Site icon Language Gurukul [ ভাষা গুরুকুল ] GOLN

ফার্সি ভাষার ইতিহাস: এক প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা

ফার্সি বর্ণমালা

ফার্সি ভাষা, যা পারস্য বা ইরানেও “পার্সি” এবং “ফারসি” নামে পরিচিত, একটি ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষা যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত। এটি আজকের ইরান, আফগানিস্তান (যেখানে এটি দারি নামে পরিচিত), ও তাজিকিস্তানে (যেখানে এটি তাজিক নামে পরিচিত) অন্যতম প্রধান ভাষা হিসেবে প্রচলিত। হাজার বছরের ইতিহাসজুড়ে ফার্সি ভাষা কেবল একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং এটি ছিল সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস ও প্রশাসনের ভাষা।

 

প্রাচীন ফার্সি (Old Persian) – খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে ৩য় শতাব্দী

প্রাচীন ফার্সি ভাষা (Old Persian) হল ফার্সি ভাষার প্রাচীনতম রূপ, যা আকেমেনিড সাম্রাজ্যের সময় (খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ থেকে ৩য় শতাব্দী) ব্যবহৃত হত। এটি মূলত একটি রাজকীয় ভাষা ছিল, যা প্রশাসনিক আদেশ, যুদ্ধজয়, ও সম্রাটদের কীর্তি তুলে ধরার জন্য ব্যবহৃত হত। এটি পারস্য সভ্যতার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের একটি প্রাথমিক দলিল।

 

ভাষার উৎপত্তি ব্যবহার

Old Persian ছিল ইন্দো-ইরানিয়ান শাখার একটি ভাষা, যার ব্যবহার শুরু হয় দারিয়ুস মহান (Darius the Great)-এর শাসনামলে (খ্রিস্টপূর্ব ৫২২–৪৮৬)। এটি আকেমেনিড রাজাদের রাজকীয় ভাষা হিসেবে পরিচিত হয় এবং পারস্য সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক নথিপত্রে ব্যবহৃত হত।

ভাষাটি বিশেষ করে ব্যবহৃত হয়:

 

লিপি লেখনশৈলী

Old Persian ভাষা লেখা হত একটি বিশেষ কিউনিফর্ম (Cuneiform) লিপিতে, যা মূলত খোদাই করা হত পাথরের ওপর। এটি মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন কিউনিফর্ম থেকে ভিন্ন একটি সরলকৃত লিপি, যাতে ছিল মাত্র ৩৬টি ধ্বনিতাত্ত্বিক চিহ্ন এবং কিছু সংখ্যা ও শব্দ-চিহ্ন।

এই লিপি ব্যবহারের মাধ্যমে লিখিত ভাষাকে সাধারণ মানুষের জন্য তুলনামূলকভাবে আরও বোধগম্য করা হয়, কারণ প্রাচীন সুমেরীয় বা অ্যাকাডিয়ান কিউনিফর্ম অনেক বেশি জটিল ছিল।

 

বেহিস্তুন শিলালিপি (Behistun Inscription)

Old Persian ভাষার সবচেয়ে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হল বেহিস্তুন শিলালিপি। এটি খ্রিস্টপূর্ব ৫২০ সালে দারিয়ুস মহান-এর আদেশে খোদাই করা হয় ইরানের কর্দিস্তান প্রদেশের বেহিস্তুন পর্বতে।

শিলালিপিটি ৩টি ভাষায় লেখা ছিল:

এটি আকেমেনিড সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস, বিদ্রোহ দমন এবং দারিয়ুসের জয়যাত্রার বিস্তারিত বিবরণ দেয়। ভাষা ইতিহাসবিদদের মতে, এই শিলালিপিটি ঠিক যেমনটি রোজেটা পাথর মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ ডিকোড করতে সাহায্য করেছিল, তেমনি Behistun Inscription Old Persian ও সমসাময়িক ভাষা বোঝার জন্য এক যুগান্তকারী অনুসন্ধান হিসেবে কাজ করে।

 

ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্ব

Old Persian ভাষা তার:

দিয়ে ঐ সময়ের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করে। এ ভাষা থেকেই পরবর্তীকালে Middle Persian ও Modern Persian ভাষার বিকাশ ঘটে।

 

প্রাচীন ফার্সি ভাষা শুধু পারস্য সাম্রাজ্যের শাসনপদ্ধতি নয়, বরং ইরানীয় সভ্যতার বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের এক মূল স্তম্ভ। আজও ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণায় এর ভূমিকা অপরিসীম।

 

