বাংলা ছোটগল্প

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলা ছোটগল্প

বাংলা ছোটগল্প

 

বাংলা ছোটগল্প

 

বাংলা ছোটগল্প

সংজ্ঞার্থ

গল্প বলা এবং শোনার প্রবণতা মানুষের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যমান থাকলেও সাহিত্যরূপ হিসেবে ছোটগল্পের সৃষ্টি ঊনবিংশ শতাব্দীতে। অর্থাৎ ছোটগল্প সাহিত্যের কনিষ্ঠতম আঙ্গিক। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, এমন কি প্রবন্ধেরও পরে ছোট গল্পের সৃষ্টি। ইংরেজি Story শব্দটির অর্থ ব্যাপক ও বিচিত্র; যেমন, রূপকথা, প্রাচীনকাহিনী, ঘটনার বিবরণ, কল্পিত কাহিনী, সংবাদ, বিবৃতি, গল্প কিংবা উপন্যাস ও নাটকের কাহিনী ইত্যাদি।

এই Story শব্দটি ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। ছোটগল্প শব্দবন্ধটিকে আমরা ইংরেজি Short Story শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রহণ করেছি। গল্প শব্দটির অর্থ অনুধাবন যতোটা সহজ, সাহিত্যরূপ হিসেবে ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ নির্ণয় ততোটা সহজ কাজ নয়। আমরা জানি, মানুষের আদিম বৃত্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো গল্প বলা এবং শোনা। সেই বৃত্তি ইতিহাসের পথ ধরে উনিশ শতকের শেষার্ধে এসে সাহিত্যিকের সচেতন মনোযোগের বিষয়ে পরিণত হয়।

উপন্যাসের মধ্যে আমরা জীবনের ব্যাপক গভীর পরিস্থিতির রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু ছোটগল্পে ঘটে একান্ত পরিস্থিতির রূপায়ণ। কিন্তু কেবল আকৃতির পার্থক্য দিয়ে ছোটগল্প ও উপন্যাসের স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করা যাবে না। ঘটনাংশ, চরিত্র, দৃষ্টিকোণ, পরিচর্যারীতির যথাযথ বিন্যাস দুটো সাহিত্যরূপের জন্যই অনিবার্য। কোনো কোনো ছোটগল্প আয়তনের দিক থেকে উপন্যাসের সমমাপেরও হতে পারে।

সুতরাং এ-দুয়ের পার্থক্য নিরূপণের জন্য আমাদেরকে এর প্রকৃতি ও মর্মগত বিভিন্নতার স্বরূপ সন্ধান করতে হয়। বহুমুখীঘটনা, বিচিত্র চরিত্র, সমাজ ও সময়ের বিশাল পট উপন্যাসে মানবজীবনের পরিপূর্ণতা (Entirety) সৃষ্টির লক্ষে গৃহীত হয়। আর ছোটগল্প এই বিশাল জীবনেরই একটা অংশের সমগ্রতা (Totality) ঘটনা, চরিত্র, দৃষ্টিকোণ ও পরিচর্যারীতির দক্ষ বিন্যাসে সৃজন করা হয়।

এই Totality বা সমগ্রতা শব্দটি উপন্যাসের স্বভাব নির্দেশের ক্ষেত্রেও কোনো কোনো সমালোচক প্রয়োগ করেছেন। আমরা দুটি সাহিত্যরূপের পার্থক্য নির্দেশের প্রশ্নে পরিপূর্ণতা ও সমগ্রতা শব্দদ্বয় ব্যবহার করছি। উদ্ভব পর্যায়ের ছোটগল্প রচয়িতাদের মধ্যে এডগার এ্যালান পো-ই (১৮০৯-১৮৪৯ ) প্রথম লেখক যিনি ছোটগল্প রচনা ও তার সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ে মনোযোগী হয়েছিলেন।

সাধারণ পাঠকের জন্য সাময়িক পত্রিকা যে গল্পরস সৃষ্টি করে, পো তাকেই বিশিষ্ট শিল্প-আঙ্গিকের মর্যাদায় উন্নীত করেন। কবিতা, নাটক ও উপন্যাসের মতো ছোটগল্পের মধ্যেও তিনি প্রত্যক্ষ করেন পরিপূর্ণ শিল্পরূপের লক্ষণ। আধুনিক বুদ্ধিমান পাঠক তার সক্ষম সংবেদনশীলতা দিয়ে যে ছোটগল্প উপভোগ করতে পারেন, এ ধারণাকেও তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন। ছোটগল্প আয়তনে ছোট হলেও যে কাঠামোসর্বস্ব নয়, এধারণাকে তিনি ভুল প্রমাণ করলেন।

বিষয় ও আঙ্গিকের সতর্ক বিন্যাসে ছোটগল্প একটি জৈব-সমগ্ররূপ প্রাপ্ত হয়। ঘটনা ছোটগল্পের আবশ্যক উপাদান বটে, কিন্তু ঘটনার পর ঘটনার উপস্থাপনা ছোটগল্প নয়। বরং একটি নির্দিষ্ট ভাবের কার্যকারণ-সম্মত বিন্যাস চরিত্রের কর্ম ও চিন্তার মধ্য দিয়ে ছোটগল্পে রূপ লাভ করে । ঘটনাংশ বা Plot সাহিত্যের প্রতিটি রূপেরই (Form) আবশ্যিক উপাদান।

কিন্তু ছোটগল্প উদ্ভবের কালে অন্যান্য সাহিত্যরূপেও ঘটনা অপেক্ষা ঘটনার কার্যকারণ কিংবা ঘটনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর সব ছোটগত্মকারের মধ্যেই এ-বিষয়ে মনোযোগ ও সতর্কতা লক্ষ করা যায়। বিষয়বস্তু বা ভাবের সঙ্গে এভাবেই ঘটনার ঐক্য নিরূপিত হয়। এডগার এ্যালান পো-র ভাবনা অনুসারে ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যকে তিনটি প্রধান সূত্রে চিহ্নিত করা যেতে পারে:

১. ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পাঠককে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দান করা (A sense of the fullest satisfaction), আনন্দ দান করা ।

২. ছোটগল্প একটি মানবিক শিল্পরূপ – শিল্পীর জীবনবিন্যাসের ব্যাখ্যা এবং অভিজ্ঞতার ঐক্যবদ্ধ সংহত রূপ ।

৩. ঘটনাংশ, চরিত্র, পরিবেশ, ঘটনান্তর্গত ভাবসূত্র — এগুলোর সমন্বয়ে ছোটগল্প এক ঐক্যময় শিল্পরূপ।

সময় ও মানবিক রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছোটগল্পের রূপরীতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এডগার এ্যালান পো-র সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ক সূত্রগুলো এখানে প্রাসঙ্গিক। ব্রান্ডার ম্যাথিউজ তাঁর ‘Philosophy of the short story’ (১৮৮৪) প্রবন্ধে ছোটগল্পের স্বরূপ নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন: A short story deals with a single character, a single event, a single emotion, or the series of emotions cotted forth by a single situation.

‘Single’ শব্দের পৌনঃপুনিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ম্যাথিউজ পো উচ্চারিত ঐক্যের ধারণাকেই স্বীকার করে নিলেন। এরপর বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধব্যাপী ছোটগল্পের রূপরীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। তার বিষয় ও আঙ্গিকের ধারণারও এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। কোনো কোনো সমালোচক ছোটগল্পকে জীবনের Sketch বা খসড়া হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।

চিত্রকলার ‘স্কেচ’ এবং ছোটগল্প যে এক জিনিস নয়, এ সত্যটি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত হলো হার্শেল ব্রিকেল রচিত ‘What happend to the short story, (১৯৫১) প্রবন্ধে। তিনি সঙ্গত কারণেই বললেন স্কেচের বৈশিষ্ট্য স্থিতিশীলতা আর ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য গতিশীল। আয়তন বা আকৃতির ছোটো-বড় দিয়ে নয়, বিষয়ের মধ্যে বড় কোন ব্যঞ্জনা এবং সমগ্রতা সৃষ্টি হলো কি-না সেটাই সার্থক ছোটগল্পের স্বভাবধর্ম।

এ-প্রসঙ্গে পাঠক্রম-ভুক্ত ‘একরাত্রি’ গল্পটির উল্লেখ করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রথম পর্যায়ের এই ছোটগল্পে ঘটনা, চরিত্র, পরিবেশ এবং ঘটনান্তর্গত ভাবসূত্রকে নিবিড় সংহত রূপ দিয়েছেন। নোয়াখালির প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেকেন্ড মাষ্টারের স্মৃতিকথনে গল্পের বিষয়বস্তু উন্মোচিত হয়েছে।

সুরবালা নাম্মী এক বালিকার সঙ্গে তার শৈশব- কৈশোরের সম্পর্ক, পরে মাটশিনী-গারিবালডি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কলকাতায় গমন, সমাজ ও দেশোদ্ধারের প্রত্যাশায় যৌবনের উজ্জ্বল সৃষ্টিশীল মুহূর্তগুলোর অপচয় এবং শেষে একটি সাধারণ বিদ্যালয়ের সেকেন্ড মাষ্টার হওয়ার ঘটনাক্রম অন্তর্ময় ভঙ্গিতে বিধৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যর্থতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।

এ-গল্পে ঘটনা কিংবা চরিত্র কোনোটাই প্রাধান্য পায়নি। সবকিছু মিলিয়ে এক নিবিড় ঐক্যবদ্ধ গল্পরূপ সৃষ্টি হয়েছে। এ- গল্পকে জীবনের খন্ডাংশের রূপায়ণ বলা যাবে না। বরং জীবনের অন্বিষ্ট ভাববস্তুকে একটি চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে সমগ্র আয়তনে তুলে ধরা হয়েছে। স্কেচ বা খসড়া জীবন ধরা দেয় অস্পষ্ট ব্যঞ্জনাহীন অবস্থায়। কিন্তু ছোটগল্পে ক্ষণকালীন জীবনের মধ্যেও সৃষ্টি হয় চিরকালীন ব্যঞ্জনা।

‘একরাত্রি’ গল্পের শেষে প্রলয়ংকরী রাত্রের অন্ধকারে সেকেন্ড মাষ্টার ও সুরবালার পাশাপাশি অবস্থান সত্ত্বেও যে একাকিত্ব, নৈঃসঙ্গ্য ও বিচ্ছিন্নতাকে তুলে ধরা হয়েছে, তার ব্যঞ্জনা চিরকালীন। উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ের প্রশ্নে আমরা বলতে পারি, ছোটগল্প এমন এক ধরনের সাহিত্যরূপ, যা নির্দিষ্ট ঘটনাংশকে আশ্রয় করে চরিত্র, পরিবেশ ও ভাবসূত্রের মধ্যে নিবিড় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে।

এই ভাবসূত্র কখনো গভীর কাব্যিক ব্যঞ্জনায়, কখনো বা নাটকীয় মুহূর্তের উজ্জ্বলতায় আবার কখনো কখনো মানব-মনস্তত্ত্ব বিশেষণের গভীরতায় নিবিড় রসরূপ লাভ করে। ছোটগল্পের উপকরণ জীবনের যে-কোনো ক্ষেত্র থেকে গৃহীত হতে পারে। কিন্তু জীবনের যে অংশ লেখকের অন্বিষ্ঠ, তাকে সমগ্র রূপে উপস্থাপন করা সার্থক ছোটগল্পের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

ছোটগল্পের গঠন কৌশল

উপন্যাস এবং ছোটগল্পের প্রকরণের পরিভাষা অভিন্ন। যেমন, দৃষ্টিকোণ ( Point of view), ঘটনাংশ (Plot), চরিত্রায়ণ (Characterization), পরিচর্যা (Treatment) প্রভৃতি। কোনো ছোটগল্পকে সমগ্র জৈব-ঐক্যে (Organic whole) রূপ পেতে হলে উলিখিত আঙ্গিক-উপাদানের ব্যবহার আবশ্যিক।

মানুষের বহির্জীবন কিংবা অন্তর্জীবনের যে-কোন ক্ষেত্র থেকে ছোটগল্পের উপকরণ আহৃত হতে পারে। নির্মম কঠিন বাস্তব জগৎ, মানবমনের জটিল রহস্য, সংকট ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বহমান জীবনের যে-কোন প্রসঙ্গকে গল্পকার গল্পের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। দৃষ্টিকোণ হচ্ছে জীবনকে দেখা এবং উপস্থাপন করার বিশেষ ভঙ্গি।

ছোটগল্পে বিধৃত ঘটনা, চরিত্র ও আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গ যখন গত্মকার নিরাসক্তভাবে উপস্থাপন করেন, তখন প্রয়োগ ঘটে সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণের (Author’s omniscient point of view) । নায়ক, কেন্দ্রীয় চরিত্র কিংবা গল্পবিধৃত কোনো চরিত্রের কথকতায় গল্পের ঘটনা বর্ণিত হলে, তা বলা হয় উত্তম পুরুষের দৃষ্টিকোণ (First person’s point of view)। এক্ষেত্রে সমগ্র গল্প ‘আমি’ নামক বক্তার দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত হয়।

আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় লেখক কিংবা কেন্দ্রীয় চরিত্র (নায়ক অথবা কথক চরিত্র- (Teller character) ছাড়াও ঘটনার প্রান্তে অবস্থানকারী কোনো চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পের কাহিনী উপস্থাপিত হয়। এ-পদ্ধতিকে বলা হয় প্রান্তিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ (peripheried character’s point of view)। বি.এ/বি.এস.এস প্রোগ্রামের পাঠক্রমভুক্ত ‘একরাত্রি’ গল্পটি শুরু হয়েছে এ-ভাবে
“সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি, এবং বউ-বউ খেলিয়াছি।

তাহাদের বাড়িতে গেলে সুরবালার মা আমাকে বড়ো যত্ন করিতেন এবং আমাদের দুইজনকে একত্র করিয়া আপনা-আপনি বলাবলি করিতেন, ‘আহা, দুটিতে বেশ মানায়।” গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কোনো এক স্কুলের সেকেন্ড মাষ্টারের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। উত্তম পুরুষে গল্পের ঘটনা, চরিত্র, চরিত্রের অন্তর্জগৎ, পরিবেশ-পরিস্থিতি উপস্থাপন করতে লেখককে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়।

সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ অপেক্ষা কথক চরিত্রের মাধ্যমে সাফল্যের সঙ্গে ঘটনা বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের দক্ষতা অতুলনীয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্প সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত। সমাজ ও মানুষের জীবনের যে অনালোকিত প্রাপ্ত এ-গল্পে উন্মোচিত হয়েছে, লেখকের জীবনাভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য ও গভীরতা ছাড়া তা সম্ভব ছিলো না। ভিখু, পাঁচী ও বশিরের চরিত্রের গতিবিধি ও অন্তর্জগৎ অবলোকনের জন্য লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণের প্রয়োগই যথার্থ ।

প্লট (Plot) বলতে আমরা সাধারণত উপন্যাস, নাটক বা গল্পবিধৃত ঘটনাকে বুঝি। ইতিহাসেও তো ঘটনা থাকে। তাকে তো প্লট বলি না, গল্প হিসেবেও চিহ্নিত করিনা। এর কারণ ইতিহাস হলো ঘটে যাওয়ার কাহিনীর বিবরণমাত্র। আর গল্প- উপন্যাসের ঘটনা সময়ের শৃঙ্খলা অনুসারে বিন্যস্ত হয়। এ-কারণেই প্লটকে বলা হয় কার্যকারণ-সম্বন্ধযুক্ত সময়ের বিন্যাস। গল্পবিধৃত চরিত্রও সেই সময়ের মধ্য দিয়ে বহমান।

বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাস

সাহিত্যরূপ হিসেবে ছোটগল্পের উদ্ভব ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটগল্পের প্রথম ও প্রধান শিল্পী হলেও তাঁর পূর্বে পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বর্ণকুমারী দেবী, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত- – প্রমুখ লেখক গল্পরচনায় পটভূমি প্রস্তুত করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭) নামক অনুবাদ গ্রন্থটির ঘটনা উপস্থাপনায় গল্পরসের পরিচয় পাওয়া যায়।

বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব, বিকাশ ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অতুলনীয়। কেননা, ছোটগল্প যে একটি স্বতন্ত্র সাহিতরূপ (Literary form) এই ধারণাটি রবীন্দ্রনাথের গল্পেই প্রথম ধরা পড়ে। ইতোপূর্বে যাঁরা ছোটগল্প রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তারা কাহিনী বর্ণনার মধ্যেই পরিতৃপ্তি সন্ধান করেছেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের ‘ভিখারিণী’ গল্পটি ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

মাত্র ষোল বছর বয়সে রচিত এই গল্পে ছোটগল্পের বিষয়বস্তু, রূপ ও রীতির সমস্ত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এরপর ১৮৯১ সাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে রবীন্দ্রনাথ ৯৩টি ছোটগল্প এবং আরো কিছু গল্পধর্মী সাহিত্যরূপ সৃষ্টি করেছেন। ঊনবিংশ শতব্দীতেই রবীন্দ্রনাথ ৫০ এর অধিক ছোটগল্প রচনা করেন। যার মধ্যে ‘পোষ্টমাষ্টার’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন,’ ‘কঙ্কাল’, ‘একরাত্রি’, ‘কাবুলিয়ালা’, ‘শাস্তি,’ ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘অতিথি’র মতো গল্প রয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল থেকে রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্বমানে পৌঁছে দেন। বিষয় বৈচিত্র্য ও আঙ্গিকের অভিনবত্বে পৃথিবীর আর কোনো গত্মকারকে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ মনে করা যায় না। ‘নষ্টনীড়,’ ‘হৈমন্তী,’ ‘স্ত্রীরপত্র,’ ‘পয়লা নম্বর, ‘ল্যাবরেটরি’ প্রভৃতি গল্পে রবীন্দ্রনাথের অতুলনীয় সৃষ্টিসামর্থ্যের পরিচয় মেলে।

 

বাংলা ছোটগল্প

 

রবীন্দ্রনাথের পর যাঁরা বাংলা ছোটগল্প রচনায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬- ১৯৩৮), প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬), ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৬২), প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। শরত্চন্দ্রের গল্প অভিজ্ঞতার দিক থেকে অভিনব হলেও রূপরীতি বিচারে রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য নয়। প্রমথ চৌধুরী ও ধূর্জটিপ্রসাদ মননশীল জীবনচেতনাকে ছোটগল্পের উপাদানে পরিণত করেন।

এ সময়ই আবির্ভূত হন আরো কয়েকজন ক্ষমতাধর গল্প লেখক। এঁরা হলেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, (১৮৪৭-১৯১৯), প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৪৯-১৯৩২), রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০), ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৯-১৯১১), সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪) প্রমুখ । প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বাঙালির জীবনচেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে, তার প্রতিফলন ছোটগল্পেও অনিবার্য হয়ে ওঠে।

প্রচলিত মূল্যবোধ, নারী-পুরুষের সম্পর্কের ধারণা, সংস্কার ও বিশ্বাস নতুন ধারার গাকারদের নিকট তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। এ-সময়ে উদ্ভূত গল্পলেখকদের মধ্যে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত (১৮৮২-১৯৬৪), মনীন্দ্রলাল বসু (১৮৯৭-১৯৮৬), দীনেশরঞ্জন দাশ (১৮৮৮-১৯৪১), গোকুলচন্দ্র নাগ (১৮৯৪-১৯২৫), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৭), প্রবোধকুমার সান্যাল (১৯০৫-১৯৬৭),

জগদীশচন্দ্র গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭), বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০০-১৯৬৭), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতা, সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র, নারীপুরুষের সম্পর্কের জটিলতা, ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন, সুস্পষ্ট রাজনৈতিক আদর্শনিষ্ঠা এ-সময়ের গল্পের বৈশিষ্ট্য। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক ছোটগল্পের অবয়বে মানবজীবনের দৈহিক ও মানসিক সম্পর্কের জটিল দিকগুলোকে সূক্ষ্মদৃষ্টিতে উপস্থাপন করেছেন।

দীনেশরঞ্জন দাশ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ লেখক জীবনের বাস্তব চিত্র, রাজনৈতিক আদর্শ ও জিজ্ঞাসাকে ছোটগল্পে রূপ দিলেন। বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় চিরচেনা জীবন থেকে উপকরণ আহরণ করলেও অভিজ্ঞতা ও বিন্যাসের অভিনবত্বে তাঁদের গল্প বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। গল্পের বিষয়বস্তুর মতো আঙ্গিক-নিরীক্ষায়ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর গল্পলেখকরা সচেতনভাবে মনোনিবেশ করলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের গল্পলেখকদের ব্যতিক্রমী জীবনদৃষ্টি ও বিষয়ভাবনার সমান্তরালে উপাদান ও উপস্থাপনার অভিনবত্বে আরো একটি স্বতন্ত্র গল্পের ধারা লক্ষ করা যায়। এই ধারার গল্পকাররা হলেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৮৭), বনফুল ওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯), শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯), সজনীকান্ত দাস (১৯০০-১৯৬২), মনোজ বসু (১৯০১-১৯৮৭),

প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-১৯৮৫), অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০১-১৯৯৯), শিবরাম চক্রবর্তী (১৯০৫), গজেন্দ্রকুমার মিত্র (১৯০৮), আশাপূর্ণা দেবী (১৯০৯) প্রমুখ । কৌতুক- হাস্যরস ও বিদ্রূপ এঁদের গল্পের উপজীব্য হলেও জীবনের বর্ণনা অপেক্ষা বিশেষণকেই তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তীকালে আবির্ভ ত গল্প লেখকদের মধ্যে সুবোধ ঘোষ (১৯১০-১৯৭০), নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬-১৯৭৫),

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী (১৯১২-১৯৮২), সন্তোষকুমার ঘোষ (১৯২০-১৯৮৫), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০), সোমেন চন্দ্র (১৯২০-১৯৪২) উলেখযোগ্য। সমাজ-অভিজ্ঞতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ছোটগল্পের বিষয় ও রীতির ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে,, উলিখিত লেখকদের গল্পে তার প্রমাণ সুস্পষ্ট।

বাংলাদেশের ছোটগল্প

ভৌগোলিক-সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ড আদিকাল থেকেই ছিলো স্বতন্ত্র। মূলত নদীমাতৃক ও ভূমিনির্ভর এই দেশ ও তার জনগোষ্ঠী জীবনোপকরণ, জীবনযাপন ও অস্তিত্ব সাধনায় গোড়া থেকেই বাস্তবমুখী ও সংগ্রামশীল।

উনিশ শতকে ইংরেজি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিক্ষার প্রভাবে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে ভৌগোলিক অবস্থান ও ইংরেজ রাজশক্তির অসহযোগিতার ফলে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশ)তা ঘটেনি। এ-দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যাত্রা শুরু হয় বিংশ শতাব্দীতে । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে এই মধ্যবিত্তশ্রেণী চেতনা ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হতে শুরু করে।

যে-কারণে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশবিভাগের পূর্বেই এ-দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সাহিত্যসাধনার স্বতন্ত্র পটভূমি রচনায় সমর্থ হয়। এ-পর্যায়ের গল্পকারদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৯), সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ (১৯২২-১৯৭১) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

এ-ভূখন্ডের স্বতন্ত্র জীবনধারা, অস্তিত্ববিন্যাস, মানবসম্পর্ক প্রভৃতি এই গল্পলেখকদের মুখ্য উপজীব্য। উলিখিত গল্পকারদের অনেকেই দেশ বিভাগের পরও গল্পচর্চা করেছেন। কেবল কলকাতা-কেন্দ্রিক ছোটগল্প নয়, বিশ্বমানের ছোটগল্প রচনায়ও যে কেউ কেউ পারদর্শী ছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বস্তুসংক্ষেপ:

ছোটগল্প এমন এক ধরনের সাহিত্যরূপ যা নির্দিষ্ট ঘটনাংশকে আশ্রয় করে চরিত্র, পরিবেশ ও ভাবসূত্রের মধ্যে নিবিড় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। এই ভাবসূত্র কখনো গভীর কাব্যিক ব্যঞ্জনায়, কখনো বা নাটকীয় মুহূর্তের উজ্জ্বলতায়, আবার কখনো কখনো মানব-মনস্তত্ব বিশেষণের গভীরতায় নিবিড় রসরূপ লাভ করে। ছোট গল্পের উপকরণ জীবনের যে কোন ক্ষেত্র থেকে গৃহীত হতে পারে।

কিন্তু জীবনের যে অংশ লেখকের অন্বিষ্ঠ, তাকে সমগ্র রূপে উপস্থাপন করা সার্থক ছোটগল্পের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

 

বাংলা ছোটগল্প

 

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

সংক্ষিপ্ত-উত্তরমূলক প্রশ্ন

১. ছোটগল্প কাকে বলে?

২. ছোটগল্পের সঙ্গে উপন্যাসের মৌলিক পার্থক্য কোথায়?

৩. ছোটগল্পের গঠনবৈশিষ্ট্য আলোচনা করুন।

৪. প্রবণতা অনুসারে ছোটগল্পের শ্রেণীকরণ করুন। ৫. বাংলা ছোটগল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বিবৃত করুন।

রচনামূলক প্রশ্ন

১. ছোটগল্পের গঠনকৌশল সম্বন্ধে যা জানেন লিখুন ।

২. ছোটগল্পের রূপবৈচিত্র্য বিষয়ে আলোচনা করুন।

আরও দেখুন :

 

Leave a Comment