ফার্সি বর্ণমালার চর্চা ও লেখা

ফার্সি ভাষা, যা ইরান, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে ব্যবহৃত একটি সমৃদ্ধ সাহিত্যভাষা, তার নিজস্ব একটি আকর্ষণীয় ও নান্দনিক বর্ণমালা রয়েছে। এই বর্ণমালা আরবি বর্ণমালার উপর ভিত্তি করে গঠিত হলেও এতে রয়েছে কয়েকটি অতিরিক্ত বর্ণ এবং নিজস্ব উচ্চারণগত ও শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য।

ফার্সি বর্ণমালার চর্চা ও লেখা একটি শিল্প এবং একধরনের ধ্যানের মতো, বিশেষত যখন হাতে লেখা বা ক্যালিগ্রাফির বিষয় আসে।

 

ফার্সি বর্ণমালার পরিচিতি

ফার্সি ভাষায় মোট ৩২টি বর্ণ রয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি বর্ণ আরবি থেকে নেওয়া এবং ৪টি অতিরিক্ত বর্ণ ফার্সি উচ্চারণ প্রকাশের জন্য যুক্ত করা হয়েছে:

অতিরিক্ত চারটি ফার্সি বর্ণ:

  1. پ (পে)
  2. چ (চে)
  3. ژ (ঝে)
  4. گ (গাফ)

ফার্সি বর্ণমালা ডান দিক থেকে বাম দিকে লেখা হয়।

 

বর্ণ সংযোগ (Letter Connection)

ফার্সি বর্ণমালার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বর্ণ সংযোগ। অধিকাংশ বর্ণ শব্দে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়, এবং প্রতিটি বর্ণের চারটি রূপ থাকতে পারে:

  1. স্বতন্ত্র (Isolated)
  2. প্রারম্ভিক (Initial)
  3. মধ্যবর্তী (Medial)
  4. শেষ (Final)

উদাহরণ:

বর্ণনামস্বতন্ত্রপ্রারম্ভিকমধ্যবর্তীশেষ
بব্ببــبــب
نন্ننــنــن
مম্ممــمــم

তবে কিছু বর্ণ এমন আছে যেগুলো ডানে যুক্ত হলেও বামে যুক্ত হয় না। যেমন: ا (আলিফ), د (দাল), ذ (যাল), ر (রে), ز (জে) ইত্যাদি।

 

হাতে লেখা চর্চা

হাতে লেখা বা দস্তনবিশি (Calligraphy) ফার্সি ভাষায় একটি ঐতিহ্যবাহী এবং সুপ্রাচীন শিল্পধারা। এটি শুধু লেখা নয়, একধরনের সৃজনশীল চর্চা। ফার্সি হাতে লেখায় ব্যবহার হয় বিশেষ ধরনের কলম (Qalam) ও কালির।

 

দস্তনবিশির উপকরণ

ফার্সি হাতে লেখার জন্য নিচের উপকরণগুলো ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করা হয়:

  • কলম (Qalam): বাঁশ, সরু কাঠ বা খর্জুরগাছের ডাল দিয়ে তৈরি বিশেষ কাটা কলম।
  • কালি (Ink): প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি ঘন, কালো বা নীল রঙের কালি।
  • কাগজ (Kāghaz): মসৃণ, হাতে প্রস্তুত বা পালিশকৃত কাগজ যাতে কালি সহজে ছড়িয়ে না পড়ে।
  • মিজ (Meiz): হাত লেখার জন্য নির্দিষ্ট এক ধরনের ঢালু ডেস্ক।

 

ফার্সি হাতে লেখার প্রধান ধারা
১. নস্তালিক (Nastaʿlīq)
  • সর্বাধিক নান্দনিক ও কাব্যিক ধারা।
  • বক্ররেখা ও ঢালু অক্ষরের জন্য পরিচিত।
  • প্রধানত কবিতা, সাহিত্য, ও রাজকীয় দলিল লেখার জন্য ব্যবহৃত।
  • নস্তালিক লেখা তুলনামূলক কঠিন এবং ধৈর্য ও দক্ষতা দাবি করে।
২. নসখ (Naskh)
  • সহজপাঠ্য ও পরিষ্কার একটি ধারা।
  • আরবি ও ফার্সি উভয় ভাষার কোরআনিক পাঠ, পাঠ্যবই ও আনুষ্ঠানিক নথিতে ব্যবহৃত।
  • এই ধারা ফার্সি শিক্ষার্থীদের হাতে লেখা শেখার প্রাথমিক ধাপ।
৩. শিকস্তে (Shekasteh)
  • “ভাঙ্গা” বা দ্রুত লেখার রীতি হিসেবে পরিচিত।
  • এটি একটি গতিশীল ও ফ্লুইড ধারা, যেখানে অনেক সংক্ষিপ্তকরণ এবং বাঁক থাকে।
  • ব্যক্তিগত চিঠি, দাপ্তরিক নথি এবং দ্রুত লেখার প্রয়োজনীয়তায় ব্যবহৃত হতো।

 

হাতে লেখা শেখার ধাপসমূহ

হাতে লেখা শেখা একটি পদ্ধতিগত ও ধাপে ধাপে চর্চার বিষয়:

. বর্ণ চর্চা (Lette r Practice)
  • প্রতিটি বর্ণের স্বতন্ত্র রূপ চর্চা করা হয়।
  • শিক্ষার্থী শিখে কোন বর্ণ কিভাবে কলমের বিভিন্ন কৌণিক চাপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হয়।

