বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। উপন্যাস রচনার পাশাপাশি সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও তাঁর মননশীলতার পরিচয় সুস্পষ্ট। বিশেষত প্রবন্ধ রচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সমকালে যে চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, বিষয়বস্তু বিচারে তা উলেখের দাবি রাখে। উনিশ শতকের বাংলা গদ্য গড়ে ওঠার সময় তাঁর প্রবন্ধ-রচনাশৈলীও এক বিশেষ গদ্যভঙ্গির প্রতিনিধি হিসেবে সমাদৃত হয়।
লেখক পরিচিতি
‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধের লেখক বঙ্গিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার নৈহাটি থানার কাঁঠালপাড়া গ্রামে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। পিতার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর হুগলী কলেজের বিদ্যালয় বিভাগে প্রথম ভর্তি হন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর গ্র্যাজুয়েট হন দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে। ওই বছরই যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর নিযুক্ত হন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ললিতা তথা মানস’ নামক কাব্য প্রকাশিত হয়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ তাঁর রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাস; বের হয় ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে।
‘সীতারাম’ (১৮৮৮) তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস। ১৮৭২ থেকে ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ‘বঙ্গদর্শন’ নামক একটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। সার্থক উপন্যাস রচনাই শুধু নয়, বাংলা ভাষায় প্রথম তুলনামূলক সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধও তিনি রচনা করেন। তাঁর হাতে বাংলা গদ্যরীতি বিশিষ্টতা অর্জন করে। বিদ্যাসাগরের সংস্কৃতানুসারী ভাষা ও প্যারীচাঁদ মিত্রের কথ্য বাক্-ভঙ্গি নতুনভাবে বিন্যস্ত করে তিনি একটি নিজস্ব গদ্যরীতি প্রবর্তন করেন।
‘বঙ্গদর্শনে’র মতো একটি উচ্চাঙ্গের সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করেও তিনি বাংলা গদ্যের শ্রীবৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখেন। নিজেও প্রবন্ধের বিষয় ও আঙ্গিকে বৈচিত্র্য আনয়ন করেন। লঘু কৌতুক, হাস্যরস, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, মননশীলতা, গাম্ভীর্য, আবেগ ইত্যাদির সংমিশ্রণে তাঁর প্রবন্ধ বিশিষ্ট হয়ে ওঠে।
পাঠ-পরিচিতি
‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “বিবিধ প্রবন্ধ’ নামক প্রবন্ধ-গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রবন্ধ ১২৮৫ বঙ্গাব্দের ‘বঙ্গদর্শন’ সাময়িক পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি লেখকের একটি চিন্তামূলক প্রবন্ধ । চিন্তাটি মূলত বাংলা ভাষা ও তার লেখ্যরীতি সম্পর্কিত। এই প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা গদ্যরীতির উৎকর্ষ বিষয়ক নিজস্ব সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন।
এ প্রসঙ্গে তাঁর সমকালীন উল্লেখযোগ্য গদ্য রচয়িতাদের ভাষারীতি বিশেষণ করা হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং প্যারীচাঁদ-কালীপ্রসন্নর ভাষারীতিই ওই সময় বাংলা গদ্যচর্চায় ব্যবহৃত হত। বঙ্কিমচন্দ্র এঁদের চর্চিত ভাষারীতিকে শাণিত বুদ্ধি ও আধুনিক চিন্তার আলোকে বিশেষণ করেছেন।
একই সঙ্গে যৌক্তিক যুক্তির পারম্পর্যে এই উভয় মতের সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলা গদ্যরীতি সম্পর্কে নিজস্ব বক্তব্য প্রদান করেন বলে প্রবন্ধটির নামকরণ করা হয় ‘বাঙ্গালা ভাষা’। নামকরণটি নিঃসন্দেহে যথাযথ হয়েছে।
মূলপাঠ
প্রায় সকল দেশেই লিখিত ভাষা এবং কথিত ভাষায় অনেক প্রভেদ। যে সকল বাঙ্গালী ইংরেজি সাহিত্যে পারদর্শী, তাঁহারা একজন লন্ডনী কী বা একজন কৃষকের কথা সহজে বুঝিতে পারেন না, এবং এতদ্দেশে অনেকদিন বাস করিয়া বাঙ্গালীর সহিত কথাবার্তা কহিতে কহিতে যে ইংরেজেরা বাঙ্গালা শিখিয়াছেন, তাহারা প্রায় একখানিও বাঙ্গালাগ্রন্থ বুঝিতে পারেন না।
প্রাচীন ভারতেও সংস্কৃত ও প্রাকৃতে, আদৌ বোধ হয়, এইরূপ প্রভেদ ছিল, এবং সেই প্রভেদ হইতে আধুনিক ভারতবর্ষীয় ভাষাসকলের উৎপত্তি। বাঙ্গালার লিখিত এবং কথিত ভাষায় যতটা প্রভেদ দেখা যায়, অন্যত্র তত নহে। বলিতে গেলে, কিছুকাল পূর্বে দুইটি পৃথক্ ভাষা বাঙ্গালায় প্রচলিত ছিল। একটির নাম সাধুভাষা; অপরটির নাম অপর ভাষা। একটি লিখিবার ভাষা, দ্বিতীয়টি কহিবার ভাষা।
পুস্তকে প্রথম ভাষাটি ভিন্ন, দ্বিতীয়টির কোন চিহ্ন পাওয়া যাইত না। সাধুভাষায় অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দসকল বাঙ্গালা ক্রিয়াপদের আদিম রূপের সঙ্গে সংযুক্ত হইত। যে শব্দ আভাঙ্গা সংস্কৃত নহে, সাধুভাষায় প্রবেশ করিবার তাহার কোন অধিকার ছিল না। লোকে বুঝুক বা না বুঝুক, আভাঙ্গা সংস্কৃত চাহি। অপর ভাষা সে দিকে না গিয়া, যাহা সকলের বোধগম্য, তাহাই ব্যবহার করে। গদ্য গ্রন্থাদিতে সাধুভাষা ভিন্ন আর কিছু ব্যবহার হইত না।
তখন পুাকপ্রণয়ন সংস্কৃত ব্যবসায়ীদিগের হাতে ছিল। অন্যের বোধ ছিল যে, যে সংস্কৃত না জানে, বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রণয়নে তাহার কোন অধিকার নাই, সে বাঙ্গালা লিখিতে পারেই না। যাঁহারা ইংরেজিতে পন্ডিত, তাহারা বাঙ্গালা লিখিতে পড়িতে না জানা গৌরবের মধ্যে গণ্য করিতেন। সুতরাং বাঙ্গালায় রচনা ফোঁটা-কাটা অনুস্বারবাদীদিগের একচেটিয়া মহল ছিল। সংস্কৃতেই তাহাদিগের গৌরব।
তাঁহারা ভাবিতেন, সংস্কৃতেই তবে বুঝি বাঙ্গালা ভাষার গৌরব; যেমন গ্রাম্য বাঙ্গালী স্ত্রীলোক মনে করে যে, শোভা বাড়ুক আর না বাড়ুক, ওজনে ভারি সোনা অঙ্গে পরিলেই অলঙ্কার পরার গৌরব হইল, এই গ্রন্থকর্তারা তেমনি জানিতেন, ভাষা সুন্দর হউক বা না হউক, দুর্বোধ্য সংস্কৃতবাহুল্য থাকিলেই রচনার গৌরব হইল। এইরূপ সংস্কৃতপ্রিয়তা এবং সংস্কৃতানুকারিতা হেতু বাঙ্গালা সাহিত্য অত্যন্ত নীরস, শ্রীহীন, দুর্বল, এবং বাঙ্গালা সমাজে অপরিচিত হইয়া রহিল।
টেকচাঁদ ঠাকুর প্রথমে এই বিষবৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করিলেন। তিনি ইংরেজিতে সুশিক্ষিত। ইংরেজিতে প্রচলিত ভাষার মহিমা দেখিয়াছিলেন এবং বুঝিয়াছিলেন। তিনি ভাবিলেন, বাঙ্গালার প্রচলিত ভাষাতেই বা কেন গদ্যগ্রন্থ রচিত হইবে না? যে ভাষায় সকলে কথোপকথন করে, তিনি সেই ভাষায় “আলালের ঘরের দুলাল” প্রণয়ন করিলন। সেই দিন হইতে বাঙ্গালা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি । সেই দিন হইতে শুষ্ক তরুর মূলে জীবন-বারি নিষিক্ত হইল ।
সেই দিন হইতে সাধুভাষা, এবং অপর ভাষা, দুই প্রকার ভাষাতেই বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রণয়ন হইতে লাগিল, ইহা দেখিয়া সংস্কৃতব্যসবায়ীরা জ্বালাতন হইয়া উঠিলেন; অপর ভাষা, তাঁহাদিগের বড় ঘৃণ্য। মদ্য, মুরগী এবং টেকচাঁদি বাঙ্গালা এককালে প্রচলিত হইয়া ভট্টাচার্যগোষ্ঠীকে আকুল করিয়া তুলিল। এক্ষণে বাঙ্গালা ভাষার সমালোচকেরা দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হইয়াছেন। একদল খাঁটি সংস্কৃতবাদী – – যে গ্রন্থে সংস্কৃতমূলক শব্দ ভিন্ন অন্য শব্দ ব্যবহার হয়, তাহা তাঁহাদের বিবেচনায় ঘৃণার যোগ্য।
অপর সম্প্রদায় বলেন, তোমাদের ও কচকচি বাঙ্গালা নহে। ইহা আমরা কোন গ্রন্থে ব্যবহার করিতে দিব না। যে ভাষা বাঙ্গালা সমাজে প্রচলিত, যাহাতে বাঙ্গালার নিত্য কার্য সকল সম্পাদিত হয়, যাহা সকল বাঙ্গালীতে বুঝে, তাহাই বাঙ্গালা ভাষা – তাহাই গ্রন্থাদির ব্যবহারের যোগ্য। অধিকাংশ সুশিক্ষিত ব্যক্তি এক্ষণে এই সম্প্রদায়ভুক্ত। আমরা উভয় সম্প্রদায়ের এক এক মুখপাত্রের উক্তি এই প্রবন্ধে সমালোচিত করিয়া স্থূল বিষয়ের মীমাংসা করিতে চেষ্টা করিব।
সংস্কৃতবাদী সম্প্রদায়ের মুখপাত্রস্বরূপ আমরা রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয়কে গ্রহণ করিতেছি। বিদ্যাসাগর প্রভৃতি মহামহোপাধ্যায় পন্ডিত থাকিতে আমরা ন্যায়রত্ন মহাশয়কে এই সম্প্রদায়ের মুখপাত্রস্বরূপ গ্রহণ করিলাম, ইহাতে সংস্কৃতবাদীগিদের প্রতি কিছু অবিচার হয়, ইহা আমরা স্বীকার করি। ন্যায়রত্ন মহাশয় সংস্কৃতে সুশিক্ষিত, কিন্তু ইংরেজি জানেন না – পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য তাঁহার নিকট পরিচিত নহে।
তাঁহার প্রণীত বাঙ্গালা সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাবে ইংরেজি বিদ্যার একটু পরিচয় দিতে গিয়া ন্যায়রত্ন মহাশয় কিছু লোক হাসাইয়াছেন। আমরা সেই গ্রন্থ হইতে সিদ্ধ করিতেছি যে, পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের অনুশীলনে যে সুফল জন্মে, ন্যায়রত্ন মহাশয় তাহাতে বঞ্চিত। যিনি এই সুফলে বঞ্চিত, বিচার্য বিষয়ে তাঁহার মত তাঁহার নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেই যে অধিক গৌরব প্রাপ্ত হইবে, এমত বোধ হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: যে সকল সংস্কৃতবাদী পন্ডিতদিগের মত অধিকতর আদরণীয়, তাঁহারা কেহই সেই মত স্বপ্রণীত কোন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখেন নাই। সুতরাং তাঁহাদের কাহারও নাম উল্লেখ করিতে আমরা সক্ষম হইলাম না। ন্যায়রত্ন মহাশয় স্বপ্রণীত উক্ত সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাবে আপনার মতগুলি লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন এই জন্যই তাঁহাকে এ সম্প্রদায়ের মুখপাত্রস্বরূপ ধরিতে হইল।
তিনি “আলালের ঘরের দুলাল” হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া লিখিয়াছেন যে, “এক্ষণে জিজ্ঞাস্য এই যে, সর্ববিধ গ্রন্থ রচনায় এইরূপ ভাষা আদর্শস্বরূপ হইতে পারে কিনা?- ? – আমাদের বিবেচনায় কখনই না। আলালের ঘরের দুলাল বল, হুতোমপেঁচা বল, মৃণালিনী বল – পত্নী বা পাঁচজন বয়স্যের সহিত পাঠ করিয়া আমোদ করিতে পারি – কিন্তু পিতাপুত্রে একত্র বসিয়া অসঙ্কুচিতমুখে কখনই ও সকল পড়িতে পারি না।
বর্ণনীয় বিষয়ের লজ্জাজনকতা উহা পড়িতে না পারিবার কারণ নহে, ঐ ভাষারই কেমন একরূপ ভঙ্গী আছে, যাহা গুরুজনসমক্ষে উচ্চারণ করিতে লজ্জাবোধ হয়। পাঠকগণ! যদি আপনাদের উপর বিদ্যালয়ের পুত্ত্বক নির্বাচনের ভার হয়, আপনারা আলালী ভাষায় লিখিত কোন পুাককে পাঠ্যরূপে নির্দেশ করিতে পারিবেন কি? – — বোধ হয়, পারিবেন না।
কেন পারিবেন না? – ইহার উত্তরে অবশ্য এই কথা বলিবেন যে ওরূপ ভাষা বিশেষ শিক্ষাপ্রদ নয়, এবং উহা সর্বসমক্ষে পাঠ করিতে লজ্জাবোধ হয়। অতএব বলিতে হইবে যে, আলালী ভাষা সম্প্রদায়বিশেষের বিশেষ মনোরঞ্জিকা হইলেও, উহা সর্ববিধ পাঠকের পক্ষে উপযুক্ত নহে। যদি তাহা না হইল, তবে আবার জিজ্ঞাস্য হইতেছে যে, ঐরূপ ভাষায় গ্রন্থরচনা করা উচিত কিনা? আমাদের বোধে অবশ্য উচিত।
