এমনটা হইল কেন। মনের মধ্য হইতে উত্তর আসিল, তোর সে সুরবালা কোথায় গেল । আমি প্রত্যুত্তরে বলিলাম, আমি তো তাহাকে ইচ্ছা করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছি। সে কি চিরকাল আমার জন্য বসিয়া থাকিবে।

মনের ভিতরে কে বলিল, তখন যাহাকে ইচ্ছা করিলেই পাইতে পারিতে এখন মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাহাকে একবার চক্ষে দেখিবার অধিকারটুকুও পাইবে না। সেই শৈশবের সুরবালা তোমার যত কাছেই থাকুক, এক রাত্রি তাহার চুড়ির শব্দ শুনিতে পাও, তাহার মাথাঘষার গন্ধ অনুভব কর, কিন্তু মাঝখানে বরাবর একখানি করিয়া দেয়াল থাকিবে। আমি বলিলাম, তা থাক্ -না, সুরবালা আমার কে । উত্তর শুনিলাম, সুরবালা আজ তোমার কেহই নয়, কিন্তু সুরবালা তোমার কী না হইতে পারিত।

এ কথা সত্য। সুরবালা আমার কী না হইতে পারিত। আমার সব চেয়ে অন্তরঙ্গ, আমার সব চেয়ে নিকটবর্তী, আমার জীবনের সমস্ত সুখ দুঃখভাগিনী হইতে পারিত – সে আজ এত দূর, এত পর, আজ তাহাকে দেখা নিষেধ, তাহার সঙ্গে কথা কওয়া দোষ, তাহার বিষয়ে চিন্তা করা পাপ। আর, একটা রামলোচন, কোথাও কিছু নাই হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত, কেবল গোটা-দুয়েক মুখস্থ মন্ত্র পড়িয়া সুরবালাকে পৃথিবীর আর সকলের নিকট হইতে এক মুহূর্তে ছোঁ মারিয়া লাইয়া গেল !

আমি মানবসমাজে নূতন নীতি প্রচার করিতে বসি নাই, সমাজ ভাঙিতে আসি নাই, বন্ধন ছিঁড়িতে চাই না। আমি আমার মনের প্রকৃত ভাবটা ব্যক্ত করিতেছি মাত্র। আপন-মনে যে-সকল ভাব উদয় হয় তাহার কি সবই বিবেচনাসংগত। রামলোচনের গৃহভিত্তির আড়ালে যে সুরবালা বিরাজ এক রাত্রি  করিতেছিল সে যে রামলোচনের অপেক্ষাও বেশি করিয়া আমার, কথা আমি কিছুতেই মন হইতে তাড়াইতে পারিতেছিলাম না। এরূপ চিন্তা নিতান্ত অসংগত এবং অন্যায় তাহা স্বীকার করি, কিন্তু অস্বাভাবিক নহে।

এখন হইতে আর কোনো কাজে মনঃসংযোগ করিতে পারি না। দুপুরবেলায় ক্লাসে যখন ছাত্রেরা গুনগুন করিতে থাকিত, বাহিরে সমস্ত ঝাঁ-ঝাঁ করিত, ঈষৎ উত্তপ্ত বাতাসে নিম গাছের পুষ্পমঞ্জরির সুগন্ধ বহন করিয়া আনিত, তখন ইচ্ছা করিত – কী ইচ্ছা করিত জানি না – – এই পর্যন্ত বলিতে পারি, ভারতবর্ষের এই-সমস্ত ভাবী আশাস্পদ-দিগের ব্যাকরণের ভ্রম – সংশোধন করিয়া জীবনযাপন করিতে ইচ্ছা করিত না।

স্কুলের ছুটি হইয়া গেলে আমার বৃহৎ ঘরে একলা থাকিতে মন টিকিত না, অথচ কোনো ভদ্রলোক দেখা করিতে আসিলেও অসহ্য বোধ হইত। সন্ধ্যাবেলায় পুষ্করিণীর ধারে সুপারি-নারিকেলের অর্থহীন মর্মরধ্বনি শুনিতে শুনিতে ভাবিতাম, মনুষ্যসমাজ একটা জটিল ভ্রমের জাল। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করিতে কাহারও মনে পড়ে না, তাহার পরে বেঠিক সময়ে বেঠিক বাসনা লইয়া অস্থির হইয়া মরে।

