আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-ব্যাখ্যামূলক বাগর্থবিদ্যা ক্যাটজ ও ফোত্তরের তত্ত্ব
ব্যাখ্যামূলক বাগর্থবিদ্যা ক্যাটজ ও ফোত্তরের তত্ত্ব
ব্যাখ্যামূলক বাগথবিদ্যার মূল বিষয়টি ছিল বাক্যের অর্থ ব্যাখ্যাত হবে উপরি সংগঠনে গভীর সংগঠন থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে। নীচে ব্যাখ্যামূলক বাগর্থবিদ্যার প্রধান প্রবক্তাদের তত্ত্বসমূহ সংক্ষেপে আলোচিত হলো।
ক্যাটজ ও ফোডরের তত্ত্ব: ক্যাটজ ও ফোডর (১৯৬৩) -এর মতে বাগার্থিক তত্ত্বের লক্ষ্য হলো মানুষের ভাষিক যোগ্যতার বিশেষ দিক যা অর্থের উপলব্ধি বা নির্ধারণের সাথে যুক্ত তার ব্যাখ্যা প্রদান করা। একটি বাগার্থিক তত্ত্ব নিম্নলিখিত উপায়ে বক্তাদের অর্থনির্ধারনমূলক ক্ষমতার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করে থাকে (Katz & Fodor 1963: 169):
১. কোন বাক্যের অর্থ কি ও কয়টি তা নির্ধারণের মাধ্যমে,
২. বাগার্থিক অসামসা সনাক্তকরণের মাধ্যমে,
৩. বিভিন্ন বাকাসমূহের মধ্যে বাক্যান্তর সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে, এবং
৪. অন্য যে কোন বাগার্থিক বৈশিষ্ট্য বা
সম্পর্ক যা ব্যাখ্যামূলক ক্ষমতায় কোন ভূমিকা রাখে তা চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে।
ক্যাটজ ও ফোডর ভাষার বাগধিক বর্ণনার জন্য দুই ধরনের উপাদানের কথা বলেন একটি অভিধান এবং – একগুচ্ছ প্রক্ষেপন নিয়ম ।
অভিধানে শব্দ বা এন্ট্রির অর্থের বর্ণনা থাকে এবং প্রক্ষেপন নিয়মে সেই শব্দগুলো কিভাবে ব্যকরণসম্মতভাবে স্বার্থকতা উৎপাদন না করে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হবে তার বর্ণনা থাকে ।
ক্যাটজ ও ফোডরের মতে প্রতিটি এন্ট্রিতে থাকে :
(১) একটি বাক্যিক শ্রেণীকরণ,
(২) একটি বাগধিক বর্ণনা, ও
(৩) তার ব্যবহারগত সঙ্গতির বিবৃতি ।
বা্যিক শ্রেণীকরণে অন্তর্ভুক্ত থাকে বাক্যতাত্ত্বিক চিহ্নকের একটি অনুক্রম, যেমন বিশেষা, বিশেষ্য মূর্ত, ক্রিয়া, ক্রিয়া সকর্মক ইত্যাদি। বাগধিক বর্ণনায় অন্তর্ভুক্ত থাকে বাগাধিক চিহ্নকের একটি অনুক্রম যার উপর প্রক্ষেপন নিয়ম ক্রিয়া করে দ্ব্যর্থকতা হ্রাস করে । একটি এস্টির অনেকার্থকতা বাগধিক চিহ্নকের (বাচি) পথে শাখাবিভক্তির আকারে প্রকাশিত হয়, যেমন :
বাংলা ভাষার অভিধান থেকে এবার আমরা কিশোর শব্দটিকে বিশ্লেষণ করতে পারি। ব্যাকরণিকভাবে এটি বিশেষ্য (যেমন- দুরন্ত কিশোর) অথবা বিশেষণ (যেমন- কিশোর বয়স / উপন্যাস) হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। বাগধিকভাবে এটি মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে মানুষ প্রাপ্তবয়স্কও নয়, শিশুও নয় (আমরা লিঙ্গভেদ উপেক্ষা করছি)। ফলে আমরা লিখতে পারি :