যেমন ফলারে বসিয়া অনবরত মিঠাই এন্ডা খাইলে জিহ্বা একরূপ বিকৃত হইয়া যায় – মধ্যে মধ্যে আদার কুচি ও কুমড়ার খাট্টা মুখে না দিলে সে বিকৃতির নিবারণ হয় না, সেইরূপ কেবল বিদ্যাসাগরী রচনা শ্রবণে কর্ণের যে একরূপ ভাব জন্মে, তাহার পরিবর্তন করণার্থ মধ্যে মধ্যে অপরবিধ রচনা শ্রবণ করা পাঠকদিগের আবশ্যক। ”
শব্দার্থ ও টীকা
লন্ডনী কক্নী — লন্ডনের গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা অর্থাৎ লন্ডনের আঞ্চলিক ভাষা। প্রাচীন ভারতেও সংস্কৃত ও প্রাকৃতে
প্রভেদ ছিল— আদিকালে ভারতে সংস্কৃত ভাষাভাষী অঞ্চলে অশিক্ষিত জনসাধারণ প্রাকৃতভাষায় ভাব বিনিময় করতো। প্রাচীন ভারতে মানুষের শ্রেণীভাগের মতো ভাষাতেও এমন উচ্চ-নিচ প্রভেদ ছিলো। যেমন, কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটকে দুষ্মন্ত বা শকুন্তলার ভাষা সংস্কৃত হলেও মৎস্যশিকারীর ভাষা প্রাকৃত।
সংস্কৃত ব্যবসায়ী – সংস্কৃত পন্ডিত; ব্যঙ্গার্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। –
অনুস্বারবাদীদিগের— সংস্কৃত পন্ডিতদের; বিদ্রূপার্থে। সংস্কৃত ভাষার মতো প্রচুর অনুস্বার ও বিসর্গ ব্যবহার করে যে- পন্ডিতগণ বাংলা ভাষাকে আড়ষ্ট করতে চান তাদের বুঝানো হয়েছে।
সংস্কৃতানুকারিতা — সংস্কৃত ভাষাকে অনুকরণ করার প্রবণতা।
টেকচাঁদ ঠাকুর – প্যারীচাঁদ মিত্রের ছদ্মনাম টেকচাঁদ ঠাকুর। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ও ১৮৮৩ – খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা গদ্যে কথ্য ভাষারীতির তিনি প্রবর্তক। তাঁর মতে, সংস্কৃত শব্দবহুল গদ্যরীতির পরিবর্তে প্রচলিত শব্দনির্ভর সরল গদ্যই বাংলা ভাষায় আদর্শ হওয়া উচিত। এই গদ্যরীতিতে তিনি ‘আলালের ঘরের দুলাল’, (১৮৫৭) গ্রন্থটি রচনা করেন।
বিষবৃক্ষ — যে গাছ বিষাক্ত ফল দেয়। এখানে সংস্কৃতবহুল বাংলাভাষাকে বলা হয়েছে।
নিষিক্ত — সিঞ্চিত। –
মুখপাত্র — প্রধান প্রতিনিধি ।
রামগতি ন্যায়রত — ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম; মৃত্যু ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। মূলত প্রাচীনপন্থী ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘সংস্কৃত সাহিত্য প্রস্তাব’-এর অনুকরণে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ‘বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
বিদ্যাসাগর— প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা। জন্ম ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে; মৃত্যু ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে। পিতার নাম বীরসিংহ শর্মা।
বস্তু-সংক্ষেপ
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই লেখ্য ভাষা ও কথ্য ভাষার পার্থক্য বর্তমান। তবে বাংলায় এর প্রভেদ যতোটা ব্যাপক, অন্যভাষায় ততটা নয়। সাধু ভাষা ও অপর ভাষা এই দুই ভাগে বাংলা ভাষা বিভক্ত। প্রথম দিকে বাংলায় সাধুভাষায় লিখার কাজ সম্পন্ন হতো এবং সেখানে অপর ভাষার কোন রূপ চিহ্ন থাকতো না। অপর ভাষা মৌখিকভাবে ব্যবহার হতো। বিশেষ করে সাধুভাষায় অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দাবলি বাংলা ক্রিয়াপদের আদি রূপের সঙ্গে যুক্ত হয়।
গদ্য গ্রন্থাদি সাধুভাষা ছাড়া রচিত হতো না। অনেকে মনে করতেন যে, সংস্কৃত ভাষা না জানলে বাংলা গ্রন্থ রচনা সম্ভব নয়। অপর ভাষা অপেক্ষাকৃত বোধগম্য হলেও পুস্তকাদিতে তার ব্যবহার দেখা যায়নি। ফলে কতিপয় পন্ডিতের সংস্কৃতপ্রিয়তা ও সংস্কৃতানুকারিতার জন্যে বাংলা সাহিত্য অত্যন্ত নীরস, শ্রীহীন, দুর্বল এবং বাঙালি সমাজে অপরিচিত হয়ে ওঠে।
ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত টেকচাঁদ ঠাকুর প্রথম কথোপকথনের ভাষা অর্থাৎ অপর ভাষায় ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এরপর থেকে সাধুভাষা ও অপর ভাষা এই দুই প্রকার ভাষাতেই বাংলা গ্রন্থ রচিত হয়। তবে খাঁটি সংস্কৃতবাদী ও টেকচাঁদি পক্ষীয়দের মধ্যে এ নিয়ে তর্ক থেকে যায়। প্রথম পক্ষ মনে করেন যে, সংস্কৃতমূলক শব্দ ছাড়া বাংলায় অন্য শব্দ ব্যবহার ঘৃণার যোগ্য, দ্বিতীয় পক্ষের মত এই যে, সংস্কৃত শব্দের কচকচি প্রকৃত বাংলা নয়, তাই গ্রন্থে ব্যবহার হতে পারে না।
পন্ডিত রামগতি ন্যায়রত্নকে সংস্কৃতবাদীদের মুখপাত্র হিসেবে অভিহিত করে প্রবন্ধকার তাঁর গদ্যভাবনা বিচারে অবতীর্ণ হয়েছেন। ন্যায়রত্ন মহাশয় সংস্কৃত-সুপন্ডিত হলেও ইংরেজি জানেন না। তাঁর মতে, ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’ ইত্যাদি পিতাপুত্র একত্রে অসঙ্কুচিত চিত্তে পাঠ করা চলে না – বন্ধু বা পত্নীর সঙ্গে পাঠ করে আমোদ করা চলে।
কারণ ওই ভাষাতে ‘কেমন একরূপ ভঙ্গী আছে যে কারণে তা গুরুজনসমক্ষে উচ্চারণে লজ্জাবোধ হয়। এ জন্যে ওই ভাষা পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষাপ্রদও নয়। ন্যায়রত্ন মহাশয়ের মতো সংস্কৃতবাদীদের মত পুরোপুরি মান্য করলে ‘মাগো আমাকে খাবার দাও’ – এই সাধারণ বাংলা বাক্যটি ‘হে মাতঃ খাদ্যং দেহি মে’ বলতে হয়।
বুঝার ক্ষেত্রে যেহেতু বাক্যটি কষ্টসাধ্য, সেহেতু শিক্ষার ব্যাপরটিও এখানে গৌণ হয়ে যায়। ন্যায়রত্ন মহাশয় সংস্কৃতশব্দবহুল গদ্যের কথা বললেও তাঁর রচিত ‘বাঙ্গালা সাহিত্য’ বিষয়ক প্রস্তাব কিন্তু সরল প্রচলিত ভাষায় লিখিত।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সংক্ষিপ্ত-উত্তরমূলক প্রশ্ন
১. বঙ্কিমচন্দ্র ‘সাধুভাষা’ ও ‘অপর ভাষা’ বলতে কি বুঝিয়েছেন?
২. রামগতি ন্যায়রত্নের মতে বাংলা গদ্য কেমন হওয়া উচিত?
২ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর-প্রশ্নের নমুনা-উত্তর
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রামগতি ন্যায়রত্নকে সংস্কৃতবাদীদের মুখপাত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। ন্যায়রত্ন সংস্কৃতে সুপন্ডিত, কিন্তু ইংরেজি জানেন না। তিনি বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দাধিক্য ও সমাসবদ্ধ পদ আমদানির পক্ষপাতী। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বা ‘হুতোম পেঁচার নক্সা’ পাঠ করলে লজ্জা জন্মে বলে তিনি মনে করেন।
আভাঙ্গা অর্থাৎ খাঁটি সংস্কৃত শব্দ ছাড়া অন্য শব্দ প্রাচীনপন্থীরা বাংলা গদ্যে অন্তর্ভুক্ত করার বিপক্ষে। যাদের সংস্কৃতে দখল নেই, তাদের বাংলা গ্রন্থ প্রণয়নের অধিকার নেই- – প্রাচীনপন্থীদের এই মতই ছিলো রামগতি ন্যায়রত্নের মত।
প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা লিখুন
১. অন্যের বোধ ছিল যে সংস্কৃত না জানে, বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রণয়নে তাহার কোন অধিকার নাই, সে বাঙ্গালা লিখিতে পারেই না।
২. সুতরাং বাঙ্গালায় রচনা ফোঁটা-কাটা অনুস্বারবাদীদিগের একচেটিয়া মহল ছিল।
১ নং ব্যাখ্যার নমুনা-উত্তর:
আলোচ্য বাক্যটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বাঙ্গালা ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে চয়ন করা হয়েছে। এখানে সংস্কৃত পন্ডিতদের মতে বাংলা ভাষার আদর্শ ও রূপ কি হওয়া উচিত সে কথা প্রবন্ধকার ব্যক্ত করেছেন। উইলিয়াম কেরীর কথ্যভাষায় আশ্রয়, রামরাম বসুর আরবী-ফারসী শব্দ-নির্ভরতা আর মৃত্যুজ্ঞয় বিদ্যালঙ্কারের সংস্কৃত ভাষারীতি অবলম্বন – এই ত্রয়ী ধারায় বাংলা গদ্যরীতির প্রাথমিক সূচনা হয়।
কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলা ভাষা, বিশেষত বাংলা গদ্যের আদর্শ ও রূপ কোন নির্দিষ্টতা নিয়ে স্বীকৃত হয়ে ওঠেনি। গ্রন্থাদি সাধুভাষায় প্রণীত হতো এবং এর প্রণেতা ছিলেন মূলত সংস্কৃত পন্ডিতগণ। তাঁরা স্বভাবতই বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত শব্দ ও রীতি নির্ভর করে গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য হলো, বাংলা ভাষায় সংস্কৃত প্রভাব অবশ্যই থাকতে হবে এবং সংস্কৃত প্রভাব অস্বীকার করে বাংলা গ্রন্থ রচিত হতে পারবে না।
এই অভিমতটি এক সময় এতোটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, ধারণা জন্মে, যাঁরা সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণ জানেন না, তাঁরা বাংলা পুস্তক লিখতেই পারেন না। সংস্কৃত পন্ডিতদের এই বক্তব্যটি অবশ্য পরবর্তীকালে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়।
মূলপাঠ
ন্যায়রত্ন মহাশয়ের মত সমালোচনায় আর অধিক কাল হরণ করিবার আমাদিগের ইচ্ছা নাই। আমরা এক্ষণে সুশিক্ষিত অথবা নব্য সম্প্রদায়ের মত সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইব। এই সম্প্রদায়ের সকলের মত একরূপ নহে। ইহার মধ্যে একদল এমন আছেন যে, তাঁহারা কিছু বাড়াবাড়ি করিতে প্রস্তুত। তন্মধ্যে বাবু শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় গত বৎসর কলিকাতা রিভিউতে বাঙ্গালা ভাষার বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। প্রবন্ধটি উৎকৃষ্ট।
তাঁহার মতগুলি অনেক স্থলে সুসঙ্গত এবং আদরণীয়। অনেক স্থলে তিনি কিছু বেশী গিয়াছেন। বহুবচন জ্ঞাপনে গণ শব্দ ব্যবহার করার প্রতি তাহার কোপদৃষ্টি। বাঙ্গালায় লিঙ্গভেদ তিনি মানেন না। পৃথিবী যে বাঙ্গালায় স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দ, ইহা তাঁহার অসহ্য। বাঙ্গালায় সন্ধি তাঁহার চক্ষুশূল। বাঙ্গালায় তিনি ‘জনৈক’ লিখিতে দিবেন না। ত্ব প্রত্যয়াস্ত এবং য প্রত্যয়াপ্ত শব্দ ব্যবহার করিতে দিবেন না।
সংস্কৃত সংখ্যাবাচক শব্দ, যথা- একাদশ বা চত্বারিংশত বা দুইশত ইত্যাদি বাঙ্গালায় ব্যবহার করিতে দিবেন না। ভ্রাতা, কল্য, কর্ণ, তাম্র, স্বর্ণ, পত্র, মন্ত্রক, অশ্ব ইত্যাদি শব্দ বাঙ্গালা ভাষায় ব্যবহার করিতে দিবেন না। ভাই, কাল, কান, সোনা কেবল এই সকল শব্দ ব্যবহার হইবে। এইরূপ তিনি বাঙ্গালা ভাষার উপর অনেক দৌড়া করিয়াছেন। তথাপি তিনি এই প্রবন্ধে বাঙ্গালাভাষা সম্বন্ধে অনেকগুলি সারগর্ভ কথা বলিয়াছেন।
বাঙ্গালা লেখকেরা তারা স্মরণ রাখেন, ইহা আমাদের ইচ্ছা। – শ্যামাচরণ বাবু বলিয়াছেন এবং সকলেই জানেন যে, বাঙ্গালা শব্দ ত্রিবিধ – -প্রথম, সংস্কৃতমূলক শব্দ, যাহার বাঙ্গালায় রূপান্তর হইয়াছে, যথা – – গৃহ হইতে ঘর, ভ্রাতা হইতে ভাই। দ্বিতীয়- – সংস্কৃতমূলক শব্দ, যাহার রূপান্তর হয় নাই। যথা: – জল, মেঘ, সূর্য। তৃতীয়, যে সকল শব্দের সংস্কৃতের সঙ্গে কোন সম্বন্ধ নাই।
প্রথম শ্রেণীর শব্দ সম্বন্ধে তিনি বলেন যে, রূপান্তরিত প্রচলিত সংস্কৃতমূলক শব্দের পরিবর্তে কোন স্থানেই অরূপান্তরিত মূল সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করা কর্তব্য নহে, যথা – মাথার পরিবর্তে মস্তক, বামনের পরিবর্তে ব্রাহ্মণ ইত্যাদি ব্যবহার করা কর্তব্য নহে। আমরা বলি যে, এক্ষণে বামনও যেমন প্রচলিত ব্রাহ্মণও সেইরূপ প্রচলিত; পাতাও যেরূপ প্রচলিত, পত্র ততদূর না হউক, প্রায় সেইরূপ প্রচলিত।
ভাই যেরূপ প্রচলিত, ভ্রাতা ততদূর না হউক, প্রায় সেইরূপ প্রচলিত। যাহা প্রচলিত হইয়াছে, তাহা উচ্ছেদে কোন ফল নাই, এবং উচ্ছেদ সম্ভবও নহে। কেহ যত্ন করিয়া মাতা, পিতা, ভ্রাতা, গৃহ, তাম্র বা মস্তক ইত্যাদি শব্দকে বাঙ্গালা ভাষা হইতে বহিষ্কৃত করিতে পারিবেন না। আর বহিষ্কৃত করিয়াই বা ফল কি? এ বাঙ্গালাদেশে কোন চাষা আছে যে, ধান্য, পুষ্করিণী, গৃহ বা মস্তক ইত্যাদি শব্দের অর্থ বুঝে না।
যদি সকলে বুঝে তবে কি দোষে এই শ্রেণীর শব্দগুলি বধার্থ? বরং ইহাদের পরিত্যাগে ভাষা কিংদংশে ধনশূন্য হইবে মাত্র। নিষ্কারণ ভাষাকে ধনশূন্য করা কোন ক্রমে বাঞ্ছনীয় নহে। আর কতগুলি এমন শব্দ আছে যে তাহাদের রূপান্তর ঘটিয়াছে আপাতত বোধ হয়, কিন্তু বাস্তবিক রূপান্তর ঘটে নাই, কেবল সাধারণের উচ্চারণের বৈলক্ষণ্য ঘটিয়াছে। সকলেই উচ্চারণ করে “খেউরি,” কিন্তু ক্ষৌরী লিখিলে সকলে বুঝে যে, এই সেই ‘খেউরি’ শব্দ।
এ স্থলে ক্ষৌরীকে পরিত্যাগ করিয়া খেউরি প্রচলিত করায় কোন লাভ নাই। বরং এমত স্থলে আদিম সংস্কৃত রূপটি বজায় রাখিলে ভাষার স্থায়িত্ব জন্মে। কিন্তু এমন অনেকগুলি শব্দ আছে যে, তাহার আদিম রূপ সাধারণের প্রচলিত বা সাধারণের বোধগম্য নহে – তাহার অপভ্রংশই প্রচলিত এবং সকলের বোধগম্য। এমত হলেই আদিম রূপ কদাচ ব্যবহার্য নহে।
যদিও আমরা এমন বলি না যে, , “ঘর” প্রচলিত আছে বলিয়া গৃহ শব্দের উচ্ছেদ করিতে হইবে, অথবা মাথা শব্দ প্রচলিত আছে বলিয়া মস্তক শব্দের উচ্ছেদ করিতে হইবে; কিন্তু আমরা এমত বলি যে, অকারণে ঘর শব্দের পরিবর্তে গৃহ, অকারণে মাথার পরিবর্তে মস্তক, অকারণে পাতার পরিবর্তে পত্র এবং তামার পরিবর্তে তাম্র ব্যবহার করা উচিত নহে।
কেন না, ঘর, মাথা, পাতা, তামা বাঙ্গালা; আর গৃহ, মস্তক, পত্র, তাম্র সংস্কৃত। বাঙ্গালা লিখিতে গিয়া অকারণে বাঙ্গালা ছাড়িয়া সংস্কৃত কেন লিখিব? আর দেখা যায় যে, সংস্কৃত ছাড়িয়া বাঙ্গালা শব্দ ব্যবহার করিলে রচনা অধিকতর মধুর, সুস্পষ্ট ও তেজস্বী হয়। “হে ভ্রাত:” বলিয়া যে ডাকে, বোধ হয় যেন সে যাত্রা করিতেছে, “ভাইরে” বলিয়া যে ডাকে, তাহার ডাকে মন উছলিয়া উঠে। অতএব আমার ভ্রাতা শব্দ উঠাইয়া দিতে চাই না বটে, কিন্তু সচরাচর আমার ভাই শব্দটি ব্যবহার করিতে চাই।
ভ্রাতা শব্দ রাখিতে চাই, তাহার কারণ এই যে, সময়ে সময়ে তদ্ব্যবহারে বড় উপকার হয়। “ভ্রাতৃভাব” এবং “ভাইভাব,” “ভ্রাতৃত্ব” এবং “ভাইগিরি” এতদুভয়ের তুলনায় বুঝা যাইবে যে, কেন ভ্রাতৃ শব্দ বাঙ্গালায় বজায় রাখা উচিত। এই স্থলে বলিতে হয় যে, আজিও অকারণে প্রচলিত বাঙ্গালা ছাড়িয়া সংস্কৃত ব্যবহারে অনেক লেখকের বিশেষ অনুরক্তি আছে। অনেক বাঙ্গালা রচনা যে নীরস নিস্তেজ এবং অস্পষ্ট, ইহাই তাহার কারণ।
দ্বিতীয় শ্রেণীর শব্দ, অর্থাৎ যে সকল সংস্কৃত শব্দ রূপান্তর না হইয়াই বাঙ্গালায় প্রচলিত আছে, তৎসম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলিবার নাই। তৃতীয় শ্রেণীর অর্থাৎ যে সকল শব্দ সংস্কৃতের সহিত সম্বন্ধশূন্য, তৎসম্বন্ধে শ্যামাচরণ বাবু যাহা বলিয়াছেন, তাহা অত্যন্ত সারগর্ভ এবং আমরা তাহার সম্পূর্ণ অনুমোদন করি। সংস্কৃতপ্রিয় লেখকদিগের অভ্যাস সে, এই শ্রেণীর শব্দ সকল তাঁহারা রচনা হইতে একেবারে বাহির করিয়া দেন। অন্যের রচনায় যে সকল শব্দের ব্যবহার শেলের ন্যায় তাহাদিগকে বিদ্ধ করে।
ইহার পর মূর্খতা আমরা আর দেখি না। যদি কোন ধনবান ইংরেজের অর্থভান্ডারে হালি এবং বাদশাহী দুই প্রকার মোহর থাকে, এবং সেই ইংরেজ যদি জাত্যাভিমানের বশ হইয়া বিবির মাথাওয়ালা মোহর রাখিয়া, ফার্সি লেখা মোহরগুলি ফেলিয়া দেয়, তবে সকলেই সেই ইংরেজকে ঘোরতর মূর্খ বলিবে। কিন্তু ভাবিয়া দেখিলে, এই পন্ডিতেরা সেই মত মূর্খ । তাহার পরে অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দকে বাঙ্গালা ভাষায় নূতন সন্নিবেশিত করার ঔচিত্য বিচার্য।
দেখা যায়, লেখকেরা ভূরি ভূরি অপ্রচলিত নূতন সংস্কৃত শব্দ প্রয়োজনে বা নিখুঁয়োজনে ব্যবহার করিয়া থাকেন। বাঙ্গালা আজিও অসম্পূর্ণ ভাষা, তাহার অভাব পূরণ জন্য অন্য অন্য ভাষা হইতে সময়ে সময়ে শব্দ কর্জ করিতে হইবে। কর্জ করিতে হইলে, চিরকেলে মহাজন সংস্কৃতের কাছেই ধার করা কর্তব্য। প্রথমত:, সংস্কৃত মহাজনই পরম ধনী; ইহার রত্নময় শব্দভাণ্ডার হইতে যাহা চাও, তাহাই পাওয়া যায়; দ্বিতীয়ত:, সংস্কৃত হইতে শব্দ লইলে, বাঙ্গালার সঙ্গে ভাল মিশে।
বাঙ্গালার অস্থি, মজ্জা, শোনিত, মাংস সংস্কৃতেই গঠিত। তৃতীয়ত:, সংস্কৃত হইতে নূতন শব্দ লইলে, অনেকে বুঝিতে পারে; ইংরেজি বা আরবী হইতে লইলে কে বুঝিবে? “মাধ্যাকর্ষণ” বলিলে কতক অর্থ অনভিজ্ঞ লোকেও বুঝে। “গ্লাবিটেশন” বলিলে ইংরেজি যাহারা না বুঝে, তাহারা কেহই বুঝিবে না। অতএব যেখানে বাঙ্গালা শব্দ নাই, সেখানে অবশ্য সংস্কৃত হইতে অপ্রচলিত শব্দ গ্রহণ করিতে হইবে।
কিন্তু নিষ্প্রয়োজনে অর্থাৎ বাঙ্গালা শব্দ থাকিতে তদ্বাচক অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার যাঁহারা করেন, তাঁহাদের কিরূপ রুচি, তাহা আমরা বুঝিতে পারি না । স্থূল কথা, সাহিত্য কি জন্য? গ্রন্থ কি জন্য? যে পড়িবে, তাহার বুঝিবার জন্য। না বুঝিয়া, বহি বন্ধ করিয়া, পাঠক ত্রাহি ত্রাহি করিয়া ডাকিবে, বোধ হয় এ উদ্দেশ্যে কেহ গ্রন্থ লিখে না।
যদি এ কথা সত্য হয়, তবে যে ভাষা অধিকাংশ লোকের বোধগম্য অথবা যদি সকলের বোধগম্য কোন ভাষা না থাকে, তবে যে ভাষা অধিকাংশ লোকের বোধগম্য তাহাতেই গ্রন্থ প্রণীত হওয়া উচিত। যদি কোন লেখকের এমন উদ্দেশ্য থাকে যে, আমার গ্রন্থ দুই চারিজন শব্দপন্ডিতে বুঝুক, আর কাহারও বুঝিবার প্রয়োজন নাই, তবে তিনি গিয়া দুরূহ ভাষায় গ্রন্থপ্রণয়নে প্রবৃত্ত হউন। যে তাঁহার যশ করে করুক, আমরা কখন যশ করিব না।
তিনি দুই একজনের উপকার করিলে করিতে পারেন, কিন্তু তাঁহাকে পরোপকারকাতর খলস্বভাব পাখন্ড বলিব। তিনি জ্ঞানবিতরণে প্রবৃত্ত হইয়া, চেষ্টা করিয়া অধিকাংশ পাঠককে আপনার জ্ঞানভান্ডার হইতে দূরে রাখেন। যিনি যথার্থ গ্রন্থকার, তিনি জানেন যে, পরোপকার ভিন্ন গ্রন্থপ্রণয়নের উদ্দেশ্য নাই; জনসাধারণের জ্ঞানবৃদ্ধি বা চিত্তোন্নতি ভিন্ন রচনার অন্য উদ্দেশ্য নাই; অতএব যত অধিক ব্যক্তি গ্রন্থের মর্ম গ্রহণ করিতে পারে, ততই অধিক ব্যক্তি উপকৃত ততই গ্রন্থের সফলতা।
জ্ঞানে মনুষ্যমাত্রেরই তুল্যাধিকার। যদি সে সর্বজনের প্রাপ্য ধনকে, তুমি এমত দুরূহ ভাষায় নিবন্ধ রাখ যে, কেবল যে কয়জন পরিশ্রম করিয়া সেই ভাষা শিখিয়াছে, তাহারা ভিন্ন আর কেহ তাহা পাইতে পারিবে না, তবে তুমি অধিকাংশ মনুষ্যকে তাহাদিগের স্বত্ত্ব হইতে বঞ্চিত করিলে। তুমি সেখানে বঞ্চক মাত্র। তাই বলিয়া আমরা এমত বলিতেছি না যে, বাঙ্গালার লিখন পঠন হুতোমি ভাষায় হওয়া উচিত।
তাহা কখন হইতে পারে না। যিনি যত চেষ্টা করুন, লিখনের ভাষা এবং কথনের ভাষা চিরকাল স্বতন্ত্র থাকিবে। কারণ, কথনের এবং লিখনের উদ্দেশ্য ভিন্ন। কথনের উদ্দেশ্য কেবল সামান্য জ্ঞাপন, লিখনের উদ্দেশ্য শিক্ষাদান, চিত্ত সঞ্চালন। এই মহৎ উদ্দেশ্য হুতোমি ভাষায় কখন সিদ্ধ হইতে পারে না।
হুতোমি ভাষা দরিদ্র, ইহার তত শব্দধন নাই; হুতোমি ভাষা নিস্তেজ, ইহার তেমন বাঁধন নাই; হুতোমি ভাষা অসুন্দর এবং যেখানে অশীল নয়, সেখানে পবিত্রতাশূন্য। হুতোমি ভাষায় কখন গ্রন্থ প্রণীত হওয়া কর্তব্য নহে। যিনি হুতোমপেঁচা লিখিয়াছিলেন, তাঁহার রুচি বা বিবেচনার প্রশংসা করি না। টেকচাঁদি ভাষা, হুতোমি ভাষার এক পৈঠা উপর। হাস্য ও করুণরসের ইহা বিশেষ উপযোগী।
স্কচ্ কবি বর্ণস্ হাস্য ও করুণ রসাত্মিকা কবিতায় স্কচ্ ভাষা ব্যবহার করিতেন, গম্ভীর এবং উন্নত বিষয়ে ইংরেজি ব্যবহার করিতেন। গম্ভীর এবং উন্নত বা চিন্তাময় বিষয়ে টেকচাঁদি ভাষায় কুলায় না। কেন না, এ ভাষাও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র, দুর্বল এবং অপরিমার্জিত। অতএব ইহাই সিদ্ধান্ত করিতে হইতেছে যে, বিষয় অনুসারেই রচনার ভাষার উচ্চতা বা সামান্যতা নির্ধারিত হওয়া উচিত। রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন, সরলতা এবং স্পষ্টতা।
যে রচনা সকলেই বুঝিতে পারে, এবং পড়িবামাত্র যাহার অর্থ বুঝা যায়, অর্থগৌরব থাকিলে তাহাই সর্বোৎকৃষ্ট রচনা। তাহার পর ভাষার সৌন্দর্য, সরলতা এবং স্পষ্টতার সহিত সৌন্দর্য মিশাইতে হইবে। অনেক রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য সৌন্দর্য- সে স্থলে সৌন্দর্যের অনুরোধে শব্দের – একটু অসাধারণতা সহ্য করিতে হয়। প্রথমে দেখিবে, তুমি যাহা বলিতে চাও, কোন্ ভাষায় তাহা সর্বাপেক্ষা পরিষ্কাররূপে ব্যক্ত হয়।
যদি সরল প্রচলিত কথাবার্তার ভাষায় তাহা সর্বাপেক্ষা সুস্পষ্ট এবং সুন্দর হয়, তবে কেন উচ্চ ভাষার আশ্রয় লইবে? যদি সে পক্ষে টেকচাঁদি বা হুতোমি ভাষায় সকলের অপেক্ষা কার্য সুসিদ্ধ হয়, তবে তাহাই ব্যবহার করিবে। যদি তদপেক্ষা বিদ্যাসাগর বা ভূদেববাবুপ্রদর্শিত সংস্কৃতবহুল ভাষায় ভাবের অধিক স্পষ্টতা এবং সৌন্দর্য হয়, তবে সামান্য ভাষা ছাড়িয়া সেই ভাষার আশ্রয় লইবে। যদি তাহাতেও কার্য সিদ্ধ না হয়, আরও উপরে উঠিবে; প্রয়োজন হইলে তাহাতেও আপত্তি নাই।
– নিষ্প্রয়োজনেই আপত্তি। বলিবার কথাগুলি পরিস্ফুট করিয়া বলিতে হইবে – যতটুকু বলিবার – – তজ্জন্য ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য, যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন তাহা গ্রহণ আছে, সবটুকু বলিবে করিবে, অশীল ভিন্ন কাহাকেও ছাড়িবে না। তারপর সেই রচনাকে সৌন্দর্য-বিশিষ্ট করিবে – কেন না, যাহা অসুন্দর, মনুষ্যচিত্তের উপরে তাহার শক্তি অল্প।
এই উদ্দেশ্যগুলি যাহাতে সরল প্রচলিত ভাষায় সিদ্ধ হয়, সেই চেষ্টা দেখিবে- লেখক যদি লিখিতে জানেন, তবে সে চেষ্টা প্রায় সফল হইবে। আমরা দেখিয়াছি, সরল প্রচলিত ভাষা অনেক বিষয়ে সংস্কৃতবহুল ভাষার অপেক্ষা শক্তিমতী। কিন্তু যদি সে সরল প্রচলিত ভাষায় সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হয়, তবে কাজে কাজেই সংস্কৃতবহুল ভাষার আশ্রয় লইতে হইবে। প্রয়োজন হইলে নিঃসঙ্কোচে সে আশ্রয় লাইবে।
