একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্র বিশ্লেষণ ২

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্র বিশ্লেষণ ২

একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্র বিশ্লেষণ ২

এই গবেষণায় উপাত্ত হিসেবে বিশ্লেষণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত ‘জাতীয় সেমিনার এর দাওয়াতপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্লেষণের সুবিধার্থে দাওয়াতপত্র নিচে উপস্থাপিত হলো।

 

একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্র বিশ্লেষণ-২

 

ক. সার্লের বাককৃতি তত্ত্ব অনুসারে একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্রের বাককৃতি বিশ্লেষণ
বিশ্লেষিত দাওয়াতপত্রটির (একটি বিভাগের জাতীয় সেমিনার উদযাপন বিষয়ক) উক্তিমালা বা ডিসকোর্স বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে মোট ৪টি অংশ রয়েছে।

অংশগুলি হলো i) সম্বোধন ii) তথ্য বা বিষয়ের বর্ণনা iii) আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো এবং iv) ধন্যবাদ জানানো। এই চারটি অংশে যে ধরনের ভাষাগত উপাদান, যা বাককৃতির তত্ত্বানুসারে প্রস্তাব কৃতির অন্তর্ভুক্ত, সংযুক্ত হয়েছে তা নিচের সারণিতে উল্লেখ করা হলো।

সারণি: ১৯ একাডেমিক (জাতীয় সেমিনার) নমুনা দাওয়াতপত্রের কাঠামোগত অংশ

 

একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্রে ব্যবহৃত কৃতি অনুসারে বিনম্রতার স্বরূপ বিশ্লেষণ

 

আমন্ত্রণকারী দাওয়াতপত্রের উল্লিখিত প্রস্তাব কৃতির শুরুতেই আমন্ত্রিত অতিথিকে সম্বোধন করে ‘সুধী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাধারণত আনুষ্ঠানিক পরিবেশে কাউকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিনম্রতাসূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়। দাওয়াতপত্রের পরবর্তী অংশে রয়েছে তথ্য বা বিষয়বস্তু বর্ণনা।

এ অংশে আমন্ত্রণকারী আমন্ত্রিত অতিথিকে অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য কিছু তথ্য প্রদান করেছেন। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে কী উপলক্ষে, কখন, কোথায় অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছে, অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি এবং প্রধান বক্তার নাম প্রভৃতি। এরপর আমন্ত্রণকারী,

 

আমন্ত্রণগ্রহণকারীকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। প্রস্তাব কৃতির সবশেষে রীতি অনুসারে আমন্ত্রণগ্রহিতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমন্ত্রণকারী পদবিসহ নিজের নাম ও বিভাগের নাম উল্লেখ করেছেন। আমন্ত্রণপত্রের উল্লিখিত কাঠামোগত অংশসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশ তথ্য বা বিষয়ের বর্ণনা। এ অংশটির মাধ্যমে আমন্ত্রণগ্রহিতা অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে অবগত হতে পারেন।

আমাদের প্রতিনিয়ত উচ্চারিত উক্তি বা লেখনির সাহায্যেও কাজ নির্দেশিত হয়। এই দাওয়াতপত্রের লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমেও কাজ নির্দেশিত হয়েছে এবং এখানে লেখকের মনোগত অভিপ্রায় প্রকাশ পেয়েছে। এ মনোগত অভিপ্রায়কে সার্ল বলেছেন ‘নিবেদন কৃতি’।

এই দাওয়াতপত্রের ক্ষেত্রে আমন্ত্রণকারীর মনোগত অভিপ্রায় হলো আমন্ত্রণগ্রহিতা যেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন, অর্থাৎ অভিথিকে আমন্ত্রণ জানানো। সার্নের মতে (Searle, 1969) প্রস্তাব কৃতির আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট’ অংশটি বিবৃতিমূলক নিবেদন কৃতি। কারণ এখানে আমন্ত্রণকারী অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে আমন্ত্রণগ্রহিতাকে কিছু তথ্য বা বিবৃতি প্রদান করেছেন।

পরবর্তী অংশ *উক্ত সেমিনারে ………প্রত্যাশা করছি এই অংশটি সার্নের (Searle. 1969) মতে আদেশমূলক নিবেদন কৃতি। কারণ এ অংশে আমন্ত্রণকারী অনুরোধের মাধ্যমে আমন্ত্রণগ্রহিতাকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে বলেছেন। ‘আদেশমূলক নিবেদন কৃতি প্রকাশ পেয়েছে অনুরোধের মাধ্যমে। সর্বশেষ লিখিত *ধন্যবাদসহ প্রকাশমূলক নিবেদন কৃতি, এর মাধ্যমে আমন্ত্রণকারীর মানসিক অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে।

আমরা জানি আমন্ত্রণকারী আমন্ত্রণগ্রহিতা উভয়ের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে কোন অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত হয়। এই দাওয়াতপত্রেও আমন্ত্রণকারীর অনুরোধের সাড়া প্রদান করে আমন্ত্রণগ্রহিতা যদি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন বা কোনো কারণে থাকতে না পারলে তা জানিয়ে দেন তাহলে সংজ্ঞাপন সম্পন্ন হবে। সার্ন (Searle, 1969) একে প্রতিক্রিয়া কৃতি বলেছেন। এভাবেই একটি দাওয়াতপত্রের বাককৃতিটি সুসম্পন্ন হয়।

