আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় শিখন ফল: শুনা, বলা, পড়া ও লেখা – যা আরবি ভাষার দক্ষতা শিক্ষাদান পদ্ধতি এর অন্তর্ভুক্ত।
শিখন ফল: শুনা, বলা, পড়া ও লেখা
ভাষার দক্ষতা অর্জনের প্রথম সোপান হলো- শ্রবণ দক্ষতা। মানুষের পারস্পরিক ভাবের আদান প্রদান বা দৈনন্দিন যোগাযোগের ক্ষেত্রে শ্রবণ দক্ষতা বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। যে কোন ভাষায় শ্রবণ দক্ষতা অর্জন করতে হলে— সর্বপ্রথম প্রয়োজন মনযোগ দিয়ে শোনা। গৃহপরিবেশে শোনার সুযোগ পেলে- ভাষা দক্ষতা অর্জনের ভিত রচিত হয়। ক্রমান্বয়ে সেই ভাষা ব্যবহার করে নিজের প্রয়োজন ও চাহিদা প্রকাশ করতে পারে। শিশুরা তাদের আপন-আপন পরিবেশ থেকে যেভাবে আলাপ-চারিতা শুনে অনুকরণ করে, সেভাবেই নিজ ইচ্ছা- অনিচ্ছা ও চাহিদার প্রকাশ ঘটায়।
শিশুর বয়স যতই বাড়ে, ততই সে উপযুক্ত শব্দ ব্যবহারের মাধমে বাক্য গঠন করে এবং ভাষা ব্যবহারে দক্ষতা ও নিপুনতা অর্জন করে। তাই শিশুর ভাষা দক্ষতার বিকাশে শ্রবণ দক্ষতা’ অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ, শোনার সুযোগ হলে- বলার আগ্রহ (Interest in Speaking)সৃষ্টি হবে। পরবর্তীকালে শুদ্ধভাবে লিখে প্রকাশ করতে পারবে।
শিক্ষার্থীর শোনা বা শ্রবন দক্ষতার ওপর নির্ভর করে শিখন-শিখানো কার্যাবলির সাফল্য । শ্রবণ দক্ষতা অর্জিত হলে শিক্ষর্থীরা কথন, পঠন ও লিখন দক্ষতা অর্জনে সফল হয়ে ওঠে। ভালভাবে শুনলেই কেবল বিষয়বস্তু অনুধাবন, অনুশীলন ও বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব হয়ে ওঠে। ভাষার উচ্চারণ শ্রবণের মাধ্যমে বাক্য গঠন, প্রকাশভঙ্গি, চিন্তাধারাসহ নানাবিধ বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়; দু’জন ব্যক্তির মধে সংলাপ ও যোগাযোগের জন্য কথোপকথন শ্রবনের মাধ্যমে একে অপরের ভাব বুঝতে পারে বলেই তা সংঘটিত হয়ে থাকে। এজন্য ‘শ্রবণ দক্ষতা’ (Listening Skill) ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি।
শ্রবণ দক্ষতার গুরুত্ব
শিশুরা যে ভাষাতে শোনে সে ভাষাতেই কথা বলতে শেখে। যে কোন ভাষা আয়ত্ত করার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হয় সে ভাষা শ্রবণ করা। মানুষের দুটি কান, একটি মুখ; দু’বার শোনে একবার বলে। শ্রবণ দক্ষতা অর্জিত হলেই কেবল বলার দক্ষতা ও নৈপুণ্য অর্জিত হয়। কোন কাজের আঞ্জাম দিতে চাইলে প্রথমে ব্যক্তিকে শুনতে ও বুঝতে হবে। তা হলেই তিনি কাজটি সঠিকভাবে করতে সক্ষম হবেন।
ভাষা শ্রবণ ব্যতীত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না। শ্রবণ দক্ষতার সাহায্যে জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার অর্জন করা সম্ভবপর হয়। রেডিও, টেলিভিশন, টেপরেকর্ডার, অডিও, ভিডিও, ইউটিউব ও আলোচকদের মুখ থেকে জ্ঞান সম্পন্ন অনেক কথা শ্রবণ করে নিজের জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। পড়া কিংবা আবৃত্তি করার জন্য শোনার কোন জুড়ি নেই। অতএব, ‘শ্রবণ দক্ষতা’ অর্জন ভাষা শিক্ষা ও শিক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার।
শ্রবণ দক্ষতার শিখন ফল
- সিলেবাসভুক্ত গল্প, সংলাপ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়াদি মনোযোগের সাথে শ্রবণ করে ও অর্থ অনুধাবন করে
- শিক্ষার্থীরা বলতে ও লিখতে সক্ষম হবে।
- সংলাপসমূহে ব্যবহৃত আসবাবপত্র ও বস্তু সামগ্রীর নাম ও পরিভাষাদি শুনে বুঝতে এবং নিজে কথোপকথনে
- অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করার ও উত্তর দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।
- শ্রেণিকক্ষে সহপাঠীদের সাথে ও তার বাইরের কোনো বিষয়ের আলোচনা আগ্রহ সহকারে শ্রবণ করে তা উপলব্ধি করতে পারবে।
- নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দেশাত্মবোধ ইত্যাদি উপদেশমূলক আরবি সাহিত্য তথা গল্প, কবিতা ও সংলাপ শ্রবণ করে- আরবি ভাষায় তা ব্যক্ত করতে পারবে।
- তাওহীদ, রেসালাত, নসিহত, হজ, নদ-নদীসহ নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্য, মানুষকে সহায়তা, প্রতিষ্ঠান, আমানত, দয়া, ভাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলা, হাট বাজার বা মার্কেটে কথোপকথন, স্বাধীনতা, ইন্টারনেট, প্রভৃতি বিষয়
- সম্পৃক্ত বর্ণনা, কবিতা ও সংলাপ শুনে ও অনুধাবন করে তা বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারবে।
- রোজা, হজ, মসজিদে নববী, বাইতুল্লাহ, হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু/আনহাশৃঙ্খলা, সাধীনতা, কক্সবাজার ভ্রমন, দেশপ্রেম, মাদরাসা ক্যাম্পাস, শারীরিক ব্যায়াম, গাছপালা, ই-লার্নিং প্রভৃতি গল্প,
- সংলাপ ও কবিতায় পঠিত বিষয়াদি শুনে অনুধাবন করবে এবং তা ব্যক্তি জীবনে বাস্তব প্রয়োগ করতে পারবে।
- শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর এবং বিদেশিদের সাথে আরাবি ভাষায় আলোচনা শুনে অনুধাবন করতে পারবে এবং নিজে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
- বিষয়বস্তু সংশ্লিষ্ট গল্প, কবিতা ও সংলাপ থেকে নিত্য-নতুন শব্দ শুনে তা আত্মস্থ করতে সক্ষম হবে।
- যে কোনো গল্প, কবিতা, হামদ-নাত, কথোপকথন, বক্তৃতা শ্রবণ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইসলামি চেতনাবোধ জাগ্রত হবে। • সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা শুনে— তার মর্ম অনুধাবন করতে পারবে।
‘শ্রবণ দক্ষতা’ শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সমস্যাসমূহ
যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে শোনা বা শ্রবন দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুনে বুঝতে না পারা বা ভালোভাবে শুনতে না পারলে, উদ্ভূত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। শ্রেণিকক্ষের ক্ষেত্রে- এ বিষয়টি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা শিক্ষার্থী শিক্ষার্থী। পারস্পরিক বোঝা-পড়া নির্ভর করে— শোনার ওপর। এক্ষেত্রে প্রধানত দু’ধরণের সমস্যা হতে পারে।
প্রথমত:
এ দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক বা পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। যেমন— শারীরিক সমস্যা, শ্রবনেন্দ্রিয়ের ত্রুটি ও বধিরতা, ভাষা বলাও শোনার সুযোগ না পাওয়া, শব্দ দূষণে আক্রান্ত প্রতিকূল পরিবেশ, অমনোযোগ, অনাগ্রহ, জড়তা, শঙ্কা প্রভৃতি ।
দ্বিতীয়ত:
শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অর্জনে কিছু অন্তরায় হতে পারে। যথা— শিক্ষকের অনুপযোগী কন্ঠস্বর বা স্বরপ্রক্ষেপণ, উচ্চারণগত ত্রুটি, মুদ্রাদোষ, বৈচিত্রহীন উপস্থাপন, একটানা দীর্ঘ-ক্লাস, জনবহুল স্থানে প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি কারণে শোনার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া অন্যবিধ অনেক সমস্যা রয়েছে, যেসব কারণে শুনে হৃদয়ঙ্গম করা দুঃসাধ্য ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়।
শ্রবণ দক্ষতা সমস্যাসমূহের সমাধান
- শুনার ক্ষেত্রে সমস্যাগুলোর সম্যক সমাধান করার কয়েকটি পদ্ধতি তুলে ধরা হলো ।
- গৃহপরিবেশে পারস্পরিক আলাপ-চারিতার ব্যবস্থা করা ।
- শোনার আগ্রহ ও উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা। উপযুক্ত বিষয় নির্বাচন এবং বিষয়টি হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয় করে তোলা ।
- রেডিও, টেলিভিশন, অডিও, ভিডিও প্রভৃতি শ্রবণের ব্যবস্থা করা।
- শ্রবনেন্দ্রিয়ের বা শারীরিক সমস্যা থাকলে তা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
- অনুপ্রেরণা ও পরামর্শমূলক নির্দেশান ।
- শিক্ষকের শ্রেণি উপযোগী কন্ঠস্বর সৃষ্টির চেষ্টা করা।
- আকর্ষণীয় শ্রবণ উপরকরণ ব্যবহার করা।
শ্রবণ দক্ষতা শিক্ষাদানের বিভিন্ন কৌশল
১. শিক্ষার্থীদেরকে প্রথমে শিক্ষকের বক্তব্য শ্রবণ করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। এজন্য ক্লাস রুমকে অবশ্যই কোলাহলমুক্ত করে উপযুক্ত স্থানে পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষক তার বক্তব্য পেশ করবেন।
২. আরবি এবারত বা কথোপকথন সুন্দরভাবে বলা বা শোনার জন্য শিক্ষার্থীর সামনে শিক্ষককেই উত্তম আদর্শ মডেল হতে হবে।
৩. আরবি এবারত বা বাক্য সমষ্টি শিক্ষার্থীদের সামনে পুনরাবৃত্তি করতে হবে।
৪. শিক্ষক পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীদের লিসেনিং স্কিল বা শোনার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এজন্য তাদের সামনে পঠিত এবারত মনোযোগ সহকারে শুনতে বাধ্য করবেন। এরপর শিক্ষার্থীরা ঐ এবারত বা অনুচ্ছেদ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করবে।
৫. প্রত্যেক শিক্ষার্থীই তাদের সামনে পঠিত বিষয় পৃথক পৃথকভাবে বলার চেষ্টা করবে। কেননা, পৃথক বলার মাধ্যমে পাঠের মধ্যকার ভুলভ্রান্তি স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর সামষ্টিক পাঠে— কোন বিষয় শুনতে ও পড়তে সকলেরই ভাল লাগে ।
৬. শিক্ষার্থীর পাঠপরিকল্পনা: শ্রবণ দক্ষতা শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষককে অবশ্যই সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
আরও দেখুনঃ