আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় কবিতা অলঙ্কার ছন্দ
কবিতা অলঙ্কার ছন্দ
কবিতা অলঙ্কার ছন্দ
কবিতা
কবিতা নিয়ে কথা বলা যতো সহজ এর সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করা ততোটা সহজ কাজ নয়। কবিতা পছন্দ করেনা পৃথিবীতে এরকম লোকের সংখ্যা খুবই কম। কবিতা সম্পর্কে যতো আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে, সাহিত্যের অন্য কোন রূপ সম্পর্কে তা হয়নি। প্রত্যেক সচেতন সংবেদনশীল মানুষের মধ্যেই কবিতার প্রতি আকর্ষণ রয়েছে। মানুষের বিস্ময়, স্মৃতি, স্বপ্ন, কল্পনার এক অপরূপ মিশ্রণে কবিতার সৃষ্টি।
ব্যক্তির অনুভূতি, আবেগ, রহস্যানুভূতি প্রতিফলন ঘটায় প্রতিটি যথার্থ কবিতাই এক স্বতন্ত্র সৃষ্টি । যথার্থ বলার কারণ, অনেক অনুকারী কবিতা আছে যেখানে মৌলিক অনুভবের পরিবর্তে অন্য কোন কবির অনুভূতি, আবেগ ও সৃষ্টিশীল কল্পনার প্রতিধ্বনিই মুখ্য হয়ে ওঠে।
উপরের আলোচনা থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, কবিতার সংজ্ঞার্থ নির্ণয় সহজ কাজ নয়। তবুও সাহিত্যের প্রতিটি শাখারই একটি মৌলিক মানদন্ড আছে।
সে মানদন্ড বিচার করে কবিতা সম্পর্কেও একটা মোটামুটি ধারণা অর্জন করা যেতে পারে। বিশেষ অনুভূতি প্রকাশের জন্য শব্দগুচ্ছের তাৎপর্যময় বিন্যাস থেকে কবিতার সৃষ্টি। কিন্তু এ-ধারণাও পূর্ণাঙ্গ নয়। আরো সুস্পষ্ট করে বলা যায় আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন, কল্পনা প্রভৃতি ব্যক্তিমানসের সাধারণ প্রবণতার অংশ; এগুলোর সঙ্গে যখন সৃষ্টিশীলতা যুক্ত হয়, অনিবার্য শব্দের তাৎপর্যময় বিন্যাস তাকে করে তোলে ব্যঞ্জনাময়। তখনই একটি কবিতার জন্ম সম্ভব হয়।
এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি কবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের বিশেষণ থেকে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেষ্টা করতে পারি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বঙ্গভাষা’ কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে মাতৃভাষাপ্রেম ও গভীর দেশাত্মবোধ। কবি সনেটের আঙ্গিকে নিজের জীবনেতিহাস পর্যালোচনা ও আত্মবিশেষণ থেকে মাতৃভাষার টানে স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়েছেন।
চৌদ্দ মাত্রার চৌদ্দ চরণের সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনিবার্য কিছু শব্দের বিন্যাসের মাধ্যমে কবি নিজ অনুভূতি, আবেগ, স্মৃতি, স্বপ্ন ও বাস্তব প্রাপ্তির পরিপূর্ণ ছবি তুলে ধরেছেন এই কবিতায়। ‘বলাকা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আবেগের বেগকে সৃষ্টিজগতের অন্তর্নিহিত অবিরাম গতির ছন্দে অনুভব করেছেন। এ-কবিতায় শব্দ ব্যবহার ও ছন্দ-পরিকল্পনা কবির অনুভূত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাতায়ন পাশে গুবাক-তরুর সারি’ কবিতায় প্রেমচেতনা ও প্রকৃতিচেতনার অনুপম মেলবন্ধন ঘটেছে। ‘বনলতা সেন’ সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের বহুল পঠিত কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্যক্তিপ্রেম কিংবা দেশপ্রেম যাই-ই ব্যক্ত হোকনা কেন, হাজার বছরের পথচলার ক্লান্ত পরিব্রাজক যখন উচ্চারণ করে বলেছে সে, “এতদিন কোথায় ছিলেন? / পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”
তখন দেশকালের সীমা লুপ্ত হয়ে মানুষের চিরকাঙ্ক্ষিত শুশ্রূষার মমতাসিদ্ধ নারীর মাতৃমূর্তিই প্রধান হয়ে ওঠে। হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’ ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত কবিতা। এ-কবিতায় মাতৃভাষাপ্রেম ও দেশপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শোষণের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং সংগ্রামের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। পাঁচটি কবিতার বিষয়বস্তুর মতো আঙ্গিকরীতিও স্বতন্ত্র। শব্দচয়ন ও ব্যবহারে প্রত্যেক কবির রুচি আলাদা।
কিন্তু প্রতিটি কবিতাই আমাদের মধ্যে স্থায়ী আবেদন সৃষ্টিতে সক্ষম। সুতরাং সাধারণভাবে বলা যায়, কবির স্বতস্ফূর্ত অনুভূতি শব্দ ও ছন্দের অনিবার্য বিন্যাসে জীবনের অন্তর্ময় এবং স্থায়ী আবেদন সৃষ্টির উপযোগী যে শব্দসৌধ সৃষ্টি করে তাই-ই কবিতা ৷
কবিতার শ্রেণীকরণ
প্রতিটি সাহিত্য আঙ্গিকেরই উপাদান মানুষের জীবন, পারিপার্শ্বিক সমাজ অর্থাৎ মানুষের চিন্তা ও কর্মের সঙ্গে সংশিষ্ট সকল প্রসঙ্গ। জীবনকে দেখার এবং উপস্থাপন করার বৈশিষ্ট্যই সাহিত্যের প্রতিটি আঙ্গিককে স্বতন্ত্র করে দেয়। আবার এইসব সাহিত্যরূপের মধ্যে বিষয়বস্তু, আঙ্গিকবিন্যাস ও ভাষারীতির কারণে শ্রেণীকরণ অনিবার্য হয়ে পড়ে। কবিতার আঙ্গিক-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে হলে, তার বিভিন্ন শ্রেণীর স্বতন্ত্র-গঠনরীতি, ভাষাবিন্যাস, ছন্দরীতি প্রভৃতি বিষয়ে জানতে হবে।
কাব্যনাট্য
আদিযুগে কাব্যভাষাই ছিলো সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন। ফলে, নাটকের প্রাথমিক রূপ কাব্যনাটকেও কবিতার ভাষা ও ছন্দরীতি অনুসৃত হতো। গ্রীক বা রোমান সাহিত্যের স্বর্ণযুগে নাটককে বলা হতো জীবনের অনুকরণ, ঘনিষ্ট প্রতিফলন। এলিজাবেথান যুগের কালজয়ী নাট্যকার শেক্সপীয়রের নাটকগুলো জীবনের বহুমুখী বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করলেও কবিতার রূপরীতিই ছিলো তাঁর প্রধান অবলম্বন।
সাধারণ দর্শক-শ্রোতার নিকট গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য নাট্যসংলাপের ভাষাকে লৌকিক ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসেন নাট্যকাররা। মৌখিক ভাষার স্পন্দন নাটকের কাব্যগুণকে কিছুটা খন্ডিত করলেও পরবর্তীকালে নাটকে গদ্যভাষার প্রয়োগ অনিবার্য করে তোলে। কিন্তু কাব্যনাট্যের ধারা সাহিত্যের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়নি।
উনিশ শতকে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু কাব্যনাটকের রূপরীতি, ভাষা ও ছন্দকে মানুষের পরিবর্তনশীল সাহিত্যরুচির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে প্রভৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে সৈয়দ শামসুল হক কাব্যনাটক রচনার ক্ষেত্রে গভীর নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও শিল্পসাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন।
মহাকাব্য দুই প্রকার:
জাত মহাকাব্য (Epic of Growth):
এতে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের যূথবদ্ধ জীবনপ্রণালী, মানব-মানবীর আচার- আচরণ-বিশ্বাস, প্রেম-সংগ্রাম বিন্যস্ত হয়। নির্দিষ্ট সময়খন্ডের পরিবর্তে একটি সমাজের অতীত বর্তমানের দীর্ঘ সময়-সীমা জাত মহাকাব্যে অনুসৃত হয়। ব্যক্তিবিশেষ রচনা করলেও জাত মহাকাব্যে সামাজিক ঘটনা-পরিক্রমা ও জীবনের সমাগ্রিক রূপায়ণ ঘটে। বাল্মীকি রচিত ‘রামায়ণ’ ও কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত ‘মহাভারতের ঘটনা, বিষয়বস্তু ও চরিত্রের বৈচিত্র্য ভারতবর্ষের অদিকালের গোটা সমাজ ব্যবস্থাকেই উন্মোচন করেছে।
হোমার রচিত ইলিয়ড ও ওডেসি প্রাচীন গ্রীসের যৌথ সমাজব্যবস্থার মহাকাব্যিক রূপ। ইলিয়ড-এ ট্রয়যুদ্ধের শেষ পর্যায়ের কাহিনী অবলম্বিত হলেও দশ বছর ব্যাপ্ত যুদ্ধের সমগ্র ছবিই কবির গ্রন্থণ-নৈপুণ্যে এতে বিধৃত হয়েছে। ওডেসিতে ট্রয় যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইথাকা রাজ্যের জনজীবন, নায়ক ওডেসিয়ুসের অবিশ্বাস্য ভ্রমণ ও সংগ্রাম এবং পেনিলোপির বিড়ম্বিত-ভাগ্য জীবন। হোমার ঘটনাভারাক্রান্ত মহাকাব্যে চরিত্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সাহিত্যিক মহাকাব্য (Literary epic):
এ জাতীয় মহাকাব্য পৌরাণিক ঘটনা কিংবা কোন জাত মহাকাব্যের ঘটনাসূত্র অবলম্বনে কবির যুগমানস, সমাজমানস ও দৃষ্টিভঙ্গির সমবায়ে এক আধুনিক সৃষ্টি। এই শ্রেণীর মহাকাব্যের মধ্যে ভার্জিলের ‘ঈনিদ’ (Eneid) তাসোর ‘জেরুজালেম ডেলিভার্ড (Jerusalum Delivered ), দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ (Divine Commiedia), জন মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ (Paradise Last) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য উল্লেখযোগ্য। পুরাতনের আশ্রয়ে নতুন যুগের জীবনসত্য প্রতিটি সাহিত্যিক মহাকাব্যেরই বিষয়বস্তু।
গীতিকবিতা
ব্যক্তি-অনুভূতির স্বত:স্ফূর্ত প্রকাশ গীতিকবিতার প্রধান লক্ষণ। সাবলীলতা ও সহজতায় এই কাব্য-আঙ্গিক সর্বাপেক্ষা বৈচিত্র্যময় ও প্রভাবশালী। প্রাচীন গ্রীসে বীণাযন্ত্র সহযোগে যে সঙ্গীত পরিবেশিত হতো, তাকে বলা হতো Lyric । এ থেকে বোঝা যাচ্ছে Lyric বা গীতিকবিতার সঙ্গে সঙ্গীত ধর্মের সম্পর্ক সুনিবিড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা একই সঙ্গে কবিতা ও গান। তবুও মনে রাখতে হবে সঙ্গীত অপেক্ষা গীতিকবিতার ক্ষেত্র বহুবিচিত্র।
মানবীয় অনুভূতির বহুমুখী সত্য গীতিকবিতায় রূপ পায়। সঙ্গীতে থাকে সুরের প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ, আর গীতিকবিতায় কথা ও সুরের সমন্বয়। ফলে, , সঙ্গীত অপেক্ষা গীতিকবিতার ক্ষেত্র বহুগুণে বিস্তৃত। ব্যক্তি অনুভূতির সূক্ষ্মতর প্রকাশ অনিবার্য শব্দ, ধ্বনি এবং ছন্দোবিন্যাসে গীতিকবিতায় রূপ পায় বলে আদিকাল থেকেই কবিতার এই রীতি সর্বাধিক চর্চিত সাহিত্যধারা।
এ-প্রসঙ্গে মহাকাব্যের সঙ্গে গীতিকবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকগত পার্থক্যের স্বরূপ নির্দেশ করা প্রয়োজন। মহাকাব্যের বিষয় আঙ্গিক ও পূর্বনিরূপিত আর গীতিকবিতার বিষয়, রীতি ও সময়, সমাজ ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মহাকাব্য বস্তুনিষ্ঠ (Objective) আর গীতিকবিতা ভাবনিষ্ঠ (Subjective) কবিতা ।
বাংলাদেশের কবিতা
বাংলাদেশের কবিতায় স্বতন্ত্র ভিত্তি রচিত হয় চলিশের দশকে। সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্র ধারার সঙ্গে শিল্পদৃষ্টির নতুনত্ব এ-সময়ের কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে। এ-সময়ে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-১৯৭৬), আবুল হোসেন (১৯২১-), সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
আবুল হোসেনের ‘নববসন্ত’ (১৯৪০), ফররুখ আহমদের ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৫), সৈয়দ আলী আহসানের ‘চাহার দরবেশ (১৯৪৫), আহসান হাবীরের ‘রাত্রিশেষ’ (১৯৪৭) কাব্যে উপকরণ, জীবনজিজ্ঞাসা ও শিল্পরীতির স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়। পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্প-ভাবনায় যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়।
এ-সময়ের কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুলাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গনি হাজারী, আজীজুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী উলেখযোগ্য। ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে নবোদ্ভূত মধ্যবিত্তের জীবনচেতনার রূপায়ণে এ-পর্যায়ের কবিতা এক নতুন মাত্রা যোগ করে ।
ষাটের দশকে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, মাহবুব সাদিক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। পাশ্চাত্য কবিতার ধ্যানধারণার সঙ্গে ব্যক্তিমানসের নিভৃতচারিতা ও রাজনীতি সচেতনতা এঁদের কবিতার স্বভাবধর্ম।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এ-সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ কবির আবির্ভাবে বাংলাদেশের কবিতায় নতুন প্রাণবন্যা সূচিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কবিতা যাঁদের সাধনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আবিদ আজাদ, সানাউল হক খান, সাজ্জাদ কাদির, সিকদার আমিনুল হক, আল মুজাহিদী, মাহবুব হাসান, হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুলাহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
অলঙ্কার
কবিতার প্রকরণ বা শিল্পরূপ অনুধাবনের জন্য অলঙ্কার, চিত্রকলা বা Image, ছন্দ এবং ছন্দস্পন্দ সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। অলঙ্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ [অলম্-কৃ (করা) + ঘঞ ণ] আভরণ বা ভূষণ। অর্থাৎ যে-সকল উপাদান কবিতার অবয়বকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে সাধারণ অর্থে তাই অলঙ্কার। কিন্তু কবিতা এমন একটি শিল্পমাধ্যম, যেখানে অলঙ্কার বহিরঙ্গ উপাদান হিসেবে গৃহীত হয়নি, অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
অনুভূতি বা চেতনা প্রকাশের প্রয়োজনে কবি প্রথমে অনিবার্য কিছু শব্দ নির্বাচন করেন। অতঃপর চেতনা ও শব্দের এমন একটি মেলবন্ধন ঘটান যেখানে একটি থেকে আরেকটিকে বিচ্ছিন্ন করলে কবিতারই অপমৃত্যু হয়। প্রাচীন গ্রীসে অলঙ্কার-শাস্ত্রে র উদ্ভব হয়। ঐ সময়ে গ্রীক মনীষীরা কাব্যতত্ত্বেরও উদ্ভাবন করেন। এ দুয়ের মধ্যে তাঁরা সুস্পষ্ট পার্থক্যও নির্ধারণ করেছিলেন।
অলঙ্কার বা Rhetoric-এর লক্ষ্য ছিলো কাব্যের বাগ্মিজ্জা ও রচনার গুণাগুণ নির্দেশ করা আর কাব্যতত্ত্ব বা Poetics-এর বিচার্য ছিলো বিভিন্ন সাহিত্য-আঙ্গিকের (যেমন ট্র্যাজেডি, কমেডি, মহাকাব্য প্রভৃতি) প্রকৃতি ও রচনারীতির বিশেষণ। প্রাচীন ভারতেও অলঙ্কারশাস্ত্র এবং কাব্যতত্ত্বের ব্যাপক চর্চা হয়েছে এবং এক পর্যায়ে অলঙ্কার কাব্যতত্ত্বকেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। অলঙ্কার সেখানে কবিতার শরীরী প্রসঙ্গে পরিণত হয়েছে।
