শব্দার্থ ও বাক্যার্থ

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-শব্দার্থ ও বাক্যার্থ

শব্দার্থ ও বাক্যার্থ

মূল্যহীন সোনা হয় তব স্পর্শে, হে শব্দ অপ্সরী দূরাপের মদগর্ব খর্ব করো পরশে নিষ্ক্রিয়। তোমার অবেদ্য গানে অব্যক্তির গতর্ক প্রহরী বিষয় নিদ্রায় লোটে, মুক্তি পায় অনির্বচনীয় । তোমার আকাশবাণী জলেস্থলে, পর্বতে, কাননে আনন্দে, ব্যাথায়, রসে, রূপসীর পার্থিব আননে ।।

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত শব্দকে তুলনা করেছিলেন অপ্সরীর সঙ্গে, তিনি লক্ষ্য করেছিলেন এর সর্ববিস্তারী রূপ । বস্তুতঃ শব্দ কর দাপুটে জিনিস । তবে এই দাপট অবশ্যই এর অর্থের জন্য। শব্দার্থের মাধ্যমে মানুষের মনের ভাব প্রকাশিত হয়, ‘মুক্তি পায় অনির্বচনীয় ।

 

শব্দার্থ ও বাক্যার্থ

 

কবির কল্পনা নয়, আমরা এখানে দেখবো বাগর্থবিদগণ শব্দকে কিভাবে দেখেছেন, কিভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এর অর্থ শব্দের অর্থ সংক্রান্ত আলোচনাকে বলা হয় শাব্দিক বাগর্থবিদঃ । শব্দের অর্থ নির্ণয় খুব সহজ কাজ নয়। অর্থের তারল্য ও অনির্ধারণযোগ্যতাই এর প্রদান কারণ । একটি শব্দের অর্থকে মৌলিক ধারণায় ভেঙ্গে ফেলা যেতে পারে এবং ঐ মৌলিক ধারণাসমূহকে আমরা বলতে পারি অর্থমূল বা বার্ষিক পরমাণু (Hofmann 1993 226 ) । যেমন :

পুরুষ

মহিলা

বালিকা

নপুংসক বেশ্যা বন্ধ্যা

মৃতবৎসা

পুংলিঙ্গ+ প্রাপ্তবয়স্ক

লিঙ্গ+ প্রাপ্তব

পুংলিঙ্গ + অপ্রাপ্তবয়স্ক

ড্রীলিঙ্গ + অপ্রাপ্তবয়স্ক

পুংলিঙ্গ+ প্রাপ্তবয়স্ক + পুরুষত্বহীনতা

ড্রীলিঙ্গ + প্রাপ্তবয়স্ক বেশ্যাবৃত্তি

স্ত্রীলিঙ্গ+ প্রাপ্তবয়স্ক + বিবাহিত + সন্তানহীনতা

স্ত্রীলিঙ্গ+ প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত + মৃতসন্তান

এভাবে শব্দের অর্থ নির্ণয়ে আমরা যা করছি তা মূলতঃ অন্য শব্দের সাথে তুলনা একটি শব্দ সংশয়ের অন্যান্য শব্দের সাথে যে সম্পর্ক স্থাপন করে আমরা তাকে বলে অনুস্থাপনিক সম্পর্ক। উপরের দুটা েছয়টি শব্দ নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরস্পরের সাথে অনুস্থাপনাত সম্পর্কে আবদ্ধ।

 

শব্দার্থ ও বাক্যার্থ

 

একটি বিচ্ছিন্ন শব্দের অর্থ বের করা প্রায়ই মুশকিলের কাজ। শব্দের অর্থ সুন্দর হয় এর বাক্যে ব্যবহারে। একটি শব্দ বাক্যের অন্যান্য শব্দের সাথে যে সম্পর্ক স্থাপন করে আমরা তাকে বলি পারস্পরিক সম্পর্ক
জল পড়ে পাতা নড়ে। এ বাক্যটিতে জল এর সাথে পাড়া ও পাতার সাথে নড়ার সম্পর্ক রয়েছে। আমরা বুঝতে পারি যে এখানে পড়া মানে পঠন (যেমন- বই পড়া), পরিধান (যেমন- কাপড় পড়া) কিংবা মক্কোচ্চারণ (যেমন-

পানিপড়া) নয়, এর অর্থ হলো পতন। তেমনি এখানে পাতা মানে বিশেষ্য বাচক বইয়ের বাগ বা ক্রিয়াবাচক স্থাপন করা (যেমন- ফাঁদ পাতা) নয়, এর অর্থ গাছের পাতা। বাক্যের অর্থ সংক্রান্ত আলোচনাকে বলে ব্যাকরণিক বাগধবিদ্যা । বাক্যের অর্থ কেবলমাত্র তার শব্দের অর্থগুলোর উপর নির্ভর করে না, শব্দগুলোর বিন্যাসের উপরও নির্ভর করে ।

বাক্যের অর্থ যদি কেবল শব্দগুলোর অর্থের দ্বারা নির্ণীত হতো তাহলে নীচের বাক্য দুটোর অর্থ হতো

একই রাজার হয় করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। কাঙালের জন্য করে সমস্ত রাজার ধন চুরি।

কিংবা নীচের শব্দ গুলোর বিন্যাস অর্থপূর্ণ হতো

শুনে একলা না তবে আসে যদি চল তোর রে ডাক কেউ

এখানে অর্থপূর্ণ শব্দগুলো একটি অর্থহীন বাক্য সৃষ্টি করেছে কারণ তারা ব্যাকরণের নিয়ম মেনে বিন্যস্ত হয়নি,

যেমনটা হয়েছে নীচে:

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে শব্দার্থ ও বাক্যার্থের সম্পর্ককে আমরা নিম্নলিখিত সহজ

সূত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি

বাক্যার্থ শব্দার্থ ব্যাকরণিক নিয়মাবলী

আর এইচ রবিন্স (১৯৯৮৩ : ১৭) বলেন, “সাধারণভাবে বলতে গেলে শব্দ হচ্ছে সুবিধাজনক একক যার অর্থ বিবৃত করা হয় এবং এটা মনে করা দোষের নয় যে শব্দ অর্থপ্রাপ্ত হয় বাক্যে প্রয়োগের মাধ্যমে। অধিকাংশ বাক্যই একাধিক শব্দযোগে গঠিত, তবে বাক্যের অর্থকে বিচ্ছিন্ন বাক্যগুলোর অর্থের যোগফল মনে করা যায় না
সত্যশতমূলক বাগর্থবিদ্যায় (বিস্তারিত আলোচনা চতুর্থ অধ্যায়ে) শব্দ ও বাক্যের এ সম্পর্ক একটি মূলনীতির মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়, যথা :

“কোন প্রকাশের অর্থ হলো তার অংশগুলোর অপেক্ষক
দার্শনিক গটলর ফ্রেজের নামানুসারে এর নাম হয়েছে বিরচনামূলকতার ফেন্দীয় নীতি । ক্ষতঃ শব্ বাক্যার্থের প্রকৃতি ও সম্পর্ক নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য তত্ত্ব।

 

শব্দার্থ ও বাক্যার্থ

 

তবে এসব তত্ত্বের সাথে একটি আভিমুখিক সমস্যা প্রাসঙ্গিকথাবে যুক্ত। সমস্যাটি হলো ভাষিক তত্ত্ব শব্দার্থ থেকে বিশ্লেষণ শুরু করে বাক্যার্থের দিকে যাবে। নাকি বাক্যার্থ থেকে বিশ্লেষণ শুরু করে শব্দার্থের দিকে যাবে। আমাদের বিবেচনায় উভয় পদ্ধতিই নীতিগতভাবে বৈধ ।

কেম্পসন (১৯৭৭ : ২৮) বলেন, “যদি শব্দার্থের স্বাধীন বৈশিষ্ট্যয়ন প্রদত্ত হয়, তবে বাক্যার্থকে শব্দার্থের অহরণরূপে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে, আর যদি বাক্যার্থকে স্বাধীন বৈশিষ্ট্যয়ন প্রদত্ত হয় তবে শব্দার্থকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে বাক্যাথে তার অবদানের মাধ্যমে।

আরও দেখুন:

 

Leave a Comment