মুখ্যার্থ ও গৌণার্থ

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-মুখ্যার্থ ও গৌণার্থ

মুখ্যার্থ ও গৌণার্থ

অর্থতত্ত্ব  শব্দার্থ

অর্থবহ ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে শব্দ বা রূপমূল বলে। একটি ধ্বনি বা একাধিক ধ্বনি সমন্বেয়ে যে রূপমূল গঠিত হয় তার অর্থ কোনো একটি বস্তু বা ভাবকে বুঝায় যায় একটি প্রতীক আমাদের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। কোনো কোনো ধ্বনি সময় কী অর্থ বহন করে তা সেই ভাষার লৌকিক ব্যাপার। যেমন বাংলায় ব + অ + ই= ‘বই’ রূপমূলটি যে অর্থ প্রকাশ করে ইংরেজি ভাষা সম্প্রদায় সেই একই অর্থে Book

Book রূপমূল ব্যবহার করে। কাজেই রূপমূল কোন বন্ধ বা ভাবের অর্থ সূচিত করে এবং সেই অর্থ নির্দিষ্ট ভাব সম্প্রদায় গ্রহণ করে। একেই শব্দার্থ বলে।
অর্থতাত্ত্বিকরা রূপমূলেরর দু’ ধরনের অর্থের উল্লেখ করেছেন। যথা :

১. রূপমূলের আভিধানিক অর্থ বা মুখ্যার্থ

2. রূপমূলের পরিবেশগত অর্থ বা গৌণার্থ

 

মুখ্যার্থ ও গৌণার্থ

 

মুখ্যার্থ : রূপমূলের সুস্পষ্ট নির্দিষ্ট যে আভিধানিক অর্থ থাকে তাই মুখ্যার্থ বা প্রধান অর্থ। যেমন-বই শব্দের মুখ্য অর্থ পুস্তক-ইংরেজি প্রতিশব্দ Book, মাথা শব্দের অর্থ ‘শির’ ইংরেজি প্রতিশব্দ Head
গৌণার্থ : কথোপকথনে বা বাক্যে প্রয়োগকালে পরিবেশগত কারণে রূপমূলের আভিধানিক অর্থের অতিরিক্ত যে এক বা একাধিক অলঙ্কারিক অর্থ প্রকাশ করে তাই হল গৌণার্থ ।

‘মাথা’ শব্দের আভিধানিক বা মুখ্যার্থ হল ‘শির’ আর গৌণার্থ নানা অর্থে প্রযুক্ত। বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিক পরিবেশে ডেমরার আঞ্চলিক ভাষায় ‘মাথা’ রূপমূলটির ‘গৌণার্থ’ নিচে দেয়া হল:

১. ‘মাথা’ রূপমূলটির গৌনার্থ বা পরিবেশগত রূপ
(ক) (মেধা) পোলাডার মাত্রা বালা (ছেলেটির মেধা ভাল ) এখানে ‘মাথা’ রূপমূলের অর্থ মেধা।

(শুরু/শেষ) তুই সরকের মাতায় দারা (তুই রাস্তার শেষ/শুরুতে দাঁড়া)
এখানে ‘মাথা’ রূপমুলের অর্থ শুরু বা শেষ।

(গ) (প্রধান ব্যক্তি) আমজাদ আমাগোর গেরামের মাতা (আমজাদ আমাদের গ্রামের সম্মানিত ব্যক্তি ) এখানে মাথা রূপমূলের অর্থ প্রধান অথবা সম্মানিত ব্যক্তি।

২. ‘লাগা’ রূপমূলটির গৌণার্থ বা পরিবেশগত রূপ
E (মনোযোগ) উইটা পইরা লাগ বালাবাবে পাশ করবি।

(উঠে পরে লাগ ভালভাবে পাশ করবি) এখানে ‘লাগ’ রূপমূলের অর্থ হল মনোযোগ দিয়ে পড়া।

(খ) (ঝগড়া) ‘হ্যারা দুই বাই বইনে লাগছে’ (তারা দুই ভাই বোন লেগেছে)।
এখানে ‘লাগ’ রূপমূলের অর্থ ঝগড়া।

(91) (নজর লাগা) পোলাডা ক্যামুন হুগাই গেছে, চোখ লাগছে । এখানে ‘লাগ’ রূপমূলের অর্থ কারো খারাপ নজর লাগা । 3

(ঘ) (অসম্মান) এই কাম করলে মুহে চুনকালি লাগবো। এখানে ‘লাগ’ রূপমূলের অর্থ অসম্মান হওয়া।

