ভাষা পরিবেশ

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-ভাষা পরিবেশ

ভাষা পরিবেশ

মনের ভাব প্রকাশের জন্য বক্তা ও শ্রোতার প্রয়োজন। বক্তার মনে যে ছবি প্রতিফলিত হয় তিনি সেই ছবি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। শ্রোতা শব্দ শুনে শব্দের সাথে সম্পর্কিত ছবি মস্তিষ্কে যায় এবং ধারণার জন্ম দেয়। অর্থাৎ শ্রোতা বস্তুটা চিন্তা করে করে ছবি আঁকে। অর্থাৎ বস্তুর নাম সম্পর্কে বক্তা চিন্তা করেন, পরে বলেন। মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে স্নায়ুর সম্পর্ক বিদ্যমান।

নাম ও অনুভূতির মধ্যে অর্থ একটি পারস্পরিক সম্পর্কের সৃষ্টি করে। একটা নাম ও একটা অনুভূতি যেভাবে পরিবেশগত দিকের সূচনা করে তার প্রকৃতি অনুসারে তাকে দুটো পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যেমন-

ক. বিভিন্ন নামের সঙ্গে একটি অনুভূতি: সমার্থক রূপমূল

খ. একটা নামের সঙ্গে বিভিন্ন অনুভূতি : প্রয়োগের পরিবর্তন, সমধ্বন্যাত্মক রূপমূল ও বিভিন্ন অর্থ নিচের দু’টো পর্যায়ের বিভিন্ন দিকের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

ভাষা পরিবেশ

বিভিন্ন নামের সঙ্গে একক অনুভূতি

সম্পূর্ণ সমার্থের বিপরীতে দুটো শক্তি ক্রিয়াশীল, একটা হচ্ছে অনুভূতির অস্পষ্টতা এবং অন্যটা আনুভূতিক অতিরিক্ততা। এ দুটো দিক ছাড়া প্রদত্ত পরিবেশে যেসব রূপমূল অন্য রূপমূলের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে তাকেই সমার্থকরূপে গ্রহণ করা যায়।

২৫. মুক/মূহ (মুখ) রূপমূল যে অর্থে প্রযুক্ত হয় তা নিম্নরূপ :

ক.কথা, অঙ্গবিশেষ, দিক, সম্মান, অপমান, গালি, সংযত, লজ্জা, আশীর্বাদ ইত্যাদি । বাক্যে প্রয়োগ :

খ.তোর মুহে (কথা) কিন্তু আটকায় না (তোর মুখে কিছু আটকায় না)

রইমা মুহে (মুখ অঙ্গ বিশেষ) দুক পাইছে (রইমা মুখে ব্যথা পেয়েছে)

গ. দহিন মুহি (দিক) গরো দেক (দক্ষিণ মুখের ঘরে দেখ)

ঘ. পোলায় বাফের মুক (সুনাম সম্মান) রাখছে (ছেলেটা বাপের মুখ রেখেছে) তর লাগি হগলতের মুহে (অপমান)

চুনকালি পরছে। (তোর জন্য সকলের মুখে চুনকালি পড়েছে)

চ. ঐ বেডি মুক (গালি) খারাপ করছে। (ঐ মহিলা মুখ খারাপ করছে)

ছ. মূক (সংযত) সামলাইয়া রাক কইছি । (মুখ সমলিয়ে রাখ বলছি)

জ. বিয়ার কতা হুইনা মুক (লজ্জা) লুকাইছে (বিয়ের কথা শুনে মুখ লুকিয়েছে) ঝ, তোর মুহের (আশীর্বাদ) কতা যেন হয়। (তোর মুখের কথা যেন হয়)

প্রমিত বাংলায় মতো ডেমরার প্রচলিত ভাষায়ও এধরনের বিভিন্ন নামের সঙ্গে একক অনুভূতিসম্পন্ন সমার্থক

রূপমূলের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন-

মাতা (মাথা) আত (হাত), চোক (চোখ), কতা (কথা), পাকা ইত্যাদি।

সমার্থক রূপমূল আঞ্চলিক ভাষায় প্রয়োগের সময় আঞ্চলিক উচ্চারণে বাক্যে ব্যবহৃত হয়।

২৬. মাতা (মাথা)
অর্থগত দিক :
ক. (প্রধান)   খালেক আমগো গ্রামের মাতা (খালেক আমাদের গ্রামের মাথা)
খ. (বুদ্ধি )    শিফাতের মাতা বালা (সিফাতের মাথা ভাল)

গ. (প্রত্যঙ্গ)   কাক্কুর মাতাত চুল নাই (কাকার মাথায় চুল নাই )
ঘ. (সর্বনাশ)আদর দিয়া পোলার মাতা খাইছত (আদর দিয়ে ছেলের মাথা খেয়েছ)
ঙ. (সম) মাতাত আত দিয়া ক তুই জাবি না (মাথায় হাত দিয়ে বল তুই যাবি না)

চ. (পরিশ্রম )  মাতার গাম ফালাইয়া টেকা আনি। (মাথার ঘাম ফেলে টাকা আনি)

ছ. (ক্রোধ)   হ্যার মাতা গরম কতা কম ক (তার মাথা গরম কথা কম বল)

জ. (শীর্ষে)   গাছোর মাতায় একটা আম দেহা যায় (গাছের মাথায় একটা আম দেখা যায়)

ঞ. (আদর)ছোড় পোলারে মাতায় তুইল্যা রাহে মায় (ছোট ছেলেকে মাথায় তুলে রাখে
মায়)

ট. (হতাশ)  চুরির কতা হুইনা বাজানের মাতাত বাজ পরছে (চুরির কথা শুনে বাজানের মাথায় বাজ পড়েছে)

27. আত (হাত)

ক. (দক্ষতা)  হ্যার কামের আত বালা (তার কাজের হাত ভাল )

খ. ( খ্যাতি ) হগল ডাকতরের আত হোমান না (সব ডাক্তারের হাত সমান না)

গ. (প্রত্যক্ষভাবে) গাছতে আম পারতে গিয়া হাতেনাতে দরা। (গাছ থেকে আম পাড়তে গিয়ে হাতে
নাতে ধরা )

ঘ. ( দ্রুত সময় নাই আত চালা (সময় নেই হাত চালা)

ঙ. (বশ)  বুয়ারে আত করলে কাম অইবো (বুয়াকে হাত করলে কাজ হবে)

চ. (পকেট খরচ) আমার আত খরচা নাই (আমার হাত খরচ শেষ)

ছ. (আরম্ভ করা) খোদার নামে কামে আত দে (খোদার নামে কাজে হাত দে)

জ. (অধিকার) মার কতার উপর আমার আত নাই (মার কথার উপর আমার আমার আতটা বিশ করে (আমার হাতটা ব্যথা করে)

ঝ. (অঙ্গ)

ঞ. ( অভাব ) রহিমের আত টান হগল সমায় (রহিমের হাতটান সবসময়

ভাষা পরিবেশ

একই নামের সঙ্গে বিভিন্ন অনুভূতি

একই নাম একাধিক চেতনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। তাই রূপমূলের অর্থ নির্ধারণে অনুভূতি বা চেতনার গুরুত্ব অনেক।
এক্ষেত্রে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান: যথা-

  • একই অনুভূতির একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের পরিবর্তন। যেমন-শোন্দর বাড়ি (সুন্দর বাড়ি) শোন্দর মাইয়া (সুন্দরী মেয়ে
  • একটা রূপমূলের একাধিক অনুভূতি : বিভিন্ন অর্থ। যেমন- আল্লার আত (আল্লাহর হাত) মাইনশের আত (মানুষের হাত )
  • একাধিক রূপমূল : সমার্থক।
    যেমন: পোলাডা খাইটটা (ছেলেটা বেটে) খাইটটা মরি (পরিশ্রম করে শেষ)

 

ভাষা পরিবেশ

 

প্রয়োগের পরিবর্তন

একই রূপমূল প্রয়োগের ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন অনুভূতি ও চেতনা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে একদিকে দ্বৈততা ও অন্যদিকে অস্পষ্টতা ও অনুভূতির স্থিতিস্থাপকতা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। কখনও বস্তু বা বিষয়কে সরাসরি বিশেষণযুক্ত অর্থ প্রকাশ করতে। যেমন লোহার শইল (লোহার শরীর) দেহকে বোঝাচ্ছে।

কখনও বা বিশেষণ এবং বিশেষ্য উভয় অংশ মিলে তৈরি এমন একটি অর্থ যা নিছক এ বস্তু বা বিষয়টিকে বোঝাচ্ছেনা অন্যকোন বিষয় নির্দেশিত হয়। যেমন-দয়ার শইল (দয়ার শরীর) মানবিকতাকে বোঝাচ্ছে শরীরকে নয়।

রূপমূল

২৮. শ‍ইল (শরীর)

লোআর শ‍ইল

মানইশের শই

দয়ার শইল

নরোম শ‍ইল

শুন্দর শ‍ইল

(লোহার মতো শক্ত শরীর )

(মানুষের শরীর )

(দয়ার শরীর )

(নরম শরীর )

(সুন্দর শরীর )

২৯. গর (ঘর)

ইটার গর মাড়ির গর

দালান গর

টিনের পর

চালা গর

সুন্দর গর

(ইটের ঘর)

(মাটির ঘর)

(ইটের তৈরি ঘর)

(টিনের ঘর)

(টিনের ঘর)

(সুন্দর ঘর)

৩০. গাট (ঘাট) (পুকুরের ঘাট)

শানবান্দাইনা গাট (শানবাঁধা

গাঙ্গের গাট ঘাট)

পুশকুনির পাট খেয়া গাট

(নদীর ঘাট) (নদীর ঘাট)

একটি রূপমূলের একাধিক অর্থ : অর্থতত্ত্ব বিশ্লেষণে একটা রূপমূলের একাধিক অর্থ একটা প্রধান দিক। অর্থগত দিক বিচারে একটি রূপমূলের একাধিক অর্থ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে রূপমূলের আভিধানিক অর্থের সাথে পরিবেশগত নতুন নতুন অর্থ আরোপিত হয়।

আর এই একাধিক নতুন অর্থ প্রকাশের পেছনের মূল কারণ দুটি-
প্রথমত, বিভিন্ন অনুভূতির মধ্যস্থিত সম্পর্ক দ্বিতীয়ত, সামাজিক সম্পর্কগত দিক অনেক সময় কোনো কোনো রূপমূলের মুখ্য অর্থ লুপ্ত হয়ে গিয়ে গৌণ প্রধান হয়ে উঠে। যেমন-ভাঙা ক্রিয়াপদের গৌণ অর্থেরই ব্যবহার বেশি। বক্তা কোন অর্থটি বোঝাতে চান তা নির্ভর করে তার এবং শ্রোতার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও মনোভাবের ওপর।

ক্রিয়াপদের বিভিন্নার্থক ব্যবহার, যেমন- ভাঙা ক্রিয়াপদ, গর (ঘর) ভাঙা, করাল (প্রতিজ্ঞা) ভাঙা, দল ভাঙা, গাছ ভাঙা ইত্যাদি। দুটো ভিন্নতর ভাষার সহঅবস্থানের ফলে দুটো ভিন্ন অনুভূতির মধ্যে সচেতনতা তাদের পাশাপাশি মানানসই অবস্থান সহজতর করে। সামাজিক সম্পর্কগত দিকে দুটো ভাষা সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দেশ করে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত শ্রমিকশ্রেণির জনগণের ডেমরা অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাসের কারণে ডেমরা অঞ্চলের প্রচলিত ভাষার সাথে বহিরাগত শ্রমিকদের ভাষা পরস্পর মিলিত হয়। এই কারণে ডেমরা অঞ্চলে বহিরাগত ভাষার রূপমূলের প্রয়োগ দেখা যায়।

৩১. সম্বোধনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বহিরাগত রূপমূল যেমন- অই আহ, ও মনু। হেতি, হেতারা
বাক্যে প্রয়োগ—’অই মনু আহ’। এ বাক্যে ব্যবহৃত ‘মনু’ রূপমূলটি ‘বরিশাল’ অঞ্চলের শ্রমিকদের ভাষা থেকে
আগত ।

“হেতি রোগ লইয়া গেল গা’ (সে সব নিয়ে চলে গেল) এ বাক্যে ‘হেতি’ (সে) এবং গেলগা (চলে গেল) দাউদকান্দি অঞ্চলের শ্রমিকদের ভাষা থেকে আগত ।

আরও দেখুন:

Leave a Comment