আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-স্বর তরঙ্গ
স্বর তরঙ্গ (Intonation )
প্রতিটি ভাষায় বাক্যে যে শব্দ সংযোজিত হয় তার সঙ্গে অতিরিক্ত একটা সুর যুক্ত থাকে। স্বরতন্ত্রীর কম্পনের দ্রুততার উপরেই সুরের পার্থক্য নির্ভর করে। শব্দের মধ্যে সুরের ওঠানামাকে সুরাঘাত বলে। সুর সম্বলিত শব্দ বাক্যে প্রযুক্ত হয়ে স্বরতরঙ্গের সৃষ্টি করে। ডেমরার প্রচলিত ভাষায় স্বরতরঙ্গের প্রভাব খুব বেশি। এ স্থানের মানুষ উচ্চৈঃস্বরে কথা বলে।
তবে এই সুরাঘাতের কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। বাক্যে স্বরতরঙ্গের পার্থক্যের জন্য অর্থের পার্থক্য ঘটে থাকে। ভাষাতাত্ত্বিক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের মতে “স্বরতরঙ্গ হচ্ছে ভাষার উচ্চারণ প্রকৃতির স্বর। কথা বলার সময় স্বরতরঙ্গ লক্ষ্য করার বিশেষ দিক হল অক্ষরের মধ্যে গতির পরিবর্তন এবং কন্ঠস্বরের উত্থান ও পতন” । (আধুনিক ভাষাতত্ত্ব- ১৯৯৭-২৩৫পৃ.)
বাংলা বাক্যের স্বরতরঙ্গের প্রকারভেদ প্রথম সূত্রবঙ্গ করেন চার্লস এ ফার্গুসন ও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। ভ্যানিয়েল জোনস কর্তৃক প্রদর্শিত স্বরতরঙ্গের রেখা চিহ্নের মাধ্যমে বাংলায় তিন প্রকার স্বরতরঙ্গের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন-
১. ঊর্ধ্ব থেকে নিম্নগামী বা অবরোহী
২. নিম্ন থেকে ঊর্ধ্বগামী বা আরোহী
৩. সমান্তরাল
স্বরতরঙ্গ বিচারের সময় সুরের ওঠানামার সাধারণ, উঁচু ও নিচু এই তিনটি মাত্রাভেদকে অধ্যাপক জোন্স নিম্নলিখিত স্তরে প্রদর্শন করেছেন।
উচ্চগ্রাম____
মধ্যগ্রাম___
নিম্নগ্রাম___
বিভিন্ন শ্রেণির বাক্যের সাহায্যে ডেমরার ভাষার সুরতরঙ্গের রেখাচিত্র নিচে দেখানো হল :
ক. সাধারণ বিবৃতিমূলক বাক্য (Assertive Sentence) :
অবরোহী স্বরতরঙ্গ বিবৃতিমূলক বাক্যে কোন বিশেষ শব্দের উপর জোর না দিয়ে অত্যন্ত সহজভাবে বলা হয়। বাক্যের শুরুর দিকে গলার স্বর উচ্চগ্রামে থাকে এবং ক্রমশ নিচে নেমে আসে বাক্যের শেষের দিকে। এ ক্ষেত্রে স্বরতরঙ্গ ঊর্ধ্ব থেকে নিম্নগামী হয়।
যেমন হ্যায় কয় । (সে বলে)
আমি খাইতাম না। (আমি খাব না )
খ. প্রশ্নবোধক বাক্য (Interrogative Sentence) :
প্রশ্নবোধক বাক্যে স্বরের ওঠানামা আছে। ধ্বনাত্মক বাক্য, সংশয়মূলক বাক্য ঋণাত্মক বাক্যে যে সুর থাকে প্রশ্নবোধক বাক্যে সে সুর থাকে না। ডেমরার প্রচলিত ভাষায় প্রশ্নবোধক বাক্য দু’ ধরনের দেখতে পাওয়া যায়। যথা-
১. এক ধরনের প্রশ্নে শুধুমাত্র উত্তরদাতার কাছ থেকে হ্যাঁ বা ‘না’ উত্তর অথবা একটি ‘শব্দের’ মাধ্যমে উত্তর জানতে চাওয়া হয়।
২. প্রশ্নের উত্তরে উত্তরদাতার কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাওয়া হয়।
এই দুই ধরনের প্রশ্নবোধক বাক্যে সুরতরঙ্গ দু’ রকমের হয়। প্রথম শ্রেণির স্বরতরঙ্গ নিম্ন থেকে ঊর্ধ্বগামী হয়।
যেমন: ক্যামনে যাবি? (কিভাবে যাবি?)
কখনো কখনো দেখা যায়, ক্রিয়ার উপর কম জোর দিয়ে কর্তার উপর বেশি জোর দিয়ে প্রশ্ন করা হয়। এ ধরনের বাক্যে স্বরতরঙ্গ প্রথমে উচ্চগ্রাম থাকে, পরে নিচে নেমে যায় এবং শেষে পুনরায় একটু উপরে উঠে যায়। যেমন-
সাদী কি খায়?
এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ অথবা একটি শব্দে দেয়া হয়।
দ্বিতীয় শ্রেণির প্রশ্নে স্বরতরঙ্গ সাধারণ বিবৃতিমূলক বাক্যের মতই কিছুটা নিম্ন থেকে উচ্চ উঠে আবার উচ্চ থেকে নিম্নগামী হয়।
এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর এক শব্দে দেয়া যায় না উত্তরদাতার কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়। ডেমরার প্রচলিত ভাষায় অনেক সময় এমন কিছু প্রশ্নবোধক বাক্যের প্রয়োগ দেখা যায় যার কোন উত্তর প্রত্যাশা করা হয় না। প্রশ্নকর্তাই সব জানে এমন ভাব প্রকাশিত হয়।
তুচ্ছার্থে নেতিবাচক কিছু বোঝাতে ‘কি’ শব্দ প্রয়োগ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সুরতরঙ্গ উচ্চ থেকে নিম্নগামী হয়।
গ. সংশয়মূলক বাক্য
মনের ভেতর কোন বিষয়ে সংশয় বা দ্বিধা নিয়ে বক্তা যখন বাক্য প্রয়োগ করে তখন সেই বাক্যে কোন স্বরতরঙ্গ ওঠা নামা করে না সাধারণত একই রকম থাকে। যেমন: রহিমে গাইতে জানে। (রহিমে গান জানে

নির্দেশমূলক বাক্য (Imperative Sentence)
ডেমরার প্রচলিত ভাষায় আদেশ, নির্দেশ ও অনুরোধসূচক বাক্যের সুরতরঙ্গ উচ্চ থেকে নিম্নগামী হয়, আবার কখনো নিম্ন থেকে উপরে উঠতে দেখা যায়। যেমন-
১. আয়েন তো, খাইয়া লন।
(আসেন তো, খেয়ে নেন)
২. যাইতে কইছি, যা ।
( যেতে বলছি, যা )
৩. আহ, পরতে বও।
(আস, পড়তে বস)
আরও দেখুন: