আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-ব্রাউন ও লেভিনসন এর বিনম্রতার কৌশল অনুসারে বাংলা ভাষায় লিখিত দাওয়াতপত্রের বিনম্রতার ফলাফল পর্যালোচনা
ব্রাউন ও লেভিনসন এর বিনম্রতার কৌশল অনুসারে বাংলা ভাষায় লিখিত দাওয়াতপত্রের বিনম্রতার ফলাফল পর্যালোচনা
এই গবেষণাকর্মের ফলাফলে ব্রাউন ও লেভিনসন এর বিনম্রতা তত্ত্বের (Brown and Levinson, 1987) যথাযথ প্রয়োগ ঘটেছে। বাংলা ভাষায় লিখিত বিভিন্ন শ্রেণির দাওয়াতপত্রে বিনম্রতাসূচক শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এই ফলাফলে প্রতিফলিত হয় যে, ব্রাউন ও লেভিনসনকৃত ইতিবাচক বিনম্রতা চরিতার্থ করার ১৫টি কৌশলের মধ্যে বিশ্লেষিত ৫ শ্রেণির দাওয়াতপত্রে ৫টি কৌশলের প্রয়োগ ঘটেছে, যথা-
১) শ্রোতাকে মনোযোগ দেওয়া ii) বাড়িয়ে তোলা (শ্রোতার অনুভূতি) iii) কার্যক্রমে বক্তা- শ্রোতাকে অন্তর্ভুক্ত করা iv) শ্রোতার সহানুভূতি বাড়িয়ে তোলা এবং v) শ্রোতাকে খেয়াল করা। একইভাবে ব্রাউন ও লেভিনসন এর নেতিবাচক কিম্রতা চরিতার্থ করার ১০টি কৌশলের মধ্যে ৬টি কৌশলের প্রয়োগ দাওয়াতপত্রসমূহে পাওয়া যায়, যেমন- i) বক্তা হিসেবে কৃতজ্ঞ হওয়া ii) অকিঞ্চিৎকর হওয়া iii) সম্মান দেওয়া iv) রক্ষাকবচ v) স্বাভাবিকভাবে পরোক্ষ হওয়া এবং vi) হস্তক্ষেপ কমিয়ে আনা।
উল্লিখিত কৌশলসমূহ ব্যতীত ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিনম্রতা চরিতার্থ করার অবশিষ্ট কৌশলের প্রয়োগ বিশ্লেষিত নমুনা পাওয়াতপত্রে পরিলক্ষিত হয় নাই। কারণ, অবশিষ্ট কৌশলসমূহ যোগাযোগের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলেও বাংলা ভাষায় লিখিত দাওয়াতপত্রে এগুলি ব্যবহার করা হয় না।
কৌশলসমূহ অনুসারে পারিবারিক দাওয়াতপত্রে ৪৫টি ইতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ ও ৭১টি নেতিবাচক বিদ্ৰতাসূচক শব্দ পাওয়া যায়। অর্থাৎ ৩৯ শতাংশ ইতিবাচক এবং ৬১ শতাংশ নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দের প্রয়োগ আমন্ত্রণকারী করেছেন। একইভাবে ধর্মীয় দাওয়াতপত্রে ৮টি ইতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ এবং ১৪টি নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
শতকরা হিসেবে যার পরিমাণ যথাক্রমে ৩৬ ও ৬৪ শতাংশ। সামাজিক-সাংস্কৃতিক শ্রেণির দাওয়াতপত্রে ২৩টি ইতিবাচক ও ৪৬টি নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ পাওয়া যায়। অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ ইতিবাচক এবং ৬৭ শতাংশ নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ এই শ্রেণির দাওয়াতপত্রে রয়েছে।
দাপ্তরিক শ্রেণির দাওয়াতপত্রের ক্ষেত্রে ৩৮টি ইতিবাচক এবং ৮৮টি নেতিবাচক বিনম্রতা নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ পাওয়া যায়। ৩০ শতাংশ ইতিবাচক এবং ৭০ শতাংশ নেতিবাচক শব্দ আমন্ত্রণকারী এক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন।
