আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-দাওয়াতপত্র প্রণয়নকারীর নিকট থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের বিনম্রতা ও বাককৃতি বিশ্লেষণ
দাওয়াতপত্র প্রণয়নকারীর নিকট থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের বিনম্রতা ও বাককৃতি বিশ্লেষণ
সারণি: ২৬ দাওয়াতপত্র প্রণয়নকারীর নিকট থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের প্রকৃতি
পাঁচটি শ্রেণির ৫ জন দাওয়াতপত্র প্রণয়নকারীর নিকট থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা প্রত্যেকেই সচেতনভাবে দাওয়াতপত্রে বিনম্রতাসূচক বিভিন্ন শব্দ/বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন আমন্ত্রিত অতিথির উদ্দেশ্যে। উদাহরণস্বরূপ, পারিবারিক দাওয়াতপত্রে ধর্মীয় বিনম্রতাসূচক শব্দের ব্যবহার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে প্রথানুসারে তারা করেন।
ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্রে ধর্মীয় অনুভূতি, ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখার জন্য রীতি অনুসারে ধর্মীয় বিদ্রতাসূচক শব্দ ব্যবহার করেন। আমন্ত্রণকারী দাওয়াতপত্রে ‘জনাব’, ‘বেগম’, ‘সুধী’, ‘মহাশয়’, ‘সুহৃদ’, ‘সম্মানিত সদস্য’, ‘শুভেচ্ছা’ প্রভৃতি বিনম্রতাসূচক শব্দসমূহ ব্যবহার করেছেন আমন্ত্রণগ্রহিতার প্রতি যথাযথ সম্মান, বিনয়, আন্তরিকতা প্রকাশের মাধ্যমে তাকে সম্বোধন করার উদ্দেশ্যে।
একই সাথে আমন্ত্রণকারীর সদিচ্ছা যেন দাওয়াতপত্রের লিখিতরূপেও প্রতিফলিত হয় এবং অতিথি যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন ইত্যাদি বিষয় চিন্তা করেও তিনি এ ধরনের শব্দাবলি ব্যবহার করেন। ব্রাউন ও লেভিনসনের তত্ত্ব (Brown and Levinson, 1987) মতে এই ধরনের শব্দ ইতিবাচক বিনম্রতা নির্দেশ করে।
আমন্ত্রণগ্রহিতার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য আমন্ত্রণকারী এই শব্দসমূহ লিখিত ডিসকোর্সে ব্যবহার করেন। ইতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ বা বাক্যাংশ ব্যবহারের মাধ্যমে আমন্ত্রণকারীর অভিব্যক্তি (face) আমন্ত্রণ গ্রহণকারীর নিকট বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে, ‘উপস্থিতি ও দোয়া’, ‘আন্তরিকভাবে কামনা করছি’, ‘ত্রুটি মার্জনীয়’, ‘সবান্ধব উপস্থিতি’, ‘বিনীত নিবেদন’, ‘সদয় সম্মতি জ্ঞাপন’, ‘অনুরোধ করছি’ প্রভৃতি বিনম্রতা প্রকাশক শব্দ/বাক্যাংশ আমন্ত্রণকারী
দাওয়াতপত্রে ব্যবহার করেছেন আমন্ত্রণ গ্রহিতার প্রতি বিনয়, সৌজন্য, আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য। আমন্ত্রণগ্রহণকারীর নিকট বিনীতভাবে যেন আমন্ত্রণপত্রটি গৃহীত হয় এবং আমন্ত্রিত অতিথি যেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন এ বিষয়টি লক্ষ রেখেও আমন্ত্রণকারী এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করেন।
দাওয়াতপত্রে প্রয়োগকৃত এ শব্দ/ বাক্যাংশসমূহ ব্রাউন ও লেভিনসন এর তত্ত্বানুসারে (Brown and Levinson, 1987) নেতিবাচক বিনম্রতা নির্দেশ করে। দাওয়াতপত্রে ইতিবাচক অপেক্ষা নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ অধিক ব্যবহার করা হয়। প্রাপ্ত উপাত্তে দেখা যায়, অতিথিকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করে, বিনয়ের সাথে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ আমন্ত্রণকারী অধিক ব্যবহার করেন।
আমাদের সংস্কৃতিতে আমন্ত্রিত অতিথিকে সরাসরি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে আদেশ করে বলা হয় না। এটি অসৌজন্যমূলক, এভাবে বললে আমন্ত্রণকারীর আন্তরিকতা প্রকাশ পায় না এবং অতিথিও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন না বলে মনে আমন্ত্রণকারী করেন।
আমাদের সমাজে এ রীতি প্রচলিতও না। একইসাথে অতিথি যেন কোন কারণে মনে না করেন, আমন্ত্রণকারী তাকে যথাযথ সম্মানের সাথে, বিনয়ের সাথে আমন্ত্রণ জানান নাই, এ কারণেও নেতিবাচ বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ আমন্ত্রণকারী অধিক ব্যবহার করে থাকেন। ব্রাউন ও লেভিনসন এর তত্ত্ব (Brown and Levinson, 1987) মতে, এই ধরনের নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ ব্যবহারের মাধ্যমে আমন্ত্রকারীর অভিব্যক্তি ভীতিকারী কর্ম বা অভীক হ্রাস পায়।
পিচ এর বিনম্রতার রীতি (Leech, 1983) অনুসারে, ‘জনাব’, ‘বেগম’, ‘সুধী’, ‘মাননীয়’, ‘সম্মানিত সদস্য’, ‘মহাশয়’, ‘সুহৃদ’ ইত্যাদি বিনম্রতাসূচক শব্দ অনুমোদিত রীতির অংশ। আমন্ত্রণকারী এই বিনম্রতাসূচক শব্দসমূহ দাওয়াতপত্রে প্রয়োগ করে আমন্ত্রণগ্রহিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন।
“উপস্থিতি ও দোয়া”, “আন্তরিকভাবে কামনা করছি’, ‘সর্বান্ধব উপস্থিতি’, অনুমোদিত রীতি এবং সদয় সম্মতিজ্ঞাপন’, ‘ত্রুটি মার্জনীয়’, ‘বিনীত অনুরোধ’, ‘বিনীত নিবেদক’ প্রভৃতি বিনম্রতাসূচক বাক্যাংশ মিতচারিতা রীতির অংশ। সার্গ এর বাককৃতি তত্ত্ব (Searle, 1969) অনুসারে দেখা যায়, দাওয়াতপত্র প্রণয়নকারী বা আমন্ত্রণকারী দাওয়াতপত্রে বিদ্রতাসূচক শব্দ বা বাক্যাংশসমূহ ব্যবহার করেছেন মূলত আমন্ত্রণগ্রহিতা যেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন, সেই উদ্দেশ্যে।
অর্থাৎ আমন্ত্রণকারী দাওয়াতপত্রে বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ প্রয়োগের অন্তরালে অতিথিকে অনুরোধ করেছেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য। এখানে প্রস্তাব কৃতির অন্তরালে আদেশমূলক নিবেদন কৃতি অর্থাৎ ‘অনুরোধ’ পেয়েছে আমন্ত্রণপত্র প্রণয়নকারীর।
আরও দেখুন: