আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-অর্থ পরিবর্তনের ধারা
অর্থ পরিবর্তনের ধারা
সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের ফলে পুরনো মূল্যবোধের অবলুপ্তি ঘটে। ফলে পূর্বের প্রচলিত ধ্যানধারণা ও বস্তুর ব্যবহার অপ্রচলিত হয়ে যায়, নতুন ধ্যানধারণা ও বস্ত্র ব্যবহার চালু হয়। এইভাবে ভাষার রূপমূলও অপ্রচলিত হতে হতে একসময় হারিয়ে যায় আবার নতুন রূপমূল ও তৈরি হয়।
আবার সুদূর ভবিষ্যতেও হয়ত সেটি থাকবে না। রূপমূল পরিবর্তনের মতোই অর্থেরও পরিবর্তন ঘটে। সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনে, ভিন্ন পারিবেশিক কারণে, মানসিক ও অন্য অঞ্চলের ভাষার সান্নিধ্যলাভের ফলে রূপমূলের অর্থ পরিবর্তিত হয়। রূপমূলের অর্থের পরিবর্তন তিনটি ধারায় বিভক্ত। যথা-
১. অর্থপ্রসার (Expansion of Meaning)
২. অর্থসংকোচ (Contraction of Meaning )
৩. অর্থসংশ্লেষ (Transferring of Meaning)
ডেমরা অঞ্চলের ভাষায় রূপমূলের অর্থ পরিবর্তনে উপরোল্লিখিত তিনটি

অর্থপ্রসার (Expansion of Meaning)
প্রক্রিয়াই কার্যকর।
কোন রূপমূলের মূল অর্থ যা ছিল এখন যদি আরও ব্যাপক অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয় তাকে শব্দের অর্থপ্রসার বলে। সাধারণত রূপক বা অতিশয়োক্তির প্রভাবে এরকম অর্থ প্রসার বা অর্থবিস্তার ঘটে থাকে। ভাষা ব্যবহারকারী রূপমূলগুলোকে অর্থের সীমিত গণ্ডি থেকে বিস্তৃত অর্থে প্রয়োগ করে। ডেমরার প্রচলিত ভাষায় এ ধরনের রূপমূলের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন-
১৩. পশশুকা’ (পরশু) রূপমূলের অর্থ ডেমরা অঞ্চলে ‘গতকালের আগের দিন’ এবং ‘আগামীকালের পর দিন’ দুই অর্থেই প্রযুক্ত। মূলত বাংলা ‘পরশু’ রূপমূল সংস্কৃত পরশঃ থেকে জাত যার আসল অর্থ ছিল ‘আগামীকালের পর দিন’, কিন্তু বর্তমানে ডেমরার স্থানীয় ভাষায় ‘পরও’ বলতে ‘গতকালের আগের দিন’ এবং ‘আগামীকালের পর দিনকেও বোঝায় এক্ষেত্রে অর্থ প্রসারিত হয়েছে।
ক. আমি পত্তকা যামু (আমি পরশু দিন যাবো) আগামীকালের পরের দিন অর্থে খ. পশশুকা কাম কইরা দিছি না (পরশু দিন কাজ করে দিয়েছি না) গতকালের আগের দিন অর্থে।
১৪. হাট (বাজার) সপ্তাহের এক বা একাধিক নির্দিষ্ট দিনে বেচাকেনার জন্য নির্ধারিত স্থান। ডেমরা অঞ্চলে হাটের অর্থ প্রসারিত হয়ে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘লোক সমাবেশ -হাট রূপমূল ব্যবহার করে