 

 

টীকা

সিদ্ধিদাতা – গণেশ শিব ও দুর্গার জ্যেষ্ঠপুত্র। অভীষ্ট পূরণ করেন বলে ভারতীয় পুরাণে ইনি সিদ্ধিদাতা অভিধায় পরিচিত।

বাঙাল –  পূর্ববঙ্গবাসী। বিদ্রূপার্থে গ্রাম্য লোক ।

মাটসীনি – জুসেপ্পে মাসিনি (১৮০৫-৭২)। ইতালির বরেণ্য জননেতা। ইতালির জেনোয়া শহরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। প্রথম জীবনে ‘কারবোনারি’ নামের একটি গুপ্ত রাজনৈতিক সমিতির সদস্য ছিলেন। পরে ইতালীয়দের রাজনৈতিক মুক্তি ও সামজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠন করেন ‘তরুণ ইতালি’ নামের জগদ্বিখ্যাত দল। প্রজাতান্ত্রিক ইতালি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মাসিনিকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে নির্বাসন কাটাতে হয়।

১৮৪৯ সনে রোমে তাঁর নেতৃত্বে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও দ্রুত ঐ প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে। মাৎসিনির রাজনৈতিক আদর্শ সমগ্র ইউরোপের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করলেও ইতালিতে তাঁর মতাদর্শের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে জুসেপ্পে গারিবালডি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।

গারিবালডি – জুসেপ্পে গারিবালডি (১৮০৭-৮২)। মাৎসিনির মতাদর্শের অনুসারী জুসেপ্পে গারিবালডি ছিলেন ইতালির দেশপ্রেমিক নেতা ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা। সালেনিস-এর এক ধীবর পরিবারের সন্তান গারিবালডি ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে মাৎসিনির ‘তরুণ ইতালি দলের সদস্য হন। রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে তিনিও দেশ থেকে নির্বাসিত হন এবং ইউরোপের ফ্রান্স ও দক্ষিণ আমেরিকার উরুগুয়েতে বসবাস করেন।

১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মাৎসিনির নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এর পর তাকে পলাতক জীবন বেছে নিতে হয়। ১৮৫৯ সনের বিপবের প্রাক্কালে তিনি আবার প্রকাশ্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং সিসিলির স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘লালকুর্তা’ (Red Shirts) এক রাত্রি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে অংশ নেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সিসিলি স্বাধীন হলে তিনি নেপলসে চলে আসেন এবং রাজা দ্বিতীয় ফ্রান্সিসকে বিতাড়িত করে নেপল্স অধিকার করেন।

গারিবালডির স্বপ্ন ছিলো পোপকে পরাজিত করে রোমের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা। দুবার তিনি এককভাবে রোম জয়ের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তবে তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘ইতালিয়দের ইতালি’ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে আধুনিক প্রজাতান্ত্রিক ইতালির অন্যতম স্বপ্ন দ্রষ্টা গারিবালডির স্বপ্ন সফল হয়।

পতিত ভারত – উপনিবেশ-শৃঙ্খলিত ভারত; পরাধীন ভারত।

এনট্রেন্স – প্রবেশিকা পরীক্ষা; ব্রিটিশ ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা। নওয়াখালি বিভাগ অবিভক্ত বাংলার একটি প্রশাসনিক বিভাগ। ‘হঠাৎ বানের ডাক শোনা গেল – সমুদ্র ছুটিয়া আসিতেছে।’ গল্পের শেষাংশের স্থানিক পটভূমি নওয়াখালি বিভাগের একটি পাড়া গাঁ। নওয়াখালি বিভাগ বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চল। এখানে বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছ্বাসকে বোঝানো হয়েছে।

বস্তুসংক্ষেপ

গল্পের কথক অনামা-নায়ক পূর্ববাংলার পাড়াগাঁয়ের ছেলে। তার শৈশবের খেলার সঙ্গী ছিলো সুরবালা। দুজনে একত্রে পাঠশালায় গিয়েছে, কখনো ‘বউ বউ’ খেলা করেছে। উভয়পক্ষের অভিভাবকরাও এ দুজনের শৈশবলীলার মধ্যে ভাবীকালের মধুময় পরিণতির সম্ভাব্যতা সঙ্গোপনে লালন করেছেন। বয়স বেশি না হলেও অভিভাবকদের আলাপচারিতা ও মন্তব্যের অর্থ অনুধাবনের সামর্থ্য ছিলো গত্মকথকের।

সম্ভবত এ কারণেই সর্বসাধারণের অপেক্ষা সুরবালার প্রতি তার দাবি ও অধিকার যে সুনির্ধারিত এমন একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিলো মনে। ফলে যথেচ্ছ শাসন ও উপদ্রব সুরবালার ওপর আরোপ করতে সে ছিলো অকুণ্ঠিত। তার ধারণা ছিলো তার প্রভুত্ব স্বীকার করবার জন্যই পিতৃগৃহে সুরবালার জন্ম হয়েছে। নায়কের পিতা ছিলেন চৌধুরী জমিদারের নায়েব। তাঁর ইচ্ছা ছিলো ছেলেকেও তিনি জমিদারি সেরেস্তায় বসিয়ে গোমস্তাগিরিতে ঢুকিয়ে দেবেন।

কিন্তু উচ্চাকাঙ্খী নায়কের এতে সায় ছিলো না। গ্রামেরই এক যুবক নীলরতন যেভাবে ভাগ্যান্বেষণে গ্রাম-পালিয়ে ক্রমে কালেক্টর সাহেবের নাজির হয়েছে, সেরকমই, না হয় অন্তত জজ আদালতের হেডকেরানি হওয়ার স্বপ্ন ছিলো তার। ফলে নীলরতনের দৃষ্টান্ত শিরোধার্য করে একদিন পালিযে গেলো সে কলকাতায়। কলকাতায় পালিয়ে আসার সময়ে সুরবালার বয়স ছিলো আট, আর তার পনেরো।

অনামা এই নায়ক কলকাতায় এসেছিলো নাজির সেরেস্তাদার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু রাজনৈতিক জগতের সংস্পর্শে এসে মাসীনি-গারবালড়ি হওয়ার আয়োজনে বিভোর হয়ে উঠলো সে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশিষ্ট হয়ে পরাধীন ভারতের উদ্ধার কর্মে আত্মনিয়োগ করলো।

এ-সময়ে গ্রামে সুরবালা ও তার পিতা একমত হয়ে দুজনের বিবাহের জন্য উদ্যোগী হলেন, এ-সংবাদ যখন নায়কের কাছে এলো – তখন নায়কটি দেশোদ্ধারের মন্ত্রে পূর্ণরূপে উজ্জীবিত, আজীবন বিয়ে না করে দেশের জন্য প্রাণোৎসর্গের প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ফলে পিতাকে সে নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিলো যে বিদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ না করে সে বিয়ে করবে না। ইতোমধ্যে উকিল রামলোচন বাবুর সঙ্গে বিয়ে সুসম্পন্ন হয়ে গেলো সুরবালার।

এ সংবাদ পরে যখন নায়কের কাছে পৌঁছালো তখন সে ‘পতিত ভারতের চাঁদা আদায়কার্যে ব্যস্ত’, ফলে এ সংবাদ নিতান্ত তুচ্ছ বলেই তার কাছে মনে হলো। কিন্তু অচিরেই রূঢ় জীবন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হলো নায়কটিকে। পূর্বেই এনট্রেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলো সে। কিন্তু ফাস্ট আর্টস্ পরীক্ষার প্রাক্কালে অকালে পিতৃবিয়োগ ঘটল তার। বিধবা মা আর অনূঢ়া বোনের দায়িত্ব বর্তালো তার উপর।

বাধ্য হয়ে কলেজ পরিত্যাগ করে কাজের সন্ধানে বেরুতে হলো তাকে। অনেক চেষ্টায় চাকুরি জুটল নওয়াখালি বিভাগের একটি ছোট শহরের এনট্রেন্স স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারির পদে । নায়কের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিলো স্কুলের আটচালা ঘরের একটি চালায়। আর স্কুল ঘরটির অনতিদূরেই ছিলো সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের বাসা। নায়কের জানা ছিলো যে, রামলোচনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, অতিপরিচিত বাল্যসঙ্গিনী সুরবালাও অবস্থান করে।

ক্রমে রামলোচন বাবুর সঙ্গে আলাপও হলো তার। কিন্তু সুরবালার সঙ্গে নিজের পূর্বপরিচয়ের কথা উত্থাপন করা অসঙ্গত বিবেচনা করে রামলোচন বাবুর কাছে ঐ বিষয়ে নীরব রইলো সে। এমন একটি আত্মপ্রতারণামূলক উপলব্ধিতে উপনীত হলো সে যেন তার জীবনের সঙ্গে সুরবালা কখনোই জড়িত ছিলো না, সুরবালার কথা যেন তার স্মৃতিপটে ভালো করে উদয়ই হয় না ।

একদিন রামলোচন বাবুর বাসায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায় গত্মকথক এই নায়ক। বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে পাশের ঘরে চুড়ির মৃদু টুংটাং শব্দ, ‘কাপড়ের একটুখানি খসখস’ ধ্বনি ও একটুখানি পদশব্দ নায়কের অন্তর্জগতে আলোড়ন তোলে। সে অনুভব করে জানালার ফাঁক দিয়ে কোনো কৌতূহলপূর্ণ চোখ তাকে নিরীক্ষণ করছে।

সাথে সাথেই নায়কের স্মৃতিপটে জেগে ওঠে ‘বিশ্বাস সরলতা এবং শৈশব প্রীতিতে ঢলঢল দুখানি বড় চোখ, কালো কালো তারা, ঘনকৃষ্ণ পলব, স্থিরসিদ্ধ দৃষ্টি। রোম্যানটিক বেদনায় আপুত হয়ে ওঠে সে। বাসায় ফিরে এসেও অচরিতার্থতাজাত এক ধরনের বিষণ্ণতা আকড়ে থাকে তাকে। তার মনে হয়, যে সুরবালাকে সে একদিন ইচ্ছে করলেই পেতে পারতো। এখন মাথা খুঁড়ে মরলেও এক বার চোখে দেখার অধিকারটুকুও সে পাবে না।

শৈশবের খেলার সঙ্গিনী সুরবালা তার যত কাছেই থাকুক মধ্যখানে স্থিত একটি বৃহৎ দেয়াল দুজনের অনতিক্রম্য দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। আত্মসান্ত্বনার বশবর্তী হয়ে নায়ক ভাবে সুরবালা তার কে! কিন্তু পরক্ষণেই মনস্তাপদীর্ণ বেদনায় সে উপলব্ধি করে যে, সুরবালা আজ তার কেউ নয় সত্য, কিন্তু সুরবালা তার এই ছিন্নভিন্ন জীবনে কী না হতে পারত!

 

 

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের উত্তর লিখুন

১. শৈশবে সুরবালা প্রসঙ্গে অনামা নায়কের ধারণা ব্যাখ্যা করুন।

২. কোন্ উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে একরাত্রি গল্পের নায়ক কলকাতায় পাড়ি জমিয়েছিল?

৩. ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়কের কলকাতার রাজনীতি-সংশিষ্ট জীবনের পরিচয় দিন।

৪. উকিল রামলোচন প্রসঙ্গে গত্মকথকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিন।

৫. সুরবালার বিবাহিত জীবন কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল নায়কের মনে?

৬. জীবনের কোন্ রূঢ় বাস্তবতার শিকার হয়ে ‘একরাত্রি’র নায়ককে এক ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারির পদ গ্রহণ করতে হয়েছিল?

আরও দেখুন :

 

Exit mobile version