এবার যদি আমরা একটি কিশোর দৌড়াচ্ছে এই বাক্যের কিশোরের কথা ধরি তাহলে দেখবো এখানে কিশোর বাক্যের বা বাকাস্থ ক্রিয়ার কর্তা । বাক্যের অন্তর্গত শব্দসমূহের অর্থ বর্ণনায় সময় তাই এরূপ তথ্যও বাগধিক চিহ্নকের সাথে উল্লেখ করা প্রয়োজন। ফলে আলোচ্য বাক্যে কিশোর এর অর্থের বর্ণনা হবে এরকম :
কিশোর বিশেষ্য (মানব) (অপ্রাপ্তবয়স্ক) (অশিশু) < উদ্দেশ্য >
কৌণিক বন্ধনীর ভিতর আবদ্ধ এ ধরনের নিয়মকে বলা হয় সঙ্গতিবিধি। কাজেই দেখা যায় কোন শব্দের বাক্যতাত্ত্বিক ও বাগধিক চিহ্নক, এবং সঙ্গতিবিধি শব্দটির বাক্যে ব্যবহারের উপর কিছু বিধিবিধান আরোপ করে যাতে শব্দের সমবায়ে সুনির্দিষ্ট অর্থযুক্ত ব্যকরণসম্মত বাক্য তৈরী হয়।
প্রক্ষেপন নিয়মের সাহায্যে এই বিধিবিধান আরো নিশ্চিত হয়। এবার প্রক্ষেপন নিয়ম কিভাবে কাজ করে দেখা যাক। বিশ্লেষণের জন্য আমরা The man hits the colourful ball এই ইংরেজী বাক্যটি নিতে পারি। এর বাক্যতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় এতে The man উদ্দেশ্য এবং hits the colourful ball বিষেয়।
উদ্দেশ্য গঠিত একটি ডিটারমিনার ও একটি মূর্ত বিশেষ্য সহযোগে। বিষেয়টি একটি ক্রিয়া শব্দগুচ্ছ যা একটি সকর্মক ক্রিয়া ও একটি বিশেষ্য শব্দগুচ্ছ নিয়ে গঠিত । বিশেষ্য শব্দগুচ্ছটি আবার একটি ডিটারমিনার, একটি বিশেষণ ও একটি মূর্ত বিশেষ্য নিয়ে গঠিত। বাক্যটির গঠনচিত্র এভাবে দেখানো যায় :
কাজেই আমরা প্রান্তিক গ্রন্থি হিসাবে পাচ্ছি – The man, hits, the colourful, ball । এই শব্দগুলো যাতে অব্যাকরণসম্মতভাবে সম্মিলিত না হয় তার জন্য রয়েছে উপশ্রেণীকরণ নিয়ম, যেমন :
S → NP + VP
VP→ V+NP
NP (Det) + (Adj) + N
V→→→ hits
N→ man, ball
Adj→ colourful
Det the
এই নিয়মগুলো অব্যকরণসম্মত বাক্যের উৎপাদন রোধ করে বটে, কিন্তু এগুলো অসমাস বাক্যের উৎপাদন রোধ করতে পারে না। ফলে উক্ত নিয়মগুলো লঙ্ঘন না করেও আমরা এ ধরনের বাকা পাই (এগুলো এই অর্থে অসন্ত্রাস যে এগুলো আমাদের কাম্য বাকা নয়) :
The ball hits the colourful man.
The colourful ball hits the man. The colourful man hits the ball
এ ধরনের বাক্যের উৎপাদন রোধ করে আমাদের কাম্য বাক্যটি পেতে হলে যা করতে হবে তাহলো প্রতিটি শব্দের বাগধিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা। যেমন বলা প্রয়োজন hit এখানে অস্বেচ্ছাকৃত আঘাত বোঝাচ্ছে, colourful এখানে বস্তুর চাকচিক্য বোঝাচ্ছে ইত্যাদি। যেমন ক্যাটজ ও ফোডর দেখান :
(বর্ণ) → [রঙচঙে] <নিষ্প্রাণ ভৌত ক
colourful বিশেষণ <
(মূল্যায়ন) → [বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ] <নান্দনিক বস্তু>
hits ক্রিয়া সকর্মক ক্রিয়া (কাজ) (তাৎক্ষণিকতা) →
[সংঘর্ষ হওয়া] <উদ্দেশ্য : [ভৌত বস্তু], কর্ম : [ভৌত বস্তু]> *[আঘাত করা] <উদ্দেশ্য : [ মানুষ বা উচ্চস্তরের প্রাণী), কর্ম : [ভৌতবস্তু]>
এখানে দেখা যায় কোন কোন বাগার্থিক বৈশিষ্ট্য প্রথম বন্ধনীর ভিতর এবং কোনো কোনোটি চৌকো বন্ধনীর ভিতর আবদ্ধ । কড়াকড়িভাবে বললে, প্রথম শ্রেণীর বাগধিক বৈশিষ্ট্যগুলো হলো বাগধিক চিহ্নক এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর বাগার্থিক বৈশিষ্ট্য গুলো হলো প্রভেদক যা শব্দের স্বাতন্ত্রিকতার নির্দেশক ।
যাহোক, এভাবে শব্দপথ দেখানো থাকলে নির্দিষ্ট বাক্যের জন্য শব্দের নির্দিষ্ট অর্থ বেছে নেয়া যায়, যার ফলে অনাকাঙ্খিত বাক্যের উৎপাদন বন্ধ হয়। যেমন এক্ষেত্রে আমরা hits এর জন্য বেছে নেবো দ্বিতীয় পথটি এবং colourful এর জন্য বেছে নেবো প্রথম পথটি, যার ফলে বাক্যের উদ্দেশ্যরূপে ball আসতে পারবে না এবং man এর সাথে colourful ব্যবহৃত হতে পারবে না। তার ফলেই কেবল আমরা আমাদের নির্দিষ্ট অর্থযুক্ত ব্যাকরণসম্মত কাম্য বাক্যটি লাভ করবো ।
ক্যাটিজ ও ফোডর (১৯৬৩) এভাবেই বাক্যের অর্থের একটি মোটামুটি সুষ্ঠু ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এই তত্ত্বের উপর এরপর কাজ করেন ক্যাটজ ও পোস্টাল (১৯৬৪)। তারা বলেন যে গভীর সংগঠন হলো একটি বাক্যের বাগধিক ব্যাখ্যার জন্য যে সব মালমশলা প্রয়োজন তার চিত্রায়ন।
এর ফলে গভীর সংগঠন থেকে একদিকে যেমন ধ্বনিতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বেড়িয়ে আসবে, অন্যদিকে তেমনি বেড়িয়ে আসবে বাগধিক ব্যাখ্যা। কোন বাক্যের অর্থনির্ধারণের জন্য গভীর সংগঠনই ইনপুট হিসাবে কাজ করবে। তাদের এ বক্তব্যে চমস্কি (১৯৬৪ : ১০) সমর্থন প্রদান করেন এবং বলেন :
এভাবে বাক্যতাত্ত্বিক উপাদান প্রতিটি বাক্যের জন্য (প্রতিটি বাক্যের প্রতিটি ব্যাখ্যার জন্য) আবশ্যিভাবে সরবরাহ করবে একটি বাগধিকভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য গভীর সংগঠন এবং একটি ধ্বনিবৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য উপরি সংগঠন এবং এদুটি পৃথক সংগঠনের সম্পর্কের ব্যাখ্যা প্রদান করবে ।
এর প্রতিফলন ঘটে চমস্কির Aspects of the Theory of Syntax (1965)-এ । এতে তিনি রূপান্তরমূলক ব্যাকরণের যে প্রমিত রূপ নির্ধারণ করেন তাতে বাগর্থবিদ্যার অবস্থান সুসংগত হয় । প্রমিত তত্ত্বের কাঠামোটি সংক্ষেপে এরকম একটি ব্যাকরণের থাকবে তিনটি উপাদান :
বাক্যতাত্ত্বিক উপাদান, বাগধিক উপাদান এবং ধ্বনিতাত্ত্বিক উপাদান বাক্যতাত্ত্বিক উপাদান গঠিত হবে একটি ভিত্তি এবং একটি রূপান্তরমূলক উপাদানের সমন্বয়ে। ভিত্তি আবার গঠিত হবে একটি শ্রেণীমূলক উপউপাদান এবং একটি শব্দকোষ সমবায়ে । ভিত্তি সঞ্জনন করবে গভীর সংগঠন।
একটি গভীর সংগঠন বাগধিক উপাদানে প্রবেশ করবে এবং বাগধিক ব্যাখ্যা অর্জন করবে। গভীর সংগঠন আবার রূপস্বরমূলক নিয়মের সাহায্যে উপরি সংগঠনে মানচিত্রায়িত হবে যা ধ্বনিতাত্ত্বিক উপাদানের নিয়মাবলী মারফত ধ্বনিবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রাপ্ত হবে ( চমস্কি ১৯৬৫ : ১৪১)। প্রমিত তত্ত্বের সংগঠনকে নিম্নরূপ চিত্রের সাহায্যে দেখানো যায় ( Lyons 1977 412)
আরও দেখুন: