Site icon Language Gurukul [ ভাষা গুরুকুল ] GOLN

বাগার্থিক ক্ষেত্র

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-বাগার্থিক ক্ষেত্র

বাগার্থিক ক্ষেত্র

সোস্যুরের ক্রমকালিক সমকালিক বিভাজনের পর থেকে অনেক ভাষাবিজ্ঞানী সমকালিক মাত্রায় বাগধিক ক্ষেত্র বিশ্লেষণে ব্যাপৃত হন এবং তাদের ক্ষেত্রতত্ত্ব নির্মান করেন। ক্ষেত্রতত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য এই যে কোন ভাষার যাবতীয় শব্দ পরস্পরের সাথে ধারণাগতভাবে সম্পৃক্ত এবং তারা সবাই মিলে একটি ক্ষেত্র তৈরী করে ।

ক্ষেত্রটির গঠন স্তরক্রমিক এবং প্রান্তিক ঘরে অবস্থান করে ভাষার একক শব্দাবলী। বাগধিক ক্ষেত্র বিভাজিত হয় বহুসংখ্যক ৰাগধিক এলাকায় এবং প্রতিটি এলাকায় থাকে একগুচ্ছ নিবিত্ত সম্পর্কিত শব্দ ।

সোস্যুরের মতে, ভাষার কোন শব্দের অর্থ অন্যান্য শব্দের সাথে তার সম্পর্কের উপর নির্ভর করে এবং নির্দিষ্ট কোন শব্দকে একগুচ্ছ শব্দের কেন্দ্ররূপে দেখানো যায়। যেমন আমরা যদি শিক্ষা শব্দটিকে ধরি তাহলে দেখবো শব্দটি ভাষার অন্যান্য শিক্ষাবিষয়ক শব্দাবলীর সাথে একাধিক রৈখিক সম্পর্কে আবদ্ধ।

 

 

প্রতিটি ভাষায় বর্ণবিষয়ক বিভিন্ন শব্দ রয়েছে। বর্ণবিষয়ক শব্দাবলীর দিক থেকে এক ভাষা অন্য ভাষা থেকে ভিন্ন হতে পারে। এই ভিন্নতাকে অনেকে ভাষিক আপেক্ষিকতার প্রমান হিসাবে উপস্থাপন করেন। একই বর্ণালীকে কেন বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে তা আজও গবেষণার বিষয় । বাংলা ভাষার বর্ণবিষয়ক শব্দাবলীকে আমরা নিম্নরূপে বিভক্ত ও উপবিভক্ত করতে পারি :

 

এখানে দেখা যায় পুরো বর্ণক্ষের প্রথমে ছয়টি অঞ্চলে বিভক্ত হয়েছে, পরে সেগুলো আবার বৈচিত্র্য অনুযায়ী উপ-অঞ্চলে বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু উপবিভক্তির মধ্যে যে জিনিসটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় তা হলো মূল ছয়টি বর্ণাঞ্চল এখানে সংকুচিত হয়ে অন্যান্য উপবর্ণের পাশে অবস্থান নিয়েছে, অর্থাৎ উপবর্ণগুলি মূল বর্ণাঞ্চলকে পুরোপুরি দখল করে নিতে পারেনি।

বাংলায় কমলা বেগুণী এগুলো একদিকে বিভিন্ন ধরনের লাল এবং অন্যদিকে লাল থেকে ভিন্ন। যেমন ইংরেজীতে man একদিকে নারী পুরুষ উভয়কেই বুঝায় আবার অন্যদিকে নারীর সাথে বৈপরীত্য প্রকাশ করে। এখানে এক ধরনের উপনামীয় সম্পর্ক বিদ্যমান যা আমরা পরে আলোচনা করবো ।

আগেই বলেছি বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে বর্ণালী বিশ্লেষণ করে থাকে, ফলে দুটি ভাষার বর্ণবিষয়ক শব্দাবলী বাগধিক ক্ষেত্র বিচারে সচরাচর সমাপতিত হয় না। হিয়েমশ্রে ইংরেজী ভাষার বর্ণবিষয়ক শব্দাবলীর তুলনা করে দেখিয়েছেন তারা কিভাবে ভিন্নরূপ বাগধিক ক্ষেত্র নির্দেশ করে

বাগার্থিক ক্ষেত্রের ধারণাটি জাতিবিষয়ক শব্দাবলীর বেলায়ও প্রযোজ্য । প্রতিটি ভাষাগোষ্ঠী স্বতন্ত্রভাবে জাতি সম্পর্কের ক্ষেত্রকে বিভাজিত করে থাকে, ফলে দুটি ভাষার জাতিবিষয়ক শব্দাবলীও সমাপতিত হয় না । এই ব্যাপারটিও বিভিন্ন ভাষাগোষ্টির সমাজসংগঠন ও সমাজচিন্তনের ভিন্নতা প্রতিপন্ন করে। আমরা বাংলা ও ইংরেজী ভাষার জাতিবিষয়ক শব্দাবলীর তুলনা করে বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারি। ইংরেজী ও বাংলা ভাষার জাতিবিষয়ক শব্দাবলীকে এভাবে চিত্রবদ্ধ করা যায়:

 

 

কাজেই দেখা যায় বাঙ্গালীরা যেখানে বাবা কিংবা মায়ের দিক থেকে আত্মীয়তার ভিত্তিতে চচাচী / মাম -র পার্থক্য করে ইংরেজরা সেখানে uncle / aunt দিয়েই তা চালিয়ে নেয়। ইংরেজরা ভাতিজা ভাগ্নে উভয়কে বোঝাতে nephew এবং ভাতিজি ভাগ্নী উভয়কে বোঝাতে niece ব্যবহার করে। ইংরেজরা চাচাত/মামাত ভাইবোনের মধ্যে লিঙ্গভেদ করে না, cousin দিয়েই উভয়কে বোঝায়, কিন্তু বাঙ্গালীরা চাচাত, মামাত ভাইবোনের মধ্যে লিঙ্গভেদ করে এবং নির্দিষ্টভাবে বলার জন্য ভাই বা বোনের পূর্বে চাচাত মামাত প্রভৃতি বিশেষণ ব্যবহার করে।

তদপুরি বাংলা ভাষায় রয়েছে ফুফা / ফুফু (মুসলমানদের জন্য), পিসা / পিসি (হিন্দুদের জন্য), ধানু বালা (মুসলমানদের জন্য), মেসো / মাসি ( হিন্দুদের জন্য)-র ভেদ্য। আবার চাচা-চাচীকে পিতার বয়স তুলনায় (বিশেষত হিন্দুদের বেলায় প্রযোজ্য) জ্যাঠা-জ্যাঠী, কাকা-কাকী হিসাবে চিহ্নিত করা হয় । কাজেই বোঝা যায় বাংলা ভাষার প্রাতিবিষয়ক শব্দাবলীর বাগধিক সংগঠন ইংরেজী ভাষার জাতিবিষয়ক শব্দাবলীর বাগধিক সংগঠন থেকে জটিল। ইংরেজী ভাষার প্রতিবিষয়ক শব্দাবলীকে একটি বাক্সচিত্রে প্রদর্শন করা যেতে পারে

 

 

কিন্তু বাংলা ভাষার জাতিবিষয়ক শব্দাবলীকে এরকম সরলভাবে একটিমাত্র বারে প্রকাশ করা যায় না । মোটামুটিভাবে তাদেরকে এভাবে দেখানো যায় :

 

প্রাণীজগত ও উদ্ভিদজগতের শ্রেণীবিন্যাসের জন্য বাগার্থিক ক্ষেত্রের ধারণা কাজে লাগানো হয়। যেমন জীব বিজ্ঞানীরা জীবজগতকে জীবের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সর্গ, বর্ণ, গোত্র, জাতি, প্রজাতি এরূপ ভরক্রমে বিন্যস্ত করে থাকেন। এটি করা হয় বৈজ্ঞানিক আলোচনার প্রয়োজনে। প্রাণীজগতকে আমরা জাগতিক প্রয়োজনে অন্যভাবেও শ্রেণীবিভাগ করতে পারি । যেমন

 

 

এখানে প্রাণীকে প্রথমে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে পোষশ্রেণী, হিংসপ্রাণী ও গবাদিপশু। পোষাপ্রাণীর মধ্যে পড়ে বিড়াল, কুকুর, ঘোড়া । ময়না, টিয়া প্রভৃতি পোষা পাখিও এই শ্রেণীতে রাখা যেত। হিংস্রপ্রাণীর মধ্যে পড়ে বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ। গোখরো, অজগর প্রভৃতি সরীসৃপ এবং ঈগল, চিল প্রভৃতি শিকারী পাখিও এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারতো। গবাদি পশুর মধ্যে পড়ে গরু, ছাগল, মহিষ। ভেড়া, পাঠা, দুম্বা প্রভৃতিও এই শ্রেণীতে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার যোগ্য ।

কেবল প্রাণী বা বস্তুর জগত নয়, কর্মের জগতকেও এভাবে বাগধিক অঞ্চলে বিভক্ত করা সম্ভব । কর্মের বিভাজনের সময় আমরা বিবেচনা করতে পারি কোনটি জনহিতকর কর্ম, কোনটি স্বার্থপর কর্ম, কোনটি নৈতিক কর্ম, কোনটি অনৈতিক কর্ম কোনটি সাংসারিক কর্ম, কোনটি বিনোদনমূলক কর্ম, কোনটি কষ্টকর কর্ম, কোনটি আরামদায়ক কর্ম, কোনটি পেশাগত কর্ম, কোনটি অপেশাগত কর্ম ইত্যাদি। নিডা এবং অন্যান্য (১৯৭৭ : ১৬১) ইংরেজী ভাষায় বিভিন্ন সঞ্চারণমূলক শব্দকে কিছু বাপধিক অঞ্চলে শ্রেণীবিভক্ত করে দেখান যে তারা কিরূপে একে অপরের সাথে

একইভাবে ফ্লোরার (১৯৭৪: ৪০) ইংরেজী বিভিন্ন আওয়াজ বিষয়ক শব্দাবলীর শ্রেণীবিন্যাস করে তাদের বাগার্থিক অবস্থান নির্ণয় করেন :

 

 

ক্ষেত্রতত্ত্ব অনুসারে একটি ভাষার শব্দভান্ডার পরস্পর সম্পর্কিত শব্দাবলীর একটি সেট, যা ক্ষেত্র বা ময়দানের সাথে তুলনীয় এবং সেই সেট বিভক্ত কতগুলি উপসেটে যাদেরকে বলা হয় বাগধিক অঞ্চল। যদি শব্দভান্ডারকে ড, বাগদিক অঞ্চলকে বা এবং প্রতিটি শব্দকে শ ধরি তাহলে ক্ষেত্রতত্ত্বের ধারণাকে এভাবে ব্যক্ত করা যায়

ডবা, (শ) বা () বা ( 4 )

ক্ষেত্রতত্ত্বের সবচেয়ে শক্তিমান ভাষ্যে এটা ধরে নেয়া হয় যে শব্দভান্ডার সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ এবং তাকে সুস্পষ্ট রূপে বিভাজিত করা সম্ভব। ফলে (১) দুটি বাগধিক অঞ্চল এমনভাবে সন্নিহিত হবে যে তাদের মাঝখানে কোন শব্দ থাকবে না, অর্থাৎ কোন শব্দই একসাথে দুটি অঞ্চলে অন্তর্ভূক্ত হতে পারবে না, এ (2) বাগধিক অঞ্চলের সমষ্টি হবে শব্দভান্ডারের সমান অর্থাৎ এমন কোন শব্দ থাকবে না যা কোন না কোন অঞ্চলের সদস্য নয় (Lyons 1977 268) ।

