গবেষণার পদ্ধতি ও অন্যান্য দিক ভূমিকা

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-গবেষণার পদ্ধতি ও অন্যান্য দিক ভূমিকা

গবেষণার পদ্ধতি ও অন্যান্য দিক ভূমিকা

ভাষা মানুষের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। মনের ভাব প্রকাশের এই মাধ্যমটি কখনো হঠাৎ করে কিংবা কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একদিনে সৃষ্টি হয় না। কালের পরিক্রমায় যেকোনো বস্তু বা প্রাণী যেভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করে ভাষার ক্ষেত্রেও অনুরূপ যুক্তিটি ক্রিয়াশীল। সৃষ্টির আদিকাল থেকে অর্থাৎ ভাষা শেখার প্রক্রিয়াটি যখন থেকে আরম্ভ হয়েছিল সেই প্রক্রিয়াটি অদ্যাবধি থেমে নেই।

যে কারণে যত দিন যাচ্ছে প্রতিটি ভাষার ক্ষেত্রে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে, এমন কি ভাষার সংশোধন এবং বিয়োজনও হচ্ছে। কোনো ভাষা কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। ফলে কোনো কোনো ভাষা প্রতিনিয়ত তার পুষ্টিসাধনে কালাতিক্রম করছে, আবার কোনো ভাষা সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে দিশেহারা হয়ে, অর্থাৎ অন্যভাষার করালগ্রাসের কবলে পড়ে তার কক্ষপথ হতে ছিটকে গিয়ে বিলুপ্তি হতে চলেছে।

 

গবেষণার পদ্ধতি ও অন্যান্য দিক ভূমিকা

 

ভাষার নিয়তিটা বড়ই বিচিত্র। কারো বলার উপায় নেই, কোনো ভাষা বর্তমানে পরিপূর্ণতা অর্জন করে একটি লক্ষে এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভাষা নিরন্তর পরিবর্তনশীল।

চিরপরিবর্তনশীল ভাষা সমাজ- সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। ১৭৮৬ সালের আগে পৃথিবীতে প্রচলিত সকল ভাষার সঠিক ইতিহাস জানা নেই, কারণ স্যার উইলিয়াম জোনসের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে বৈজ্ঞানিকভাবে ভাষার ইতিহাস সংরক্ষণ ও চর্চার প্রয়াস শুরু হয়।

প্রায় দু’ তিন শ’ বছর আগেও ভাষাতাত্ত্বিকরা উপভাষা বলতে সাধু ভাষার পরিবর্তিত রূপকেই গণ্য করেছেন। ড. রফিকুল ইসলাম, উপভাষাতত্ত্ব ও বাংলাদেশের উপভাষা বিশ্লেষণ প্রবন্ধে লিখেছেন, * ১৮৭৫ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন ভাষার ইতিহাস বা উদ্ভব বা বিবর্তন স্থির করতে গিয়ে বিভিন্ন ভাষা ও উপভাষার সংগঠন

বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ তথ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড বা শিষ্ট ভাষা বিশেষ ঐতিহাসিক বা সামাজিক কারণে কোনো না কোনো উপভাষা থেকেই উদ্ভূত এবং উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা শিষ্ট বা সাধু ভাষার বিকৃত রূপ নয়, (বাঙলা ভাষা: বাঙলা ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধসংকলন, হুমায়ুন আজাদ, পৃ. ৩৩৬)।

‘উপ’ শব্দের অর্থ নৈকট্য বা সাদৃশ্য। ‘ভাষা’ শব্দের আগে ‘উপ’ উপসর্গযোগে তৈরি হয়েছে ‘উপভাষা’ শব্দটি, যার শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায় ‘ভাষার সাদৃশ্য’ বা ভাষার মতো, অর্থাৎ যা মূল ভাষার মতো তা-ই হল উপভাষা।

উপভাষার কোনো লিখিত রূপ নেই। লোকের মুখে মুখে প্রচলিত তাই এটি স্বতঃস্ফূর্ত ও অকৃত্রিম। মূল ভাষা থেকে উপভাষার পার্থক্যের কারণ এর উচ্চারণ পার্থক্যের জন্য স্বতন্ত্র ধ্বনি বিন্যাস, নিজস্ব মৌলিক শব্দ-ভাণ্ডার ও ব্যাকরণের সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে না চলা।

ভাষাতাত্ত্বিক ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ উপভাষার সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন- কোনো অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যখন একটা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে বসবাস করেন তখন ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়,

সামাজিক ও পেশাগত কারণে চলিত ভাষার বিভিন্ন ধারিক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলের চলিত ভাষার পাশাপাশি তার ব্যতিক্রমধর্মীরূপ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অতএব উপভাষা হচ্ছে চলিত ভাষার একটা উপরূপ যা চলিত ভাষার চেয়ে কম ভাষাভাষীদের অঞ্চলে নিজস্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবহৃত হয়। (আধুনিক ভাষাতত্ত্ব, ১৯৯৭, পৃ.১৪২)।

 

গবেষণার পদ্ধতি ও অন্যান্য দিক ভূমিকা

 

গবেষণার আলোচ্য বিষয়, ঢাকার পূর্ব-উপকন্ঠ অর্থাৎ শীতলক্ষ্যা নদীর ডান তীর ঘেঁষা ডেমরা থানার শ্রমিক শ্রেণির ভাষা। ডেমরা থানা একটি নদী বিধৌত এলাকা। যেহেতু নদীর তীর এলাকায় ডেমরার অবস্থান, ভৌগলিক পরিবেশের কারণে এখানে মানুষের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মের দুটি জিনিস চোখে পড়ার মতো হবে এটাই স্বাভাবিক। এক. নদী এলাকায় প্রভূত পলিমাটি বিদ্যমান।

এই পলিমাটি কৃষির বড় নিয়ামক শক্তি, যেটার ওপর ভর করে শ্রমিকশ্রেণির একটা বড় অংশ কালাতিপাত করে; দ্বিতীয়ত, শ্রমিকশ্রেণি গড়ে উঠার পেছনে যে জিনিসটি বড় ভূমিকা পালন করে সেটি হল জলপথ। সুদীর্ঘকাল থেকে শীতলক্ষ্যার জলপথকে পুঁজি করে এ এলাকায় গড়ে উঠেছে নানাধরনের কলকারখানা। কৃষি এবং কলকারখানাকে ফলবান করার জন্য তখন থেকে দরকার ছিল উৎকৃষ্টসংখ্যক মানুষের।

মানবশ্রেণির এ বড় একটি অংশ তারা কারা? তারা সৃষ্টির আদি পেশায় নিয়োজিত শ্রমজীবী মানুষ। নিজেদের গতর খাটিয়ে তারা কৃষিকাজ করে ফসল উৎপাদন করত, অথবা বণিকশ্রেণির কলকারখানায় শ্রম বিক্রি করে টাকা কামাই করত, যেটা এখনো তারা নিরন্তরভাবে করে চলেছে।

কৃষি এবং কলকারখানায় নিয়োজিত যেসব শ্রমজীবী মানুষের কথা বলা হল এসব কর্মে তাদের উপস্থিতি বহুকাল আগে থেকে। বর্তমানে ডেমরাতে শ্রমজীবী মানুষের কর্মপরিধি আরো বেড়েছে। এখন শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কৃষি এবং কলকারখানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। শ্রমজীবীদের এখন বড় একটা অংশ পরিবহন খাতে কর্মরত।

 

গবেষণার পদ্ধতি ও অন্যান্য দিক ভূমিকা

 

গবেষণার মূল বিষয় শ্রমজীবী মানুষের ভাষা। ডেমরার শ্রমজীবী মানুষের রয়েছে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত উপভাষা। কিন্তু সেই স্বতন্ত্র উপভাষাটি কোন পর্যায়ে রয়েছে তা গবেষণা করে দেখার অপেক্ষা রাখে। আগেই বলেছি, ভাষার মধ্যে কোনো স্থায়ী স্থিরতা নেই। নানাকারণে ভাষার মধ্যে পরিবর্তন আসতে পারে।