বোঝানো হয়।
যেমন : গল্পের আট বহাইছো (গল্পের হাট (আসর) বসিয়েছে)
‘বেচাকেনা’ হাট রূপমূল ব্যবহার করে বোঝানো হয়।
যেমন: গরুর আটো যামু (গরুর হাটে যাবো)
সারুইলার আটো বাজার করতো গ্যাছে। (সারুলিয়ার হাটে বাজার করতে গিয়েছে)।
১৫. গর (ঘর) ডেমরায় ‘ঘর’ রূপমূলটির অর্থ নির্দিষ্ট কোন ‘ঘর’ নয়, এখানে গর বলতে পরিবার, বংশ, সংসার, বাড়ি, ইত্যাদি বোঝায়।
ক. বালা গর দেইখ্যা মাইয়া বিয়া দিমু (ভাল ঘর দেখে মেয়ে বিয়ে দেবো)
এখানে ‘গর’ দ্বারা বংশমর্যাদা বোঝাচ্ছে।
খ. আমার ‘গর’ বালা কইরা শাজাইছি (আমার ঘর ভাল করে সাজিয়েছি)
এখানে ‘গর’ দ্বারা সংসার বোঝাচ্ছে।
গ. তোমার গরের কতা কও (তোমার ঘরের কথা বল ) এখানে ‘গর’ দ্বারা ‘বাড়ি’ বোঝাচ্ছে।
ঘ. আমার গরের সবাই বেরাইবার গ্যাছে (আমার ঘরের সবাই বেড়াতে গিয়েছে)
এখানে ‘গর’ দ্বারা পরিবার বোঝাচ্ছে।
১৬. কোটিন (কঠিন)-কোটিন অর্থ শক্ত। ডেমরা অঞ্চলে ‘কঠিন’ রূপমূলের অর্থ বিস্তৃত হয়ে নানা অর্থ
পরিগ্রহ করেছে। যেমন ক. কামাইল্যার লাহান কোটিন মানু দেহি নাই। (কামালের মত কঠিন মানুষ দেখি নাই )
এখানে ‘কোটিন’ দ্বারা নিষ্ঠুর ব্যক্তি বুঝানো হয়েছে।
খ. বুগোল অনেক কোটিন বিষয়। (ভূগোল অনেক কঠিন বিষয় )
এখানে ‘কোটিন’ দ্বারা জটিল অর্থ বোঝাচ্ছে। গ. হেড ছারে অনেক কোটিন মানুষ (হেড স্যার অনেক কঠিন মানুষ)
এখানে কোটিন দ্বারা নীতিবান, উত্তম, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অর্থ প্রকাশ পায়।
১৭.বকা (অশ্লীল গালি) : বকার অর্থ এখন গালি নয় রাগ, ধমক, তিরস্কার সবই ‘বকা’ রূপমূল দ্বারা
বোঝানো হয়।
১৮. ডেমরা অঞ্চলে পূর্বে অচতোর (অস্ত্র) অর্থ লোহার তৈরি তরবারিকে বোঝানো হত, বর্তমানে এই অর্থ প্রসারিত হয়ে যেকোন অস্ত্র-দা, বটি, ছুরি, চাকু, আগ্নেয়াস্ত্রকে ‘অচতোর দ্বারা বোঝানো হয়।
অর্থসংকোচ (Contraction of meaning)
কোন শব্দের বিভিন্ন অর্থের মধ্যে কালক্রমে কোন একটি অর্থ মুখ্য হয়ে উঠলে অন্যান্য অর্থগুলো ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রধানরূপে প্রতীয়মান অর্থবিশিষ্ট শব্দে অর্থসংকোচ পরিলক্ষিত হয়। অর্থসংকোচনের এরকম উদাহরণ ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় দেখা যায়। ডেমরায় শব্দের অর্থসংকোচ দুটি প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে-
ক. সাধারণ (General) থেকে বিশেষ (Special) অর্থে পরিবর্তন
১৯. কাফোর (কাপড়) এর অর্থ যেকোন কাপড়। কিন্তু ডেমরা অঞ্চলে কাফোর (কাপড়) বলতে একমাত্র মহিলাদের পরিধান, অর্থাৎ শাড়িকেই কাপড় বলে।
২০. খাওন (খানা) অর্থ যেকোন খাবার। কিন্তু এ অঞ্চলে মৃত ব্যক্তির আত্মার কল্যাণ কামনায় মিলাদসহ যে ভোজ অনুষ্ঠান হয় তাকে ‘খাওন’ নামে অভিহিত করা হয়।
খ. ভাববাচকতা বা বিশেষ অর্থ থেকে বস্তুবাচকতা বা সাধারণ অর্থে রূপান্তরিত।
২১. ফকির অর্থ পূর্বে ছিল সংসারত্যাগী, মরমী সাধক, বর্তমানে ফকির শব্দের অর্থ সংকুচিত হয়ে ‘ভিক্ষুক’ অর্থে পরিণত হয়েছে।
২২. অলুদ (হলুদ) এর অর্থ রঙ বিশেষ। বস্তুবাচক অর্থে হলুদ এখন তরকারিতে ব্যবহার করার একধরনের মসলা হিসেবে পরিচিত
২৩. ‘জিয়াইল’ শব্দের অর্থ বাঁচিয়ে রাখা যায় এমন কোন জীব। ডেমরা অঞ্চলে শিং মাছকে ‘জিয়াইল’ মাছ বলে। কিন্তু কৈ, খইলশা, মাগুর ইত্যাদি মাছও পাত্রে পানি দ্বারা জিইয়ে রাখা যায় অনেক দিন, কিন্তু এ মাছগুলোকে জিয়াইল বলা হয় না, একমাত্র ‘শিং মাছকেই বলে।

অর্থসংশ্লেষ (Transferring of Meaning)
রূপমূলের অর্থের ক্রমাগত প্রসারণ ও সংকোচনের ফলে কখনও কোন রূপমূলের এমন অর্থ তৈরি হয়, যার সঙ্গে মূল অর্থের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না, একে অর্থসংশ্লেষ বলে। ডেমরা অঞ্চলে অর্থসংশ্লেষের প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন :
২৪. ‘ছায়া’ রূপমূলের অর্থ কোন কিছুর প্রতিবিম্ব। কিন্তু বর্তমানে ডেমরায় ‘ছায়া’ বলতে স্ত্রীলোকে ব্যবহৃত পেটিকোটকে বোঝায়।
শুভাষণ : অসুন্দর, অমঙ্গল, দোষ-ত্রুটি, অশ্লীল অর্থকে সরাসরি প্রকাশ না করে ভদ্রোচিত সুন্দর ভাষায়: প্রকাশরীতি শুভাষণ হিসেবে পরিচিত। ডেমরার ভাষায়ও এ শুভাষণরীতির প্রচলন আছে। যেমন- হউর বারি (শ্বশুরবাড়ি) কোন অপরাধীর বিচারে জেল হলে বলে, হউর বারি গ্যাছে (শ্বশুরবাড়ি গেছে) বলা হয়।
শুভাষণরীতি দুভাবে সম্পন্ন হয়। যেমন-
১. শব্দের ভালো অর্থের আবরণে খারাপ অর্থকে আচ্ছাদিতকরণ : বিয়ের কনে দেখতে কালো হলে তার গায়ের বর্ণের কথা সরাসরি না বলে, ভদ্রতার আড়াল করে বলে মাইয়ার রঙ শ্যামলা/ময়লা (মেয়ের রঙ শ্যামলা / ময়লা)।
২. শব্দের ভাল অর্থ খারাপ অর্থে নির্দেশিত :
‘পিরিত’ অর্থ প্রেম। কিন্তু শুভাষণের ক্ষেত্র পিরিত বলতে অবৈধ প্রেমকে বোঝানো হয় যা এখানে অপ বা নিষেধ অর্থ নির্দেশ করে। তেমনি নাগর অর্থ নগরের লোক। কিন্তু এখন এর অর্থ হয়েছে ‘অবৈধ প্রণয়’।
আরও দেখুন: