ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট জনসংখ্যা

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট জনসংখ্যা

ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট জনসংখ্যা

ডেমরা থানার জনসংখ্যা ৪,২৭,৯৭২ জন, যার মধ্যে ২,৩৮,১৭৩ জন পুরুষ এবং ১,৮৯,৭৯৯ মহিলা। (প্রাগুক্ত)

 

ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট জনসংখ্যা

 

ডেমরার ইউনিয়ন ওয়ার্ড এবং মৌজা-মহল্লার বৈশিষ্ট্য

ডেমরা থানায় ৩টি ওয়ার্ড, ৩টি ইউনিয়ন, ৯টি মহরা, ২৪টি মৌজা এবং ৪৭টি গ্রাম রয়েছে। ওয়ার্ড/ইউনিয়ন, মহলা/মৌজা এবং গ্রামের গড় জনসংখ্যার আকার যথাক্রমে ৭১,৩২৯, ১২,৯৬৯ এবং ৯,১০৬ জন। (প্রাগুক্ত)

স্থানীয় ও বহিরাগত

ডেমরা থানা বিভিন্ন ধরনের কলকারখানা সমৃদ্ধ কৃষি প্রধান এলাকা। এ এলাকার অধিবাসীরা কৃষিকাজ, ক্ষেতমজুর, দোকানদারি ক্ষুদ্র ব্যবসা, সেই সঙ্গে কলকারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বর্তমানে ডেমরায় শ্রমিকদের কর্মপরিধি বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে শ্রমিকদের আধিক্য।

এক সময় স্থানীয় শ্রমিকেরা ছিল কাজের মূলশক্তি। কাজের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের শ্রমিকেরাও এসে যুক্ত হচ্ছে নানাকাজে। বর্তমানে বাইরের শ্রমিকের সংখ্যা এত বেড়েছে তারা স্থানীয় শ্রমিকদের ছাড়িয়ে গেছে।

পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস

ডেমরা থানায় যত পরিবার রয়েছে তার ৩.১১% কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। কৃষিকাজের এই অংশে ফসল, গরু-ছাগল, বন ও মৎস্যচাষের সঙ্গে জড়িত ১.৬২%, কৃষিতে মঞ্জুরি দেয় ১.৪৯%। অন্যান্য উৎসের সঙ্গে জড়িত পরিবার হল অকৃষি মজুরি ১.৭৯%, কলকারখানা ২.০৬%, ব্যবসা ২৮.৪২%, চাকরি ৩২.০৮, নির্মাণ কাজ ৩.২১, ধর্মীয় সেবা ০.১৭, ভাড়া ও বৈদেশিক আয় ২.৯৫, ট্রান্সপোর্ট ও যোগাযোগ ১১.৩২ এবং অন্যান্য ১৪.৮৮%। (প্রাগুক্ত, আদমশুমারি রিপোর্ট)

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড

ডেমরা থানায় ২১.৬২% শিশু রয়েছে, যাদের বয়স ১০ বছরের নিচে। জনসংখ্যার মধ্যে ১০ বছর এবং তার ওপরের বয়সী রয়েছে ৩২.৩১%, যারা কোন কাজ করে না। কাজ অনুসন্ধান করছে এমন জনসংখ্যা রয়েছে এখানে ২.৮৯%। গৃহস্থালি কাজে জনসংখ্যা 22.৫৫% এবং বাদ বাকি ৪২.২৫% নানাকাজের সঙ্গে জড়িত।

এই ৪২.২৫% এর মধ্যে কৃষিতে ৬.৩৫%, কল-কারখানায় ২.৪১%, ব্যবসায়ে ৯.৫২%, চাকরিতে ১.২৮%, নির্মাণকাজে ১.৬৮%, ট্রান্সপোর্ট এবং যোগাযোগে ৪.৩১% এবং অন্যান্য কাজে ১৬.৭১% নিয়োজিত রয়েছে। (প্রাগুক্ত, আদমশুমারি রিপোর্ট)

ডেমরায় করিম জুটমিল ও বাওয়ানি জুটমিল নামে দুটি বড় পাটকল রয়েছে। বস্ত্রশিল্পের কারখানা রয়েছে দুটি। এর মধ্যে একটি পাইটি এলাকায়, অন্যটি ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায়।

এছাড়া ছোট বড় অনেক কলকারখানা আছে ডেমরা এলাকায়। এসব কলকারখানায় স্থানীয় ও বহিরাগত শ্রমিকেরা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ডেমরার অন্তপুর নিবাসী অল্পশিক্ষিত ও নিরক্ষর মেয়েরাও ঘরে বসে নেই। তারা ঘরে বসে টুপি সেলাই, জামা, শাড়িতে জরি, পুঁতি ও সুতার কাজ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে।

সামাজিক জীবন

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ডেমরা থানার মানুষের জীবনযাত্রার মান উচ্চ, মধ্য ও নিম্নশ্রেণিভুক্ত। তবে বেশিরভাগ মানুষেরই জীবনযাত্রার মান মধ্যবিত্ত শ্রেণি পর্যায়ের। বহিরাগত অধিবাসীদের মধ্যে ৭০% ভাগ অধিবাসীর জীবনযাত্রার মান নিম্নপর্যায়ের। তারা বেশিরভাগ কলকারখানার শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত। এ এলাকার মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি করে না। বহিরাগত ভিক্ষুকও তুলনামূলকভাবে অনেক কম দেখা যায়।

স্বভাব

এ এলাকার মানুষেরা স্বভাবগত দিক থেকে অধিকাংশই অলস, জেদি এবং মারমুখি। তবে বড় কোন সমস্যায় এলাকার মানুষ একজোট হয়ে কাজ করে। এখানকার সংসারজীবন এবং কর্মক্ষেত্রে নারী- নির্বিশেষে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত। -পুরুষ
ডেমরা থানার সর্বত্রই পৈতৃক জায়গাজমি নিয়ে ঝগড়াঝাটি হয় এবং তা মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। বর্তমানে সেটি অনেকগুণে বেড়ে গেছে।

খাদ্য

খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে এ এলাকায় বসবাসরত জনগণের নিজস্বরীতি ও ঢং রয়েছে। তারা সাধারণত অন্য সকলের মতো সাধারণ খাবার খেয়ে থাকে। তবে টকজাতীয় খাবারের প্রতি এ অঞ্চলের মানুষের আগ্রহ একটু বেশি। টকজাতীয় তরকারিকে এ অঞ্চলের লোকেরা সাধারণত খাট্টা বলে থাকে।

‘মাছে ভাতে বাঙালি’-এ প্রবাদটি ডেমরার জনগণের জন্য প্রযোজ্য। কারণ আগে এখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। বর্ষা মৌসুমে সেটি বেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হত। আগে এসব এলাকার মানুষ সকালের নাস্তায় পান্তা ভাত, গরম ভাত, তরকারি, খৈ, মুড়ি ইত্যাদি খেত। বর্তমানে খাবারের তালিকায় আটার রুটি, চা, পাউরুটি ইত্যাদি স্থান করে নিয়েছে।

এলাকার মানুষের প্রতিটি ঘরে দুপুর ও রাতের খাবার তালিকায় ডাল অবশ্যই থাকে। এছাড়া মাছ, মাংস, সবজি খেয়ে থাকে। এ এলাকার মানুষ নিরামিশ খুব পছন্দ করে। মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রতি এলাকার মানুষের দুর্বলতা অত্যধিক।

দৈনিক খাদ্যের বিবরণ (১টি পরিবারের)

 

ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট জনসংখ্যা

 

বাড়িতে আগত অতিথিদের আপ্যায়নের পর পান-তামাক পরিবেশনের প্রচলন আগেও ছিল, এখনো আছে।

পোশাক-পরিচ্ছদ

পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে বাঙালি সংস্কৃতি ও আধুনিকতার ছাপ বিদ্যমান। সাধারণত মহিলারা আটপৌঢ়ে পোশাক পরিধান করে। বর্তমানে আধুনিকতার ছাপ ও সেটেলাইটের প্রভাব পড়েছে তরুণপ্রজন্মের ওপর। আগে এ এলাকার পুরুষেরা পাঞ্জাবি, পায়জামা, লুঙ্গি ব্যবহার করত।

মেয়েরা ব্যবহার করত জামা, পায়জামা, গামছা। তারা বিয়ের পর শাড়ি পরত। মহিলাদের একটি অংশ শাড়ির নিচে ব্লাউজ, পেটিকোট ব্যবহার করত না।
অলঙ্কার হিসাবে সোনা-রূপার চল ছিল, তবে রূপার গয়না বেশি ব্যবহার করত। পায়ে মল, কোমরে বিছা, হাতে বাজুবন্ধ, গলায় হাতলি ইত্যাদি ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো।

বাড়িঘর

ডেমরার স্থানীয় অধিবাসীদের ৯০% নিজ নিজ পৈতৃক নিবাসে, ১০% শহর এলাকায় বসবাস করে। এই থানার অন্তর্গত বিভিন্ন অঞ্চলে বহিরাগত ২০% মানুষ নিজেরা জায়গা কিনে বাড়ি করে বসতি স্থাপন করেছে। ৮০% মানুষ অন্যদের বাড়িতে ভাড়া এবং বস্তিতে বসবাস করে।

ডেমরা থানার অন্তর্গত গ্রামগুলো বাঁশঝাড়, আম, জাম, তাল এবং নানা গাছপালায় আচ্ছাদিত। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গাছপালা আছে। বাড়িঘর পূর্বে মাটির ছিল, টিনের চাল ছিল। জমি থেকে ঘরের ভিটা বেশ উঁচুতে ছিল, কারণ পূর্বে ডেমরা এলাকা চারদিক থেকে পানি দ্বারা বেষ্টিত ছিল। এসব এলাকায় স্থানে স্থানে মাটির টিলার মত উঁচু এলাকার ঘরবাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছিল এসব গ্রাম। স্বচ্ছল ও কম স্বচ্ছ

পরিবারের ঘরের বাহ্যিক অবস্থার খুব বেশি ভারতম্য ছিল না। তবে স্বচ্ছল পরিবারের অবস্থা অন্যদের তুলনায় ভাল ছিল।
স্বচ্ছল পরিবারগুলোতে খাট-পালঙ্ক ব্যবহৃত হত, তবে খুব কম। চৌকি ব্যবহার করত। তাছাড়া ঘরের মেঝে মাটিতে বিছানা করেও তারা ঘুমোত। গোয়ালঘর, রান্নার ব্যবস্থা আলাদা আলাদা ছিল সব বাড়িতেই।

উৎসব

সামাজিক উৎসবগুলোর সবই এখানে পালিত হয়। ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর, সুন্নতে খাতনা, বিবাহ, কান ফোঁরানোর উৎসব, জন্মদিন ইত্যাদি ছাড়াও পহেলা বৈশাখে ডেমরার মাতুয়াইলে বিরাট মেলা হয়। সেখানে স্বপ্নে পাওয়া একটি ঔষধ দেয়া হয়, যা দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে নিয়ে যায়। এই ঔষধ সকালে খালি পেটে খেতে হয়। যেদিন ঔষধটি খায় সেদিন সবাইকে নিরামিশ খেতে হয়।

শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী বালু নদীর পাশে বাউলের বাজার এলাকায় প্রতি বছর বাউলমেলা হয়। भाী পূর্ণিমার পরের দিন এ মেলা বসে। মেলায় দুপুরে কীর্তন এবং রাতে যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলার এক সপ্তাহ পর আরেকটি মেলা বসে, যা দীনবন্ধু মেলা নামে পরিচিত। বালু নদীর পাড়ে অবস্থিত মন্দিরের পাত্রের ফলক থেকে জানা যায়, মহাপুরুষোত্তম শ্রী শ্রী সুধারাম বাউল প্রায় আড়াই শ’ বছর আগে সাধনার পর সিদ্ধি লাভ করে ডেমরার কায়েত পাড়ায় এসে জীবের কল্যাণ কামনায় আত্মনিয়োগ করেন।

তখন থেকে ওই জায়গার নাম হয় বাউলের বাজার (তীর্থভূমি)। আগে এলাকার মানুষ মুসলমানেরা বাউলভাবাপন্ন এবং পীরবাদী ছিল। তারা তাদের গাছের ফল বা উৎপাদিত ফসলের রান্না করা খাবার আগে পীর বা মোল্লাকে দিত, পরে নিজেরা খেত। বর্তমানে তার প্রচলন নেই বললে চলে।

শিশুদের নামকরণ

নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করলে নাম রাখা হত মসজিদের ইমামকে দিয়ে। এছাড়া নিজেদের পরিবারের টাইটেল ব্যবহার করেও নাম রাখার প্রচলন দেখা যায়। যেমন হোসেন, মোল্লা, খান ইত্যাদি টাইটেল ।

ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট জনসংখ্যা

সামাজিক সংস্কার

সামাজিক সংস্কার মানুষের মজ্জাগত সহজাত প্রবৃত্তি। শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলের মধ্যে কিছু কিছু সামাজিক সংস্কার বিদ্যমান। যেমন-যাত্রাপথে পেছন থেকে ডাকলে অমঙ্গল ভাবে, হাঁচি দিলে অমঙ্গল মনে করে। স্বপ্নে দাঁত পড়া দেখলে মুরুব্বি শ্রেণির কেউ মারা যাবে এ জাতীয় সংস্কার বিদ্যমান। সন্ধায় কেউ ঘর কাট দেয় না অমঙ্গল হবে ভেবে।

সংস্কারাচ্ছন্ন শ্রেণির লোকেরা ভূত, প্রেত ইত্যাদি বিশ্বাস করে। মানুষ বিশ্বাস করে ভূত প্রাচীন বটগাছে বাস করে। কারণ বটগাছের ঘন পাতায় সব সময় এক রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি করে। সহজ সরল

মানুষ রহস্যঘেরা পরিবেশে আতঙ্কিত হয়ে বিশ্বাস করে এখানে ভূত বাস করে। আর ভগ্নপ্রায় জীর্ণ মন্দির নয়তো কবরস্থানে বাস করে জ্বিন-ভূত এটাই তাদের বিশ্বাস। শুধু সহজ সরল সাধারণ মানুষই নয়, শিক্ষিত লোকেরাও এই জ্বিন-ভূতের আতঙ্কে আতঙ্কিত।

কৃষিকাজ

লাঙ্গল, দা, কাঁচি, শাবল ইত্যাদি সাধারণ যন্ত্রপাতি ছাড়াও উন্নত ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতিও ব্যবহার করে থাকে। কৃষিতে স্থানীয় নিম্নবিত্ত মানুষ ও বহিরাগত শ্রমিক উভয়ে শ্রম দিয়ে থাকে। উত্তরবঙ্গ বিশেষ করে রংপুর জেলার মানুষ এখানে এসে কৃষিতে শ্রম বিক্রি করে। সবচে’ বড় সংখ্যক মানুষ আসে ময়মনসিংহ জেলা থেকে।

শিক্ষা ও সংস্কৃতি

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে অতীতে কম ছিল। বর্তমানে শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। ডেমরা এলাকার মানুষ বরাবরই সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনুরাগী। এখানে যাত্রাপালা, কবিগান, বয়াতির গান, মঞ্চনাটক, সাহিত্যক্লাব ইত্যাদির প্রচলন রয়েছে।

ধর্ম

ডেমরা এলাকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকের আধিক্য লক্ষণীয়। অন্য ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা নগণ্য। ডেমরার ধার্মিকপাড়া নামক স্থানে তুলনামূলকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস বেশি চোখে পড়ে। সুফি বাউল ও ভাববাদী মনের পরিচয় এ এলাকার মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

 

ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট জনসংখ্যা

 

আরও দেখুন:

 

Leave a Comment