Site icon Language Gurukul [ ভাষা গুরুকুল ] GOLN

সংকেত বিজ্ঞান ও বাগর্থ বিদ্যা

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-সংকেত বিজ্ঞান ও বাগর্থ বিদ্যা

সংকেত বিজ্ঞান ও বাগর্থ বিদ্যা

সংকেতবিজ্ঞান একটি ব্যাপক পরিসর শাস্ত্র। এতে আলোচিত হয় সংকেত আদানপ্রদানের ক্রিয়াকৌশল । মানুষের ভাষিক যোগাযোগ সম্পন্ন হয় তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে। তথ্য আদানপ্রদানের প্রক্রিয়াটি এরকম : প্রথমে বক্তা তার মনের ভাবকে বা বাণীকে ভাষায় সংকেতবন্ধ করেন, তারপর তিনি তা উচ্চারণের মাধ্যমে ধ্বনিতরঙ্গে রূপান্তরিত করেন, সেই ধ্বনিতরঙ্গ শ্রোতার প্রবণযজ্ঞের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছলে তিনি তার পাঠোদ্ধার করেন। প্রক্রিয়াটি এভাবে দেখানো যায়;

বাণী →সংকেতবদ্ধকরণ→ সুনিতরঙ্গপাঠাকার→ বাণী
বক্তা                                                    শ্রোতা

কিন্তু একজন ভাষাব্যবহারকরী শব্দের অর্থকে কিভাবে উপলব্ধি করে ? এ প্রশ্নের উত্তরে ফেদিন দ্য সোস্যুর বলেন যে ভাষা ব্যবহারকারীর মনে থাকে ধারণা ও ধ্বনিমূর্তির সমন্বয়ে গঠিত সংকেত এবং এ সংকেতই তাকে শব্দের অর্থ উপলব্ধিতে সাহয্য করে ।

তিনি বস্তুর ধারণাকে বলেন সংকেতিত এবং ধারণা নির্দেশকারী ধ্বনিসমষ্টিকে বলেন সংকেতক। ভাষাব্যবহারকারী যখন সংকেতক ও সংকেতিতের মধ্যে সঠিকভাবে সমন্বয় সাধন করেন তখনই তার মধ্যে কোন শব্দের অর্থের উপলব্ধি হয়। সোসারের সংকেতের ধারণাকে নিম্নরূপে দেখানো যায় :

 

এখানে একটি জিনিস পরিস্কার যে সোস্যুরের সংকেত জাগতিক বস্তু থেকে দূরে । তিনি শব্দের সাথে ধারণার সম্পর্কের কথা বলেন, কিন্তু ধারণা কিভাবে জাগতিক বন্ধুর সাথে সম্পর্কিত সেকথা বলেন না। ফলে তার সংকেতের ধারণা অপূর্ণাঙ্গ এবং তা শব্দের অর্থকে যথার্থরূপে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

অর্থকে যথার্থরূপে ব্যাখ্যা করতে হলে জাগতিক বস্তুর সাথে ধারণার এবং ধারণার সাথে শব্দের সম্পর্ক দেখাতে হবে। ঠিক এই কাজটিই করতে সক্ষম হয়েছিলেন অগডেন ও রিচার্ডস। তারা দেখান যে জাগতিক বা সরাসরি ধারণার সাথে এবং ধারণা সরাসরি ভাষিক প্রতীকের সাথে কারণিক সূত্রে যুক্ত, তবে ভাষিক প্রতীক ও জাগতিক বস্তুর সাথে কোন সরাসরি যোগাযোগ নেই। তারা ব্যাপারটিকে একটি মৌলিক ত্রিভূজে প্রদর্শন করেন যাকে পরবর্তীকালে ভাষাবিজ্ঞানীরা সাংকেতিক ত্রিভুজ বা সংকেতায়নের ত্রিভুজ নামে অভিহিত করেন। এটি নিম্নরূপ :

অগডেন ও রিচার্ডসের মতবাদ আচরণবাদী ধারণার (বিস্তারিত আলোচনা তৃতীয় অধ্যায়ে) উপর প্রতিষ্ঠিত । এতে মনস্তাত্ত্বিক সত্ত্বা তথা ধারণা বা চিন্তার ব্যাপারটি যা প্রতীক ও নির্দেশিতের মধ্যে সেতুবন্ধস্বরূপ তা স্পষ্টরূপে সংজ্ঞায়িত নয়। এতে বলা হয়েছে ভাষাব্যবহারকারীর মধ্যে চিন্তার উদয় হয় বাহ্যিক নিয়ামকের প্রভাবে, কিন্তু বাস্তবে বাহ্যিক নিয়ামকের প্রভাব আমাদের চিন্তায় সর্বদা উপস্থিত নয়।

যাহোক, নানারূপ দুর্বলতা সত্ত্বেও অ্যাডেন ও রিচার্ডসের মতবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরে, তা হলো ভাষা, চিন্তা ও জগত পরস্পরসম্পর্কিত । সংকেতবিজ্ঞান এভাবেই সংকেত বা প্রতীকের ধারণার মাধ্যমে অর্থ বিশ্লেষনের প্রয়াস পায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সংকেতবিজ্ঞান কিভাবে আমাদের প্রস্তাবিত বাগর্থবিদ্যার সাথে যুক্ত ? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমরা এরিখ ফ্রম (১৯৭৭ : ৫৮-৬৩)-এর প্রতীকের ধারণা ও শ্রেণীবিভাগের সাথে পরিচিত হবো।

তার মতে প্রতীক হলো এমন কিছু যা অন্য কিছুকে নির্দেশ (আমরা বলবো প্রতীকায়িত) করে। প্রতীক তিন শ্রেণীর : সার্বজনীন, আকস্মিক ও প্রচলনির্ভর । সার্বজনীন প্রতীক হলো সেগুলো যাদের সাথে প্রতীকায়িতের একটি আন্তর সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমন কান্না দুঃখের প্রতীক, হাসি সুখদ অনুভবের প্রতীক ।

এই প্রতীকগুলি সার্বজনীন, কারণ এগুলো সর্বত্র সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । আকস্মিক প্রতীক হলো সেগুলো যাদের সাথে প্রতীকায়িত অনির্ধারিত সম্পর্কে আবদ্ধ। যেমন কারো কাছে ট্রাক ঘাতকের প্রতীক হতে পারে, কারণ তার ছেলে হয়ত ট্রাকের নীচে চাপা পড়ে মারা গেছে, আবার কারো কাছে এটি আশীর্বাদের প্রতীক হতে পারে কারণ এটি হয়ত তার শত্রুকে খতম করেছে।

সবশেষে, প্রচলনির্ভর প্রতীক হলো সেগুলো যাদের সাথে প্রতীকায়িত প্রথাগত সূত্রে সম্পর্কিত । যেমন বক (ব-অ-ক) বললে আমরা এক ধরনের সাদা পাখিকে বুঝে থাকি । কিন্তু এর তো অন্য নামও হতে পারতো যেমন লুতু, বিদং, সারেগামা ইত্যাদি। তা হওয়া অসম্ভব ছিল না অথবা তাতে দোষেরও কিছু হতো না।

কিছু অন্য কিছু না বলে কেন আমরা ঐ বিশেষ সাদা পাখিকে বক বলে ডাকি তার কারণটি প্রথাগত । প্রথাই ঠিক করে দিয়েছে আমরা কাকে কি নামে ডাকবো। এক্ষেত্রে প্রতীক ও প্রতীকায়িতের মধ্যে কোন আবশিক যোগাযোগ নেই। এদের মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান তাকে বলা যায়, সোস্যুরের ভাষায়, যথেচ্ছ ।

মানুষের ভাষা প্রচলনির্ভর প্রতীকের সমষ্টি যাদের বিশ্লেষণ ভাষাবিজ্ঞনের কাজ, অন্যজাতীয় প্রতীকসমূহের আলোচনা তার আওতাভুক্ত নয়। কাজেই সংকেতবিজ্ঞান যদি সমস্ত সংকেত বা প্রতীকের আলোচনা হয় আর ভাষাবিজ্ঞান যদি হয় বিশেষ ধরনের সংকেত বা প্রতীকের আলোচনা, তবে ভাষাবিজ্ঞান সংকেতবিজ্ঞানের একটি

শাখা। আবার যদি বাগথবিদ্যা ভাষাবিজ্ঞানের অংশ হয় তবে তা সংকেতবিজ্ঞানের শাখা নয়, একটি উপশাখা । ভাষাবিজ্ঞানের মধ্যস্থতায় সংকেতবিজ্ঞান ও বাগর্থবিদ্যার সম্পর্কটি নিম্নরূপে দেখানো যায়

 

এখানে উলম্ব রেখাবিশিষ্ট বিশাল বৃত্তটি হলো সংকেতবিজ্ঞান, আনুভূমিক রেখাবিশিষ্ট মধ্যম বৃত্তটি ভাষাবিজ্ঞান এবং বর্গাকৃতি ঘরবিশিষ্ট ছোট বৃত্তটি বাগথবিজ্ঞান ।

আরও দেখুন:

 

Exit mobile version