লিয়ম্স বাগধিক ক্ষেত্র ও শাব্দিক ক্ষেত্রের মধ্যে পার্থক্য করেন। । কোন ভাষা সংশ্রয়ে পারস্পরিক বা অনুস্থাপনিক সম্পর্কের মাধ্যমে বাগধিক এককসমূহ যে ক্ষেত্র তৈরী করে তাকে বাগধিক ক্ষেত্র বলে। আর কোন ভাষা সংয়ে পারস্পরিক বা অনুস্থাপনিক সম্পর্কের মাধ্যমে শব্দভান্ডার যে ক্ষেত্র তৈরী করে তাকে শাব্দিক ক্ষেত্র বলে।

আমাদের বিবেচনায় বাগধিক ক্ষেত্র ও শাব্দিক ক্ষেত্র একই জিনিসের দুটি দিকমাত্র, প্রথমটি ধারণাগত দিক এবং দ্বিতীয়টি রৌলিক দিক। আমরা যখন শব্দজগতের ক্ষেত্র নির্ধারণ করি তখন ধারণাজগতেরও ক্ষেত্র নির্ধারিত হয়। রাগধিক ক্ষেত্রের একটি মনাত্তিক ভিত্তি হয়েছে ।

ভাষার শব্দসমূহ মন্দো অনুযঙ্গাত্মক নীতি অনুযায়ী সংঘবদ্ধ হয়। যদি কতকগুলি শব্দ রূপ ও অর্থের দিক থেকে কাছাকাছি হয় তবে মানুষের চেতনা তাদেরকে একসাথে সংযুক্ত করে। যেমন ধান শব্দটি উচ্চারণ করলে আমাদের মনে পড়তে পারে গান কান মানু টান मान ान ान ন ম, ধাপ্পা প্রভৃতি শব্দ (রূপগত কারণে) অথবা মনে পড়তে পারে চাউল ভাত, মাঠ, মাড়াইকল, সার, লাঙ্গল, কটিনাশক পর তুর বুদ প্রভৃতি শব্দ (অর্থগত কারণে) ।

এই অবস্থাটিকেই আলেকজান্ডার লুরিয়া (১১৮২৭৩) বলেছেন সম্পর্কে অনেকার্থক প্রকৃতি (polysemantic nature of the relationship )। লুরিয়া উদাহরণ দিয়েছেন koshka (বিড়াল) শব্দটির মাধ্যমে। এ শব্দটি উচ্চারণ করলে একদিকে kroshka (টুকরা) kryshka (ঢাকনা), kruzhka (মগ), প্রভৃতি শব্দ এবং অন্যদিকে দুখ ইদুদের ফাঁদ, লোম, পোষাপ্রাণী প্রভৃতি ধারণার সাথে সংশ্লিষ্ট শব্দাবলী মনে আসতে পারে। পুরিয়ার মতে ভাষার কোন শব্দেরই এককভাবে নির্দিষ্ট স্থায়ী অর্থ নেই ।

তিনি বলেন “শব্দের যদি একক স্থায়ী ভঅর্থ থাকতো তাহলে মানুষ একটি ঝর বিভিন্ন দিক উল্লেখ করতে পারতো না অথবা একে বিশ্লেষণ করতে পারতো না এবং সম্ভাব্য সকল অনুযঙ্গ থেকে নির্দিষ্ট কিছু অনুষঙ্গকে পৃথক করতে পারতো না । কাজেই এটি খুবই সম্ভব মনে হয় যে বাগাষ্ঠির ক্ষেত্রের অস্তিত্ব রয়েছে ।

আরও দেখুন:

 

Exit mobile version