ইহাই আমাদের বিবেচনায় বাঙ্গালা রচনার উৎকৃষ্ট রীতি। নব্য ও প্রাচীন উভয় সম্প্রদায়ের পরামর্শ ত্যাগ করিয়া, এই রীতি অবলম্বন করিলে, আমাদিগের বিবেচনায় ভাষা শক্তিশালিনী, শব্দৈশ্বর্যে পুষ্টা এবং সাহিত্যালঙ্কারে বিভূষিতা হইবে।
শব্দার্থ ও টীকা
শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় — বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমকালে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সুপন্ডিত ব্যক্তি। বাংলা ভাষার উন্নতিকল্পে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা করেন এবং ভাষাকে অপেক্ষাকৃত সরল ও গতিশীল করার ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা করেছেন। শ্যামচরণ বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ভাষারীতি এবং দীর্ঘ সমাসবদ্ধপদ ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।
কোপদৃষ্টি— অসন্তুষ্টি, বিরাগভাব।
চক্ষুশূল— দর্শন করলে বিরক্তি জন্মে এমন (কিছু)।
চত্বারিংশত— চলিশ ।
দৌরাত্ম্য— উৎপীড়ন, অত্যাচার। পুষ্করিণী— পুকুর, সরোবর।
সারগর্ভ— উৎকৃষ্টগুণ বা ধর্মযুক্ত। এখানে উপদেশপূর্ণ বক্তব্য ।
ত্রিবিধ— তিন প্রকার। এখানে বাংলা ভাষায় তিন প্রকার শব্দের কথা বলা হয়েছে। যথা: সংস্কৃত, সংস্কৃতজাত, সংস্কৃত
নয় এমন শব্দ।
বধাই – বধ বা হত্যার যোগ্য, বধ করতে হবে এমন ৷
বৈলক্ষণ্য— প্রকারান্তর, ভাবের পরিবর্তন।
ক্ষৌরী— ক্ষুর কর্ম।
হালি এবং বাদশাহী দুই প্রকার মোহর— হাল আমলের অর্থাৎ তৎকালীন ইংরেজ আমলের রাণী ভিক্টোরিয়ার মুখাঙ্কিত মোহর এবং বাদশাহী আমল অর্থাৎ পূর্বকালীন ফার্সি অক্ষর মুদ্রিত মোহর।
বস্তুসংক্ষেপ
অপর ভাষা অর্থাৎ কথ্যভাষায় গদ্যচর্চাকারীদের প্রবন্ধকার নব্য সম্প্রদায় হিসেবে উলেখ করে বাংলা গদ্য সম্পর্কে তাদের অভিমত যাচাই করেছেন। শ্যামাচারণ গঙ্গোপাধ্যায়কে এদের প্রতিনিধি হিসেবে ধরা হয়েছে। শ্যামাচারণ বাবু ১২৮৪ বঙ্গাব্দে কলিকাতা রিভিউ পত্রিকায় বাংলা ভাষা বিষয়ে লিখিত একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, বাংলায় বহুবচন বাচক ‘গণ’, জনৈক শব্দ, ত্ব ও য প্রত্যয়ান্ত শব্দ, , সন্ধির ব্যবহার, সংস্কৃত সংখ্যাবাচক শব্দ যথা একাদশ, বা চত্বারিংশত ইত্যাদি পরিত্যাজ্য।
শব্দের লিঙ্গভেদ করা যাবে না। এমন কি বহু ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও ভ্রাতা, কর্ণ, তাম্র, স্বর্ণ, পত্র, মস্তক, অশ্ব ইত্যাদি শব্দ পরিত্যাগ করতে হবে। শ্যামাচরণ বাবুর বক্তব্য অনুসারে ‘ভ্রাতৃভাব’ শব্দটি ‘ভাইভাব’ লিখতে হয় কিংবা ‘ভ্রাতৃত্ব’ হয়ে যায় ‘ভাইগিরি’। এতে বাংলা রচনা নিরস, নিস্তেজ এবং অস্পষ্ট হয়ে যায়। আসলে শ্যামাচরণ বাবু ভাষার উপকার করতে গিয়ে তার উপর দৌ করেছেন। যে বাঙালি মাথা, ভাই কিংবা ঘর বুঝেন, তিনি মন্ত্রক, ভ্রাতা, গৃহও বুঝেন।
অতএব অকারণে বহুব্যবহৃত এই সংস্কৃত শব্দগুলোকে বহিষ্কার করে বাংলা ভাষাকে সম্পদহীন করবার কোন সার্থকতা নেই। বঙ্কিমচন্দ্র মনে করেন যে, যেখানে সংস্কৃত শব্দ ভাবপ্রকাশে সহায়ক সেখানে তার ব্যবহার আবশ্যিক হওয়া উচিত। অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দকে বাংলা ভাষায় সন্নিবেশত করা যেমন নিষ্প্রয়োজন, তেমনি বিনা বিচারে সংস্কৃত শব্দ বর্জনও অনুচিত বলে প্রবন্ধকার মনে করেন।
ভাবপ্রকাশের জন্যে যদি ক্ষেত্র-বিশেষে বিদেশি ভাষা থেকে শব্দ ঋণ করতে হয় তবে সংস্কৃত ভাষারপারস্থ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ সংস্কৃত শব্দসম্পদে মহাজন এবং বাংলা ভাষার নিকটীয়ও বটে। পাঠকের বোধগম্যতা সাহিত্যের প্রধান শর্ত। পরোপকার তথা জনসাধারণের জ্ঞানবৃদ্ধি বা চিত্তোন্নতি গ্রন্থরচনার প্রধান উদ্দেশ্য।
অতএব, যে ভাষায় গ্রন্থরচনা করলে অধিক ব্যক্তি তার মর্ম গ্রহণ করতে পারে সে ভাষাতেই গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিত। তাই বলে হুতোমি ভাষা এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ওই ভাষা নিস্তেজ, অসুন্দর, শব্দদারিদ্র্যপূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রে পবিত্রতাশূন্য। কথনের উদ্দেশ্য সামান্য জ্ঞাপন কিন্তু লিখনের উদ্দেশ্য শিক্ষাদান ও চিত্ত সঞ্চালন। এ জন্যেই হুতোমি ভাষা পরিত্যাজ্য হওয়া উচিত। টেকচাঁদি ভাষা হুতোমি ভাষা অপেক্ষা সামান্য উন্নত।
তবে এতে হাস্যরস সৃষ্টি করা গেলেও গম্ভীর ও উন্নত ভাবপ্রকাশ অসম্ভব। বঙ্কিমচন্দ্রের সিদ্ধান্ত, বিষয় অনুসারেই রচনার ভাষার উচ্চতা বা সামান্যতা নির্ধারিত হওয়া উচিত। সরলতা এবং স্পষ্টতাই রচনার প্রধান গুণ ও প্রথম প্রয়োজন। এর সঙ্গে সৌন্দর্যের সংমিশ্রণের ফলে রচনা সর্বোৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে। তবে বক্তব্যে বিষয়ের চাহিদা অনুসারে টেকচাঁদি বা হুতোমি কিংবা বিদ্যাসাগরি বা ভূদেবিয় সংস্কৃতবহুল ভাষা ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবহার হতে পারে।
কারণ বলার কথাগুলো পরিস্ফুট ও সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করাই প্রধান উদ্দেশ্য। এ জন্যে সংস্কৃত, আরবি, গ্রাম্য, বন্য যে-কোন ধরনের শব্দ গ্রহণ করা যেতে পারে। শুধুমাত্র অশীল শব্দাবলী পরিত্যাজ্য। কারণ অসুন্দর মনুষ্যচিত্তে স্থায়ী আসন লাভ করতে পারে না। সরল ভাষাও সংস্কৃত ভাষা অপেক্ষা কখনো শক্তিমতী হয়ে ওঠে। যদি ওই ভাষাতে প্রকৃত উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হয় তবে নিঃসঙ্কোচে সংস্কৃতভাষার আশ্রয় গ্রহণ করা যেতে পারে।
বঙ্কিমচন্দ্র মনে করেন যে, সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে সব ধরনের গোঁড়ামি ও একগুয়েমি ত্যাগ করে রচনার প্রয়োজন এবং বিষয়বস্তু অনুসারে ভাষা ব্যবহার করা উচিত। তিনি নব্য ও প্রাচীন উভয় সম্প্রদায়ের পরামর্শ ত্যাগ করে ভাষা শক্তিশালী, শব্দের ঐশ্বর্যে পুষ্ট এবং সাহিত্যালঙ্কারে ভূষিত করার লক্ষ্যে এ মধ্যপথ অবলম্বনের কথা বলেন।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের উত্তর লিখুন
১. শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা ভাষা থেকে কি কি জিনিস বাদ দিতে চান?
২. ‘হুতোমি ভাষা গ্রন্থ রচনায় পরিত্যাজ্য হওয়া প্রয়োজন – কেন?
৩. বঙ্কিমচন্দ্রের মতে রচনার ভাষার উচ্চতা বা সামান্যতা কিসের উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত?
২ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মনে করেন যে, কথনের উদ্দেশ্য কেবল অল্পকিছু ব্যক্ত করা, আর লিখনের উদ্দেশ্য হলো লোকশিক্ষাদান ও মনোজগতের সুশীল বিকাশ সাধন। এ-কারণে তিনি হুতোমি ভাষায় গ্রন্থরচনাকে পরিত্যাজ্য মনে করেছেন। কারণ, আলালি গদ্যের চেয়েও হুতোমি গদ্য নিচুমানের বলে তাঁর মত। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন যে, হুতোমি ভাষা দরিদ্র, শব্দধনহীন। এই ভাষা যথেষ্ট নিস্তেজ, শিথিল। এখানে সৌন্দর্য ও শীলতা বলে কিছু নেই আর তাই এখানে পবিত্রতাও থাকতে পারে না। এই ভাষা পাঠ করলে রুচির স্খলন ঘটে। এ সব কারণে বঙ্কিমচন্দ্র মনে করেন যে, হুতোমি ভাষা গ্রন্থ রচনায় পরিত্যাজ্য হওয়া প্রয়োজন।
প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করুন
১. যে ভাষা বাঙ্গালা সমাজে প্রচলিত, যাহাতে বাঙ্গালার নিত্যকার্য সকল সম্পাদিত হয়, যাহা সকল বাঙ্গালীতে বুঝে, তাহাই বাঙ্গালা ভাষা ।
২. ‘হে ভ্রাত:’ বলিয়া যে ডাকে, বোধ হয় যেন সে যাত্রা করিতেছে, ‘ভাইরে’ বলিয়া যে ডাকে, তাহার ডাকে মন উছলিয়া উঠে।
৩. কথনের উদ্দেশ্য কেবল সামান্য জ্ঞাপন, লিখনের উদ্দেশ্য শিক্ষাদান, চিত্ত সঞ্চালন।
৪. বিষয় অনুসারেই রচনার ভাষার উচ্চতা বা সামান্যতা নির্ধারিত হওয়া উচিত।
৫. যাহা অসুন্দর, মনুষ্যচিত্তের উপরে তাহার শক্তি অল্প।
৪ নং ব্যাখ্যার নমুনা-উত্তর :
আলোচ্য অংশটুকু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বাঙ্গালা ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে গৃহীত হয়েছে। এখানে প্রবন্ধকার বাংলা ভাষা, বিশেষত বাংলা গদ্য সম্পর্কে নিজের মত ব্যক্ত করেছেন। প্রাচীনপন্থী সংস্কৃতপ্রিয় পন্ডিতগণ বাংলা গদ্যে আভাঙ্গা অর্থাৎ খাঁটি সংস্কৃত শব্দ ও দীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদ আমদানি করার পক্ষে ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন যে, যাদের সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা নেই তাদের বাংলা গ্রন্থ প্রণয়নের অধিকার নেই।
অন্যদিকে নব্যপন্থী প্যারীচাঁদ মিত্র বা কালীপ্রসন্ন সিংহের গ্রন্থের ভাষা প্রচলিত কথ্যরীতির নির্ভেজাল অনুকৃতি। বঙ্কিমচন্দ্ৰ এই উভয় পথই অগ্রহণযোগ্য মনে করেন। কারণ তাঁর মতে কথন ও লেখনের উদ্দেশ্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। তিনি অভিমত প্রদান করেন যে, গ্রন্থের উপজীব্য বিষয়বস্তু যদি গুরুগম্ভীর হয় তবে সে অনুসারে ভাষাও গাম্ভীর্যপূর্ণ হবে, আর বিষয়বস্তু হালকা বা লঘু হলে ভাষা তাকে অনুসরণ করবে। এর উল্টো হলে ভাষা আড়ষ্ট হবে এবং বিষয়ের যথাযথ উপস্থাপনে হবে ব্যর্থ।
রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর লিখুন
১. ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষার নব্যপন্থীদের মতামত সম্বন্ধে কি বলেছেন?
২. বঙ্কিমচন্দ্রের মতে সাহিত্যের ভাষা কিরূপ হওয়া উচিত তা ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধ অনুসরণে লিখুন।
৩. . বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ হতে বাংলা ভাষার গতি প্রকৃতির পরিচয় দিয়ে আপনার মতে আদর্শ বাংলা কিরূপ হওয়া উচিত এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করুন।
৪. ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধের নামকরণের সার্থকতা যাচাই করুন।
৫. বাংলা ভাষার আদর্শরূপ কি হওয়া উচিত? বঙ্কিমচন্দ্রের মত উল্লেখ করে প্রশ্নটির যথাযথ উত্তর দিন।