মধ্য ফার্সি (Middle Persian / Pahlavi) – ৩য় শতাব্দী থেকে ৮ম শতাব্দী

মধ্য ফার্সি, যা পেহলভি ভাষা নামে অধিক পরিচিত, ছিল সাসানীয় সাম্রাজ্যের (২২৪৬৫১ খ্রি.) প্রশাসনিক ও সাহিত্যিক ভাষা। এটি ছিল প্রাচীন ফার্সির (Old Persian) উত্তরসূরি এবং আধুনিক ফার্সির (New Persian) পূর্বসূরি। এই ভাষার মাধ্যমে ফার্সি ভাষার এক নতুন যুগ সূচিত হয়, যেখানে ধর্মীয়, দার্শনিক ও রাজার আদেশ-নির্দেশ মিলিয়ে ভাষার প্রয়োগ বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে।

 

পেহলভি ভাষার বৈশিষ্ট্য

 

ধর্মীয় দার্শনিক সাহিত্য

মধ্য ফার্সি যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল জরথুস্ট্রীয় ধর্মীয় সাহিত্যের সংকলন ব্যাখ্যা। জরথুস্ট্র ধর্মের মূল গ্রন্থ অভেস্তা (Avesta) এর বিভিন্ন ব্যাখ্যামূলক টেক্সট ও ধর্মীয় আচার-বিধির সংকলন পেহলভি ভাষায় রচিত হয়। এই ধর্মীয় সাহিত্যের কিছু বিখ্যাত রচনা হল:

এসব গ্রন্থ মধ্যযুগীয় ফার্সি দার্শনিক ধারণার ভিত্তি গড়ে তোলে এবং ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।

 

প্রশাসনিক ঐতিহাসিক দলিল

সাসানীয় সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে মধ্য ফার্সি ব্যবহার হতো রাজনৈতিক দলিল, আইন, প্রজ্ঞাপন রাজ্য চুক্তিপত্রে। এ সময় রাজাদের রাজ্যাভিষেক ঘোষণাপত্র, মুদ্রা (coin inscriptions), ও রাজদরবারের নানা দলিলে মধ্য ফার্সি ব্যবহৃত হয়।

প্রসিদ্ধ রাজা শাপুর I খসরু আনুশিরওয়ান (Khosrow I Anushirvan)-এর সময় এই ভাষার ব্যবহার প্রশাসনিক নথিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে।

 

সাহিত্য সংস্কৃতি

যদিও ধর্মীয় সাহিত্যের আধিক্য ছিল, তবুও মধ্য ফার্সি যুগে কাহিনীভিত্তিক সাহিত্য, প্রবাদ, লোকগাথা গল্প চর্চাও দেখা যায়। অনেক পেহলভি রচনাই পরবর্তীতে আরবি ও আধুনিক ফার্সিতে অনুবাদ হয়ে ইসলামি যুগের ফার্সি সাহিত্যের ভিত্তি গড়ে তোলে।

এ সময়ে শাহনামা-র কাহিনির অনেক উপাদান মৌখিকভাবে প্রচলিত থাকলেও সেগুলোর ভিত্তিমূল পাওয়া যায় মধ্য ফার্সি সাহিত্যেই। এসব কাহিনি পরবর্তীতে ফেরদৌসীর বিখ্যাত মহাকাব্যে রূপ নেয়।

 

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

মধ্য ফার্সি যুগ ছিল এক সাংস্কৃতিক রূপান্তরের কাল। এটি একদিকে যেমন ধর্মীয় ভাবধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, তেমনি ভাষার বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। এই যুগেই ফার্সি ভাষা একটি পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য ও প্রশাসনিক ভাষায় পরিণত হয়, যার ভিত্তির উপর গড়ে উঠেছিল পরবর্তী ইসলামী ফার্সি সাহিত্য ও প্রশাসনিক ধারা।

 

মধ্য ফার্সি ছিল এক পরিণত ও গতিশীল ভাষা, যা ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেছিল। এর মাধ্যমে গড়ে ওঠা সাহিত্যের ধারা পরবর্তীতে আধুনিক ফার্সিকে সমৃদ্ধ করে এবং ফার্সিভাষার বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্যতাকে সুদৃঢ় ভিত্তি দেয়।

 

আধুনিক ফার্সি (New Persian) – ৯ম শতাব্দী থেকে বর্তমান

আধুনিক ফার্সি ভাষা বা দারী ফারসি”, ইসলামী বিজয়ের পরে গঠিত ফার্সি ভাষার একটি উন্নত ও পরিশীলিত রূপ, যা ৯ম শতাব্দী থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মধ্য ফার্সির (Pahlavi) স্থলাভিষিক্ত হয়ে এই ভাষার বিকাশ ঘটে বিশেষত ইসলামী সভ্যতার প্রভাব ও আরবি ভাষার সংস্পর্শে এসে। আধুনিক ফার্সি ভাষার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর আরবি লিপিতে রূপান্তর, ভাষাভাণ্ডারে আরবি শব্দের ব্যাপক অন্তর্ভুক্তি, এবং একই সঙ্গে মূল ইরানীয় গঠনরীতি বজায় রেখে একটি বিশুদ্ধ কাব্যিক দার্শনিক ভাষায় পরিণত হওয়া।

 

ভাষার রূপান্তর ও বৈশিষ্ট্য

 

️ সাহিত্য ও কবিতার স্বর্ণযুগ

১. রুদকি (Rudaki) – আধুনিক ফার্সি কাব্যধারার পিতা

রুদকি ছিলেন সমরকন্দের রাজকবি এবং আধুনিক ফার্সি ভাষায় প্রথম মৌলিক কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর কবিতায় সুর, অনুভূতি ও সরলতা একত্রিত হয়ে এক নতুন সাহিত্যধারা সূচনা করে। তিনি প্রায় ১,৩০,০০০ শ্লোক রচনা করেন, যদিও অল্পসংখ্যকই আজও বিদ্যমান।

২. আবুল কাসেম ফিরদৌসী (Ferdowsi) – “শাহনামা মহাকবি

শাহনামা” (অর্থাৎ রাজাদের কাহিনি) ছিল প্রায় ৬০,০০০ ছন্দের এক মহাকাব্য, যেখানে প্রাক-ইসলামিক ইরানের পৌরাণিক ইতিহাস ও বীরগাথার গৌরবগাথা তুলে ধরা হয়। ফিরদৌসী এই গ্রন্থে প্রায় এক হাজার বছর আগেকার পারস্য সংস্কৃতি ও পরিচয় পুনরুদ্ধার করেন।

তার কাজটি শুধু সাহিত্য নয়, বরং এক জাতীয় ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন হিসেবে বিবেচিত।

৩. সাআদী (Saadi), হাফেজ (Hafez) উমর খৈয়াম (Omar Khayyam)

৪. জালাল উদ্দিন রূমী (Rumi) – সুফিবাদের বিশ্বদূত

রূমীর রচনাসমগ্র, বিশেষ করে মসনবী-ই-মা’নভী”, সুফি দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য। তাঁর ভাষা ফার্সি হলেও, দর্শন ও মরমী কাব্যে তাঁর প্রভাব তুর্কি, উর্দু, বাংলাসহ বিশ্বের বহু ভাষায় বিস্তৃত। তাঁর কবিতা প্রেম, আত্মা ও ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্ককে গভীরভাবে অনুসন্ধান করে।

 

আধুনিক যুগে ফার্সির বিস্তার

আধুনিক ফার্সি শুধু ইরানেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আফগানিস্তানে দারি”, এবং তাজিকিস্তানে তাজিক” নামে প্রচলিত। ভারত, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার বহু অঞ্চলে ফার্সি প্রভাব এখনো সাহিত্য, সংগীত, ধর্মীয় রচনায় বিদ্যমান।

ফার্সি সাহিত্য পশ্চিমা অনুবাদকদের হাত ধরে আজও বহুজাতিক পাঠক-সমাজে আদৃত। রুমির কবিতা আমেরিকার সর্বাধিক বিক্রীত কবিতাসংকলনের মধ্যে একটি।

 

আধুনিক ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য হাজার বছরের ঐতিহ্য বহন করে এমন এক সাংস্কৃতিক শক্তি, যা আজও বিশ্বের শিল্প, ধর্ম, দর্শন ও চিন্তাচর্চায় প্রাসঙ্গিক। ভাষা গুরুকুলের ফার্সি কোর্সে এই ভাষার কাব্যময় রূপ, তার ব্যাকরণ ও ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হয়ে শিক্ষার্থীরা লাভ করতে পারবেন একটি জীবন্ত ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা।

 

ফার্সির বিস্তারউপমহাদেশ মধ্য এশিয়া

ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং পারস্যের সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফলে ফার্সি ভাষা উপমহাদেশ, মধ্য এশিয়া, এমনকি আনাতোলিয়া ও ককেশাস অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। ভারতবর্ষে মুঘল আমলে ফার্সি ছিল রাজকীয় ও প্রশাসনিক ভাষা। দিল্লি, লাহোর, আগ্রা, হায়দ্রাবাদে ফার্সি সাহিত্যের চর্চা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক দলিল, যেমন আকবরনামা, শেরশাহনামা ইত্যাদি, ফার্সি ভাষায় লেখা। মুঘল আমলে ফার্সি ছিল কবিতা, ইতিহাস ও রাজনীতি চর্চার প্রধান মাধ্যম।

বর্তমানে ফার্সি ভাষা আধুনিক প্রযুক্তি, মিডিয়া, চলচ্চিত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ভাষাগত পার্থক্য (যেমন দারি ও তাজিক) থাকলেও মূলত একে একটি অভিন্ন ভাষা হিসেবে ধরা হয়।

 

ফার্সি ভাষা শুধু একটি ভাষা নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার যা কবিতা, ইতিহাস, ধর্ম ও দর্শনের মাধ্যমে পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। ভাষা গুরুকুলের এই কোর্সের মাধ্যমে আপনি শুধু একটি ভাষা নয়, বরং হাজার বছরের এক জীবনচর্চার সঙ্গে পরিচিত হবেন।

Exit mobile version