খ. ব্রাউন ও লেভিনসনের বিনম্রতার তত্ত্ব অনুসারে একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্রের বিনম্রতা বিশ্লেষণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ কর্তৃক মহান একুশে উদ্‌যাপন উপলক্ষে দিনব্যাপী জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠানটিতে বিভাগীয় প্রধান আমন্ত্রণকারী হিসেবে দাওয়াতপত্রে বেশ কিছু বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন।

এসব শব্দ/বাক্যাংশের মধ্যে রয়েছে- ‘সুধী’, ‘মহান’, ‘সদয় সম্মতি জ্ঞাপন’, ‘মাননীয়’, ‘অলংকৃত করবেন’, ‘বিশিষ্ট’, ‘উপস্থিতি আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করছি’, ‘ধন্যবাদসহ প্রভৃতি। আমাদের সংস্কৃতিতে আনুষ্ঠানিক পরিবেশে রীতি অনুসারে কাউকে সম্বোধন করার জন্য সম্মানসূচক শব্দাবলি ব্যবহার করা হয়।

নির্বাচিত এই দাওয়াতপত্রটিতে আমন্ত্রণকারী আমন্ত্রণগ্রহিতাকে সম্বোধন করে ‘সুধী’ বিনম্রতাসূচক শব্দটি প্রয়োগ করেছেন। এই শব্দটির মাধ্যমে আমন্ত্রণকারী আমন্ত্রণগ্রহিতার প্রতি মনোযোগ প্রদান করছেন। ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ব্রাউন ও লেভিনসনের তত্ত্বমতে (Brown and Levinson, 1987) ‘সুধী’ ইতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ। ইতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ ব্যবহার করে আমন্ত্রণকারী নিজের অভিব্যক্তি (face) বৃদ্ধি করেছেন। আমন্ত্রিত অতিথির নিকট।

অমর একুশে উদ্‌যাপন উপলক্ষে সেমিনারটির আয়োজন করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনে শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একুশের পূর্বে ‘মহান’ বিনম্রতাসূচক শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠানে সাধারণত প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিবর্গ প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধান অতিথি হিসেবে ‘উপাচার্য এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উক্ত অনুষদের ডিন’ উপস্থিত থাকবেন দাওয়াতপত্রটিতে উল্লেখ করা হয়। রীতি অনুসারে ‘উপাচার্য’ এবং ‘ডিন’-কে সম্মান জানিয়ে বিনম্রতাসূচক শব্দ ‘মাননীয় ব্যবহার করা হয়েছে তাঁদের পদবির পূর্বে।

‘সদয় সম্মতি জ্ঞাপন’, ‘অলংকৃত করবেন’ বিশ্রুতাসূচক বাক্যাংশ প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথিকে সম্মান জানিয়ে আমন্ত্রণকারী আমন্ত্রণপত্রে উল্লেখ করেছেন। অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে যিনি উপস্থিত থাকবেন তিনিও বাংলাদেশে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি, এ কারণে তাঁকে সম্মান জানিয়ে ‘বিশিষ্ট’ বিনম্রতাসূচক শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

 

একাডেমিক নমুনা দাওয়াতপত্র বিশ্লেষণ ২

 

উল্লিখিত ‘আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করছি ‘ধন্যবাদসহ বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশসমূহের সাহায্যে আমন্ত্রণকারী বিনম্রতার সাথে অতিথিকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করেছেন। ‘মহান’, ‘সদয় সম্মতিজ্ঞাপন’, ‘মাননীয়’, ‘অলংকৃত করবেন’, ‘বিশিষ্ট’, ‘উপস্থিতি আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করছি”, “ধন্যবাদসহ প্রভৃতি বিনম্রতাসূচক যে শব্দ/বাক্যাংশ আমন্ত্রণকারী দাওয়াতপত্রে ব্যবহার করেছেন তা ব্রাউন এবং লেভিনসনের তত্ত্বমতে (Brown and Levinson, 1987) নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, প্রধান বক্তা এবং আমন্ত্রিত অতিথি কেউই যেন অসম্মানিতবোধ না করেন এ কারণে আমন্ত্রণকারী উল্লিখিত নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশসমূহ দাওয়াতপত্রে ব্যবহার করেছেন।

এই নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ ব্যবহারের মাধ্যমে আমন্ত্রণকারী নিজের অভিব্যক্তি ভীতিকারী কর্ম (অভীক) হ্রাস করেছেন (Brown and Levinson, 1987)। দাওয়াতপত্রের ক্ষেত্রে ইতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ/বাক্যাংশ ব্যবহারে আমন্ত্রণকারীকে মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি নেতিবাচক বিনম্রতাসূচক শব্দ ব্যবহারে আমন্ত্রণগ্রহিতাসহ অন্যান্য অতিথিদের সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে, দুটো বিষয়ই ব্রাউন ও লেভিনসনের তত্ত্বমতে তাৎপর্যপূর্ণ।

 

আরও দেখুন:

 

Leave a Comment