বাংলা প্রবন্ধ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলা প্রবন্ধ

বাংলা প্রবন্ধ

 

বাংলা প্রবন্ধ

বাংলা প্রবন্ধ

সংজ্ঞার্থ

সাহিত্যের অন্যান্য রূপ নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, প্রবন্ধ নিয়ে এতোটা হয়নি। এর কারণ সম্ভবত এই যে কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প এবং নাটককেই সাহিত্যের সৃষ্টিশীল আঙ্গিক মনে করা হয়। অবস্থান-বিচারে কোনো কোনো সমালোচক প্রবন্ধকে দ্বিতীয় শ্রেণীর সাহিত্যরূপ (Literary Form) মনে করেন। কিন্তু আধুনিককালে মানুষের বুদ্ধি, যুক্তি এবং চিন্তানির্ভরতা প্রবন্ধের প্রাসঙ্গিকতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রবন্ধ বলতে আমরা সাধারণত এমন এক ধরনের গদ্য রচনাকে বুঝি, যা আলোচনার মাধ্যমে কোনো বিশেষ বক্তব্য, দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা বিষয়-অন্তর্গত বক্তব্যকে উপস্থাপন করে— চিন্তা এবং যুক্তির পরস্পর মিলনে পাঠককে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সহায়তা করে। ইংরেজি Essay-র প্রতিশব্দ হিসেবে প্রবন্ধকে গ্রহণ করে থাকেন অনেকে। কিন্তু বাংলা ভাষায় প্রবন্ধের ক্ষেত্র ইংরেজি Essay-র তুলনায় ব্যাপক।

ইংরেজিতে Treatise, discourse বা dissertation জাতীয় রচনার সঙ্গে প্রবন্ধের পার্থক্য বিদ্যামান। ওই তিনটি সংজ্ঞায় বিশেষ ধরনের নিয়মতান্ত্রিক’ ও ‘সম্পূর্ণ’ বিষয়োম্মোচন বোঝায়— যে নিয়মের শাসন বা সম্পূর্ণতা প্রবন্ধের ক্ষেত্রে সব সময় মেনে চলা হয় না।’ আরও উলেখ্য যে, Treatise বা dissertation জাতীয় রচনা নির্দিষ্ট ‘সীমাবদ্ধ’ পাঠকশ্রেণীর জন্য রচিত হয়। কিন্তু প্রবন্ধ রচিত হয় ‘সাধারণ পাঠকের দিকে লক্ষ রেখে।

এ-কারণে বিষয় বা পরিভাষার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো নীতিও মেনে চলে না প্রবন্ধ । বরং বক্তব্য বা বিষয় উপস্থাপনের প্রয়োজনে কখনো গল্প, কখনো দৃষ্টান্ত, কখনো কৌতুক, আবার কখনো সূক্ষ্ম-অনুভূতি প্রয়োগের মাধ্যমে পাঠকের বুদ্ধি ও যুক্তিকে জাগ্রত করাই প্রবন্ধের লক্ষ্য।

প্রবন্ধের রূপগত বৈশিষ্ট্য

ইংরেজিতে যেমন Essay-র সমধর্মী বেশ কিছু পরিভাষা— যেমন Treatise, dissertatorn, dircouse) রয়েছে, বাংলা ভাষায়ও অনরূপ কিছু শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। যেমন— নিবন্ধ, সন্দর্ভ, প্রস্তাব প্রভৃতি। এই শব্দগুলোর প্রয়োগ সংস্কৃত সাহিত্য এবং প্রাচীন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে লক্ষ করা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যচর্চার ক্ষেত্রে উক্ত শব্দগুলো বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছেন লেখকরা।

কোনো গ্রন্থের টীকা অর্থে ‘নিবন্ধ’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো সংস্কৃত সাহিত্যে, ‘সন্দর্ভ’ শব্দটির অর্থ সম্যকরূপে গ্রন্থন, রচনা বা সংগ্রহ। উনিশ শতকে বাংলা গদ্যসৃষ্টির সূচনাপর্বে ব্যাখ্যানমূলক, বিতর্কমূলক ও বর্ণনামূলক রচনাকে ‘প্রস্তাব’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ মনীষীরা তাঁদের বিভিন্নধর্মী গদ্যরচনাকে ‘প্রস্তাব’ নামে চিহ্নিত করতেন।

রামগতি ন্যায়রত্ন ‘প্রস্তাব’ শব্দটিকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস-ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছিলেন। উনিশ শতকের সত্তর দশক থেকেই মূলত গভীর চিন্তা, ব্যাখ্যা ও বিশেষণমূলক গদ্যরচনাকে প্রবন্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করা শুরু হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা গদ্যরচনার সংকলনের নাম দেওয়া হয় প্রবন্ধপুস্তক (১৮৭৯)। প্রবন্ধ শব্দটির আভিধানিক অর্থ (প্রকৃষ্ট রূপে বন্ধন) থেকেই এর রূপগত বৈশিষ্ট্য নিরূপণের চেষ্টা হয়েছে।

কিন্তু সময়ের বিবর্তনে প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ও রূপসৃষ্টির ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে। এক সময় মনে করা হতো যুক্তি ও মননশীলতার প্রয়োগে সৃজনশীল মৌলিক শিল্পকর্মসমূহকে (যেমন, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প) মানুষের বোধের আয়ত্বে নিয়ে আসা প্রবন্ধের অন্যতম একটি কাজ। মানুষের জীবনের অন্যান্য প্রসঙ্গ যেমন সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, দর্শন, নন্দনতত্ত্ব, বিজ্ঞান, শিক্ষা— এগুলোও প্রবন্ধ সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত।

কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে প্রবন্ধরূপী এমন কিছু সৃষ্টি বিভিন্ন কালে হয়েছে, যেগুলো অনেকটা মৌলিক সৃষ্টি কর্মের পর্যায়ভুক্ত। প্লেটোর Dialogue কিংবা এ্যারিস্টটলের Poetics গ্রন্থ দুটি মৌলিক কোনো সাহিত্যকর্মের পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু অনেক মৌলিক সৃষ্টির চাইতে তার প্রাসঙ্গিকতা এখনো পর্যন্ত বিদ্যমান। সাহিত্যবিচারের মৌলিক মানদন্ডের মতো এগুলো যে ভাবীকালেও গ্রহণীয় থাকবে সে-বিষয়ে কোনা সন্দেহ নেই।

 

বাংলা প্রবন্ধ

 

প্রবন্ধের শ্রেণীবিভাগ

বিষয়ের প্রকৃতি ও উপস্থাপন-বৈশিষ্ট্য বিচারে প্রবন্ধকে প্রধানত দুটি শ্রেণীভুক্ত করা হয়:

১. বস্তুনিষ্ঠ বা তন্ময় প্রবন্ধ (Formal or Informative Essay)

২. ভাবনিষ্ঠ বা মন্ময় প্রবন্ধ (Familiar of Intimate Essay)

বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে লেখক নিরাসক্তভাবে বিষয়ের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে যুক্তিশৃঙ্খলার মাধ্যমে গভীরভাবে বিষয় বিশেষণ করেন। চিন্তাশীল অনুসন্ধানী পাঠক এ-জাতীয় প্রবন্ধের অনুরাগী। বঙ্কিমবন্দ্রের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ Formal প্রবন্ধের গোত্রভুক্ত।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘প্রবন্ধপুস্তক’ বা ‘বিবিধ প্রবন্ধ’, জ্যোতিরিন্দ্র নাথের ‘প্রবন্ধমঞ্জুরী’, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘নানা প্রবন্ধ’, শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘প্রবন্ধাবলী’, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রবন্ধমালা’, ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ ও ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’, কাজী মোতাহের হোসেনের ‘সংস্কৃতি কথা’, মুনীর চৌধুরীর ‘বাংলা গদ্যরীতি’ বস্তুনিষ্ট প্রবন্ধ বা Formal Essay-র দৃষ্টান্ত।

ভাবনিষ্ট মন্ময় প্রবন্ধকে ব্যক্তিগত প্রবন্ধ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। এজন্যেই এ-জাতীয় প্রবন্ধের শ্রেণীকরণে Familior of Personal শব্দগুলো প্রয়োগ করা হয়। এ-ধরনের প্রবন্ধে বিষয়বস্তু অপেক্ষা লেখক পাঠককেই বেশি গুরুত্ব দেন লেখক। নিজ অনুভূতিকে পাঠকের অনুভূতি ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান।

বলা যায়, এ-জাতীয় প্রবন্ধে লেখকের ব্যক্তিসত্তার ‘আত্মপ্রকাশ ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ ও ‘লোক রহস্য’, রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ এ-জাতীয় প্রবন্ধের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ।

বাংলাদেশের প্রবন্ধ

বাংলাদেশের প্রবন্ধের পটভূমি তৈরি হয় বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৯২১) পরিএগুলে। মুসলিম সাহিত্য সমাজ ‘লিখা’ পত্রিকার (১২৬৯) মাধ্যমে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের চর্চা করতে গিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজ আধুনিক বুদ্ধি ও গভীর চিন্তা সম্বলিত প্রবন্ধ রচনায় মনোনিবেশ করেন।

এ-পর্যায়ের লেখকদের মদ্যে কাজী আবদুল ওদুদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আব্দুল কাদির, আবুল ফজল প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কাজী মোতাহার হোসেন, মুহাম্মদ এনামুল হক ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পূর্বেই বাংলাদেশ- কেন্দ্রিক স্বতন্ত্র প্রবন্ধশৈলীর ভিত্তি তৈরি করেন।

১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পর নতুন সামাজিক-রাষ্ট্রিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রাবন্ধিকগণ সাহিত্যবিচারের পাশাপাশি সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়েও প্রবন্ধ রচনা শুরু করেন। এ-সময়ের নবোদ্ভূত প্রাবন্ধিকদের মধ্যে আবু জাফর শামসুদ্দীন, রনেশ দাশ গুপ্ত, শওকত ওসমান, আবদুল হক, সৈয়দ আলী আহসান, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, আহম্মদ রফিক, আনোয়ার পাশা, আহমদ শরীফ, হাসান হাফিজুর রহমান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিচিত্র পরিসরে এই সব প্রাবন্ধিকের চিন্তা ও অনুভূতি পরিভ্রমণ করেছে। এঁদের অব্যবহিত পরে প্রবন্ধ রচনায় মনোনিবেশ করেন বদরুদ্দীন উমর, আবদুল হাফিজ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আহমেদ হুমায়ুন, মোহাম্মদ মাহফুজউলাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখ। এঁদের প্রায় সকলেই বিচিত্র বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন।

ষাটের দশকের নবোদ্ভূত প্রাবন্ধিকেরা প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ও ভাষারীতির ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা সঞ্চারে মনোযোগী হন। এ-ধারার প্রাবন্ধিকদের মধ্যে আবদুলাহ আবু সায়ীদ, হায়াৎ মামুদ, আহমদ ছফা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ আকরম হোসেন, শামসুজ্জামান খান, আবুল কাসেম ফজলুল হক, হুমায়ুন আজাদ উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রবন্ধের রূপ ও রীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এঁদের অবদান এখনো পর্যন্ত গতিশীল ও বৈচিত্র্যময়।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের প্রবন্ধ নিত্যনতুন চিন্তা ও চেতনায় সমৃদ্ধি লাভ করেছে। বিশ্বসাহিত্যের অনুভূতি ও চিন্তাস্রোতের সঙ্গে সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সাহিত্যের পর্যবেক্ষণেও নিত্যনতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে ।

বস্তুসংক্ষেপ

প্রবন্ধ বলতে আমরা সাধারণত এমন এক ধরনের গদ্য রচনাকে বুঝি, যা আলোচনার মাধ্যমে কোন বিশেষ বক্তব্য, দৃষ্টি- ভঙ্গি কিংবা বিষয়-অন্তর্গত বক্তব্যকে উপস্থাপন করে —–চিন্তা এবং যুক্তির পরস্পর মিলনে পাঠককে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সহায়তা করে। প্রবন্ধ রচিত হয় ‘সাধারণ পাঠকের দিকে লক্ষ্য রেখে। এ-কারণে প্রবন্ধ বিষয় বা পরিভাষার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন নীতিও মেনে চলে না।

বরং বক্তব্য বা বিষয় উপস্থাপনের প্রয়োজনে কখনো গল্প, কখনো দৃষ্টান্ত, কখনো কৌতুক, আবার কখনো সূক্ষ্ম-অনুভূতি প্রয়োগের মাধ্যমে পাঠকের বুদ্ধি ও যুক্তিকে জাগ্রত করাই প্রবন্ধের লক্ষ্য।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

রচনামূলক প্রশ্ন

১. প্রবন্ধের রূপগত বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে যা জানেন বিস্তারিত লিখুন।

২. প্রবন্ধ কাকে বলে? প্রবন্ধের শ্রেণীবিভাগ আলোচনা করুন

 

বাংলা প্রবন্ধ

 

সংক্ষিপ্ত-উত্তরমূলক প্রশ্ন

১. প্রবন্ধ কাকে বলে?

২. প্রবন্ধকে কি মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টির পর্যায়ভুক্ত করা যায়?

৩. প্রবন্ধের শ্রেণীকরণ করুন।

৫. বাংলাদেশের প্রবন্ধের ধারা বর্ণনা করুন।

আরও দেখুন :

 

Leave a Comment