একাডেমিক শ্রেণির ক্ষেত্রে ৩৩টি ইতিবাচক ও ৭৫টি নেতিবাচক বা ৩১ শতাংশ ইতিবাচক ও ৬৯ শতাংশ নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ দাওয়াতপত্র প্রণয়নকারী ব্যবহার করেছেন। সব মিলিয়ে উল্লিখিত ৫টি শ্রেণির দাওয়াতপত্রে ৩৩ শতাংশ ইতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ এবং ৬৭ শতাংশ নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশের প্রয়োগ ঘটেছে।
প্রতিটি ভাষায় নিজস্ব স্বকীয়তা বিদ্যমান। পারিপার্শ্বিক সামাজিক অবস্থা দ্বারা আমাদের ভাষিক আচরণ প্রভাবিত হয়। সংস্কৃতিগত ভাবেই বাঙালি ভাষিক সমাজে বিনম্রতার বহুল প্রচলন রয়েছে। লিখিত ভাষার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। দাওয়াতপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে কিম্রতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়।
অতিথিকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে আমন্ত্রণকারী নিজের আন্তরিকতা, সৌজন্যবোধ তুলে ধরে বিনীতভাবে অনুরোধ করার জন্য দাওয়াতপত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক বিভিন্ন শব্দ বা বাক্যাংশ প্রয়োগ করেন।
ইতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশের সাহায্যে আমন্ত্রণকারী নিজের অভিব্যক্তি’ আমন্ত্রণকারীর নিকট উপস্থাপন করেন এবং ‘অভীক’ হ্রাস করার জন্য নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ ব্যবহার করেন। প্রতিটি শ্রেণির দাওয়াতপত্রে নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ অধিক ব্যবহার করা হয়েছে।
অতিথিকে বিনীতভাবে অনুরোধ জানানোর জন্য আমন্ত্রণকারী এই শ্রেণির শব্দ অধিক প্রয়োগ করেছেন। নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে আমন্ত্রণকারী নিজের বিনম্রতা, আন্তরিকতা আমন্ত্রণগ্রহিতার নিকট প্রকাশ করার পাশাপাশি নেতিবাচক পরিস্থিতিও পরিহার করেন।
কারণ এ ধরনের নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দাবলি দাওয়াতপত্রে ব্যবহার না করলে আমন্ত্রণগ্রহিতা অসন্তুষ্ট হতেন এবং অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন না। এর ফলে আমন্ত্রণকারী এবং আমন্ত্রণগ্রহিতার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক হ্রাস পেতো। ভাষিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ অপেক্ষা নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
এই ধরনের শব্দাবলি ব্যবহারের কারণে আমন্ত্রণগ্রহিতাও আমন্ত্রণকারীর আন্তরিকতা, বিনম্রতা, শ্রদ্ধাবোধ, সৌজন্যবোধ অনুভব করে নিজে সম্মানিত হন। বিনম্রতাসূচক এই শব্দসমূহের প্রয়োগ আমাদের সংস্কৃতির অংশ।
এই ধরনের শব্দের প্রয়োগ ভাষিক বিনম্রতাকেই নির্দেশ করে এবং একই সাথে আমন্ত্রণকারীর অভিব্যক্তি ভীতিকারী কর্ম বা ‘অভীক হ্রাস করে সমাজে ঐকতান বজায় রাখে (Habwe, 2010)। বিনম্রতাসূচক সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ‘অভিব্যক্তি’ বৃদ্ধি এবং ‘অভীক’ হ্রাস দুটো বিষয়ই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যা দাওয়াতপত্রের লিখিত উক্তিমালা বা ডিসকোর্সে সুস্পষ্ট হয়।
আরও দেখুন: