আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-পাণ্ডুলিপি তত্ত্ব
পাণ্ডুলিপি তত্ত্ব
মনোবিজ্ঞানী শ্যাঙ্ক (১৯৮৪) এবং এ্যান্ডারসন (১৯৮৩) ভাষার অর্থ ব্যাখ্যায় পান্ডুলিপি তত্ত্ব প্রচার করেন। এ তত্ত্বকে ধারণাগত নির্ভরশীলতা তত্ত্বও বলা হয়। এ তত্ত্ব অনুসারে পান্ডুলিপি হলো ঘটনার সাধারণ টেমপ্লেট যাতে ধারণাসমূহ অবস্থিত থাকে, যে ধারণাসমূহ ঘটনা সংঘটনের সময় পান্ডুলিপির সাথে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে । আমরা অনেক রকম পান্ডুলিপির কথা চিন্তা করতে পারি, যেমন শ্রেণীকক্ষ পাণ্ডুলিপি, আদালতকক্ষ পান্ডুলিপি
হাসপাতাল পান্ডুলিপি, কাঁচাবাজার পাণ্ডুলিপি অফিসকক্ষ পান্ডুলিপি, চা-চক্র পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি । প্রতিটি পান্ডুলিপিতেই থাকে কিছু ভূমিকা। যেমন, শ্রেণীকক্ষ পান্ডুলিপিতে থাকে শিক্ষক, ছাত্র, শিক্ষকসহকারী, ইত্যাদি ভূমিকা, আদালতকক্ষ পাণ্ডুলিপিতে থাকে বিচারক, বাণী, বিবাদী ইত্যাদি ভূমিকা, হাসপাতাল পান্ডুলিপিতে থাকে ডাক্তার, রোগী, নার্স ইত্যাদি ভূমিকা ।
এই ভূমিকাগুলো প্রাথমিকভাবে ধারণা এবং কোন ভাষায় প্রাপ্ত শব্দ এই ধারণাগুলোর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। ভূমিকা এবং শব্দের এই সম্পর্ক ISA সংকেত দ্বারা প্রকাশিত হয় । যেমন :
শব্দ
শিক্ষক
ছাত্র
ডাক্তার
রোগী
সংগ
ISA
ISA
ISA
ISA
ধারণা
শিক্ষক
ডাক্তার
রোগী
এভাবে যদি লেখা হয় রাজীব ISA শিক্ষক তাহলে বুঝতে হবে এর অর্থ হলো রাজীব একজন শিক্ষক লেখা হয় কামাল ISA বিচারক, তাহলে বুঝতে হবে এর অর্থ হলো কামাল একজন বিচারক। এখানে শিক্ষক, বিচারক এগুলো হলো ধারণা এবং রাজীব, কামাল এরা হলো সেই ধারণার দৃষ্টান্ত।
কোন কোন পেশায় বিশেষ পোষাকের প্রয়োজন হয়। তখন ভুমিকা ও পোষাককে HASA সংকেত দিয়ে সংযুক্ত করা হয়। যেমন:
বিচারক
নৃত্যশিল্পী
বর
HASA
HASA
HASA
HASA
রোধ
ইউনিফর্ম
ঘাঘরা
পাগড়ি
বিশেষ ভূমিকার সাথে বিশেষ বস্তু বা যন্ত্রের যোগ থাকতে পারে। এগুলোকে বলা হয় PROPS ভূমিকা ও PROPS -এর সম্পর্কও HASA সংকেত দিয়ে প্রকাশিত হয়। যেমন :
শিক্ষক
HASA
ব্ল্যাকবোর্ড
ডাক্তার
HASA
স্টেথিস্কোপ
অফিসার
HASA
ডেস্ক
কসাই
HASA
এতে অবশ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সাধারন মানুষ কসাই নাম শুনলেই কেন শিউরে ওঠে এবং নির্দয় লোককে কেন কসাইয়ের সাথে তুলণা করা হয়। পান্ডুলিপির ভিতরে কার্যাবলী সময়ানুক্রমে সম্পন্ন হয় । এ কার্যাবলীই টেমপ্লেটকে সচল করে তোলে এবং তাকে একটা বাস্তব ভিত্তি দান করে।
যে কোন কার্যের বর্ণনার জন্য ভাষা থেকে শব্দ বাছাই করতে হয় যাকে বলা হয় পরিশৃঙ্খলা। পরিশৃঙ্খলায় দেখানো হয় কোন ধারণার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি শব্দ কিভাবে ঐ ধারণার সাথে সংশিষ্ট অন্যান্য শব্দের সাথে সম্পর্কিত । এখানে ক্ষেত্র তত্ত্বের ধারণাটি কাজে লাগে। আমরা সঞ্চালন ক্রিয়াপদটির ধারণাগত ক্ষেত্রের দিকে তাকাতে পারি:
শ্রেণীকক্ষ পান্ডুলিপিতে সঞ্চালন কার্য আছে। শিক্ষক শ্রেণীকক্ষের এদিক ওদিক হেঁটে বেড়াতে পারেন, তিনি চকডাস্টার ডেস্কের উপর রাখতে পারেন, কিংবা ছাত্রদের কাছ থেকে খাতা সংগ্রহ করতে পারে এবং পড়ে আবার ফেরত দিতে পারে।
এসব সঞ্চালন কার্য। একটি দ্রব্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় রাখাকে বলে পাদার্থের ভৌত স্থানান্তর যা চিহ্নিত হয় PTRANS দ্বারা এবং অন্য কোন দ্রব্য এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির কাছে যাওয়াকে বলে স্বত্বের স্থানান্তর যা চিহ্নিত হয় ATRANS দ্বারা ।
শ্রেণীকক্ষের ভিতর শুধু দ্রব্যেরই স্থানান্তর হয় না ধারণারও স্থানান্তর হয় ছাত্র থেকে শিক্ষক এবং শিক্ষক থেকে ছাত্রের মধ্যে। ধারণার এক আধার থেকে আরেক আধারে যাওয়াকে বলে তথ্যের মানসিক স্থানান্তর যা চিহ্নিত হয় MTRANS দ্বারা ।
প্রতিটি পান্ডুলিপিতে আবার মূল্যায়ন নামে একটি অংশ রয়েছে যাতে ভূমিকার দৃষ্টিকোণ থেকে চলমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন হয়ে থাকে। শ্রেণীকক্ষেও শিক্ষক ও ছাত্র ক্লাশ চলার সময় যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেন ক্লাশ কেমন হচ্ছে এবং তার প্রেক্ষিতে নিজেদের কাজকে পরিস্থিতির সাথে মানানসই করে তোলেন। এবার আমরা শ্রেণীকক্ষ পান্ডুলিপিকে অতিসরলায়িতভাবে নিম্নের চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি :
বাস্তব জীবনে একই ব্যক্তি বিভিন্ন পান্ডুলিপিতে বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন । শ্রেণীকক্ষে কেউ ছাত্র হতে পারেন, খেলার মাঠে ক্রিকেটার হতে পারেন, সংগঠনের নেতা হতে পারেন ইত্যাদি । এভাবে ভূমিকার স্থানান্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন পান্ডুলিপির মধ্যে মিথক্রিয়া ঘটে এবং তারফলে জটিল সংশয়ের সৃষ্টি হয়।
কোন বিশেষ কার্যের মাধ্যমেও পাণ্ডুলিপিসমূহের মধ্যে মিথক্রিয়া হতে পারে। যেমন টাকা আদানপ্রদান কার্যের সাথে অনেক পান্ডুলিপি একই সাথে জড়িত, যথা ব্যাংক, জীবনবীমা, দোকান, সিনেমা হল, কাউন্টার ইত্যাদি । – এরকম পরস্পরসম্পৃক্ত কতগুলো ক্ষেত্র নিয়ে গঠিত হয় পাণ্ডুলিপিগুচ্ছ ।
সৃষ্টিশীল কর্ম পাণ্ডুলিপিতাহ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত লেখালেখি, ছবি আঁকা, বয়নকার্য ভাস্কর্য তৈরী ইত্যাদি । তেমনি সমস্যা সমাধান পাণ্ডুলিপিগুচ্ছ -এর মধ্যে পড়ে চিকিৎসা প্রকৌশল শিক্ষকতা ওকালতি ইত্যাদি । এভাবে বিচার করলে দেখা যায় মানুষের ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সকল কর্ম ও প্রতিষ্ঠানই পাণ্ডুলিপির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ।
নিঃসন্দেহে ধারণার সংগঠন সম্পর্কে পাণ্ডুলিপি তত্ত্বের বিশ্লেষণ বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। অভিধান প্রণয়ন, অফিস প্রশাসন, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং অনেক ক্ষেত্রেই এ তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়েছে এবং সুফল পাওয়া গেছে । কিন্তু এই তত্ত্বের অসুবিধা হলো এটি ধারণার সংগঠন সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ কথা বললেও ভাষার অর্থ সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলে না। ধারণার সাথে ভাষার সম্পর্ক আছে বটে কিন্তু ধারণা মানে অর্থ নয় এবং ধারণার বিশ্লেষণ মানে অর্থের বিশ্লেষণ নয়। তাই বিভিন্ন গুণ থাকা সত্ত্বেও বাগার্থিক তত্ত্ব হিসাবে এর মুলা খুব বেশি নয়।
আরও দেখুন: