Site icon Language Gurukul [ ভাষা গুরুকুল ] GOLN

স্থানিকতা বাদ

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-স্থানিকতা বাদ

স্থানিকতা বাদ

স্থানিকতাবাদ হলো সেই মতবাদ যেখানে দাবি করা হয় যে ভাষার স্থানিক প্রকাশ ও ধারণাগুলো অ-স্থানিক প্রকাশ ও ধারণাগুলোর চাইতে মৌলিক ( Lyons 1977 718; Miller 1985 119 ) এই মতবাদটি একটি প্রম্প আকারে উপস্থাপিত হয় যার একটি মনভ্রাত্ত্বিক ভিত্তি রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। মানবীয় বোধ বা জ্ঞানের ক্ষেত্রে স্থানিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব এখন অনেক মনোবিজ্ঞানীই স্বীকার করেন।

স্থানিকতাবাদের দুটি তরজমা রয়েছে শক্ত ও দুর্বল। শক্ত তরজমা অনুযায়ী নাবোধকতা, পরিমাপন ক্রিয়াবয়ব, ভাববাচকতা, সমরূপদ সহ ভাষার যে সমস্ত দিক স্থানিক ও অন্যান্য প্রকাশের সাথে জড়িত স্থানিকতাবাদের বিশ্লেষণ তাদের সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

অন্যদিকে দুর্বল তরজমা শুধু এতটুকু দাবি করে যে অনেক ভাষাতে কালিক প্রকাশগুলো স্থানিক প্রকাশ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। যেমন ইংরেজীতে যতো কালবাচক প্রকাশ আছে তাদের প্রায় সবই এসেছে স্থানবাচক প্রকাশ থেকে। উটি (Traugott) দেখান যে for, since,

till আজ এগুলো কেবল কালচক অর্থে ব্যবহৃত হয় অন্য একসময় এগুলো কেবল স্থানবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হতো। বিভিন্ন ভাষার ব্যাকরণে কালবাচক শব্দকে প্রায়ই স্থানবাচক অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এর কারণটিও স্থানিকতাবাদ। যেমন বাংলায় আমরা বলে থাকি নিকট ভবিষ্যত, সুদুর ভবিষ্যত । এখানে আমরা সময়ের দিকে ইঙ্গিত করলেও সময়কে বিচার করি স্থানিক দূরত্বের নিরিখে, কারণ নিকট ও দূর মূলত স্থানবাচক শব্দ।

সময়ের এরূপ স্থাননির্ভর হওয়ার প্রক্রিয়াকে লিয়া বলেছেন কালের স্থানীকরণ। বাংলায় দূরদর্শী অদুরদর্শী প্রভৃতি শব্দেও কালের স্থানীকরণ লক্ষ্যণীয়। ঘটনা কালে সম্পাদিক হয়, তথাপি প্রায়ই একে আমরা স্থানিক মাত্রায় স্থাপন করে থাকি। যেমন আমরা বলতে পারি টুনির যখন জন্ম হলো তখন চারদিকে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল।

এখানে টুনির জন্মের ঘটনা একটি নির্দিষ্ট সময়ের কথা বলে বটে, কিন্তু সেই ঘটনাটি একটি স্থানের ইঙ্গিত দেয় যে স্থানে ঘটনাটি ঘটেছে। এভাবে এটি কালের চেয়ে স্থানের মৌলিকতাই প্রমান করে ।
স্থানিকতাবাদীরা কালিক অবস্থানকে স্থানিক অবস্থানের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেও একে আবার তারা বিমূর্ত অবস্থানের চেরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। বিমূর্ত অবস্থান হলো হতাশায়, হরিষে ইত্যাকার প্রকাশ ।

কাজেই স্থানিকতাবাদীদের মতে তিনি দুঃখে আছেন এর চেয়ে অধিক মূর্ত হলো তিনি সময় কাটাচ্ছেন যদিও তা তিনি বাসায় আছেন এর চেয়ে কম মূর্ত আমরা যখন উপরে নীচে, সামনে পিছনে, ডানে বামে ইত্যাদি বলি তখন নিজের অবস্থানের ভিত্তিতে অন্য কিছুর অবস্থান নির্ণয় করি।

বাস্তব জীবনের অনেক ঘটনা বর্ণনায় আমরা এরূপ অবস্থানগত বিবেচনা আরোপ করি । যেমন আমরা বলি দ্রব্যমূল্যের উৎগতি/নিম্নগতি শেয়ারবাজারে মূল্যসূচকের উন্নতি/ অবনতি, রাজনৈতিক দলের একত্রীকরণ অর্থনৈতিক মেরুকরণ ইত্যাদি। এখানে স্থানিক ধারণা আরোপ করা হয়েছে।

লিগ মনে করেন ভাষার আলংকারিক ব্যবহারের বিষয়টাও স্থাকিতাবাদ দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন আকাশছোঁয়া খ্যাতি, অতল অন্ধকার প্রভৃতি শব্দগুচ্ছের অর্থ মৌলিকভাবে স্থানিক ধারণা নিয়েই নির্ণীত হয় ।
যাত্রা বা ভ্রমন স্থানসাপেক্ষ। প্রতিটি ভ্রমনের একটি সূচনাস্থল ও গম্ভব্য থাকে ।

এই স্থানিক সূচনা ও গন্তব্যের ধারণাকে আমরা অনেক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করে থাকি । যেমন শিক্ষণের ব্যাপারে একটি স্তর থেকে শিক্ষা শুরু হয় এবং একটি উচ্চতর স্তরে লক্ষ্য অর্জিত হয়। ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটি একই রকম একটি ইতিবাচক অবস্থান থেকে তার যাত্রা শুরু এবং একটি নেতিবাচক অবস্থানে গিয়ে তার যাত্রা শেষ হয়।

আগমন করা, প্রস্থান করা, ঘুমিয়ে পড়া, জেগে ওঠা, খুঁজে পাওয়া, হারিয়ে ফেলা, বিয়ে করা, তালাক দেয়া জন্মগ্রহণ করা, মৃত্যুবরণ করা প্রভৃতি সবই এমনমূলক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। যদি ক প্রারম্ভবিন্দু এবং সমাপ্তিবিন্দু হয় তাহলে এমনমূলক প্রক্রিয়াটিকে এভাবে দেখানো যায়

 

এখানে + কোন কিছুর উপস্থিতি এবং কোন কিছুর অনুপস্থিতি বোঝায়। যাত্রার শুরুতে যার অস্তিত্ব থাকে যাত্রার শেষে তার অবলুপ্তি ঘটতে পারে অথবা যাত্রার শুরুতে যার অস্তিত্ব নেই যাত্রার শেষে তার প্রাপ্তি ঘটতে পারে। যেমন ঘুমিয়ে পনের ক্ষেত্রে চেতনার লোপ এবং জেগে উঠার ক্ষেত্রে চেতনার আবির্ভার ঘটে ।

একইভাবে আগমন ও প্রস্থান করার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট স্থানের সাথে সংস্পর্শ ও বিচ্যুতি ঘটে খুঁজে পাওয়া ও হারিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে একটি দ্রব্য দৃষ্টিগোচর হয় ও তার অপনয়ন ঘটে।

বিয়ে করা ও তালাক দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথাসিদ্ধ জীবনসঙ্গীর অর্জন ও বিয়োজন ঘটে এবং সবশেষে জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ করার ক্ষেত্রে জীবন নামক প্রপঞ্চের যোগ ও বিয়োগ ঘটে। এখানে একটি জিনিস লক্ষ্যণীয় যে স্থানিক ধারণা দিয়ে যখন এভাবে আমরা শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করি তখন আমরা আংশিকভাবে মৌলিক উপাদান বা বাতলিক বৈশিষ্ট্যও অনুসন্ধান করি । নীচের তালিকায় বিষয়টি বিধৃত

আগমন করা।

প্রস্থান করা

দেশে উঠা ঘুমিয়ে পড়া }

খুঁজে পাওয়া হারিয়ে ফেলা

বিয়ে করা তালাক দেয়া }

জন্মগ্রহন করা

মৃত্যুবরন করা

} * জীবন

যৌক্তিক কারণকে স্থানিকতাবাদী ধারণায় বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যদিও তবে এরূপ যুক্তিবাক্য স্থানিক ধারণা পরিপুষ্ট। এটি ইঙ্গিত দেয় যে ক থেকে খ এর উৎপত্তি অর্থাৎ ক যেখানে একটি ভ্রমনমূলক প্রক্রিয়া বিদ্যমান। যেমন, যদি বৃষ্টি হয় তবে মাটি ভিজে এ বাক্যটি একটি অবস্থাগত রূপাঙ্করের কথা বলে ।

বৃষ্টি হওয়া একটি অবস্থা এবং মাটি ভিজা আরেকটি অবস্থা । দ্বিতীয় অবস্থাটি সৃষ্টি হয় প্রথম অবস্থার ফলে এখানে ভ্রমনমূলক প্রক্রিয়াটি এভাবে দেখানো যায় :

 

 

কিছু কিছু অব্যয় ও প্রশ্নমূলক শব্দ স্থানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন যখন আমরা এভাবে কিভাবে বলি তখন আমরা একটি প্রক্রিয়ার কথা বলি। এভাবে মানে এই উপায়ে বা প্রক্রিয়ায়। কিভাবে মানে কি উপায়ে বা প্রক্রিয়ার সম্বন্ধপদের ক্ষেত্রে স্থানিক বিশ্লেষণ প্রযোজ্য।

যখন আমরা বলি রহিমের বই তখন আমরা স্বপ্নের ধারণা প্রকাশ করি যাতে একটি বা একটি ব্যক্তির দখলে থাকে। স্থানিকভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে ব্যাপারটি দাঁড়ায় এরকম: রহিম একটি স্থানে ও বই তার অল্প একটু জায়গা জুড়ে অবস্থিত। সম্পর্কটি নীচের চিত্রের মতো। আমরা ককে রহিম ও ব কে বই কল্পনা করতে পারি

 

জ্যাকেনডফ সার্বজনীন বাগর্থবিদ্যার সন্তানে ভাষার একটি স্থানিকতাবদী তত্ত্ব গঠন করেছেন । তিনি ভাষার তাবৎ ক্রিয়াকে তিনটি মৌলিক শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন go (যাওয়া), be (হওয়া) এবং stay (অবস্থান করা)। এই ত্রয়ী বিভাজনের উপর ভিত্তি করে বলা সম্ভব হবে আমরা বাক্যে কোন সম্পর্কের কথা বলছি অবস্থানিক, স্বত্বমূলক নাকি অভেদমূলক (Miller 1985 121) নীচের তিনটি বাক্য লক্ষ্য করা যাক

১. ট্রেনটি ঢাকা থেকে চিটাগাং যাচ্ছিল ।

২. হিরন হাসপাতালকে তার চক্ষু দান করলো।

৩. সন্ধ্যায় আকাশ লাল হয়ে গেল ।

এখন এই তিনটি বাক্যকে আমরা যাওয়ার ধারণা দ্বারা বিশ্লেষণ করতে পারি :

১. যাওয়া (ট্রেন, ঢাকা, চিটাগাং)

২. যাওয়া (চক্ষু, হিরন, হাসপাতাল)

এ যাওয়া (সক্ষা, আকাশ, লাল)

প্রথমটিতে অবস্থানিক সম্পর্ক প্রকাশিত হয়েছে – এখানে ঢাকা ও চিটাগাং-এর প্রেক্ষিতে ট্রেনের অবস্থান নির্দেশ করা হয়েছে।

দ্বিতীয়টিতে স্বত্বমূলক সম্পর্ক প্রকাশিত হয়েছে এখানে হাসপাতাল হিরনের চোখের স্বতাধিকারী হয়েছে।

তৃতীয়টিতে অভেদমূলক সম্পর্ক প্রকাশিত হয়েছে – এখানে সন্ধ্যার আকাশ ও লালিমা এক হয়ে গেছে ।

এভাবে স্থানিকতাবাদী প্রকল্প ভাষার অর্থ বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করেছে ।

আরও দেখুন:

 

Exit mobile version