প্রতিটি বর্ণ প্রথমে আলাদা করে লেখা শিখতে হয়। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা কলমের চাপ, কালি প্রবাহ, বর্ণের উচ্চতা ও গঠন অনুশীলন করে।

উদাহরণ:

  • ب (ব)
  • م (ম)
  • د (দ)
  • ک (ক)

এই ধাপেই কলম ধরা, হাতের ভঙ্গি, রেখার মোটা-পতলা নিয়ন্ত্রণ শেখানো হয়।

 

. বর্ণ সংযোগ (Letter Joining)
  • প্রারম্ভিক, মধ্যবর্তী ও শেষ রূপে বর্ণগুলোর যুক্ত রূপ চর্চা করা হয়।
  • এখানে কলমের কৌশল ও লাইনের ভারসাম্য শেখানো হয়।

প্রতিটি বর্ণ চারটি ভিন্ন রূপে আসতে পারে:

  • প্রারম্ভিক (Initial): শব্দের শুরুতে।
  • মধ্যবর্তী (Medial): শব্দের মাঝখানে।
  • শেষ (Final): শব্দের শেষে।
  • স্বতন্ত্র (Isolated): একক অবস্থানে।
বর্ণনামস্বতন্ত্রপ্রারম্ভিকমধ্যবর্তীশেষ
بببــبــب
نننــنــن
کککــکــک

কিছু বর্ণ যেমন ا (আলিফ), د (দাল), র (ر) — তারা শুধু ডানদিকে যুক্ত হয়, বাম দিকে নয়।

 

. শব্দ বাক্য গঠন
  • ধীরে ধীরে পূর্ণ শব্দ ও বাক্য লেখা শেখানো হয়।
  • ক্যালিগ্রাফির ভারসাম্য, সৌন্দর্যবোধ এবং লাইনের ভার মেনে কাজ করা হয়।

যখন শিক্ষার্থী বর্ণের সব রূপ আয়ত্ত করে নেয়, তখন তাদের শেখানো হয় কিভাবে একাধিক বর্ণকে যুক্ত করে শব্দ গঠন করতে হয়। এই ধাপে বর্ণ সংযোগের নিয়ম দিকনির্দেশনা অনুসরণ করা হয়

উদাহরণ:

  • بابا (বাবা) → بـ + ا + بـ + ا
  • مادر (মা) → مـ + ا + د + ر
  • دوست (বন্ধু) → د + و + سـ + ت
  • کتاب (বই) → کـ + تـ + ا + ب

এই ধাপে শিক্ষার্থী ধৈর্য, শৃঙ্খলা ও নির্ভুল বর্ণ সংযোগে দক্ষতা অর্জন করে।

 

. বাক্য ও ক্যালিগ্রাফি চর্চা / সৌন্দর্য চর্চা (Aesthetic Refinement)
  • বর্ণের ব্যাসার্ধ, আনুপাতিক দূরত্ব, এবং রেখার তীক্ষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নান্দনিকতা তৈরি হয়।
  • অভিজ্ঞ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ঢং ও অলঙ্করণও চর্চা করে।

শব্দ গঠন রপ্ত করার পর শিক্ষার্থীরা সহজ বাক্য লেখা শুরু করে। তারপর ধীরে ধীরে ক্যালিগ্রাফি বা নান্দনিকভাবে সাজানো লেখায় প্রবেশ করে।

সহজ বাক্যের উদাহরণ:

  • من دانش‌آموز هستم۔ (আমি একজন ছাত্র।)
  • این یک کتاب است۔ (এটি একটি বই।)

এই ধাপে কাগজের উপর লেখা লাইন, ভরকেন্দ্র (center of gravity), এবং বর্ণবিন্যাসে ভারসাম্য রক্ষা করতে শেখানো হয়।

৫. সঠিক ব্যাসার্ধ, রেখা ও কালি প্রয়োগ

ফার্সি ক্যালিগ্রাফির সাফল্য নির্ভর করে:

  • কলমের কোণ (angle of nib)
  • কালি প্রয়োগের ভারসাম্য
  • রেখার মোটা ও সরু বিন্যাস
  • প্রতিটি বর্ণের মাঝে যথাযথ ফাঁক রাখার উপর

এই দক্ষতা অর্জনের জন্য নিয়মিত চর্চা শিক্ষক পরামর্শ অপরিহার্য

 

দস্তনবিশি আধ্যাত্মিকতা

বহু ফার্সি ক্যালিগ্রাফার দস্তনবিশিকে শুধু লেখা নয়, বরং ধ্যান, ধৈর্য ও আত্মসংযমের একটি অনুশীলন হিসেবে বিবেচনা করেন। বিশেষত সুফি প্রভাবিত সমাজে এটি ছিল এক ধরনের আত্মশুদ্ধির পথ। কলম ও কালি ছিল একপ্রকার আধ্যাত্মিক মাধ্যম, যা দিয়ে লেখা হতো প্রেম, প্রকৃতি ও স্রষ্টার বন্দনা।

ফার্সি বর্ণমালার সৌন্দর্য ও কাঠামোগত বৈচিত্র্য এর লেখনরীতিতে একটি গভীর শৈল্পিকতা ও যুক্তির ছাপ রাখে। প্রতিটি বর্ণ বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ভিন্ন রূপ ধারণ করে – স্বতন্ত্রভাবে, শব্দের শুরুতে, মধ্যখানে বা শেষে। তাই প্রতিটি রূপ আলাদাভাবে চর্চা করা একজন শিক্ষার্থীর জন্য অত্যন্ত জরুরি, বিশেষত যারা হাতে লেখা ও ক্যালিগ্রাফিতে দক্ষতা অর্জন করতে চান।

Leave a Comment