আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় তালিকা প্রণয়ন, পোস্ট বক্স, জিগসো ও অন্যান্য পদ্ধতি – যা আরবি ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষণের পাঠদান পদ্ধতি ও কলাকৌশল এর অন্তর্ভুক্ত।
তালিকা প্রণয়ন, পোস্ট বক্স, জিগসো ও অন্যান্য পদ্ধতি
শিখন-শেখানো কার্যক্রমে কখনো একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে সফলতা লাভ করা যায় না, তাই পাঠের বিষয়বস্তুর চাহিদা অনুসারে বৈচিত্র্যময় পদ্ধতি ও কৌশল নির্বাচন ও প্রয়োগে শিক্ষককে যত্নবান হতে হয়। এ বৈচিত্র্যময় পদ্ধতিগুলোর মধ্যে তালিকা প্রণয়ন, পোস্ট বক্স এবং জিগসো পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের সক্রিয় ও মনোযোগী করে শিক্ষণ শিখন প্রক্রিয়াকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। আরবি শিক্ষককে এ সকল পদ্ধতি আয়ত্ত্ব করে শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগে সচেষ্ট হতে হবে ।
তালিকা প্রণয়ন পদ্ধতি
যে পদ্ধতিতে পাঠ্য বিষয়বস্তুর কোনো তত্ত্ব, তথ্য বা উদাহরণকে শ্রেণিবদ্ধ করে শিক্ষার্থীদের নিকট স্পষ্ট করে তোলা হয় তাকে তালিকা প্রণয়ন পদ্ধতি বলে। এ পদ্ধতির সাহায্যে শিক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তু থেকে একই ধরণের তত্ত্ব তথ্য বা উদাহরণকে শ্রেণিবদ্ধ করতে বলা হয়। তারপর তারা তাদের প্রণীত তালিকা উপস্থাপন করবে এবং সকলের নিকঠ থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে সমন্বয় করে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হবে। চূড়ান্ত তালিকার তথ্য, তত্ত্ব, উদাহরণ শিক্ষার্থীরা অনুশীলন করবে। আরবি কাওয়ায়েদ সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তু পাঠদানে এ কৌশল খুবই কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায়।
তালিকা প্রণয়ন পদ্ধতির সুবিধা
- শিক্ষার্থীরা নিজেদের পূর্ব ধারণা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তালিকা প্রণয়ন করে বলে শিক্ষণ ও শিখন সহজ হয়।
- শিক্ষার্থীদের চিন্তন ও পর্যক্ষেণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।
- নিজেরা নতুন তালিকা করে, তাই তারা আবিষ্কারের আনন্দ লাভ করে।
- একক, জোড়া ও দলগতভাবে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়।
- বিশেষ কোনো উপকরণের প্রয়োজন হয় না ।
- শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়।
তালিকা প্রণয়ন পদ্ধতির অসুবিধা
- শিক্ষার্থীদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে তালিকা প্রণয়ন পদ্ধতি প্রয়োগে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায় না।
- শিক্ষার্থীদের দেওয়া তালিকা সংরক্ষণে শিক্ষককে যথেষ্ট সক্রিয় হতে হয়, যাতে কোনো তথ্য বাদ না যায় ।
- এই পদ্ধতি প্রয়োগে অধিক সময়ের প্রয়োজন হয়। সকলের উপস্থাপিত তালিকা গৃহীত না হলে কোনো কোনো শিক্ষার্থী নিরুৎসাহিত হতে পারে।
- অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীর শ্রেণিতে এই পদ্ধতি সর্বদা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা দুরূহ হতে পারে।
পোস্ট বক্স পদ্ধতি
যে প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদেরকে নির্ধারিত ডাক বাক্স অনুযায়ী দলে বিভক্ত করে বাক্সের নির্ধারিত প্রশ্নের উত্তর আদায় করে শিক্ষণ শিখন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয় তাকেই পোস্ট বক্স পদ্ধতি বলে। অংশগ্রহণমূলক পাঠদান পদ্ধতিগুলোর মধ্যে পোস্ট বক্স অত্যন্ত জনপ্রিয় পদ্ধতি। এটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক কার্যকর একটি শিখন-শেখানো কৌশল। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা সক্রিয় থাকে এবং আনন্দময় পরিবেশে শেখার কাজটি সম্পন্ন হয়। এ পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য শিক্ষক পূর্বেই ৫/৬টি কাগজের খালি বাক্স সংগ্রহ করবেন এবং শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন স্থানে সমান দূরত্বে সেগুলো স্থাপন করবেন।
প্রত্যেকটি বাক্সের সামনের দিকে কাগজে বড় অক্ষরে একটি করে লিখিত প্রশ্ন বাক্সের গায়ে লাগিয়ে দিবেন ও সামনে কিছু সাদা কাগজের টুকরাও রাখবেন। শিক্ষার্থীদেরকে ৫/৬টি দলে ভাগ করবেন। শিক্ষার্থীরা দলীয়ভাবে ঘুরে ঘুরে বাক্সের গায়ে লাগানো প্রশ্নগুলো পড়বে এবং দলীয় অবস্থানে ফিরে গিয়ে নিজেরা আলোচনা করে প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ধারণ করবে।
অতঃপর বাক্সের সামনে রক্ষিত কাগজে উত্তর লিখে সংশ্লিষ্ট বাক্সে ফেলবে। এভাবে প্রত্যেকটি দল সকল প্রশ্নের উত্তর বাক্সে রাখা শেষ করলে সকল প্রশ্নের উত্তরগুলোকে সাজিয়ে শ্রেণিবদ্ধ করবে, প্রয়োজনে সার-সংক্ষেপ তৈরি করবে। এবার উত্তরগুলো থেকে প্রাপ্ত ধারণা দলগতভাবে আলোচনা করে উপস্থাপন করবে। শিক্ষক প্রয়োজনীয় ফলাবর্তন দিয়ে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন।
পোস্ট বক্স পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য
- এটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক কার্যকর শিখন-শেখানো পদ্ধতি।
- শিক্ষার্থীদের পূর্ব ধারণা সমন্বয়ের মাধ্যমে শিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
- এতে ছদ্ম ডাক বাক্সের ব্যবহার হয় ।
- এখানে সকল শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে ।
- এ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত প্রশ্নগুলোর ধরণ হবে উম্মুক্ত।
- সাধারণত কোনো অধ্যায়ের শুরুতে বা শেষে এ পদ্ধতির প্রয়োগ ফলপ্রসূ হয় ।
আপনি কীভাবে আরবির ক্লাসে পোস্ট বক্স পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন ?
পোস্ট বক্স পদ্ধতির সুবিধা
- শিখন প্রক্রিয়ায় সকল শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
- শিক্ষার্থীরা শ্রেণিতে পুরো সময় সক্রিয় থাকে।
- পাঠদানে বৈচিত্র্য থাকায় একঘেয়েমি দূর হয়।
- শিক্ষার্থীরা ঘুরাঘুরি করে কাজের সুযোগ পায় বলে আনন্দ পায় ।
- শিক্ষার্থীদের মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ থাকে।
- পাঠে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বৃদ্ধি পায়।
- শ্রেণির কঠোর নিয়মের বাইরে নিজেদের মতামত প্রকাশ করে ধারণা গঠন করতে পারে।
- নিম্ন মেধার শিক্ষার্থীরাও শিখনে এগিয়ে যায়।
- শিখনে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের সৃষ্টি হয়।
- শিক্ষার্থীদের জড়তা দূর হয়।
পোস্ট বক্স পদ্ধতির অসুবিধা
- এ পদ্ধতি প্রয়োগে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়।
- ছোট আকারের শ্রেণিকক্ষে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় না।
- সকল প্রকার বিষয়ের পাঠে এটি উপযোগী নয়।
- শ্রেণি শৃংখলা রক্ষায় শিক্ষককে বেশ বেগ পেতে হয় ।
- দক্ষ প্রশিক্ষিত শিক্ষক ব্যতীত এ পদ্ধতি প্রয়োগে সাফল্য অর্জন করা যায় না।
জিগসো পদ্ধতি Expart Jigsaw
শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে একটি অত্যন্ত কার্যকর সহযোগিতামূলক পদ্ধতি হলো জিগসো। ইংরেজি শব্দ Jigsaw-এর অর্থ হলো— A picture printed on cardboard or wood, that has been cut up into a lot of small pieces of different shapes that you have to fit together again. অর্থাৎ পিচবোর্ড বা কাঠের উপর মুদ্রিত একটি ছবি যেটি বিভিন্ন আকারের অনেকগুলো ছোট ছোট টুকরো করে কাটা হয়েছে, যা পরবর্তীতে আবার আপনাকে একসাথে ফিট করতে হবে।
এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের পূর্ব ধারণা ও মতামতের উপর ভিত্তি করে একটি চূড়ান্ত ধারণা অর্জনের চেষ্টা করা হয়। এখানে শিক্ষার্থীরা একে অন্যের মতামতের উপর
শ্রদ্ধা রেখে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আনন্দঘন পরিবেশে শিখন কাজে অগ্রসর হয়।
প্রয়োগ কৌশল
শ্রেণিকক্ষে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হলে নিম্নোক্ত ধাপসমূহ অনুসরণ করতে হয়:
১. বিষয়বস্তুকে ৪ থেকে ৬টি অংশে ভাগ করতে হবে।
২. শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সমসংখ্যক দলে ভাগ করতে হবে যাতে প্রত্যেক দলে সদস্য সংখ্যা হবে ৪–৬ জন।
৩. দলের প্রত্যেক সদস্যকে একটি করে পাঠের অংশ নির্ধারণ করে দিতে হবে (এক্ষেত্রে পাঠ্যবই-এর নির্দিষ্ট অংশ চিহ্নিত করে দেওয়া যায় অথবা আলাদা কর্মপত্র সরবরাহ করা যায়)।
৪. প্রতি দলের শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য নির্বাচিত অংশ স্বাধীনভাবে পড়বে এবং তার জন্য নির্ধারিত প্রশ্নের উত্তর বের করবে এবং দলের মধ্যে প্রয়োজনীয় আলোচনা করে একটি সারাংশ তৈরি করবে।
৫. তারপর প্রত্যেক দলের একজন করে নিয়ে বিশেষজ্ঞ দল গঠন করতে হবে।
৬. বিশেষজ্ঞ দলের প্রত্যেকে তাদের জন্য দেওয়া একই বিষয়বস্তুর উপর পরস্পর আলোচনা ও মত বিনিময় করবে। প্রত্যেকে পূর্ব দলে আলোচনার মাধ্যমে যা জেনেছিল, তা নতুন দলের সদস্যদের জানাবে। আলোচনা এবং যুক্তি প্রদানের পর গ্রহণ ও বর্জনের মাধ্যমে তারা তাদের জন্য নির্ধারিত বিষয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে উপনীত হবে।
৭. তারপর তারা তাদের মূল দলে ফিরে আসবে এবং মূল দলের সদস্যদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ দল থেকে তাদের নির্দিষ্ট বিষয়ে অর্জিত অভিজ্ঞতা/ধারণা বর্ণনা করবে।
৮. সবশেষে প্রত্যেক দলের শিক্ষার্থীরা তাদের বিশেষজ্ঞ দল থেকে প্রাপ্ত ধারণাগুলো একত্রিত করে সম্পূর্ণ পাঠের উপর একটি সামগ্রিক ধারণা গঠন করবে।
জিগসো পদ্ধতির সুবিধা
- জিগসো পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা সার্বক্ষণিক সক্রিয় ও মনোযোগী থাকে।
- শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়িত্বশীলতার গুণ সৃষ্টি হয় ।
- শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহযোগীতামূলক মনোভাব তৈরি হয়।
- শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে ওঠে।
- আনন্দঘন পরিবেশে শিখন অর্জিত হয়।
- শিক্ষার্থীদের জড়তা দূর হয়।
- যে কোনো সময় যে কোনো বিষয়ে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়।
জিগসো পদ্ধতির অসুবিধা
- জিগসো পদ্ধতির মাধ্যমে পাঠদানে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।
- পাঠের বিভাজিত বিভিন্ন অংশের মধ্যে দৈর্ঘ ও কাঠিন্যের ক্ষেত্রে ভারসাম্য না থাকলে সময় ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হতে পারে।
- অধিক শিক্ষার্থীর শ্রেণিকক্ষে এ পদ্ধতির ব্যবহার সফল না ও হতে পারে।
- শিক্ষকের দক্ষতা না থাকলে শ্রেণি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে।
- দল গঠনের সময় একটি দলে সকল শিক্ষার্থী নিম্ন মেধার হলে এ পদ্ধতি ব্যবহারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে।
অন্যান্য পদ্ধতি
বিষয়বস্তুর ভিন্নতা বা শিখন পরিবেশের বিভিন্নতার কারণে সকল পদ্ধতি সবসময় শিখন-শেখানোর উপযোগী হয় না। তাই বিষয়বস্তু, শিখন পরিবেশ, উপকরণের সহজলভ্যতা, স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ, শিক্ষকের দক্ষতা, শিক্ষার্থীর চাহিদা ইত্যাদি বিবেচনা করে নতুন নতুন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে।
যেমন- পর্যবেক্ষণ, বিতর্ক, স্নো বলিং, মার্কেট প্লেস, ওয়ার্কিং ওয়াল, শিক্ষা ভ্রমণ, ফিস বোল, হাঁটা, পড়া এবং বলা, আটার রোলে বাদাম সাজানো, বশীকরণ মাইক, জানা বিষয়কে উন্মুক্ত করা, অর্পিত কাজ, সাক্ষাৎকার, প্রত্যক্ষীকরণ শ্রেণিবিন্যস্তকরণ, ফাইল ঝুড়ি পদ্ধতি, জোড়ায় শিক্ষণ, সতীর্থ শিক্ষণ ইত্যাদি।
মূল্যায়ন
১. তালিকা প্রণয়ন বলতে কী বুঝেন ?
২. পোস্ট বক্স পদ্ধতি কী? এর সুবিধাগুলো লিখুন।
৩. জিগসো পদ্ধতির প্রয়োগ কৌশল বর্ণনা করুন।
আরও দেখুনঃ