পরবর্তী-সময়ে মানুষের জ্ঞানের বিস্তার, অনুভূতির তীক্ষ তা এর মনোজাগতিক সূক্ষ্মতা অলঙ্কারকে কবিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত কেেছ। কাব্যপাঠকালে তার দুটি দিক আমাদেরকে প্রথম আকর্ষণ করে: এক. কাব্যে ব্যবহৃত পদের শব্দ বা ধ্বনি; দুই. তার অর্থ বা Meaning ।
শব্দ বা ধ্বনি গ্রহণ করি শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে আর অর্থ উপলব্ধি করি মন, অনুভূতি বা বোধ দিয়ে। ফলে, কাব্যের দুটি রূপ প্রকাশ পায়। প্রথমটি বর্ণময় অবয়ব (Concrete) আর অন্যটি অর্থময় চিদ্রূপ (Abstract)।
বস্তুসংক্ষেপ :
আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন, কল্পনা প্রভৃতি ব্যক্তিমানসের সাধারণ প্রবণতার অংশ; এগুলোর সঙ্গে যখন সৃষ্টিশীলতা যুক্ত হয়, অনিবার্য শব্দের তাৎপর্যময় বিন্যাস তাকে করে তোলে ব্যঞ্জনাময়। তখনই একটি কবিতার জন্মভ সম্ভব। সাধারণভাবে বলা যায়, কবির স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি শব্দ ও ছন্দের অনিবার্য বিন্যাসে জীবনের অন্তর্ময় এবং স্থায়ী আবেদন সৃষ্টির উপযোগী যে শব্দসৌধ সৃষ্টি করে, তাই কবিতা ।
কবিতার প্রকরণ বা শিল্পরূপ অনুধাবনের জন্য অলঙ্কার, চিত্রকলা, ছন্দ এবং ছন্দস্পন্দ সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। অলঙ্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ [অলম-কৃ (করা)+ঘণ] আভরণ বা ভূষণ। অর্থাৎ যে সকল উপাদান কবিতার অবয়বকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে সাধারণ অর্থে তাই অলঙ্কার। কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দ চিরকালই স্বীকৃত ও চর্চিত হয়েছে। কেননা, কবিতার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপাদান হল ছন্দ। কবিতার ছন্দ হয়ে উঠেছে বিধৃত চেতনার অনিবার্য রূপকলা।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সংক্ষিপ্ত-উত্তরমূলক প্রশ্ন
১. কবিতা বলতে আমরা কি বুঝি ?
২. কবিতার বিভিন্ন শ্রেণীর পরিচয় দিন।
৩. মহাকাব্য কয় প্রকার ও কি কি?
৪. গীতিকবিতার রূপবৈচিত্র্যের পরিচয় দিন
৫. বাংলা কবিতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখুন।
৬. অলঙ্কার কাকে বলে? সংক্ষেপে লিখুন।
৭. বাংলা ছন্দ কয় প্রকার ও কি কি?
রচনামূলক প্রশ্ন
১. কবিতার ক্ষেত্রে অলঙ্কারের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করুন।
১ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা- উত্তর:
কবিতার সংজ্ঞার্থ নির্ণয় সহজ কাজ নয়। তবুও মনে রাখতে হবে সাহিত্যের সব শাখারই একটি মৌলিক মানদন্ড আছে যার ভিত্তিতে সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করা সম্ভব। কবির বিশেষ অনুভূতি প্রকাশের জন্য শব্দের তাৎপর্যময় ও অনিবার্য বিন্যাস থেকে কবিতার সৃষ্টি। আরো ব্যাখ্যা করে বলতে গেলে আমরা বলতে পারি, আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন কল্পনা প্রভৃতি ব্যক্তিমানুষের সাধারণ প্রবণতা। এগুলোর সঙ্গে কবির সৃজনশীলতা যুক্ত হয়ে কবিতার জন্ম হয়।
আরও দেখুন :