 

মুখ্যার্থ ও গৌণার্থ

 

8) (বাচ্চা) হাতে বর লাগছে। এখানে ‘লাগ’ অর্থ ব্যথা পাওয়া।
উল্লেখিত বাক্যে ‘লাগ’ রূপমূলের পরিবেশগত কারণে মুখ্য অর্থ ছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন গৌণার্থ প্রকাশ পেয়েছে।
ডেমরা অঞ্চলের ভাষায় ভাষায় এ ধরনের বহু রূপমূলের প্রচলন দেখা যায়। এ ধরণের অন্যান্য রূপমূলগুলো হল ঢোক (চোখ), মাতা (মাথা), পাকা, মুক (মুখ) ইত্যাদি।

আভিধানিক অর্থ রূপমূলের প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। এ ক্ষেত্রে কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয় না। বিভিন্ন পরিবেশে ব্যবহৃত সমশ্রেণির রূপমূলের অর্থ পরিবেশ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে অর্থ নির্ধারণে মানুষের চেতনা ক্রিয়াশীল থাকে। তাই পরিবেশগত অর্থ নিরূপণে অনেক সময় জটিলতা সৃষ্টি হয়। উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি তুলে ধরা হল :

  • তর্কি আম পারছে (তকি আম পেরেছে)
  •  রনি মেইলো গ্যাছে (রনি মেইলে গিয়েছে)
  •  মায় পিডা বানাইতেছে (মা পিঠা বানিয়েছে)
  • ওপরের তিনটি বাক্যের বিভিন্ন অর্থ হতে পারে এবং অর্থের তারতম্যের জন্য জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।

বাক্যগুলোর বিভিন্ন অর্থের ব্যাখ্যা নিচে দেখানো হল :
৩ নং বাক্যে বিভিন্ন ব্যাখ্যা যেমন

ক. তকি গরেরতে বাইর অগুনের আগে আম পারনের কতা কইয়া গ্যাছে। (তকি ঘরে থেকে বের হওয়ার আগে আম পারার কথা বলে গিয়েছে)

খ. আমি তকিরে আম পারতে দেকছি (আমি তকিরে আম পাড়তে দেখেছি)

গ. বাইরে যাওনের সম তকিরে গাছেতে আম পারতে দেকছি। (বাইরে যাবার সময় তকিরে গাছ থেকে আম পাড়তে দেখেছি)

উদাহরণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ‘তকির’ আম পারার তথ্য জানা যায়। তবে এ প্রক্রিয়ায় অর্থ নিরূপণে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে, কেননা ৩ (ক) বাক্যে তকির আম পারার কথা জানা যায়। এক্ষেত্রে তকি আম পারার কথা বললেও পরে সে তার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে।

সে আম না-ও পারতে পারে। আম না পেরে অন্য কোথাও যেতে পারে। আর এ ধরনের বিভিন্ন অর্থের জন্য কোন সিদ্ধান্ত নেয়া বা সঠিক অর্থ অনুধাবনে জটিলতার সৃষ্টি হওয়া সম্ভব।
৪নং বাক্যের বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যেমন ‘রনি মেইলো গ্যাছে’

ক. রনি মেইলো বেতন তুলতে প্যাছে (রনি মিলে বেতন উঠাতে গিয়েছে)

খ. রনি মেইলো গুরতো গ্যাছে (রনি মিলে ঘুরতে গিয়েছে)

গ. রনি মেইলো কাম করতে গ্যাছে (রনি মিলে কাজ করতে গিয়েছে )

 

মুখ্যার্থ ও গৌণার্থ

 

৫ নং বাক্যের অর্থগত বিভিন্ন ব্যাখ্যা নিরূপণ :
মায় পিডা বানাইছে

ক. মায় ব্যাছনের লাগি পিডা বানাইছে। (মা বিক্রি করার জন্য পিঠা বানিয়েছে)

খ. বইনের বারিত পাটাইবো হেলিগা মায় পিডা বানাইছে।

(বোনের বাড়িতে পাঠানোর জন্য মা পিঠা বানিয়েছে)

গ.মায় তঙ্গো লাগি পিডা বানাইতেছে। (মা তোমাদের জন্য পিঠা বানিয়েছে) উদাহরণগুলোতে পরিবেশগত অর্থ

নির্ধারণে মানুষের প্রজ্ঞা কাজ করে, তাই ব্যাখ্যাজনিত কারণে অর্থগত দিক যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে, তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

আরও দেখুন:

Leave a Comment