বাগর্থিক আপেক্ষিকতা বনাম বাগথিক সার্বজনীনতা

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-বাগর্থিক আপেক্ষিকতা বনাম বাগথিক সার্বজনীনতা

বাগর্থিক আপেক্ষিকতা বনাম বাগথিক সার্বজনীনতা

বাগধিক আপেক্ষিকতা অনুসারে প্রতিটি ভাষা সম্প্রদায়ের ধারণাগত সংগঠন ভিন্ন। ভাষাসমূহের মধ্যে বাহ্যিক অমিল যেমন রয়েছে আভ্যন্তরীণ অমিলও তেমনি রয়েছে। ভাষার উপর রয়েছে সংস্কৃতির প্রভাব। যেহেতু একেক ভাষার উপর একেক সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে, তাই প্রতিটি ভাষা ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতার পরিচয়বাহী।

মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী বোয়াস, ব্লুমফিল্ড, হকেট প্রমুখের লেখায় বাগার্থিক আপেক্ষিকতার সমর্থন পাওয়া যায় । তবে বাগার্থিক আপেক্ষিকতার সবচেয়ে বড় দাবি হাজির করেন এডওয়ার্ড সাপির এবং বেঞ্জামিন লী হোয় যাদের প্রস্তাবনা একসাথে সাপির দোয়া প্রকল্প নামে নামে প্রসিদ্ধ।

সাপির এবং হোয়াপ দাবি করেন যে প্রতিটি ভাষা তার নিজস্ব জগত সৃষ্টি করে, ফলে প্রতিটি ভাষার বার্ষিক সংগঠনও স্বতন্ত্র। যেহেতু ভাষার মাধ্যমে মানুষ জগতকে উপলব্ধি করে ও জগত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাই দুটি ভাষা সম্প্রদায়ের জগতদৃষ্টি ভিন্ন হতে বাধ্য।

 

বাগর্থিক আপেক্ষিকতা বনাম বাগথিক সার্বজনীনতা

 

বাগধিক আপেক্ষিকতাবাদীরা বর্ণবিষয়ক শব্দাবলী ও জাতিবিষয়ক শব্দাবলীর মাধ্যমে তাদের দাবির যথার্থতা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পান। একই বর্ণালীকে বিভিন্ন ভাষা বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে, ফলে বিভিন্ন ভাষার বর্ণবিষয়ক শব্দবলীও ভিন্ন। প্রতিটি ভাষার প্রতিবিষয়ক শব্দাবলীও স্বতন্ত্র, কারণ একের ভাষা একেক সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্থাপিত ।

রাগধিক আপেক্ষিকতার বিরুদ্ধ মতবাদ হলো বাগধিক সার্বজনীনতা। রাগধিক সার্বজনীনতাবাদীরা বাগধিক আপেক্ষিকতার বিরোধিতা করে বলেন যে সকল ভাষার অন্তর্গত ধারণাগত সংগঠন অভিন্ন । ধারণাগত সংগঠনকে একেক ভাষা একেকভাবে রূপায়িত করে, ফলে বাহ্যিক অবয়বে ভাষায় ভাষায় পার্থক্য সূচিত হয় ।

বাগধিক সার্বজনীনতার পক্ষে আছেন গ্রীনবার্গ, চমস্কি, ক্যাটজ প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানী (Lehrer 1974 150) বাগধিক সার্বজনীনতার উপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন স্বদেশ (১৯৭২) এবং ডিয়ার্ত গণিকা (১৯৮০)। এখানে আমরা তাদের মতবাদ সংক্ষেপে আলোচনা করবো।

 

বাগর্থিক আপেক্ষিকতা বনাম বাগথিক সার্বজনীনতা

 

স্বদেশ সর্বপ্রথম ২০০ মৌলিক ধারণার একটি তালিকা তৈরী করেন এবং বলেন যে এই ধারণাগুলো সকল ভাষায় বিদ্যমান। এটি বিভিন্ন আন্তভাষিক গবেষণায় কাজে লাগানো হয় এবং দেখা যায় যে এর অনেকগুলিই সঠিক অর্থে সার্বজনীন নয়। ফলে ধারণার সংখ্যা নেমে আসে ১০০ তে (Hatch & Brown 1995 117 ) । নীচে আমরা স্বদেশের কাটছাট করা তালিকাটি তুলে ধরছি বাংলা শব্দ দ্বারা