ডেমরায় যেহেতু স্থানীয় এলাকার শ্রমজীবী মানুষের পাশাপাশি বাংলাদেশের নানা অঞ্চলের মানুষের আগমন ঘটেছে, ফলশ্রুতিতে যেটা হয়েছে, এই এলাকার ভাষার ওপর নানা এলাকার ভাষার প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ হোক তার যে একটা প্রভাব পড়েছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

প্রশ্ন হতে পারে, বাংলাদেশে আরো নানা জায়গা থাকতে ডেমরা অঞ্চলকে কেন বেছে নেয়া। হল? কারণ ডেমরা অঞ্চলের রয়েছে একটি স্বতন্ত্র ভাষা, যেটি শ্রমজীবী মানুষ ব্যবহার করে। এই শ্রমজীবী ভাষাভাষী মানুষের ভাষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের আরো নানা অঞ্চলের মানুষের ভাষা।

এসব ভাষার ভেতর থেকে একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষাকে বের করে এনে গবেষণা করা সত্যিই একটি দুরূহ কর্ম। তথাপি এই ভাষাটির প্রতি আগ্রহী হওয়ার কারণ, নানা অঞ্চলের ভাষার দৌরাত্ম্যে ভাষাটি একরকম হারিয়ে যেতে বসেছে। আরো একটি প্রশ্ন হতে পারে, কেবল ডেমরা অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষের ভাষাকে গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নেয়া হল কেন? কারণ ভাষার কোনো স্থিরতা নেই। যত কাল অতিক্রম করছি আমরা শিক্ষার দিকে বেশি করে ঝুঁকছি। আমরা যত শিক্ষিত হচ্ছি এলাকার স্বতন্ত্র উপভাষাকে

এড়িয়ে গিয়ে শুদ্ধ বাংলা কিংবা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে অভ্যন্ত হয়ে উঠছি। পূর্ব-পুরুষের ভাষাকে যতটুকু এড়িয়ে যেতে পারছি ততটুকু আমরা ভদ্র হয়ে উঠছি, এটা ভাবতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। আঞ্চলিক ভাষা থেকে ভাষার অতীত ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করার লক্ষ্যে এ বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে।

ভাষা সংস্কৃতির একটি অংশ। সংস্কৃতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা জাতি ঋদ্ধ হতে পারে না। শিক্ষিত মানুষের মুখের ভাষা ভদ্রগোছের হতে পারে, কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির ভাষাকে মনে হবে অশ্লীল। যেমন, ডেমরা অঞ্চলের নিরক্ষর শ্রমিক সাধারণ কথায় কথায় ‘মাদার চোত, খানকির পোলা’ বললেও ভদ্রলোকের মুখে তা একেবারে বেমানান।

তারা বড়জোর ‘হারামজাদা, কিংবা কুত্তার বাচ্চা’ বলতে পারেন। সেটা শুনতেও শোভনীয়। কিন্তু ডেমরার নির্ভেজাল ভাষা এটা নয়। উল্লেখ থাকা দরকার, তারা যে অশ্লীল শব্দগুলো ব্যবহার করে এগুলো আক্ষরিক অর্থে গালি নয়। অনেক সময় তারা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেও অশ্লীল শব্দগুলো মনের অজান্তে বলে থাকে। যেমন- নানা নাতিকে কথায় কথায় ‘হালা’ (শালা) বলে।

সুতরাং যেটা হয়, শিক্ষিত ভদ্রলোকের মুখ থেকে অবিকৃত ভাষা টেনে আনা একরকম অসম্ভব, যেটা শ্রমজীবী মানুষের কাছ থেকে সহজে আদায় করা যায়।

আরও দেখুন:

 

Leave a Comment