১.আমি

২. তুমি

৩. আমরা

৪. এই

৫. ঐ

৬ কে

৭ কি

৮. না

৯.সকল

১০. অনেক

১১. এক

১২. দুই

১৩. বড়

১৪ লম্বা

১৫. ছোট

১৬. মেয়ে

১৭. ছেলে

১৮. ব্যক্তি

১৯. মাছ

২০. পাখি

২১ কুকুর

২২. উকুন

২৩ গাছ

২৪ বীজ

২৫. পাতা

২৬. মূল

২৭. ছাল

২৮. চামড়া

২৯. মাংস

৩০. রক্ত

৩১. হাড়

৩২. তেল

৩৩. ডিম

৩৪. শিং

৩৫. লেজ

৩৬. চর্ম (প্রক্রিয়াজাত পশু চামড়া)

৩৭. চুল

৩৮. মাথা

৩৯ কান

৪০. চোখ

৪১. নাক

৪২. মুখ

৪৩. দাঁত

৪৪. জিহবা

৪৫. নখ

৪৬.পাঁ

৪৭. হাঁটু

৪৮.. হাত

৪৯ পেট

৫০. গলা

৫১. বুক

৫২. হৃদয়

৫৩. কলিজা

৫৪ পান করা

৫৫. খাওয়া

৫৬. কামড়ানো

৫৭ দেখা

৫৮. শোনা

৫৯. জানা

৬০. ঘুমানো

৬১. মরে যাওয়া

৬২. হত্যা করা

৬৩ সাঁতড়ানো

৬৪ ওড়া

৬৫. হাঁটা

৬৬. আসা

৬৭. শোয়া

৬৮. বসা

৬৯. দাঁড়ানো

৭০. দেয়া

৭১. বলা

৭২. সূর্য

৭৩. চাঁদ

৭৪. তারা

৭৫. জল

৭৬. বৃষ্টি

৭৭ পাথর

৭৮. বালি

৭৯. মাটি

৮০. মেঘ

৮১. ধোঁয়া

৮২. আগুন

৮৩ ছাই

৮৪. পোড়া/পোড়ানো

৮৫. পথ

৮৬ পর্বত

৮৭. লাল

৮৮. সবুজ

৮৯ হলুদ

১০. সাদা

১১. কালো

১২. রাত

১৩. গরম

১৪. ঠান্ডা

৯৫. পূর্ণ

১৬ নতুন

৯৭. ভালো

৯৮. গোল

১৯. শুকনা/ শুষ্ক

১০০. নাম

আমাদের এখানে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয় যে আমরা কোন শব্দের তালিকা উপস্থিত করেছি, এটি ধারণার তালিকা যা শব্দে প্রকাশ করা হয়েছে । স্বদেশের দাবি অনুসারে প্রতিটি ভাষাতেই এই ধারণাগুলো প্রকাশের জন্য একক শব্দ রয়েছে। যেমন বাংলা ভাষায় আমরা ধারণাগুলোকে একক শব্দ দ্বারা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছি । শুধু আমরা দুই জায়গায় (৩৬ ও ৮৪) একটু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি ।

ইংরেজীসহ অন্যান্য কিছু ভাষা যারা মানুষের চামড়া ও পশুর চামড়ার মধ্যে পার্থক্য করে এবং দুটি ভিন্ন শব্দের মাধ্যমে তা প্রকাশ করে (যেমন ইংরেজীর ক্ষেত্রে skin/leather), বাংলা ভাষায় সেখানে দুটি ধারণার জন্য একটিমাত্র শব্দ রয়েছে চামড়া – (আমরা তালিকায় পশুর চামড়াকে চর্ম বলেছি দুটি ধারণার পার্থক্য বোঝানোর জন্য; কিন্তু বাস্তবে বাংলা ভাষায় শব্দদুটি পরস্পরের পরিবর্তে ব্যবহৃত হতে পারে) ।

বাংলা ভাষায় পোড়া ও পোড়ানো শব্দদুটি দুই ভিন্ন ধারণাকে প্রকাশ করে; ব্যাকরণিক বিশ্লেষণে প্রথমটি অকর্মক ও দ্বিতীয়টি সকর্মক ক্রিয়া। কিন্তু ইংরেজী ভাষায় দুটি ধারণাই bum শব্দ দ্বারা প্রকাশিত হয় । আমরা নিশ্চিত নই তালিকায় burn বলতে কোন বিশেষ ধারণাকে বোঝানো হয়েছে। তবে এটি নিশ্চিত যে শব্দটি একসাথে দুটি ধারণা বোঝাতে তালিকায় ব্যবহৃত হতে পারে না ।

কারণ তাহলে স্বদেশের সার্বজনীনতার সংজ্ঞা অনুসারে এটি আর মৌলিক ধারণা থাকে না। কাজেই আমরা মনে করি তালিকার ৮৪ নম্বর ধারণাটি আরো স্পষ্ট করে বর্ণনা করা প্রয়োজন ।
ভিয়াসবিকা বাগৰ্থিক সার্বজনীনতা নিয়ে বিশ বৎসর গবেষণা করেন। তিনি বলেন যে ধারণাগত সংগঠনের মূলে রয়েছে ১৩টি আদিম যা আর ক্ষুদ্র পর্যায়ে বিভক্ত করা যায় না এবং এই ১৩টি আদিম দিয়ে অন্যান্য সব ধারণার বিশ্লেষণ করা যায় ।

এই ১৩টি আদিম ও তাদের বিভিন্ন মাত্রায় মিশ্রণ নিয়ে গঠিত হয় প্রাকৃতিক বাগার্থিক অধিভাষা। ভিয়ার্তসবিকার ১৩টি মৌলিক বাগার্থিক আদিম নিম্নরূপ :

I (আমি)

you (তুমি)

world (পৃথিবী)

want (চাওয়া

someone (কেউ) something (কিছু) this (এই) not want (না চাওয়া) think of (কোনকিছু নিয়ে ভাবা imagine

(কল্পনা করা be part of (অংশ হওয়া)

say (বলা)

become (হওয়া)

এই ১৩টি আদিম এবং প্রাকৃতিক প্রজাতির নামসমূহ (যেমন কুকুর, আপেল) ব্যবহার করে ভাষার যে কোন ধারণার অর্থ নির্ধারণ করা সম্ভব এবং ভিয়ার্তসবিকার দাবি অনুসারে এতে অর্থ বিশ্লেষণের চক্রক অনুপপত্তি এড়ানো সম্ভব হয় । তিনি অ্যাপ্রোজান (১৯৭৪) -এর উক্তিতে তার দাবির সমর্থন খুঁজে পান :

“একটি অর্থ যতো প্রাথমিক পর্যায়ের হয় ততোই তার বিভিন্ন ভাষায় একক শব্দে প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় : প্রাথমিক অর্থগুলো স্পষ্টতঃই পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষায় একক শব্দে প্রকাশিত হয় । প্রাথমিক অর্থগুলোর সংমিশ্রনের স্তরেই কেবল বিভিন্ন ভাষায় বাগধিক সংশয়ের বৈচিত্র্য ও অসমতা সৃষ্টি হয়।”

স্বদেশ ও ভিয়ার্তসবিকার তত্ত্ব নিঃসন্দেহে বাগধিক সার্বজনীনতার পক্ষে জোরালো দাবি উপস্থাপন করে । কিছু বাগার্থিক সার্বজনীনতার যে কোন উদ্যোগ সফল হতে হলে তাকে বাগধিক আপেক্ষিকতার দাবিসমূহ অপ্রমান করতে হবে। কিন্তু সে লক্ষ্য অর্জনে জটিলতা রয়েই গেছে।

 

বাগর্থিক আপেক্ষিকতা বনাম বাগথিক সার্বজনীনতা

 

ভাষা এবং ভাষাব্যবহারকারীর উপর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রভাবকে সহজে নাকচ করা যায় না। বার্লিন ও কে (১৯৩৯) বিশটি ভাষা ও তাদের ভাষাব্যবহারকারীদের নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে যদিও ঐ সমস্ত ভাষায় বর্ণবিষয়ক শব্দাবলী ভিন্ন তথাপি যারা সেসব ব্যবহার করেন তাদের বর্ণ সম্পর্কে ইন্দ্রিয়নুভূতি একই রকম।

একটি ভাষায় কোন বিশেষ বর্ণের জন্য শব্দ না থাকলেও ভাষাব্যবহারকারীরা ঐ বর্ণের সাথে অন্য বর্ণের পার্থক্য সনাক্ত করতে পরে । অর্থাৎ ধারণাগত পর্যায়ে সবার জ্ঞানই এক। কিন্তু নৃতত্ত্ববিদদের জাতি আপেক্ষিকতার বিরুদ্ধে এখনো কোন বড় চ্যালেঞ্জ গড়ে উঠেনি। এই অবস্থায় আমরা বলতে পারি বাগাধিক আপেক্ষিকতা ও সার্বজনীনতা উভয়ই অংশত বৈধ ও অংশত অবৈধ ।

আরও দেখুন:

 

Leave a Comment